অবিস্মরণীয় কমল দাশগুপ্ত
অমিতাভ সরকার
মানুষটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ঠুংরি, টপ্পা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত- এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাঁর বিচরণ ছিল না। আধুনিক বাংলা গানের একচ্ছত্র সুরকার ছিলেন উনি। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝছেন। কমল দাশগুপ্ত। পুরোনাম কমলপ্রসন্ন দাশগুপ্ত।
১৯১২ সালের ২৮ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের যশোর অঞ্চলে নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামের পৈত্রিক ভিটেয় সত্য ধর্মের প্রচারক মহিমচন্দ্রের বংশে কমল দাশগুপ্তের জন্ম। মা প্রমোদিনী দাশগুপ্ত, বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। ক্রীড়া জগতের বিখ্যাত ব্যক্তি পঙ্কজ গুপ্ত সম্পর্কে ওঁর মাতুল। বাড়িটায় বিভিন্ন গুণীজনের অবাধ যাতায়াত ছিল। এই পরিবারের সবাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।
পরবর্তীকালে ওঁরা কলকাতায় চলে আসেন(মতান্তরে এটাও শোনা গেছে, যে ওঁর ছোটোবেলা কোচবিহারে অতিবাহিত হয়েছে)। মানিকতলায় যে বাড়িতে থাকতেন তার একতলায় ছিল গুপ্ত প্রেস। এটাই ছিল ওঁদের পারিবারিক আয়ের প্রধান উৎস। আর্থিক অবস্থা তখন বেশ সচ্ছল। বাবা সফল ব্যবসায়ী হলেও রীতিমতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চা করতেন। কাকা কিরণ দাশগুপ্তের তবলাবাদক হিসেবে বেশ সুনাম ছিল।
তিন ভাই, তিন বোন প্রত্যেকেই জীবনে সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁরা যথাক্রমে- বিমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, সুধীরা সেনগুপ্ত, ইন্দিরা দাশগুপ্তা। তিন ভাই গান করতেন। তিনজনেই নজরুলের গানের সুর করেছিলেন। তিনি এবং ছোটভাই সুরকার, গায়ক তবলাবাদক সুবল দাশগুপ্ত অল বেঙ্গলি মিউজিক কনফারেন্সে প্রথম হয়েছিলেন। ‘নাইবা ঘুমালে প্রিয়’ গানটি পাঠকদের মনে পড়ছে? কুন্দনলাল সায়গলের গাওয়া, প্রণব রায়ের কথা, আর সুর কিন্তু এই সুবল দাশগুপ্তেরই। যাইহোক, আবার আলোচনায় ফিরে আসি।
দাদার তখন হাসির গানে বিশাল নাম। একাধারে মিউজিশিয়ান এবং ম্যাজিশিয়ান বিমল দাশগুপ্ত যাদুবিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য প্রফেসর উপাধি পেয়েছিলেন। খেয়াল গানে এই দাদার কাছেই কমল দাশগুপ্তের হাতেখড়ি। সঙ্গে বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের কাছেও তালিম নিতেন। এইভাবেই কমল দাশগুপ্তের সঙ্গীতশিক্ষা শুরু।
দাদা ১৯২২ সাল থেকে ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন এবং নিজে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত শিক্ষকও ছিলেন। কোম্পানির মহড়া কক্ষে ভাইকে নিয়ে যেতেন যেখানে কিভাবে সুর দেওয়া হয়, শেখানো হতো। বাবা গত হওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব দাদার ওপরেই পড়েছিল। কাজের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেলে দাদার অনুপস্থিতিতে তাঁর এই মেজভাইটিই যে শিল্পীদের গান তোলাতেন। টুইন কোম্পানির অনেক গানের সুরও করেছিলেন, যদিও সুরকার হিসেবে সেখানে দাদার নাম থাকতো।
দাদার সঙ্গে নজরুল ইসলামের বন্ধুত্ব ছিল। কাজীসাহেব মাঝেমধ্যেই ওঁদের মানিকতলার বাড়িতে আসতেন। পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলাম কমল দাশগুপ্তের উপর গানে সুর করার ব্যাপারে পুরোটাই ভরসা করতেন। সহকারী হিসেবে কাজ করবার ফলে হার্দিক সম্পর্কটা আরও বেশি হয়। তাঁর সঙ্গেও গুরু-শিষ্যের এই সম্পর্কটা ক্রমশ গাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এই এগারো বছরে (১৯৩৪-১৯৪৫) চারশো নজরুলগীতির সুর করেছেন।
