অধরা নেপাল ভ্রমণ
ভূপেন্দ্র সরকার
তিন পাগলের ভ্রমণ। আমি অরূপ নাথ আর সুমন্দ্র চৌধুরী। ইচ্ছে হলো নেপাল যাবো নিজেদের গাড়ি নিয়ে। ঝাড়া হাত পায়ে শুধু নিজেরা গেলে কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু ভারতের গাড়ি নিয়ে বিদেশ গেলে কিছু বাধ্য-বাধকতা আছে। যদিও অন্য রাষ্ট্রে গাড়ি চালানোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স দরকার, নেপালে ভারতের ড্রাইভিং লাইসেন্স বৈধ। তবে যেহেতু অন্য রাষ্ট্র তাই ভারতের ইন্সুরেন্স ওখানে কভার করে না। আলাদা করে ইন্সুরেন্স করে নিতে হলো।
সব জোগাড় করে একদিন সকালবেলা গুয়াহাটি থেকে অরূপের ইন্ডিগো সিএস নিয়ে তিনজনে বের হলাম। অসম পার করে উত্তরবঙ্গের কামাখ্যাগুড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে আলিপুরদূয়ার পেরিয়ে ডানদিকে হাসিমারা হয়ে অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে বনের শোভা দেখতে দেখতে চলেছি। শিলিগুড়িতে স্টেশনের পাশে হোটেলে রাতে থেকে পরদিন নেপাল ঢুকবো। সেইমতো একটা রুম নেওয়া হলো। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে শিলিগুড়ি শহরের ভেতর দিয়ে সোজা চলে গেলাম ভারত নেপাল বর্ডার কাঁকড়ভিটা। এখানে গেটে ঢোকার মুখে আমাদের পরিচয় পত্র সঙ্গে গাড়ির কাগজপত্র দেখে নেপালের জন্য একটা আলাদা গাড়ির নম্বর দিয়ে দিল। যেটা আমাদের পুরো যাত্রা পথে গাড়ির সামনে সবার নজরে আসে এভাবে লাগিয়ে রাখতে হবে। তাছাড়া আমাদের গাড়ির নেপালের পথে চলার জন্য রোড ট্যাক্স দিতে হলো। ভারতের মোবাইলের সিম নেপালে কোন কাজে আসবে না। পাসপোর্ট এর ফটো কপি জমা দিয়ে নেপালের একটা সিম কার্ড নিয়ে নিলাম। নাহলে গুগল দাদা আমাদের পথ চেনাবে না। ভারতের টাকা বদলিয়ে কয়েক হাজার নেপালের টাকা নিয়ে নিলাম। জানি না পথে ভারতের টাকা চলবে কিনা?
সব কিছু করে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে বিকেল প্রায় তিনটে হয়ে গেছে। কাঁকড়ভিটা থেকে কিছু দূর অব্দি সমতল পথ। পথের দুই ধারে সবুজ ধান খেত চোখ জুড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে গুটি কয়েক দোকান, সঙ্গে বসতি। আবার দুদিকে সবুজের সমারোহ। আমাদের দেশে অনেক জমি ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়, কিন্তু নেপালে দেখলাম বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়া একটু জমিও ফাঁকা নেই। কিছু না কিছু চাষ করে রেখেছে। ধীরে ধীরে সূর্য পাহাড়ের ওপারে ডুব দিচ্ছে। অন্ধকারের চাদরে পাহাড় ঢেকে গেছে। গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় সন্ধ্যার দিকে পথের পাশে এক চায়ের দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভদ্রমহিলার দোকানে চা বিস্কিট খেলাম। আমাদের ইচ্ছে সারারাত গাড়ি চালিয়ে যাব। চা পর্ব শেষে আবার গাড়ি ছুটছে। মাঝে মাঝে দু একটা নাইট সুপার হুসহাস করে আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা এই পথে সব সময় চলাচল করায় রাস্তা ওদের নখদর্পণে। তাছাড়া এ পথে ওদের কাছে নতুন করে দেখার কিছু নেই। আমরা যেহেতু এই পথে প্রথম যাচ্ছি আশেপাশের সব দেখে শুনে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি। রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ লালবন্দীতে পথের পাশে এক ধাবাতে রাতের খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা।
