বাংলার লোক-উৎসব ও লোক মেলা প্রসঙ্গে

 

বাঙালির অস্হি-মাংস-মজ্জায় উৎসবকলা আর পালপার্বণের ঘনিষ্ঠ সংস্রব। এ সংস্রব তার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন-দর্শন ও বিশিষ্ট সামাজিক বোধের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। যুগে যুগে কালে কালে এই দর্শন ও ভাবচেতনা আমাদের সমাজের স্তরে স্তরে যে ধারা প্রবাহিত করেছে  তা গতানুগতিক শাস্ত্রধর্ম ও শাস্ত্রধর্ম-নিরূপিত আদর্শের চেয়ে অনেকাংশে ভিন্নতর। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ-জীবনের মিশ্র অনুভূতির সমন্বয়ের কারণে এ দেশের পল্লীসমাজের বোধ ও আনুষ্ঠানিকতার এক বিশেষ পরম্পরা লক্ষ করা যায়। এই বিশেষ নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমান ধারাই হচ্ছে আমাদের লোকধর্ম, লোকসংস্কৃতি, লোকদর্শন বা লোকজ ঐতিহ্য। এই লোকদর্শনই বাংলার লোকায়ত দর্শন। ছকবাঁধা আচরণ, ক্রিয়া ও প্রবৃত্তির চেয়ে আলাদা অথচ সর্বজনীন এই আদর্শে ভেদবুদ্ধির স্হান নেই, কড়াকড়ির শেকল নেই, দুর্বোধ্য উচ্চারণের পীড়ন নেই।
লোকধর্মই সকল ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কার ও আদর্শের আদি রূপ। জনমানসের অভিব্যক্তিই তার প্রথম প্রকাশ। প্রাকৃতজনের কামনা-বেদনাই তার মধ্যে রূপায়িত। তাই যুগে যুগে কামনা-বাসনার পরিতৃপ্তির অন্য সব পথ যখন রুদ্ধ, তখন এই লোকধর্ম তথা মানবধর্মের মধ্যেই জনমনের চাহিদা পূরণের উপাদান খুঁজে পেয়েছে বাংলার মানুষ। রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ – ১৯৪১ খ্রি.) যথার্থই বলেছেন –
‘নদীর পলিমাটিতে তৈরি এই বাংলাদেশ। এখানে ভূমি উর্বর। বীজমাত্রই এখানে সজীব ফসল হয়ে ওঠে। তাই এখানে প্রাণধর্মের একটি বিশেষ দাবি আছে। পলিমাটির দেশ বলেই এখানকার ভূমি কঠিন নয়। তাই পুরাতন মন্দির প্রাসাদ প্রভৃতির গুরুভার এখানে সয় না। সেই সব গুরুভার এখানে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়। পুরাতনের মৃত পাষাণভার এখানে না সইলেও জীবনের দাবিদাওয়া এখানে পুরোপুরি সফল হবে। প্রাণের নামে, মানবতার নামে দাবি করলে এখানে সাড়া মিলবে। জীবন্ত ক্ষেত্রে জীবনের দাবিই চলে। কিন্তু তাই বলে এ দেশের সাধনাকে পুরাকালের পাথরের জগদ্দল চাপে কঠিন ও ভারগ্রস্ত করে রাখলে তো চলবে না। মন্দিরের প্রাসাদের পাষাণভারে বাংলাদেশের উর্বর বিস্তারটিকে ঢেকে ফেলে জীবনের সেই দায়িত্বকে এড়াতে চাইলে আমরা হব ধর্মভ্রষ্ট।’
লোক-উৎসব শুধু কিছু লোকের উৎসব নয়। বরং বলা চলে এটি হলো সর্বসাধারণের দ্বারা গণমানুষের জন্য সংঘটিত লোকজীবনের সমষ্টিগত উৎসব। বিশেষ মানুষের সাধারণ উৎসবের উদ্দেশ্য ও মেজাজের সাথে এই উৎসবের পার্থক্য সহজেই ধরা যায়। লোক বা সাধারণ সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় লোকউৎসব। শাস্ত্রবিধানের কড়াকড়ি এখানে প্রধান হয়ে ওঠে না। অন্য উৎসবের সাথে শাস্ত্র ও সমাজের বিশেষ শ্রেণীপেশার মানুষের প্র্রাধান্য থাকে। দেশের প্রায় সর্বত্র