অপূর্ব যোগ

 

মরা যে কদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম, একদমই পানি দাওনি” – বাবার কণ্ঠে অভিযোগ, রাগ, হতাশা ছাপিয়ে উথলে ওঠে শোক। তার ঢেউ গমগম আওয়াজ তোলে নোনাধরা দেয়ালটার রুগ্ন শরীরে।

জমিজমার হিসেব-নিকেশে বাবা বাড়ি গিয়েছিল। বয়েস হয়েছে বাবার, তাকে দেখে রাখার জন্য মাও সঙ্গে চলল; আর মায়েরও তো বয়েস একদম কম হয়নি, তাই একমাত্র বোনটিও সঙ্গী হল। চাকুরি খুঁজছি দিনরাত, সামনেই কয়েকটি পরীক্ষা, তাই ছুটির কথাটা পাড়ার সাহস হল না। তারা সপ্তাহখানেকের জন্য গিয়েছিল কিন্তু প্রায় তিন সপ্তাহ কাটিয়ে এল এবং দেখতে পেল বারান্দার টবগুলোতে যেন গ্রহণ লেগেছে, শুয়ে গেছে সবগুলো চারা।

এবারের বর্ষাটা যেন কেমন ছিল! শুকোতে শুকোতে বনের গাছগুলো কাঠ হচ্ছিল ফার্নিচার হাউজে ওঠার আগেই, তাও দেখা মিলছিল না রিমঝিমের। শুরুর দিকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তো, তখন সবার আশা ছিল, আসুক শ্রাবণ। এমন করে ভাসাবে সবকিছু যে মাছেদের মত হাপুসহুপুস করে খিদে মেটাবে জলতরঙ্গের ঘূর্ণিতে। কিন্তু এহেন ছন্নছাড়া মুখ আর মলিনবেশ তার অনেকদিন দেখা যায়নি। এমনও দিন গেছে, মানুষ এক ঢোক জলের জন্য তেষ্টায় থাকতে থাকতে অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছে, জল নামছে তার জামা-কাপড় ছাপিয়ে, শরীরটা উষ্ণ প্রস্রবণ হয়ে! সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের পিঠাপিঠি ভাই ভাদ্র কিন্তু শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শ্রাবণের দিকে – শ্রাবণ যাই করুক, ভাদ্র ভাই তার স্বভাবচরিত্র বিসর্জন দেবে না কিছুতেই। লোকে যেন কইতে না পারে, কই তোর আর কী আলাদা! সব তো তোর আগের কালেই দেখে এলুম! প্রবল এক জাত্যভিমান থেকে ভাদ্র দেখিয়ে চলল সচেতন ভেল্কি যা পুরনো সব রেকর্ড ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিলে! মানুষ এসি বাসেও শান্তি পেলে না, আর এসিগুলো ভাদ্রের গরম নিঃশ্বাসের সাথে যুঝতে যুঝতে প্রাণবায়ু হারালে!

সত্যি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম বা আমিও এই ফাঁকে ফাঁকা বাসায় না কাটিয়ে বন্ধুর বাসা, বনে-বাদাড়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম; কিন্তু যখন মনে পড়েছে তখন কিন্তু পানি দিয়েছি, এমনকি ভরদুপুরে বা রাতের আঁধারে এবং যখন দিয়েছি ইচ্ছেমত দিয়েছি, যতক্ষণ না কাদায় থিকথিক করতে দেখেছি, ততক্ষণ দিয়েই গিয়েছি। এসব তো আর বলা যায় না, তাই আমি গাছগুলির দিকে চেয়ে রইলাম। নাহ্‌, আমার মধ্যে কোন অপরাধবোধ নেই, আমি বরং গাছগুলোর নবায়ন নিয়ে ভাবছি। কঠিন কাজ না, বাড়ির কাছেই নার্সারি আর সেখানে অভাব নেই এই ঘরানার চারাগুলোর। নানা জাতের, নানা বর্ণের আর গন্ধের ফুটফুটে বৃক্ষশিশুরা মুখরিত করে রেখেছে সেই নার্সারিটি! এবার অবশ্য সার নিয়ে আসতে হবে অনেক। তখন আর মরতে হবে না দুষ্টগুলিকে! ভারী এক খেলা শুরু করে দিয়েছে বজ্জাতগুলো। বাড়ি করে বয়ে নিয়ে আসতেই টুপ করে মরে যাওয়া!