কমল দাশগুপ্তের পড়াশোনা শুরু কলকাতায়। ১৯২৮ সালে ক্যালকাটা একাডেমি থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। তারপর উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। দু’বছর পর পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি কম পাশ করেন। পরবর্তীকালে মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিউজিকে ডক্টরেট হন।(এই মীরার ভজন গেয়ে যূথিকা রায় ভারতবিখ্যাত হয়েছিলেন)। একে একে হামদ, নাত, গজল, খেয়াল সবেতেই দক্ষতা অর্জন করেন। পারিবারিক কাঠামো ছাড়িয়ে দিলীপকুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রামকৃষ্ণ মিশ্র, ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁ-র কাছেও কমল দাশগুপ্ত নাঁড়া বাঁধেন। তবে জমিরউদ্দিন খাঁকেই ওঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু বলা হয়। উনি কমল দাশগুপ্ত ও ভাই সুবল দাশগুপ্তকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন।
১৯৩০ সালের দিকে নিজের সুরে প্রথম রেকর্ড বের হয়। ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে দুটো গান লিখে, সুর করে মাস্টার কমল নামে স্বকণ্ঠে রেকর্ড করেছিলেন। গানদুটো ছিল-’গানের মালা গেঁথে গেঁথে’, এবং ‘কতকাল আমি’। কমল দাশগুপ্তের প্রিয় রাগ ছিল ভৈরবী। ভৈরবীতে কয়েকশো গান তৈরি করেছেন।
তাছাড়া নিজেও আরও কিছু গান লিখেছিলেন, যেমন- ‘মম যৌবন সাথী বুঝি এলো’, ‘বিফলে যামিনী যায়’, ‘কে আজি দিল দোলা’। গানগুলো ১৯৩৪ সালে রেকর্ড করা। যূথিকা রায়কে ভজন, কীর্তন, টপ্পার পাশাপাশি তামিল, হিন্দি গানও গাইয়েছিলেন। যূথিকা রায়-কমল দাশগুপ্ত ছিল সেযুগে বিখ্যাত হিট জুটি। ভারতীয় সঙ্গীতকে এঁরা অনেক অসাধারণ গান উপহার দিয়েছেন। এছাড়া সুরদাস, কবির, মীরার ভজনের পাশে ফৈয়াজ হাশমি, কামাল আমরোহি, হসরত জয়পুরীর গীত ও গজল এমনকি অ্যারাবিয়ান নাইটসেও সুরারোপ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। শুধু তাই নয়, সুর তুলিয়ে শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ড করানোয় এই মানুষটির মুন্সিয়ানা ছিল দেখবার মতো। সেই সময় অনেক শিল্পীই কমল দাশগুপ্তের হাতে তৈরি। নিজেও খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। যন্ত্র ও সুরের আবহসঙ্গীতে তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। একসময় গ্রামোফোন কোম্পানিতে তবলাবাদক হিসেবে যোগ দেন। নিজেও ম্যান্ডোলিন, জাইলোফোন বাজাতে পারতেন। পরবর্তীতে যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে একটা দল তৈরি করেন। সারাদিন কাজের পর যূথিকা রায়কে এবং কস্তুরবা সঙ্গীত বিদ্যালয়ে গান শিখিয়েছেন। অর্থাৎ সারাক্ষণ সঙ্গীতের মধ্যেই নিজেকে নিযুক্ত রাখতেন। সুরস্রষ্ঠা হিসাবে বাংলা ছবিতে কাজ করে চারবার, আর হিন্দি ছবির জন্য একবার -এই মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পান। রাগাশ্রিত, কীর্তন, ছন্দপ্রধান গানে উনি যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।
১৯৩৪ সালে এইচএমভির সংগীতের ট্রেলার হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। প্রথম দিকে সুরকার হিসেবে এবং পরে গায়ক হিসেবেও কাজ করেছেন। এসময় নজরুল কর্মব্যস্ততার কারণে সময় পেতেন না, তখন তাঁর অনেক গানে কমল দাশগুপ্ত সুর করেছেন। করে ফেলেছেন এক মাসে ৫৩ টি গান সুর করার রেকর্ডও। প্রায় প্রতি মাসে গড়ে ৫০ টা গান রেকর্ড করা হতো, আর সেটা হতো কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে। রেকর্ড সংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে সিলভার জুবিলী অনুষ্ঠানে ওঁকে সম্মানিত করা হয়। বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথম উর্দু ভাষায় কাওয়ালী গেয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। হায়দ্রাবাদের নিজাম ওঁকে মসনদের গোল্ডেন জুবিলীতে সঙ্গীত তৈরির দায়িত্ব দেন। ভারতীয় বাহিনীর মার্চিং সং ‘’কদম কদম বড়ায়ে যা’’-র সুরস্রষ্ঠা উনিই।
