কুর্গের পথে
লীনা রায়চৌধুরী
বছরের শেষদিন-যখন কলকাতা সহ সমস্ত বঙ্গদেশ দামাল খুশীর সাথে শীতেও জুবুথুবু –মাইসোর তখন রাশি রাশি রুদ্রপলাশের আগুন আলোয় সেজে উঠেছে। মৃদু হাওয়ার আবেশে স্বচ্ছন্দ পোশাকে (না, কোনো শীতের পোশাক নয়) আমরাও তিরতিরে যন্ত্রণাগুলোকে ছুড়ে ফেলে ভেসে গেলাম আলো, আনন্দের আতিথ্যে।
দু-দিন পায়ে পায়ে ঘুরেছি ইতিহাসের আনাচ-কানাচ, মাথা ঠেকিয়ছি বীরত্বের দেউলিতে, স্তব্ধ হয়েছি ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের পশরায়। কিন্তু দুটো শব্দ কারণে-অকারণে আমার মাথায় ঘুরেছে। সেই যে- অ্যাবেরিকা আর রবাস্টা। কুর্গের বড়ো বড়ো পাতার নিকষ-সবুজ বাগানের লাল-সোনালি কফি, দেশের সেরা কফির ঠিকানা। কত মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ইচ্ছায় বহু-শতাব্দীর অর্জন!
শুরু হল পথ চলা। সুবিস্তীর্ণ মালভূমি আর রাবার, কফি, কোকর বাগিচার অসামান্য সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুর পথ করে দিয়েছে অতীতের কোডাবা উপজাতিদের বীরভূমি কুর্গ বা কোড়াগু। পশ্চিমঘাটের আদুরে আঁচল জড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ – সবুজ কুর্গ।
মাইসোর থেকে মাদিকেরি হয়ে কুর্গ। এটি হল সবুজে ঢাকা দ্রুততম পথ। যেখানে কোনও টোল নেই, মসৃণ রাস্তা এবং কোনও রাস্তা পাহাড়ি দুর্যোগে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে না স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায়। তবে আমরা কিছুটা এগিয়ে আসার পর আমাদের ইচ্ছা আর সারথীর তৎপরতায় নাগারহোলে জাতীয় উদ্যানের গাঁ ছুঁয়ে এগিয়েছি কুর্গের পথে-একটু সময় আর খরচ সাপেক্ষে।
চলার পথে আমাদের প্রথম লক্ষ্য ‘নামড্রলিং মঠ’ বা ‘গোল্ডেন মনাস্ট্রি’ । তিব্বতি জনবসতি, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা আর সবুজের অপার আদর পথকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে। বাইলাকুপ্পে-মাইসোরের একমাত্র তিব্বতি জনবসতি। এখানে গেলে বোঝাই যায় না আমি দক্ষিণভারতে আছি না তিব্বতে! বাইলাকুপ্পে শহরটি দক্ষিণ ভারতের বৃহত্তম বৌদ্ধ মঠ ‘নামড্রলিং মঠ’ বা ‘গোল্ডেন মনাস্ট্রির’ জন্য পরিচিত।পলিউল বংশের দ্রুব ওয়াং পদ্মা নরবু রিনপোচে দ্বারা 1963 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মঠ। নামড্রলিং-বিশ্বের তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের Nyingma বংশের বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্র।পাঁচ-হাজারের বেশি ভিক্ষু ও সন্ন্যাসী(লামা) , ‘ইয়েশে ওডসাল শেরাব রালদ্রি লিং’ নামে একটি জুনিয়র হাইস্কুল, একটি ধর্মীয় কলেজ এবং হাসপাতাল নিয়ে এক মহান কর্মযজ্ঞ।এই মঠের শৈল্পিক কারুকলা বিস্ময়ে হতবাক করে। কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত কথা হারিয়েছিলাম আমি! কত নিষ্ঠা,লড়াই, অবমাননা আর ভালোবাসা আছে এই অসীম সৌন্দর্য ও মহান স্থাপত্যের ভাঁজে ভাঁজে ! অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়েছে ইচ্ছা আর সাধনার পথ। তাদের প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ছিল হাতির তাণ্ডব এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় নানারকম বিপদ। সময় এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা পথ। গোল্ডেন মঠের সমাহিত রূপ এবং অনন্ত প্রজ্ঞার আড়ালে নিঃশব্দ সেবা চলেছে প্রতিনিয়ত; এই আনন্দযজ্ঞের কথা ভেবে আশ্চর্য হই, মাথা নুইয়ে আসে শ্রদ্ধায় ।
মাইসোর থেকে যত এগিয়ে চলেছি–পার্বত্য প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে তার সাজবদল বিষণ্ণ মনের(এই ভ্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছেলেকে কর্মসূত্রে মাইসোরে রেখে যাওয়া) কোণেও রঙ ধরিয়েছে। পলাশ, রুদ্রপলাশের লাল কার্পেটে মোড়া পাহাড়ি পাকদন্ডি বেয়ে এই পথচলা–আর পাহাড়তলিতে চলছে জীবনের ছন্দে চাষের আয়োজন।উপত্যকার জমি এখন তুলনামূলক রুক্ষ, কয়েক মাস পরেই হয়তো সবুজের স্নেহের স্পর্শে ভরে উঠবে। কুর্গ এবং কুর্গের পথ কিন্তু চিরহরিৎ! রাস্তা, আস্তে আস্তে মায়া ভরে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল পাহাড়ের হাত। একটু একটু করে ফাঁকা হয়ে এল জনবসতি। শুরু হয়ে গেল ‘নাগারহোলে টাইগার রিজার্ভের’ বাফার জোন। কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠা, আর গাড়ির দুলুনি সুযোগ বুঝে ঘুমকে ডেকে আনলেও পিঠ টান করে সজাগ বসে আছি। হরিণের মায়াবি,কখনো ভিতচকিত চোখ ঘুমাতে দিচ্ছে না। দূরে দূরে জঙ্গলের মধ্যে গাউরের স্থির দৃষ্টি আর সাদা মোজায় ঢাকা পা – মনে করিয়ে দিচ্ছে ঋজুদার কথা। আমার কিন্তু গুলিয়ে যাচ্ছিল কর্ণাটক(কখনো তামিলনাড়ু) আর কেরালার সীমারেখা। এদিক থেকে ওদিক পাহাড়শ্রেণির ঢাল থেকে মাথা পর্যন্ত অরণ্য আসলে একটাই–রাজনৈতিক অনুশাসনে ওদের আলাদা নাম আর ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে ঘরানা। সমস্ত এলাকাটাই বৃহত্তর নীলগিরি বায়োস্ফিয়ারের অংশ।
মাইল দুই পথচলার পর কাবেরীর এক উপনদীর সাথে দেখা। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে চলেছে। উচ্ছল আনন্দে নিজেকে নিয়েই সে ব্যস্ত। খুব ইচ্ছা হলো একবার নেমে নদীর জল ছুঁয়ে দিতে। আরিয়ানের নিষেধ মেনে সে চেষ্টা আর করিনি। বাঁ-দিকে পাহাড় আর ডানদিকে নদীর তীর ঘেষে কিছু লোক জরিপের কাজ করছেন। তাদের সাথে দুজন ইনস্ট্রাক্টার হবেন হয়তো, কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন। মোটা নেটের আচ্ছাদনে ট্রাক্টর জাতীয় একটি গাড়ি আর চারদিক ঘেরা সরকারি জীপ সেখানে দাঁড়িয়ে। দুর্ভেদ্য বন,এতটাই অন্ধকার যে তার মধ্যে সূর্যের আলো দেখতে পেলাম না। একটু ভয় পেয়ে আমিও ইচ্ছা থেকে পিছিয়ে এলাম।
এবারের লক্ষ্য ‘নিসর্গধামা রিজার্ভ’। এক নৃত্যরত বিভঙ্গে বিশাল বিশাল বাঁশ-ঝার,তার মাঝেই ভাস্কর্যের সব নিপুণ শৈলী, হরিণ,প্রচুর পাখি(নানা প্রজাতির) কাঠের ক্যানোপি, শিকড় ছোঁয়া আদিম-গাছ, আর দুদিকে গভীর এবং গাঢ় সবুজ জঙ্গলের পাহারায় এক অসামান্য রূপসী পাহাড়ি নদী। যদিও সে শান্ত নয়, কখনো রণংদেহী! তার ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্য ঘাটে এবং পারে পারে ছেয়ে আছে। লোহার ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়ে যখন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে নদীর অবুঝ বাৎসল্য, ওপারে বাইসনের ঠান্ডা দুটো চোখের নৈর্ব্যক্তিক শাসন কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।এখানে যে ওরাই রাজা বারবার মনে করিয়ে দেয় । ইচ্ছে হলে ওই লোহার তারের বাঁধা তুচ্ছ ওদের কাছে। সম্পূর্ণ জঙ্গল সোলার ফেনসিং দিয়ে ঘেরা।এখানে ওরা মুক্ত প্রকৃতির মাঝে, ওদের আপন দেশে। আমরাই অনধিকার দখল নিয়ে একদল চিরিয়াখানার জীব! মাঝে মাঝে হরিতকি আর রুদ্রপলাশের আড়ালে হরিণের কৌতূহলী দৃষ্টি; হয়তো বা সকরুণ অনুরোধ আমলকি আর হরিতকির জন্য। কিন্তু মাঝখানে সোলার ফেনসিং আর অ্যালার্ট সাইলেন্সার থাকায় কাছে আসতে পারে না। আর আমরাও অসহায়। বন, বন্যপ্রাণের ভারি সুন্দর এক সহাবস্থান এখানে। উদার, নির্লিপ্ত এই সবুজ ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও ছেড়ে যেতে হয়, চলেও গেলাম এক-মন তৃপ্তি আর ভালোবাসা নিয়ে।
জঙ্গলের বুক চিরে চলা চওড়া রাস্তা থেকে হঠাৎ করে ডানদিকে বাঁক নিয়ে আমাদের বাহন ঢুকে পড়ল হাতির চলার পথে। পাহাড়ি পথের সঙ্কীর্ণ অলি-গলি বেয়ে এগিয়ে চললাম ছোট্ট এক জনপদের উদ্দেশ্যে, আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। পথ এবং বসতি শেষ হলো কুশলনগর দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে। কুর্গের পথে ঘন চন্দন বনের মাঝখানে এই এলিফ্যান্ট ক্যাম্প।আরো কিছু আকাশছোঁয়া গাছ, মূল্যবান বনজ সম্পদ এবং ছোট বড় বন্যপ্রাণ থাকলেও মানুষের কাছে আসে না ওরা, বা ক্যাম্প পরিদর্শনে বাঁধা দেয় না। সম্পূর্ণ ক্যাম্পটাই পাহাড়ি নদী দিয়ে ঘেরা। কিন্তু আমাদের ভাগ্য এখানে সঙ্গ দিল না। টিকিট কাউন্টার থেকে বলে দিল-জল কম থাকায় নৌকা চলবে না মার্চ মাস পর্যন্ত। শুধু ইশারায় দেখিয়ে দিল ওই পাহাড়ি নদী পার হয়ে যেতে হবে। নেমে পরলাম তিনজন এবং বহু সহযাত্রী। লাল শ্যাওলায় ঢাকা তীক্ষ্ণ পাথুরে পথ। কোথাও বিশাল বোল্ডার, এতটাই উঁচু এবং ধারালো মাথা যে প্রচণ্ড জেদ আর কষ্টের পরও পা কেটে রক্তাক্ত। তবুও যেতেই হবে এই দেড় থেকে দু-কিলোমিটার আড়াআড়ি পথ। হার মানবো না। সোজা পথ হলে হয়তো কম হতো পথের দূরত্ব কিছুটা। কিন্তু জলের গভীরতা বেশি থাকায় পথ বেঁধে দেওয়া হয়েছে মোটা মোটা দড়ির গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে। প্রতিটা দড়ির মাঝেই সেই বিপজ্জনক জলসীমা। জলের তীব্র স্রোত, কনকনে ঠাণ্ডা জল,ভিজে সপসপে জামাকাপড় আর মাথার উপর অঝোরে বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলেছি আমরা–কিন্তু কুমির কুমির গুঞ্জন আমার সব সাহস আর প্রতিজ্ঞায় বাধা হয়ে দাঁড়াল। তখনও অর্ধেক পথও যাইনি। বেলা পড়ে এসেছে। ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে কাছে-দূরের সব পাহাড়, পাহাড়ি পথ আর নদীর পার ধরে নিশ্ছিদ্র জঙ্গল। আমাকে সামলাতে গিয়ে প্রিয়জনদের নাজেহাল অবস্থা দেখে মাঝপথ থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুধু আমরা নই, এখানেও বেশ কিছু সহযাত্রী পেয়েছি। সূর্য, নদীর জলে আবির ছড়িয়ে পশ্চিমের পথে। অস্তগামী সূর্যের রঙ সারা অঙ্গে মেখে মেঘেরাও কেমন কৌতুকে দেখছে আমাদের।আর মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি আদরে ভিজিয়ে দিচ্ছে । যতই পিছিয়ে আসি, মন চলেছে রঙের ম্যাজিক ঝরে পড়া সেই নিঃসীম জল আর সবুজের পথে। কিন্তু এই আশ্চর্য আলোর পিছনেই যে অন্ধকার তার পসরা সাজিয়ে হু-হু করে ছুটে আসে! অতটা পথ এই তীব্র বিপদ সাথে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে ঘোর অন্ধকারে। মন সায় দিল না।আমাদের তো আরো পথ বাকি! অপেক্ষা করছে আরো আলোর ইশারা! ফিরে এলাম সেই জলের সাথে লড়াই করতে করতে।
দিনের শেষের পাওয়া – না পাওয়ার হিসেব নিয়ে ব্যস্ত কিছু সহিস জানালো, হ্যাঁ, কুমির আছে ওই জলে। কোনো সরকারি দপ্তর নেই। নেই কোনো নিষেধাজ্ঞা। বিপদের মুখে এমন ভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন পর্যটকদের, জিজ্ঞাসা করতেই-অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় দক্ষিণীদের সেই বিখ্যাত মূদ্রায় দু-দিকে ঘার নেড়ে দিল, বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠান! তার অর্থ শুধু ওরাই জানে।
সরু এবং অস্বচ্ছ পাকদন্ডির ছন্দে ছন্দে তাল মিলিয়ে ফিরে এলাম কুর্গ – মাইসোরের পথে-মূল রাস্তায়। অপ্রসস্ত কিন্তু মসৃণ রাস্তা। তার বাদিক ধরে বড়ো বড়ো কালো-সবুজ পাতার কফি বাগান। ডানদিকে গভীর খাদ! মাঝে মাঝে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় আর হেয়ারপিন বেন্ড। যতদূর চোখ যায়, সবুজের কী বাহার! কুর্গের দিকে যত এগিয়েছি জড়িয়েছে শীত এবং প্রবল শীত! রাস্তার মাঝে মাঝেই হাতির করিডর, চিতার করিডর-লেখাগুলো দৃষ্টি – মন কেড়েছে। সবুজে মগ্ন মন- খেয়াল করিনি ড্রাইভার আর উৎপলের উৎকণ্ঠা, খেয়াল করিনি সাথের গাড়ির অবিন্যস্ত চলন। আমাদের গাড়িও কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে বেশ তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমাদের ড্রাইভারের কৌতূহলী জিজ্ঞাসার উত্তরে কর্ণাটক স্টেট পরিবহনের এক বাসের সারথী জানলেন–সামনের বাঁকে রাস্তা জুড়ে টস্কর(দাঁতাল হাতি) আর তার বিশাল এক পরিবার। এগিয়ে যাবো-যাবো না ভাবতে ভাবতেই কর্ণাটক পরিবহণের আরো একটা বাস, কিছু প্রাইভেট পরিবহণ এবং উড়িষ্যা থেকে আসা এক ট্যুরিস্ট বাস ছুটে আসছে দেখে আবারও একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা। কন্নড় ভাষায় ড্রাইভারদের মধ্যে কথোপকথন বুঝতে না পারলেও–আমাদের সারথি জানালেন, পিছনের বাস- দামাল দলের আক্রমণ থেকে কোনো মতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এক-বাস যাত্রীদের। জানাতে ভুললেন না যে, এটা ওদের রোজকার লড়াই—
অন্য পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের গাড়ি এবং সাথে আরো কিছু গাড়ি বাঁ-দিকে কফি বাগানের মধ্যে সংকীর্ণ এবং পাথুরে এক রাস্তা দিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। একটু এগোতেই চারপাশে পাইন, চীর আর সিলভার ওক-এর সমারোহ। আর বনের আড়ালে-আবডালে ছবির মতো কয়েকটা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কটেজ। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম প্রতিটি কটেজের চারপাশে সোলার ফেন্সিং এবং বেশ উঁচু কলামের উপর তারা। যা দূর থেকে বোঝা যায় না। খানিকটা চলার পর ফিরে এলো পাহাড়,ডানদিকে খাদ, খাদের ওপারে আবারও পাহাড়, যার বুক-পিঠ জুড়ে স্তরে স্তরে বনভূমি আর মাঝে মাঝে রঙের আলোয় সাজানো ছোট্ট ছোট্ট রিসর্ট। সারথি আঙুল দিয়ে দেখালেন, ওই তো কুর্গ। —কুর্গ এসে গেলে পাহাড়ের মাথায় ওই কফি বাগানে কখন যাব? যাওয়ার পথেই তো ওখানে যাওয়ার পরিকল্পনা। তাহলে কি বাতিল হয়ে গেল! ভারাক্রান্ত মনে সবে মৃদু আক্রমণে যাওয়া স্থির করতেই-আরিয়ান এক গাল হেসে আমাকে দেখালো বাঁদিকে পাথুরে পথ কেমন ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে। এক বিস্তীর্ণ কফি বাগান–এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত মানের কফি বাগানের একটিতে গিয়ে শেষ হয়েছে।দু’দিকেই এত সুন্দর জঙ্গল আর উপত্যকা যে, চোখ ফেরানো যায় না।আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি আরো এগিয়ে চললো আমাদের জন্য অপেক্ষার পথে। সবুজ-হলুদ ঝোপ আর বনফুলে ঢাকা সেই ধাপে ধাপে পথ বেয়ে চললাম পরবর্তী আশায়।
কর্ণাটকে হাতির বিশেষ পছন্দের জায়গা কফি বাগান। সারারাত ধরে শোনা যায় কাছে বা দূর থেকে পটাকার আওয়াজ। কাঁচা কফির নেশায় মত্ত হাতির দৌরাত্ম্য সামলাতে সারাবছরই দীপাবলি চলে কোডাগু বা কুর্গে, প্রশাসনের তদ্বিরে। সবুজ গালিচায় মোড়া কুর্গ পশ্চিমঘাটের বড় আদরের । তার কোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রূপময়ী নদী, পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতি এবং রোবাস্তা, অ্যারাবিকার প্রাচুর্যের আশ্চর্য মেলবন্ধন! টাটা কফি থেকে শুরু করে আলাথক্যাড, ক্লাব মাহিন্দ্রার কফি প্ল্যান্টেশন, নেচারা ভিস্তা, এরকম অজস্র নামী-অনামী কফি এস্টেটে চারিদিক সবুজ আর সবুজ।
এক-একটা কফি বাগান কেবলমাত্র কফি নয়, বিভিন্ন উন্নত মানের মশলার রত্নভাণ্ডার! কী নেই সেখানে! পাহাড়ের সবুজ মখমলি ঢাল এবং দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে যেমন কফির চাষ, তেমনই পাকদন্ডির আনাচ-কানাচ জুড়ে লাল-সোনালির সাম্রাজ্যে উজ্জ্বল উপস্থিতি এশিয়ায় এক বিশেষ স্থানে থাকা হাজার প্রজাতির মশলা, আয়ুর্বেদিক ওষুধ, মূল্যবান কাঠ এবং সবুজ সম্পদ। পাহাড়ি চড়াই-উতরাইয়ের পথ ধরে রোস্টেট কফির গন্ধ বুঁদ করে রেখেছে। হাতির আর কী দোষ!
‘MOUNTAIN VIEW COFFEE PLANTATION’ –অমায়িক যত্নে আমাদের বাগান পরিদর্শন, সবুজ বীজ থেকে সুবাসিত কফির বিভিন্ন পর্যায় বোঝানো এবং দেখানো শুরু হল- এক গবেষক ছাত্রের অসামান্য ভাষ্যে। কয়েক- মাসের ওয়ার্কশপে ওর মতো বহু ছাত্র ওখানে আপাতত-অবসরে গাইডের কাজ করছে । ওদের কোর্সের মধ্যেই পড়ে পর্যটকদের সাথে সুষম আচরণ এবং যথার্থ বর্ণনা। প্রতিটি মশলার কোন পর্যায়ে আমরা খাই, কোন পর্যায়ে উচ্চমানের রপ্তানির কাজে ব্যবহার করা হয়–আরও কত যে কর্মযজ্ঞ! সত্যিই যদি মন যা চাইছে লিখতে হয়, ‘কুর্গের পথে’ – একটা গোটা বই হয়ে যাবে। কফি গাছের আল ধরে পাকদন্ডির পথে কতটা সময় যে পাড়ি দিয়ে এসেছি প্রশ্ন – উত্তরে, খেয়াল নেই। হঠাৎ গাইডের ফোনে অ্যালার্ম কল, ফোনে কিছু আলোচনার পর ছেলেটি একটু ভীত, একটু ব্যস্ত – সমস্ত হয়ে বলল, আর এগোব না, আমাদের ফিরে যেতে হবে। কেন- প্রশ্নের উত্তরে একটাও কথা বলেনি যতক্ষণ বাগানের মধ্যে ছিলাম। নিরাপদ দূরত্বে এসে জানাল, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে জানানো হয়েছে কেরল ফেরত হাতির এক বিরাট দল ওই বাগানের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করছে, কোনোরকম বাঁধা বা নিরাপদ বেস্টনীকে গুরুত্ব না দিয়ে। বাগানের বিশেষ নিরাপত্তা মাধ্যম এটাও জানিয়েছে কাঁচা কফির বিন খেয়ে নেশাতুর হয়ে সম্ভবত তিনটি হাতি বাগানেই ঘুমিয়ে আছে। ওরা কোন জঙ্গল থেকে এসেছে বাগান কর্মীরা নিশ্চিত নয়। কফি বাগান আমাকে তৃপ্তি দিলেও, কৌতূহল আরো সামনে এগিয়ে যেতে বলছে- কিন্তু উপায় নেই। অপূর্ব কফি খাইয়ে এবং বীন থেকে কফি তৈরির প্রসেস মোটামুটি বুঝিয়ে –চারজন ফরেস্ট গার্ড দিয়ে আমাদের এবং আরো কিছু ট্যুরিস্ট যানকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে দিয়ে গেল কফি প্ল্যান্টেশনের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক দপ্তর। ওদের আতিথেয়তার ঘোর তখনও কাটেনি, দায়িত্ববোধের ওই নিটোল সংকল্প আমাকে আজও ভাবায়।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একটু একটু করে আলো জ্বলে উঠছে কাছে দূরের সবুজ পাহাড়-উপত্যকা জুড়ে। পাহাড়ি বাঁক ঘুরে ঘুরে কয়েকটা দোকান, গুটিকয়েক দোকানি আর ছোট্ট ছোট্ট রিসর্ট ঘিরে মৃদু কূজন! মেঘ আর সবুজের আড়ালে প্রকৃতির রূপের খনি আগলে বসে আছে দলছুট অতিথির পথ চেয়ে সুগন্ধি কুর্গ। মেঘের ক্যানভাস জুড়ে সেই অপেক্ষার সংকেত, স্বপ্ন আর পথচলা! দু-চোখ ভরে দেখা আর এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই আমাদের গাড়ি এসে থামল– পাহাড়ের একদম শেষ প্রান্তে আরো একটু উঁচু এবং আয়তাকার পরিসরে। যাকে ছুঁয়ে আছে ছোট্ট একটি বাড়ি, কুর্গ-আর আমাদের Airbnb। এই সমতল পরিসরের দূরের প্রান্তটি যেন হঠাৎ গড়িয়ে নেমে গিয়েছে অতল খাদের ভিতরে। আশেপাশে দ্বিতীয় কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ল না, বেশ কিছুটা নীচে কয়েকটা আলোর বিন্দু ছাড়া।আধো-অন্ধকারে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি,সামনে নিঃসীম এক পথ, ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল–যেন সত্যিই পৃথিবীর অন্তিম স্টেশন। সকালের মেঘ-বৃষ্টির সাদা আলোয় ঢাল বেয়ে উঠে আসা দু-তলা এই বাংলোটিকে এক মায়াপুরীর মতো দেখাচ্ছে। ফুলের স্বর্গরাজ্যে এক হিরণ্ময় ভোর। বাড়ির অঙ্গে অঙ্গে সেই ফুলের অলঙ্ককরণ! কয়েকটা দিন এই নিসর্গরাজ্যে যেন আমরাই রাজা।
আজ এটুকু থাক। কুর্গের গল্প কখনো বলব–কত জনপদ,পাহাড় ঘেরা চিরসবুজের দেশ! ফিরে ফিরে আসে সে কথা, ” প্রকৃতির সাথে বাঁচি। অন্যথা হলে দোষ দেবে মহাকাল” –মনে রাখব।
ফিরে এলাম পরম তৃপ্তি নিয়ে। কথা দিলাম, “আবার আসিব ফিরে… /হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে… /কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব…. ” —।
তারিখঃ এপ্রিল ২৩, ২০২৪
মুগ্ধপাঠ। অনুপম তুলিতে পরম যত্নে যেন আঁকা প্রকৃতির ছবি। সেই সাথে গদ্যের এমন মাধুরী যা নির্যাস ছড়িয়ে এগিয়ে গেছে পায়ে পায়ে বহুদুর।বনে পাহাড়ে কফির বাগানে ঘুরে বেড়ানোর অসামান্য অভিজ্ঞতা আমাকে ছুঁয়ে গেল নিবিড় সুরে।