সে অনুষ্ঠানগুলো হয় প্রায় একই কায়দায়। লোকউৎসবে ব্যক্তির চাইতে সমষ্টির স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পায়। এ উৎসব অধিকাশ ক্ষেত্রেই আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ এবং দেশের সর্বত্র একই নিয়ম-রীতিতে অনুষ্ঠিত হয় না। স্ব স্ব আঞ্চলিক অথচ সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পরিচিতি ও অনুস্মৃতি এখানে লক্ষযোগ্য। অন্যান্য উৎসবে নৃত্যগীত অত্যাবশ্যকীয় না হলেও লোকউৎসবে কিন্তু নৃত্যগীত ও নানা বিনোদনের চিত্ত আকর্ষণকারী উপাদান প্রবলভাবে বিদ্যমান। এই উৎসবকলার উপচার সাধারণ, সহজলভ্য এবং সাধারণের আয়ত্তাধীন। এ কলা বিশেষ ছকে বাঁধা নয়।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সাধারণ মানুষ নিজের ক্ষমতার বাইরেও কামনা করে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির সহায়তা। জীবনে বা মননে ব্যর্থতা কিংবা ক্ষতির সম্ভাবনাকে সে তিরোহিত করতে চায় তার সীমিত চিন্তাশক্তি দিয়ে গড়া সংস্কার ও বিশ্বাসের সাহায্যে। তার চারপাশের পরিবেশে সে দেখে গাছপালা, লতাপাতা, বনবাদাড়, পাথর, নদীনালা, খালবিল, পাখি, সাপ, ব্যাঙ, বিড়াল, মাছ, গরুমোষ ও নানা জাতের পশুপাখি। কঠিন শাস্ত্র সম্পর্কে তার ধারণা ও জ্ঞান নেই বললেই চলে। প্রকৃতির নিয়ম তার কাছে অপরিজ্ঞাত । মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়-বাজ-বিদ্যুৎ, রোগবালাই-জন্মমৃত্যু ইত্যাদির কার্যকারণ সম্পর্কিত বিষয় তার কাছে রহস্যময়তায় ভরা।
বাংলার গ্রামজীবনের সহজবোধের মানুষ সীমিত গণ্ডির জগতে স্বপ্ন দেখে আনন্দোচ্ছ্বল জীবনের। বিস্তারিত কষ্টের মাঝে চায় কিছুটা প্রশান্তি। তার সাধারণ চাওয়ার মূল লক্ষ্য স্ত্রী, পুত্রকন্যা, স্বজন নিয়ে সংসারজীবনে স্বস্তি, শান্তি, সচ্ছলতা, নিরাপত্তা, আনন্দ ও সুস্হ বিনোদন পেতে। পূর্বপ্রজন্মের আচরিত কর্মকাণ্ড, প্রচলিত কাহিনী-কিংবদন্তী ও পরিবেশ থেকে গড়ে ওঠে তার বিশ্বাস, আদর্শ ও সংস্কার। এ ভাবেই প্রাচীন বাংলার লোকবিশ্বাসে জীবজন্তু, গাছপালা, নদনদী, খালবিল, লতাপাতা, পাথর, ঝড়-বাদল, বাজবিদ্যুৎ, ফসল, ব্যবহৃত সামগ্রী এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিষয়াবলি নানাভাবে প্রতিভাত হয়েছে অলৌকিক মহিমায়। সৃষ্ট হয়েছে লৌকিক জীবনের অলৌকিক শক্তির দেবদেবী।
এসব আরোপিত মহিমার জগৎ ও লৌকিক দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধান করে সীমিত জ্ঞানের সাধারণ মানুষ  রোগবালাই থেকে মুক্তি, দুর্ভিক্ষ-মহামারী-অকালমৃত্যু, প্লাবন, শস্যহানি, সর্পভীতি ইত্যাদি থেকে পরিত্রাণ এবং ধন, শস্য, সুস্বাস্হ্য, সন্তানলাভ ও ঐহিক ও পারত্রিক কল্যাণ পাবার মানসিক শক্তি অর্জন করে। কখনো কখনো ধর্মীয় আচারের কঠিন অনুশাসন আমাদের লোকজীবনে সহজ পদ্ধতিতে মিশে যায়। লোকবিশ্বাস এবং গ্রামীণ জনজীবনের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে সমন্বিতভাবে লোকউৎসব ও লোকমেলার আয়োজন ঘটে বাংলার আনচ-কানাচে। বিপুল সমাগমে মুখর হয়ে ওঠে উৎসব-অঙ্গন।
লোকউৎসবের দুটি বিশেষ দিক লক্ষণীয়। একটি এর ব্যবহারিক দিক, অন্যটি ভাব ও আবেগের দিক। মূলত লৌকিক দেবদেবী, করিৎকর্মা মহাপুরুষের পূজা, ভক্তিজ্ঞাপন বা তাদের জন্য কাঙ্ক্ষিত সন্তুষ্টিবিধানের জন্যই সমষ্টিগত উৎসবের আয়োজন। এসব আরাধনা বা ভক্তিজ্ঞাপনের মূলে আধ্যাত্মিক মানসিকতার চাইতে ঐহিক প্রয়োজনই মুখ্য বিষয়। সহজ ভাব বা সাধারণ আবেগ এ উৎসবের সত্তা। দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সাধারণ কামনা এখানে লক্ষণীয়। বিনোদনের অবলম্বন হিসেবেও এসব উৎসবের ব্যাপকতা যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের প্রাণ-প্রবাহকে সচল রেখেছে।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর আগেও এ দেশের বহু অঞ্চলে নানা লোকজ দেবদেবীর পূজা, অনুষ্ঠান এবং বিনোদনসহ উৎসব প্রচলিত ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূর্তির অস্তিত্বের বদলে শুধু তাদের নামেই আয়োজনের ঘটা হতো গাছতলা, প্রান্তর, বড় প্রাঙ্গণ, নদী কিংবা দিঘি বা জলাশয়ের পাড়ে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ গাছ, গাছের ডাল, পল্লব, মাটির ঘট, শোলা, বেত, বাঁশ ইত্যাদি সহজলভ্য উপকরণে কল্পিত ও সজ্জিত হয়েছেন দেবদেবী। জটিল শাস্ত্রধর্মের সামান্য সংযোগ কোনও কোনও সময় লক্ষ করা গেলেও ব্যাপকভাবে ধর্মীয় আচারের চেয়ে লোক-আচারের বিষয়ই ছিল প্রধান। নানা কাহিনী ও কিংবদন্তী যুক্ত হয়ে উৎসবের মাহাত্ম্য দিনে দিনে বেড়েছে মানুষের মনে। আবহমানকাল থেকে লোক-উৎসবের মূলে অস্তিমান রয়েছে সহজ মানুষের নির্মল হৃদয় ; তার লক্ষ্য হলো অকৃত্রিম তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ। কৌম চেতনার ধারাবাহিকতা থেকে আমাদের এই চলমান আয়োজনগুলো আজও সমাজ-জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অনুন্নত পল্লী অঞ্চলে এখনো বনে-জঙ্গলে, বৃক্ষতলে, দিঘি-পুকুর-নদীপাড়ে, ক্ষেতখামার, বাঁশঝাড়ে নানা রকম অপৌরাণিক লৌকিক দেবদেবীর পূজা ও সে উপলক্ষে উৎসব এবং মেলার আয়োজন লক্ষ করি আমরা। প্রাচীনকালের অনেক উৎসব হারিয়ে গেছে কিংবা ম্লান হয়ে টিকে আছে। অস্পষ্টভাবে কিছু উৎসবের ধূসর স্মৃতি কারও কারও মনে জেগে আছে হয়তো। লক্ষ্মণসেনের (১১৭৯ – ১২০৬ খ্রি.) অন্যতম প্রধান সভাকবি গোবর্ধন আচার্য দ্বাদশ শতাব্দীতে লিখেছেন –
‘ হে কুগ্রামের বটবৃক্ষ, তোমাতে কুবের অথবা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান থাক বা না থাক, মূর্খ গ্রামীণ লোকের কুঠারাঘাত থেকে তোমার রক্ষা হয় শুধু মহিষের শৃঙ্গ তাড়নায়।’
লক্ষণীয় যে আজও গ্রামজীবনের সাধারণ সংস্কার অনুযায়ী বট, পাকুড়, বেল, নিম, তুলসী ইত্যাদি গাছ আগুনে পোড়ানো হয় না। মনে করা হয় এসব বৃক্ষের সাথে দেবতাদের নিবিড় যোগ রয়েছে।
