অভিমান শ্রাবণ
সহেলী সেনগুপ্ত
তোমার মনে আছে?
কেমন বিষণ্ণতার জল নামত দিম্মার উঠোনবাড়ির ছেঁড়াফাটা চাল দিয়ে? পুরোনো ব্যথার মতন নুয়ে পড়া চাল। ওকে না সইতে পারলেও বদলে ফেলা যেত না তাই। ঝমঝম বৃষ্টিতে মেঘের মতোই গজরাতে গজরাতে দিম্মা যখন জলছাঁট থেকে সরে বসে উনুনে খানিক চাল-ডাল চাপিয়ে খিচুড়ি রাঁধত, সামান্য উপকরণে অপূর্ব স্বাদের খিচুড়ি, আমি ঐ উঠোনবাড়ির খোলা উঠোনে ঝুপ্পুস ভিজতাম। সামনের বাড়িতে জোয়ান মরদ, দিম্মার ভাষায়, তাই দিম্মা চোখের আড়াল না হলে ভেজা বারণ ছিল। চাল থেকে অবিশ্রাম জল নামত, দশদিক ধুইয়ে দিত শাওন-ভাদঁ। আমিও কেমন নদী হয়ে বইতাম ছোট্ট উঠোনময়। আর বছর বর্ষায় খিড়কিপাঁচিল ভেঙে পড়ল, দিম্মা সারাতে পারেনি সেও। সেলাই করে কতটুকু হয়? আমি এর মাঝে নদী হয়ে বইলে সব ভেসে যাবে না? তাও বইতাম। না তাকিয়েই আমি তো জানতাম, সামনের বাড়ির জানলার খড়খড়ির আড়াল দিয়ে চেয়ে আছে দুটো মায়াবী চোখ। আমায় ভিজতে দেখছে। সামনের পানের দোকানের বিশুদার একটা পুরোনো আমলের টেপরেকর্ডার ছিল। লোকের ফেলে দেওয়া, রিল জড়িয়ে যাওয়া ক্যাসেটকে কী আশ্চর্য উপায়ে সারিয়েসুরিয়ে বিশুদা বাজাত হিন্দি গান। অনেক গান ছিল তার, অনেক। পছন্দের গান শোনাও যেত তার কাছে। এক টাকা করে এক একটা গান। দু’বার শুনতে চাইলে দু’টাকা; কিন্তু যদি অন্তত দুটো গান শোনো দু’বার করে, তবে সাড়ে তিন টাকা। পঞ্চাশ পয়সা ছাড়। ভরা বর্ষায় যদি দোকান খোলা থাকত, দিম্মার “মুখপুড়ি! তোর পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙব!” হাঁক অগ্রাহ্য করে আমি ছুটতাম বিশুদার কাছে। ক্যাসেট ঘেঁটে, ধুলো ঝেড়ে, বাদলা আলোতে চোখ কুঁচকে রিলের অবস্থা বুঝে, অনন্ত অপেক্ষার পরে বিশুদা চালিয়ে দিত ‘পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান।’
সঘন সাওয়ন লায়ি কদম বাহার।
এখনো এ গান শুনলে বর্ষার জল থইথই আমার বড্ড আটপৌরে দিম্মাবাড়ি ভেসে যায় সামনে। তুমি এসে হঠাৎ দাঁড়াও সামনে, আজও। ভিজে যাই আমি, ভিজে যাই এখনো। লজ্জায় ভিজে সপসপে হয়ে যাই একেবারে। তোমার মায়াবী চোখ, তোমার তুলিটান পাতলা ঠোঁট, তোমার দুর্নিবার হাসি, সব নিয়ে এসে দাঁড়াও সামনে। বর্ষা বান ডেকে যায় আমার শিরায় শিরায়। আমার ছোট্ট ঘর হয়ে যায় বাদলা আকাশ। আমার লাল মেঝে হয়ে যায় বাদলহাওয়ায় দুলতে থাকা সবুজ মাঠ। সে বছর, তোমার পাকা বাড়ির ছাতের ঘরে তুমি সে আটপৌরে মেয়েকে বাদামগন্ধী আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলে। খোলা মাঠে আজানুলম্বিত চুমুতে ভরে দিয়েছিলে সারা গা। বর্ষা নেমেছিল আকাশ ভরে। বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছিল ঝম্পক তালের মতন। ভয়ে তোমার হাত শক্ত করে ধরে ছিলাম আমি – আর তুমি কী যে খুঁজছিলে আমার মধ্যে আবিল হয়ে? কী আবিষ্কার করতে চাইছিলে – কী ছিল সে সাধারণ মেয়ের মধ্যে? সে তো ভরা বর্ষার নদী বই কিচ্ছুটি হতে পারেনি আজ অবধি। তোমার স্পর্শজল গায়ে মেখে সে মেয়ে বেঁচে থাকে এক জীবন।
নহী আয়ে, নহী আয়ে, কেসরিয়া বাল্মা হামার।
আজও কি দিম্মাবাড়ি আছে তেমন? তোমাদের বাড়িটা আছে, ভরা বর্ষায় দ্বীপের মতন জেগে থাকা আদরবাড়িটা? যেখানে মেঘভাঙা বৃষ্টি নেমেছিল আমার শরীরে? উঠোনটা এখনো ঝমঝম ভেজে, আগের মতন? খিড়কিপাঁচিলও সারানো হয়নি আর। পোড়োবাড়ি কেই বা সারায়? প্রাচীন ব্যথার মতন উপশমহীন আলগোছ বাড়ি – কেই বা তাতে ফিরে আসে, ভরা বর্ষায়?
অঙ্গনা বড়া সুনসান।
পিয়া তোরা…….
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১