বাবা গাছগুলোকে নিয়ে পড়ে থাকলো। দিন নেই, রাত নেই – ওগুলোকে জলখাবার খাওয়ালো, রোদে গোসল করিয়ে আনলো, দোকান থেকে মালমশলা কিনে নিজের হাতে বেটে আর পিষে স্প্রে করলো। বাবার মতো অবসর থাকলে আমিও তো করতুম! চাকরি খোঁজা, টিউশানির পাশাপাশি ক্লাব চালানো দুটো! পাড়ার কতগুলি ছেলেপুলে আমার দিকে তাকিয়ে, তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আসে, শলা-পরামর্শ, আপোস-রফা; মাঝে মাঝে ট্যুর থাকে, ট্রেকিং চলে। আমি আনমনে গাছগুলি আর বাবাকে দেখতে থাকি। বাবা গাছগুলির সাথে এমনি মিশে থাকে যে কোনটা গাছ, আর কোনটা বাবা- আলাদা করে চিনতে পারি না। প্রবল এক দৃষ্টিবিভ্রমে ভুগতে থাকি।

গাছগুলোর উপর চোখ বুলোতে বুলোতে একদিন বাবাকে বলি, “বেলি গাছটা মরে গেছে, দেখতে খারাপ লাগে খুব, তুলে ফেললে হয়। নতুন একটা এনে দেব নে।“ গাছটা বারান্দার কোণ দখল করে শুধু লম্বায় বাড়ছিল, শুধু একটি ডাল কোনমতে মুখ তুলে ছিল, আশেপাশের ডালগুলি একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। আসলে এটির কী অভাব, তা কখনো বুঝতে পারিনি। এটি কি রোদ পছন্দ করে, না জল-হাওয়া বা কী এদের বিশেষ কোন মিশ্রণ আর সমীকরণ, তা কখনোই মেলাতে পারিনি।

“কেন গাছটাতে পানি দিতে পারতে না!” – বাবা মনে হয় আমার কথা কানেই তোলেনি, এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সেই আগের কথাটিরই পুনরুক্তি করলো। বুড়ো বয়সের এই আশ্চর্য ঝোঁক, কিছু কথা একেবারেই যক্ষের মত আগলে রাখবে, আর অধিকাংশই ভুলে যাবে।

“পানি দিয়ে কি করব? এক বছর ধরে পুষছি ওটাকে, একটাও ফুল দিয়েছে?”

বাবা আমার কথার কোন উত্তর দিল না বা প্রয়োজন মনে করলো না। আমার সব কিছুতেই তার তাচ্ছিল্য। আমি যা করতে চেয়েছি জীবনে সে না করেনি, আবার পছন্দও করেনি। একবারতো পরীক্ষা ড্রপ করলাম, সামনে ছিল বিশ্বকাপ, দল বেঁধে বন্ধুরা সবাই ব্যানার করছে, ক্লাবঘর সাজানো হচ্ছে, জায়ান্ট স্ক্রিন ফিট করা হচ্ছে, সেই সময় পরীক্ষার আগের রাতগুলো বইয়ের দিকে তাকিয়ে কাটাতে হবে, ভাবতেই জ্বর আসলো গায়ে আর ফিস সব জলে গেল। মায়ের কাছে সব শুনে বাবা রাগ করলেন না একটুও, শুধু বললেন, “যার যার জীবন তার ইচ্ছেমত বেছে নেয়ার অধিকার আছে। সে যদি পরনির্ভর হয়ে বাঁচতে ভালবাসে, তাই করুক।”