১৯৩০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত আধুনিক বাংলা গান, উর্দু, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় সুর রচনায় চূড়ান্ত শীর্ষস্থান লাভ করেন। এইচএমভির অর্কেস্ট্রা পরিচালক নিউম্যানের কাছে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিখেছিলেন আর পাঁচশোর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন ব্রজেন গাঙ্গুলী ও অনাদি দস্তিদারের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ চিত্রপরিচালক এলিস জনসন তাঁর ‘ওয়ার প্রপাগাণ্ডা’ চলচ্চিত্রের আবহ সঙ্গীত তৈরি করিয়েছিলেন অন্য কেউ নয়, উপমহাদেশের সুরসম্রাট কমল দাশগুপ্তকে দিয়েই।
১৯৩৬ সালে ‘পন্ডিতমশাই’ সিনেমা দিয়ে কমল দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন। এ ছবির গীতিকার ছিলেন শৈলেন রায়, প্রণব রায়। ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত অসংখ্য ছবিতে সুরসৃষ্টি করেছেন। তা যেমন -বিবাহোৎসব, দেবযানী প্রভৃতি বাংলা সিনেমায়, তেমনি বোম্বাইতেও জওয়াব (প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি), হসপিটাল, রাণী, মেঘদূত, কৃষ্ণলীলা এরকম বলিউডের বিভিন্ন ঘরানার ছবিতে সুরকার কমল দাশগুপ্ত ওঁর সুরসংযোজনার অনবদ্য নজির গড়েছেন।
আশিখানা বাংলা, পনেরোটি হিন্দি, আটটি তামিল ছবিতে সুরসৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগু ভাষাতেও কাজ করেছেন। কোন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ালে কোন গান হিট হবে, অর্থাৎ কোন শিল্পীর গলায় কোন গান শুনতে ভালো লাগবে, আবার গানের বাণীর মর্ম বুঝে আবহ সঙ্গীতে ইন্টারল্যুড, প্রিলিউডের ব্যবহারে এই মানুষটি যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রেখে গেছেন।
মানুষ হিসেবেও কমল দাশগুপ্ত ছিলেন সৌখিন, উদারমনা। ১৯৫০ সালে কলকাতায় দুর্লভ বুইক গাড়ি কিনেছিলেন। ইনি মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। ১৯৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ হলে নিজের খরচে লঙ্গরখানা খোলেন। এখানে প্রত্যহ একশো জন নিপীড়িত মানুষকে প্রায় একমাস ধরে খাইয়েছিলেন। ওঁর মাতৃভক্তি ছিল দেখবার মতো। বাবা ও বড়দা চলে যাওয়ার পর সংসারের সব দেখভাল করতেন তিনিই। আবার ক্রিকেট খেলাতেও বেশ অনুরাগ ছিল।
আবার গানের কথায় আসি। সারা জীবনে মোট ৮৫০০ গানে সুর দিয়েছেন।স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতি এবং আকারমাত্রিক ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতিতে স্বরলিপি স্থাপনেও সিদ্ধহস্ত কমল দাশগুপ্ত রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান হিসাবেও দায়িত্বে ছিলেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে তাঁর শেষ কাজ করা চলচ্চিত্র ‘বধূবরণ’।
কাজী নজরুল ইসলাম, প্রণব রায়, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, বাণীকুমার, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রভৃতি গীতিকারের পাশাপাশি যূথিকা রায়, ফিরোজা বেগম, কানন দেবী, জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্য চৌধুরী, মান্না দে প্রভৃতি একগুচ্ছ গায়ক-গায়িকাদের জন্য সুর সংযোজনা করা নেহাৎ কম ব্যাপার নয়। এমন কোনো শিল্পী নেই যে তাঁর সুরে শুনে কথা লেখেননি বা গান করেননি। তিনি চাইলে একজন নামকরা গীতিকার, বা বড়ো মাপের কণ্ঠশিল্পী হতেই পারতেন, কিন্তু নিজে উপলব্ধি করেছিলেন যে সুর তৈরিতেই তাঁর অপরিসীম দক্ষতা। সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে, আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, দুটি পাখি দুটি তীরে, এমনই বরষা ছিল সেদিন, সেদিন নিশিতে বরিষন শেষে, ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, আমি বনফুল গো, কতদিন দেখিনি তোমায়, ভালোবাসা মোরে ভিখারি, এই কি গো শেষ দান, পৃথিবী আমারে চায়- কমল দাশগুপ্তেরই কালজয়ী সৃষ্টি। আবার, আমি যার নুপুরের ছন্দ, ওরে নীল যমুনার জল, আমার ভুবন কান পেতে নয় -এসব নজরুল সংগীতেরও সুরকার কিন্তু তিনিই।