লক্ষ্মণসেনের ‘ অনুপম প্রেমৈক পাত্রং’ বা অনুপম প্রেমের একমাত্র সখা এবং প্রতিরাজ ও মহাসামন্তচূড়ামণি বটু দাসের ছেলে মহামাণ্ডলিক ও সাহিত্যপ্রেমী শ্রীধর দাস ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সঙ্কলিত করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দী ও তার আগের ৪৮৫ জন কবির ২৩৭০টি শ্লোকের এক বিশাল গ্রন্হ। গ্রন্হটির নাম সদুক্তিকর্ণামৃত। সেই গ্রন্হের একটি শ্লোকে গ্রাম্যপূজা ও আনন্দ উৎসবের বিবরণ পাই আমরা এভাবে –
‘ নানাবিধ জীব বলি দিয়ে দেবী বনদুর্গাকে পূজা করে, গাছের তলায় ক্ষেত্রপালকে রক্ত দিয়ে দিনশেষে বর্বর লোকেরা তাদের সহচরীদের নিয়ে একতারা বাজিয়ে নাচগান করতে করতে বেলের খোলায় মদপান করছে।’
লোক-উৎসব বাংলাদেশে চিরকাল সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও মিলনের আহ্বানে অনন্য অবদান রেখেছে বলেই দেখতে পাই। মালদহের জহরাকালী, বগুড়ার শেরপুরের ভবানী কিংবা নাটোর শহরের বুড়াকালীপূজায় সকল ধর্মীয় আদর্শের মানুষের নানা প্রকারে অংশগ্রহণ লক্ষ করি। বৈশাখ মাসে জহরাকালীর মেলা, গাইবান্ধার ভরতখালির পূজা ও মেলা, হাওড়ার বাগনান থানার কাঁশরা গ্রামের আবদুল দিঘি, ময়মনসিংহ, লাঙ্গলবন্দের স্নানযাত্রার মেলা ইত্যাদি বহুশত লোক-উৎসবে সব শ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাংলার লোকমানসের দ্যোতক হয়ে টিকে আছে আজও। বাগনানের আবদুল ফকিরের মাজারে কুমড়া কিংবা অর্থ মানত করে সনাতনপন্হী হিন্দুরাও। একইভাবে চট্টগ্রামের বায়জিদ বোস্তামী, পটুয়াখালির মির্জাগঞ্জের ইয়ারউদ্দিন খলিফা, কিংবা সিলেটের শাহজালাল, শাহপরানের মাজারেও দেখতে পাই সব আদর্শের মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
সুন্দরবনের বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের পূজা করে কাঠুরিয়া, মধু সংগ্রহকারী মৌয়াল, জেলে হিন্দু-মুসলমান। বনবিবির পূজাশেষে পাঠ করা হয় মাহাত্ম্যসূচক পুথি বনবিবি-জহুরনামা।
লোক-উৎসব শুধু সনাতনপন্হী হিন্দু কিংবা শুধু মুসলমানের নয়। গ্রামীণ সরল সর্বসাধারণ যারা ভেদবুদ্ধির মারপ্যাঁচ বোঝে না তারাই আবহমানকাল থেকে লোকজ উৎসবের আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী। সে কারণেই চড়ক, নবান্ন, স্নানযাত্রা, মাজারে শিন্নি মানা, ধর্মপূজা, মোহররম, শীতলাপূজা, রক্ষাকালীপূজা, মনসাপূজা ইত্যাদি বহু উৎসব-অনুষ্ঠানে সকল সম্প্রদায়ের সাগ্রহ উপস্হিতি লক্ষ করি। লোক-উৎসব ও লোকসংস্কৃতির জাতবিচার করে এগুলো বাংলার সমাজ-জীবন থেকে ছেঁটে ফেলার অপচেষ্টা চললেও এ দেশের বুক থেকে আবহমানকালের ঐতিহ্যকে উপড়ে ফেলার ভাবনা হবে আহাম্মকের স্বর্গে বাস করার মতোই কষ্টকল্পনা। লুপ্ত ঐতিহ্যও আমাদের জীবনে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে ফিরে আসে কখনো কখনো।