রাত যত গভীর হচ্ছে পথে গাড়ির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। দু এক জায়গায় হরিণ পারাপারের করিডোর, তাই নেপাল সরকারের তরফে সতর্কবাণী লেখা। রাতের নির্জনতা উপভোগ করতে করতে তিন পাগল মনের আনন্দে চলেছি। হঠাৎ ছন্দপতন! নেপাল পুলিশের গাড়ি দাঁড় করানোর সিগন্যাল। রাত তখন দুটো, এতো রাতে এই ফাঁকা জায়গায় পুলিশ থাকতে পারে ভাবতেই পারিনি। কী হলো! না, সুমন্ত্র সীট বেল্ট না লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল ফাইন দিতে হবে। অরূপ পুলিশকে বোঝালো যে গাড়ির সীট বেল্টটা মাঝে মাঝে কাজ করছে না। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়, ভূল যেহেতু আমাদের তার মাশুলতো গুনতেই হবে। তবে সহজে দিচ্ছি না, দর কষাকষি করে বারশো থেকে পাঁচশো তে নামালাম। পাঁচশো টাকার একটা নোট পুলিশের হাতে দিতেই বললো, আরে এ তো নেপালী রুপিয়া হাম সমঝে থে আপ ইন্ডিয়ান রুপিয়া দেঙ্গে। আমরা বললাম ইন্ডিয়ান রুপিয়া বর্ডার মে এক্সচেঞ্জ কর লিয়া। রাগে গজগজ করতে করতে টাকাটা পকেটে পুরে আমাদের যেতে দিল।
সুমন্ত্রকে বললাম, এবার সীট বেল্ট লাগিয়ে নাও এক সীট বেল্টের জন্য দুবার ফাইন ভরতে পারবো না। একটু এগিয়ে একটা ধাবা খোলা পেয়ে চায়ের জন্য বসে গেলাম। সবারই একটু একটু ঝিমুনি এসেছে। চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে আবার গাড়ি চালানো হবে। চা খেতে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হলো। আমাদের ওখানে এতো রাতে মহিলারা চায়ের দোকান করছে ভাবাই যায় না। কিছুক্ষণ চলার পর ভোরের আলো আমাদের নেপালে স্বাগত জানাল। ভোর বেলা এই পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। এমনিতেও পোখরা যাওয়ার রাস্তার সৌন্দর্য অসাধারণ। সকাল প্রায় দশটায় পোখরা পৌঁছলাম। একটু এদিক সেদিক ঘুরে মন মতো হোটেলও পেয়ে গেলাম ‘হোটেল হিমালয়া হেরিটেজ’। হোটেলে ঢুকে স্নান খাওয়া সেরে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। বিকেলে বাজার এলেকা এবং আশেপাশে হেঁটে বেড়ালাম। শহরে বেশ বড় বড় হোটেল ছাড়াও ক্যাসিনো এবং বার প্রচুর। তবে আমরা কেউ এসব পথের পথিক নই কাজেই এর থেকে তফাৎ যাই।
পরদিন সকালে এক রেষ্টুরেন্টে ব্রেকফাষ্ট করতে ঢুকে মালিককে জিজ্ঞেস করলাম ইন্ডিয়ান টাকা কোথায় বদলাতে পারবো? বলাও শেষ বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছে টাকা বদলিয়ে দেওয়ার জন্য। ওদের মধ্যেই কাড়াকাড়ি আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি। টাকা বদলানোর জন্য এতো আগ্ৰহ! জানতে পারলাম নেপালে ভারতের টাকার খুব চাহিদা। নেপালের লোক যেহেতু অনেক কিছুর