একসময় তাঁর পারিশ্রমিক ছিল গগনচুম্বী। খুব কম সময়ে বিশাল নাম করে ফেলেছিলেন। ১৯৪৬ সালের ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন। গাড়ি ছাড়া চলতেন না। তারপর অবস্থা পড়তে থাকে। যূথিকার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেননি (অল্প বয়সে বালবিধবা হয়েছিলেন বলেই হয়তো পঞ্চদশী যূথিকা রায় আজীবন ব্রহ্মচারিণী থাকার সংকল্প করেছিলেন, তাই কমল দাশগুপ্তের বিবাহপ্রস্তাব একবাক্যে না করে দিয়েছিলেন। আজীবন ব্রহ্মচারিণী থাকলেও কমল দাশগুপ্তকে চিরকাল শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছিলেন। শেষ বয়সেও যূথিকা রায়ের স্মৃতিতে কমল দাশগুপ্ত ও তাঁর গান ছিল ওঁর অন্তরের সম্পদ।) এইসময় মা এবং ভাই সুবল দাশগুপ্ত গত হন। সিনেমা প্রযোজনায় হাত দিলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যে ব্যাঙ্কে তিনি সারা জীবনের আয় সঞ্চিত রেখেছিলেন সেই নাথ ব্যাঙ্কে (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ বইয়ে বলেছেন পাওনিয়ার ব্যাঙ্ক) লাল বাতি জ্বলে, ফলে দেওলিয়া হয়ে যাওয়ায় পারিবারিক সঙ্কট দেখা দেয়। জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যেটুকু টাকাও বা জমা ছিল বাড়ির বিশ্বস্ত পরিচালক তা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। গানের জায়গাতেও তখন কমল দাশগুপ্তর আগের সেই পজিশন নেই। জায়গাগুলো নিয়েছেন সব নতুন শিল্পীরা। এই অবস্থায় যখন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তখন ছাত্রী এবং কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে সঙ্গীতকে কেন্দ্র করেই প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ওঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সালটা ১৯৫৫। দুজনের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছর। ফিরোজাও তখন কলকাতায় বড়দুলাভাইয়ের অপব্যবহার এবং বড়দির দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন। চারবছর পর কমল দাশগুপ্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম নেন কামালউদ্দীন আহমেদ। এই দম্পতির তিনটি ছেলের নাম- তাহসিন, হামীন, শাফিন। ওঁদের দুজন এখনকার প্রজন্মের নামকরা সঙ্গীতশিল্পী।
১৯৬৭ সালে ঢাকা চলে আসেন। তখন এমন একটা দুরবস্থা যে বাংলায় নিকট বন্ধু,আত্মীয় সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কাজের অবস্থা একদমই ভালো নয়, অনেক আশা করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন, কিন্তু ঢাকাতে এসেও তেমন সমাদর পাননি। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটও হয়তো এসবের পিছনে কারণ ছিল। কাজ না থাকায় অবসাদ গ্রাস করে। উনি মরফিনের নেশা ধরেন। অসম্ভব পেটে যন্ত্রণা হতো, ডাক্তারের পরামর্শ মতো নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হতো। আর্থিক এবং মানসিকভাবে তখন আরওই বিপর্যস্ত। রোজগারের জন্যে ‘পথিকার’ বলে একটা মুদির দোকান চালাতেন ঢাকার হাতিরপুলে। অনেকেই জানতো না, দোকানে যিনি জিনিস বিক্রি করেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কমল দাশগুপ্ত। হঠাৎ একজন সাংবাদিক চিনতে পেরে ওঁর সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে উনি ক্ষোভবশত তা দিতে একরকম অস্বীকার করেন।