বাবা রঙ্গন শেষ করে টগরের দিকে হাত বাড়িয়েছে, বেলি গাছটা আছে আরো দূরে। কিন্তু সেদিকে না, আমি তাকিয়ে আছি একেবারে উল্টোদিকে, টব আলোকিত করে রাখা গোলাপ গাছটার দিকে। বাসায় তোলার পর থেকেই সে ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছিল। নিজের বাড়ি থেকে সাথে করে আনা কলি ফুরোনোর পরও সে মিইয়ে যায়নি, জিরোয় নি এক প্রহরও। আত্মপ্রসাদে না ভুগে আরো কলির গয়না গড়িয়ে নিয়েছিল নিজের কচি অঙ্গে। গোলাপ গাছটি রোদ খুব পছন্দ করে, আর তা পর্যাপ্ত ছিল আমাদের খোলামেলা বারান্দাটায়। কিন্তু সেই-ই তার জ্বলজ্বলে পারফর্মেন্সের একমাত্র রহস্য ছিল না। আসলে যে গরু দুধ দেয়, তাকে আদর করতেও ইচ্ছে করে! আমার এই গোলাপ গাছটা সর্বদা ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকতো। সে পরিমিত আহার করতো, মেপে চলতো তার শয়ন আর কান্ড-ক্রীড়ার মানঘণ্টা। সে কখনো অভাবের মুখ দেখেনি। তার জন্য ছিল সার্বক্ষণিক গার্ড, প্রতিরক্ষার এক নিশ্ছিদ্র দেয়াল।

দেখতে দেখতে ভাদ্র মিলিয়ে যেতে লাগলো, আশ্বিন আসি আসি করছে। বাবা আগের মতই ঋতুগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো। আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করে যেতে লাগলাম। পুজোর ছুটি ঘনিয়ে এলে ছোটবোন বাড়িতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো, মাত্রই মাসতিনেক আগে ঘুরে এসেও তাকে নাকি আবার যেতে হবে। কিছু কাজ আধেক, আর কিছু একদম না করেই চলে এসেছে যে! কিন্তু আমি কি করে যাই! আরও কিছু চাকরির এক্সাম পড়ে গেছে, আমাদের অফিসগুলো তো আর স্কুলের মত এক সপ্তাহ পুজোর ছুটি কাটায় না। এছাড়া আমার দলবলের কুয়াকাটা যাওয়ার একটা হাল্কা সম্ভাবনা উঁকি মারছে পরিষ্কার নীল আকাশে! তারা কি আমাকে না নিয়ে যেতে পারে? বা, আমারই কি উচিত তাদের একলা ছেড়ে দেওয়া!

ফাঁকা বাসায় থাকতে ভাল লাগে না, বাইরে বাইরেই বেশী কাটাই, এমনকি অপ্রয়োজনে ঘুরাঘুরি করি। যখন রাতে বাসায় আসি, তখন এত নিঃশেষিত লাগে! একা বাসায় কি কোন অদৃশ্য চাপ থাকে, যা পিষে পিষে ক্লান্তি উৎপাদন করে? সেদিন সেই ক্লান্তিকেই ঝেড়ে ফেলতে কিনা জানি না, পায়চারি করতে লাগলাম ঘর জুড়ে, মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়ালাম বারান্দায়, আর এ করতে করতেই যখন গোলাপ গাছটার দিকে চোখ পড়ল, রীতিমত হতভম্ব হয়ে গেলাম! গত কদিন খুব করে বৃষ্টি হচ্ছিল, আর মানছি এ কদিন বাসার বারান্দা আর গাছ মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মা-বোন-বিহীন বাসাটা থেকে ভোরে বেরিয়ে যাওয়া, আর রাতে বিছানায় শরীরখানা পেতে দেয়া – এই ছিল আমার বাঁধাধরা দিন-পরিক্রমা। শুধুমাত্র তাদের বাড়ি যাওয়ার দিনটির বিকেলে এক ঝলক বারান্দায় এসেছিলাম, কিছু জামাকাপড় ছিল ধাতব তারে আবদ্ধ, গাছগুলোর সাথে তারাও ভিজেছে সকাল থেকে। গোলাপ গাছটিকে দেখলাম পুরো ডুবে রয়েছে টবের চৌবাচ্চায়। ভেবেছিলাম ভালো হচ্ছে পানি পাচ্ছে, এবার হয়তো আরো বেশি ফুলের রোশনাইতে ভরে উঠবে আমার গোলাপঘর। কিন্তু এ কী দেখছি আমি? নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না যে! একটি মৃত কঙ্কাল আমার চোখের সামনে! কী করে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এল? এত অল্প সময়ের মধ্যে? মাত্রই তো তিনটে দিন চোখের বাইরে ছিল! বাইরের মুক্ত হাওয়া, আকাশ আর বর্ষার পানি সে সইতে পারেনি? এত অল্পতেই এমন অসুখ করলো যে গা কাঁপিয়ে জ্বর এল? তাকে অনেক চিকিৎসা দেয়া হল, অনর্গল ছিটানো হল জীবনুনাশক জল, খালি হলো সিরাপের পর সিরাপ। কিছুতেই কিছু হলো না, সে চিরদিনের মত হেলে পড়লো। তার শরীরের মিহি মাংসদানাগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়তে লাগলো।