জন্যই ভারতের উপর নির্ভরশীল কাজেই ভারতীয় টাকার চাহিদাও বেশী। সরকারী ভাবে ভারতীয় টাকা পেতে অনেক অসুবিধে। কেউ চিকিৎসার জন্য ভারতীয় টাকা চেয়ে আবেদন করলে ব্যাঙ্ক থেকে তাকে প্রথম অগ্ৰাধিকার দেওয়া হয় তারপর পড়াশোনা করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের। ব্যবসায়ী বা ভারতে বেড়াতে আসা লোকেদের সব শেষে বিবেচনা করা হয়। যারজন্য সবাই তাদের সামর্থ মতো ভারতীয় টাকা হাতে জমিয়ে রাখে। আমরা যেহেতু প্রথমে রেষ্টুরেন্টের মালিককে বলেছিলাম তাই ওনার থেকেই বদলিয়ে নিলাম।
আজ পোখরার সব দর্শণীয় জায়গা দেখে নেওয়ার ইচ্ছে। প্রথমেই দেখতে গেলাম ডেভিস ফলস্ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, এই ফলস্ এর জল ফেউয়া লেকে এসে জমা হয়। ডেভিস ফলস্ এর পাশেই গুহার ভিতর গুপ্তেশ্বর মহাদেব অবস্থিত। এখান থেকে একটু এগিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝে সুন্দর একটি গ্ৰাম নাম সারাংকোট। এতো সুন্দর গ্ৰাম আমি এর আগে আর দেখিনি মনে হয় আমরা নেপাল নয় সুইজারল্যান্ডের কোন গ্ৰামে এসেছি। প্রকৃতি যেন তার সবুজের ডালি এখানে উপুর করে দিয়েছেন। ওখান থেকে এসে একে একে পোখরা শান্তি স্তুপা এবং প্লাইস্টোসিন যুগের চুনাপাথরের মাহেন্দ্র গুহা দেখে চলে এলাম শ্বেতী নদী দেখতে । নদীর বিশেষত্ব হলো নদীর জল দুধের মতো সাদা কিন্তু হাতে জল নিলেই একটু পরেই জল রঙিন হয়ে যায়। শেষ দ্রষ্টব্য ফেউয়া লেক। এটা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক। লেকের জলে বোটিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। লেকের মাঝে ছোট দ্বীপে রয়েছে বারাহি মন্দির টিকিট কেটে নৌকা নিয়ে মন্দিরে যেতে হয়। এখানে চীনের এক দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হলো , ওনারা বেশ কিছুদিন থেকে নেপাল ঘুরছেন। কথায় কথায় জানাল ভারতে ঘোরার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নেপালের ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভিসা না পেয়ে ভগ্নমনোরথে চীন ফিরে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক আমাদের থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হ্যান্ডশেক করে হাত নেড়ে বাই বাই জানিয়ে একটু এগিয়ে আবার ঘুরে হাত নেড়ে বাই বাই জানাচ্ছে। এভাবে দু এক পা গিয়ে ফিরে ফিরে প্রায় দশবার হাত নেড়ে বাই বাই জানাল। আমরাও বাধ্য হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম । জানি না হয়তো এটাই ওদের দেশের রীতি, তবে ওদের এই বিদায় জানানো আমার কাছে খুবই আবেগিক মনে হলো।