প্রাক্ পলাশি যুগে বিভিন্ন উৎসব, পালপার্বণ, পূজার্চনা ও নানা অনুষ্ঠান আর মেলা এ দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরে। ধর্মীয় উৎসবাদি ছাড়াও সিরাজ-উদ্-দৌলার সময় নওয়ারা বা রাষ্ট্রীয় নৌ-উৎসবের আয়োজন হতো। বর্ষাকালে রাষ্ট্রীয় নৌবহরের বিভিন্ন ধরনের নৌকা যেমন – গড়মর্দান, হাতিমর্দান, ময়ূরপঙ্খী, মৎস্যমুখী, মকরমুখী, ইত্যাদির সমন্বয়ে মুর্শিদাবাদের গঙ্গাবক্ষে এ বিপুল কর্মসূচি চলতো। বৈশাখের প্রথম দিন পালিত হতো নববর্ষ উৎসব। এ দিন নবাব ও জমিদারদের নজরানা দেবার প্রথা ছিল। পুণ্যাহ বা রাজস্বের বার্ষিক হিসেব নিকেশের দিন ছিল এটি। জমিদারদের উপস্হিতিতে প্রজারা নজরানা দিয়ে কৃপাধন্য হতো। লাভ করতো আশীর্বাদ ও আনুকূল্য। আত্মীয়-বান্ধব ও প্রিয়জনদের মাঝে মিষ্টি বিতরণের রেওয়াজ ছিল। নওয়ারা সরকারি আয়োজনে হলেও এর আনন্দ সাধারণ মানুষও ভোগ করতো বিপুল উৎসাহে। একইভাবে আজকের বাংলাদেশের বহু এলাকায় আমরা দেখি নৌকাবাইচের ধুম যেখানে আপামর জনসাধারণের আগ্র্রহী অংশগ্রহণ লক্ষ করি। পহেলা বৈশাখের পুণ্যাহ, মিষ্টি বিতরণ ও স্বজন-মিলনের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা হালখাতা, মেলা ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষ বরণের উৎসব করে থাকি।
বাংলায় নতুনরূপে নববর্ষ উৎসবের উদ্যোক্তা হিসেবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭ – ১৯০৫ খ্রি.) নাম স্মরণীয়। ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে তিনি হিন্দুপূজা পার্বণাদি বন্ধ করে মাঘোৎসব (১১ মাঘ), নববর্ষ (১ বৈশাখ), দীক্ষাদিন (৭ পৌষ) ইত্যাদি নতুন কয়েকটি উৎসবের প্রবর্তন করেন। আমরা জানি যে ১২৫৭ বঙ্গাব্দ (১৮৫০ খ্রি.) থেকে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২ – ১৮৫৯ খ্রি.) তার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা কার্যালয়ে নববর্ষ অনুষ্ঠান শুরু করেন। ১ বৈশাখের সে অনুষ্ঠান সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮ – ১৮৯৪ খ্রি.) বলেছেন –
‘ সেই সভায় নগর, উপনগর এবং মফস্বলের প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোক এবং সে সময়ের সমস্ত বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ আমন্ত্রিত হইয়া উপস্হিত হইতেন। কলিকাতার ঠাকুরবংশ, মল্লিকবংশ, দত্তবংশ, শোভাবাজারের দেববংশ প্রভৃতি সমস্ত সম্ভ্রান্তবংশের লোকেরা সেই সভায় উপস্হিত হইতেন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির ন্যায় মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ সভাপতির আসন গ্রহণ করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই সভায় মনোরম প্রবন্ধ এবং কবিতা পাঠ করিয়া সভাস্হ সকলকে তুষ্ট করিতেন। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রগণের মধ্যে যাহাদিগের রচনা উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা তাহা পাঠ করিতেন। যে সকল ছাত্রের রচনা উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা নগদ  অর্থ পুরস্কার পাইতেন। নগর ও মফস্বলের অনেক সম্ভ্রান্ত লোক ছাত্রদিগকে সেই পুরস্কার দান করিতেন। সভাভঙ্গের পর ঈশ্বরচন্দ্র সেই আমন্ত্রিত প্রায় চারি পাঁচশত লোককে মহাভোজ দিতেন।’