মনে আছে, পুরো তিনটে দিন বিছানায় শুয়ে ছিলাম, বাইরে বেরুতে পারিনি, রোদ সহ্য হতো না। একদিন কী হল, সময়ের অনেক আগেই আঁধার নামতে শুরু করলো, প্রবল বর্ষনের সাথে দাপিয়ে বেড়ালো হিমেল বাতাস। এদিকে শুয়ে থাকতে থাকতে আমার পিঠে শেকড় গজিয়ে উঠছিলো, শেষমেশ দুর্বল শরীরটা নিয়েই বারান্দাটায় পা বাড়ালাম সন্ধ্যের দিকে। বৃষ্টির তীর ঝাঁকে ঝাঁকে তখন বিঁধছে এর ইস্পাতের খাঁচাটায়। আমার গায়েও এসে পড়তে লাগলো তার ফলা। বাদল-সোহাগ থেকে বাঁচতেই কিনা, হঠাৎ দেয়ালের কোণটাতে ঝুঁকে গেলাম আমি আর তখনই একটা দৃশ্য চমকে দিলে আকাশের মেঘের থেকেও বেশি ভয়ানক করে। যে বেলি গাছটা মরে গিয়েছিল তার মাথায় জ্বলজ্বল করছে একটি ক্ষুদে হীরের কণা! অনেক দিন পানি দেওয়া হয়নি, সেই গাছ হঠাৎ জেগে উঠেছে। বেড়ে উঠেছে নিজের মতো করে, ফুল ফুটিয়েছে আপন শক্তিতে! তার পুরো দেহ ঝকমক করছে, যৌবন উপচে উপচে পড়ছে! তার মনে হয় তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা ছিল, এই বৃষ্টিটুকুর জন্যই যেন ছিল তার যুগযুগান্তের তৃষ্ণা, এর জন্যই সে ধরে রেখেছিল তার প্রাণবায়ু হাজারো অনাদর, আর অবহেলা সয়ে! আমি আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, প্রাণভরে নিলাম সেই পারিজাতের সুবাস, আমিও যেন একে খুঁজছিলাম জন্ম-জন্মান্তর ধরে। অবশেষে তাকে পেলাম!

রাত শেষ হয়েছে, কিন্তু ভোরের সূর্য তখনো ঘোমটা পরে! নির্মল শুভ্র আকাশ, আলো-জল-রোদ-হাওয়ার এক অপূর্ব যোগ বিশ্বচরাচরে! দু’পাড়ের কাশ-সাম্রাজ্য দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে পড়েছিলাম অথচ আর কিছুটা এগুলেই ঘাট আর তারপরেই গ্রামের বাড়ি। যে নৌকোটা করে নদী পার হচ্ছিলাম, সে মনে হল একা একাই চলেছে, তারও যেন এক প্রতীক্ষা, স্রোতের গঞ্জনা সয়ে সয়ে! এদিকে মাঝি উদাস মনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; মাঝে মাঝে দুয়েকটা প্রশ্ন করেছি কিন্তু উত্তর পাইনি। কাউকে না বলেই সেই সাত সকালে একটা ছোট্র ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রওনা দিয়েছি। চাকুরি, এক্সাম, ক্লাব, ট্যুর – সবকিছুকে ছুটি দিয়ে।

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Deb Sagar
Deb Sagar
2 years ago

বাহ এভাবেও একটা গল্পের প্লট হতে পারে দেখে ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো লেখকের প্রতি, আরো সুন্দর গল্পের আশায় রইলাম।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse