রাতের পানশালা
অনুপম দত্ত
এখানে আপনি রোজ আসেন?
সন্ন্যাসীর কথায় নর্তকী স্মিত হেসে
ঝর্নার মতো কেশদাম মেলে দিয়ে
সামনের চেয়ারে বসে পড়ে
মধ্যরাতের এই পানশালায়
এমন পুরুষ সে আগে দেখেনি
একটু আগেও দ্রুতলয়ের
গান বাজছিলো
ধোঁয়ার চাদর ফুটো করে
সাইকাডেলিক আলো এসে
বিঁধে যাচ্ছিলো নাচিয়েদের ফ্যাকাসে মুখে
নর্তকী বিলোল কটাক্ষে
সন্ন্যাসীকে বিদ্ধ করার চেষ্টা করতে
গিয়ে একটা সবুজ অরণ্যে হারিয়ে গেলো
পালিশ করা কাঠের ডান্সফ্লোর
কড়া পানীয়ের গন্ধ আর কামুক পুরুষের
স্পর্শ দিয়ে তৈরি পানশালা
যেন ধূসর স্মৃতির বাষ্প
আমি কিন্তু রোজ আসি
কোথা থেকে এক শান্ত স্বর ভেসে আসে
নর্তকী তখন এক তরুণ বৃক্ষের
ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো
মনে হয় গাছের কোটর থেকে
বেরিয়ে এলো কথা ক’টা
কিছুদূরে এক শান্ত দীঘি
টলটল করছে
নর্তকীর মনে হলো সে
স্নান করেনি বহুকাল
আমি আসি, রোজ
শ্যাম্পুচর্চিত কেশরাশি থেকে
গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটা
দীঘির জলতলে মিশে যাবার আগে
যেন বলে গেলো
গ্লাস ভাঙলো কোথাও
অরণ্য ও সরোবর মুছে গেছে
নির্জন পানশালায় মুখোমুখি
নর্তকী ও শ্বেতাম্বর সন্ন্যাসী
নর্তকী গ্রীবায় আলস্য রেখে
বলে – আমার একা হতে
ভয় হয়, তাই আসি
আপনি?
আমি তোমার খোঁজে আসি
সন্ন্যাসী পানপাত্র ঠোঁটে ছোঁয়ান
কাউন্টারে এক বিষন্ন ওয়েটার
হাই তোলে
বাণিজ্যের রাত শেষ হয় হয়
আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
তোমায় খুঁজছিলাম
তখন পৃথিবী অন্যরকম ছিলো
অরণ্য, নদী, পাহাড়
অন্যরকম ছিলো
এমনই এক রাতের পানশালায়
তোমায় প্রথম দেখেছিলাম
নর্তকীর আঁকা ভুরুর নীচে
আশ্বিনের আকাশ জেগে ওঠে
সন্ন্যাসীর পানপাত্র ধরা হাত
ছুঁয়ে যায় কোমল আঙুল
হাত সরিয়ে নিয়ে স্মিত মুখে
সন্ন্যাসী বলে চলেন –
এক অসহায় মাতালকে
বড় যত্নে গোশকটে তুলে দিয়ে
তুমি আসবালয়ে ফিরছিলে
ঝড়ের রাত
হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয়
আমাদের দেখা হয়েছিলো
নর্তকী মুচকি হেসে
পানপাত্র নামিয়ে রেখে
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে
আপনি কি আমায় উদ্ধার করতে
এসেছেন, তথাগতের মতো!
ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে
সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ান
না, নিজেকে উদ্ধার করতে
আমি মধ্যরাতের পানশালায় আসতাম
ওই অরণ্য আর সরোবরে
আমার অতীত মিশে আছে
একটু পরে সন্ন্যাসী তার শ্বেতাম্বর বস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলে নিশাচর মাতালদের ভিড়ে
মিশে গেলেন
গাছের ডালে আটকে থাকা
শাদা আলখাল্লাটা হাওয়ায় দুলছিলো
দূর থেকে মনে হচ্ছিলো
যেন এক নর্তকী নাচছে রাতের পানশালায়
তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০