ফেওয়া লেক থেকে হোটেলে ফিরে এলাম সন্ধ্যার দিকে। হোটেলে ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে অরূপের সঙ্গে সুমন্ত্রর মনোমালিন্য হওয়ায় পরদিনই ঘুরে যাব ঠিক হয়। দুজনকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারলাম না আমাদের ভ্রমণের দ্বিতীয় অংশ কাঠমান্ডু হয়ে ফেরা। পরদিন সকালে তিনজন গাড়িতে ফিরছি ড্রাইভিং সীটে অরূপ। ওদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা নেই। পাহাড়ি রাস্তায় বেশ জোরেই অরূপ গাড়ি চালাচ্ছে। সুমন্ত্র দু একবার বলেছে, এতো জোরে গাড়ি চালালে আমি নেমে যাব। অরূপ ওর কথায় তেমন পাত্তা দেয়নি। ছোট একটি শহরে এটিএম থেকে টাকা তুলতে দাঁড়িয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সুমন্ত্র গাড়ি থেকে নেমে হাওয়া। দুজনে মিলে অনেক খুঁজেও ওকে বের করতে পারলাম না। তাছাড়া ওকে যে মোবাইলে ফোন করবো তারও সুবিধা নেই। ওর ভারতের সীম নেপালে কাজ করবে না। নেপালের যে সীম নেওয়া হয়েছিল সেটা আমাদের কাছে রয়ে গেছে। ভাবলাম রাগ কমলে হয়তো আসবে, দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করেও যখন এলো না। বাধ্য হয়ে দুজনে গিয়ে এটিএম থেকে টাকা তুললাম। দুহাজার টাকা তোলায় নেপালের দুহাজার বের হলো। পরে ভারতে ঢুকে দেখেছিলাম ভারতীয় টাকা চোদ্দশ টাকা একাউন্ট থেকে মাইনাস দেখাচ্ছে। অন্য রাষ্ট্রে তোলার জন্য কিছু টাকা মাসুল নিয়েছে। গাড়িতে তেল ভরে দুজনেই গাড়ি ছোটালাম। আমাদের লক্ষ্য কাঁকড়ভিটাতেই ওকে ধরবো। কারন বাসে গেলেও কাঁকড়ভিটা হয়েই যেতে হবে অন্য রাস্তা নেই। অরূপকে বললাম, এখান থেকে যে সব নাইট সুপার কাঁকড়ভিটা যাবে আমাদের তার আগেই পৌঁছতে হবে। তিনজন একসঙ্গে বেরিয়েছি দুজন ফিরলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। লোকে বলবে, এই বয়সেও বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে। এদিকে মাথার মধ্যে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করছে। পাহাড়ি রাস্তায় যদি ওর বাসের কোন দুর্ঘটনা ঘটে ওর পরিবারকে কী জবাব দেব, অফিসের সহকর্মীরাই বা কী ভাববে! অরূপ গাড়ি যত জোরে পারে চালাচ্ছে। রাস্তায় শুধু দু জায়গায় চা খেতে আর এক জায়গায় রাতের খাবার খেতে দাঁড়িয়েছিলাম। রাত দুটোর পর দুজনেরই ঘুম পাচ্ছে। ঘুম তাড়ানোর জন্য খুব জোরে গান শুনছি আর মাঝে মাঝে মাউথ ফ্রেশনার দিয়ে কুলকুচা করছি। মাউথ ফ্রেশনারের ঝাঁঝের জন্য কিছু সময়ের জন্য ঘুমের ভাব কেটে যায়। ভোর চারটার দিকে অরূপ বললো, আর পারছি না একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। দুপাশে জঙ্গলের মাঝে গাড়ির গ্লাস তুলে দিয়ে ভেতর থেকে লক করে আধ ঘন্টার মতো ঘুমিয়ে নিলাম। ওখান থেকে একটু এগিয়েই চায়ের দোকান পেয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে চা খেলাম। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম কাঁকড়ভিটা। অপেক্ষা করছি আর সুমন্ত্রর মোবাইলে ফোন করে চলেছি। হঠাৎ একবার মোবাইলে রিং হলো, যদিও সুমন্ত্র ফোন ধরলো না। তারমানে ভারতের নেটওয়ার্কে ঢুকে গেছে। যাক! পথে তাহলে কোন দুর্ঘটনা হয়নি। ওর মিসেস কে ঘটনাটা আগেই জানিয়ে ছিলাম। এবার ওর মিসেস এর থেকে জানতে পারলাম ও শিলিগুড়ি পৌঁছে ফোন করেছিল। এবার একটু নিশ্চিন্তে পথ চলতে পারবো। ভ্রমণে কখনও কখনও এমনও হয়।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১
অপূর্ব অপূর্ব! খুব ভালো লাগলো দাদা