সেই সংবাদপত্রে ‘তিনি সাক্ষাৎকার দিতে চাননি’ নামক এই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক লিখেছিলেন, ‘কমল দাশগুপ্ত বললেন, আমাকে খেয়ে বাঁচতে হবে, সংসার চালাতে হবে।’ এইভাবে পত্রিকার প্রতিবেদনে ওঁর দুরবস্থার কথা প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী শহিদুল ইসলামের প্রচেষ্টায় বেতারে ট্রান্সক্রিপশন বিভাগের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁকে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। বেতারের নিজস্ব স্টুডিও ও বাদ্যযন্ত্রী তৈরি, কাওয়ালি গান রেকর্ড, ‘’কেন এমন হয়” চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করা, বাংলা একাডেমি থেকে স্ত্রী ফিরোজা বেগমের নাম দিয়ে লেখা ‘নজরুল গীতিমালা’ প্রকাশ সবই ওঁর কৃতিত্ব। ‘নজরুল গীতিমালা’-য় কমল দাশগুপ্ত প্রবর্তিত শর্টহ্যান্ড স্বরলিপির সাংকেতিক চিহ্ন ও কৌশল দেখা যায়। এই সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে জাতীয় পুরস্কার দেয়। কিন্তু আগের মতো ফর্মে আর ফিরে আসতে পারেননি, মরফিনের নেশা আর শারীরিক কারণে চাকরি ছেড়ে দেন। এবং আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
শেষ দশ বছর বাংলাদেশের ঢাকায় ছিলেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তাঁর ছাত্রী ও সহধর্মিনী ফিরোজা বেগম ছিলেন মুখ্যশিল্পী। উভয়ের দ্বৈতসঙ্গীত পরিবেশনা শ্রোতা-দর্শকদের খুবই আনন্দ দিয়েছিল।
মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে ঢাকার পোস্ট গেজেটেড মেডিকেল হসপিটালে দেওয়া হলে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বা কেবিনে ওঁর অনুরাগীরা ভর্তি করার জন্য অনুরোধ করলে কর্তব্যরত লোকজন জিজ্ঞেস করে, যে তিনি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার কিনা। সবাই বলেছিল, তিনি মিউজিকের একজন মাস্টারপিস। এরপর ডাক্তারাও বারবার জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত, তখন এত প্রশ্নের, এত অনুসন্ধানের, উত্তরটুকু দেওয়ার আগেই সুরের যাদুকর সব উত্তরের বাইরে চলে গেছেন। দিনটা ১৯৭৪ সাল ২০ জুলাই। একটা বেডও জোটেনি।
যিনি এত বাণিজ্যিক বাংলা হিট গান উপহার দিয়েছেন, অন্তিম জীবনে তিনি ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও পাননি। রাজার মতো এসেছিলেন , অগণিত সঙ্গীত-অনুরাগীদের মন জয় করেছিলেন, কিন্তু কপদর্কহীন অবস্থায় মারা যান মাত্র একষট্টি বছরের বয়সে।
এই বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞকে নিয়ে লিখতে বসে আমার নিজেরই মনে হচ্ছে, কী বিচিত্র এই মানুষের জীবন! কোথায়, কিভাবে শুরু, সংগ্রাম, এগিয়ে যাওয়া, প্রতিষ্ঠালাভ- এসব কোনো কিছুই যেমন ঠিক থাকে না, তেমনি নিয়তির অমোঘ নির্দেশ যে কার ওপর কিভাবে বর্তায়, তা মানুষের আগেভাগে বুঝতে পারাটাই কঠিন। সবাই আমরা এই জায়গাতে কার্যত অসহায়। এত বছর পরেও কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত গান এখনকার শিল্পীরাও খুব দরদ দিয়ে গেয়ে থাকেন, এইসব গানের বাজার এখনো ঊর্ধ্বগামী। কুমার শানু, শ্রীকান্ত আচার্য, ডঃ অনুপ ঘোষাল প্রভৃতি শিল্পীদের কণ্ঠে পুজোর সময় তাঁর সুরারোপিত গান এই ডিজে, রোবটিক্সের যুগেও দুই বাংলাতেই আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু গানগুলোর স্রষ্ঠা সেই চির অবহেলিতই হয়ে গেলেন। এখনকার প্রজন্ম কমল দাশগুপ্তের নামও জানে না, যদিও বা জানে তাঁর বিপুল সৃষ্টিসম্ভার সম্বন্ধে আদৌ অবহিত কিনা সন্দেহ। বাঙালি হয়ে এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখব?
তারিখঃ এপ্রিল ২৩, ২০২৪