লোক-উৎসব এবং লোকমেলা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সাধারণত লোক-উৎসব মাত্রই লোকমেলার অস্তিত্ব ঘোষণা করে। চড়কের মেলা, নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা, বারুণীর মেলা, রাসমেলা, পৌষমেলা,রামনবমীর মেলা, রথের মেলা, মোহররমের মেলা, নৌকাবাইচ উপলক্ষে আয়োজিত মেলা, পীর-ফকিরের ওরসমেলা, লক্ষ্মীপূজার মেলা, বসন্তমেলা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত অসংখ্য মেলার দৃষ্টান্ত আমরা বাংলার সর্বত্র লক্ষ করি। এগুলির অস্তিত্ব অতীতককালের ধারাবাহিকতায় আজো অস্তিমান। কালে কালে অনেক মেলা লুপ্ত হলেও নতুন নতুন মেলার সৃজন-সংবাদও আমরা জানি।
আবহমানকালের বাংলার মেলার ঐতিহ্য এ দেশের পল্লীপ্রকৃতির এক বিশেষ সম্পদরূপে আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাংলার আদিবাসী ও প্রান্তীয় জনপদের মধ্যেও বহু উৎসব ও মেলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও জার্মানি, মেক্সিকো ও স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশসমূহে অতীতে অনেক লোকমেলার প্রচলন ছিল বলে আমরা জানি।
মেলার মানসিক আনন্দের সাথে গ্রামবাংলার আর্থিক ও বাণিজ্যিক তাৎপর্য অসীম। আগের দিনে সাধারণত জমিদার, জোতদার তথা অবস্হাসম্পন্ন মানুষেরা গ্রামীণ মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মেলাতে নানারকম আমোদপ্রমোদ ও বিনোদনের ব্যবস্হা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ও অবসাদ লাঘব করে নতুন প্রাণশক্তির যোগান দেয়। স্হানীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, কৃষিজাত সামগ্রী, লোকজীবনে ব্যবহার্য নানাবিধ উপকরণ ও খেলনা মেলায় বেচাকেনা হয়ে থাকে। স্হানীয় কৃষক, কারিগর ও শিল্পী তথা কামার, কুমার, তাঁতি, মালাকর, মোদক-ময়রা, গোয়ালা ইত্যাদি শ্রেণীর উৎসাহ ও চাঞ্চল্য মেলার পূর্ব থেকেই বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ সারা বছরের আবশ্যকীয় বীজ, যন্ত্রপাতি, আসবাব ও তৈজসপত্র কিনতে পারে মেলায়। ব্যবসায়ী ও মহাজনরাও লাভবান হয় তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। মেলায় সামাজিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটে, সমাজবন্ধন দৃঢ় হয়। মোটকথা, বাংলার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে লোকমেলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
লোক-উৎসব ও লোকমেলার অস্তিত্ব এবং অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা বিষয়ে চিন্তা করলে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, এর মধ্যে প্রাকৃতজনের প্রাণস্পন্দন বিধৃত। প্রাগার্য, বৈষ্ণব, হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, আদিবাসী, শৈব, শাক্ত, সুফিবাদ, নববৈষ্ণব, সনাতনপন্হী, মুসলিম এবং বিভিন্ন কালে আগত তুর্কি, মোঙ্গলীয়, পাঠান, মোগল জনগোষ্ঠী ও নানা জনজাতির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশ্রণে গড়া সহজচিন্তার বাংলার মানুষের কাছে লোক-উৎসব ও লোকমেলা অদ্ভুত অনুরণন সৃষ্টি করে। গড়ে তোলে ভালোবাসার মেলবন্ধন। বাঙালির এই সহজবোধের আদর্শই তার জীবনের নিয়ামক হয়ে টিকে আছে আজও।
কোনোকালেই বাংলার মানুষের কষ্টক্লিষ্ট জীবনে দুর্দশার অভাব ছিল না। তবুও তারা সমন্বিত আয়োজনের নানা উৎসব-পার্বণের আনন্দধারায় সিক্ত হয়ে মিলনের প্রবাহে গতিমান থেকেছে চিরকাল। শত অভাব-অনটন, দুর্যোগ-বিপর্যয় ও সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খেলেও বাঙালি তার চিরায়ত রঙ্গপ্রিয়তা পরিত্যাগ করতে পারেনি। এ কারণে ঈশ্বর গুপ্তের (১৮১২ – ১৮৫৯ খ্রি.) পৌষ-পার্বণ কবিতায় পাই –
‘সুখের শিশিরকাল সুখে পূর্ণ ধরা।
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গভরা॥’
বৈষয়িক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক – সকলক্ষেত্রেই দুর্দশা আর ভাঙ্গনের হাহাকার প্রবলতর হচ্ছে ক্রমাগত। কৃষিনির্ভর যৌথ সামাজিক জীবনে আজ নৈরাশ্যের আঁধার। সকল স্তরের মানুষের বসবাসে সমৃদ্ধ নিউক্লিয়াস বসতগ্রাম ও যৌথ পারিবারিক বন্ধন এখন ছিন্নভিন্ন, একাকার। এককভাবে বেঁচে থাকার অশুভ প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে সমন্বিত সুস্হ চেতনা আর প্রাণোচ্ছ্বল ঐক্যবোধ। তবুও
নানা কষ্ট ও দুর্দশার কাল অতিক্রম করেও বাঙালি তার সতেজ, সহজ, সজীব মানসিকতার পরিচয় রাখে প্রচলিত নানাবিধ উৎসবকলার মধ্যে। অল্পকালের জন্য হলেও পরস্পর যেন মিলিত হয় পারিবারিক বন্ধনে। যেদিন এ জাতি তার এই উৎসবপ্রিয় মনটিকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবে সেদিন তার জাতিসত্তা তথা জাতিগত বৈশিষ্ট্য লোপ পাবে – এ বিষয়ে সন্দেহ নেই বলে ধারণা করা যৌক্তিক। তাই সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই সহজ সজীবতার উদ্ধার, লালন, পৃষ্ঠপোষণ ও জাগরণ নিয়ে কাজ করা জরুরি। আমাদের অমনোযোগ ও অবহেলা-অনীহা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যেন ঐতিহ্যহীনতার অন্ধকার প্রসারিত না করে।
সহায়ক সূত্র –
১. বরুণকুমার চক্রবর্তী : লোক-উৎসব ও লোক-দেবতা প্রসঙ্গ
২. বিনয় ঘোষ : বাংলার নবজাগৃতি
৩. শ্রীসুকুমার সেন : প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী
৪.  ড. অতুল সুর : বাঙলা ও বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতি
৫. সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায় : প্রাক্ পলাশী বাংলা
৬. কুমুদনাথ মল্লিক : নদীয়া কাহিনী
৭.  দেবী পাল : ঈশ্বর গুপ্তের জীবন ও কবিকৃতি
৮. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত : বাংলাদেশ বাঙালী – আত্মপরিচয়ের সন্ধানে
৯.  সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।

*সমর পাল, প্রাবন্ধিক ও গবেষক, সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

তারিখঃ এপ্রিল ২৫, ২০২৪

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse