আমার স্ত্রীর গোপন প্রেমিক
অনির্বাণ সরকার
•
আমার স্ত্রী প্রেমে পড়েছে। এটা আমি বুঝতে পারি। শারমিনকে, মানে আমার স্ত্রীকে এটা আমি বুঝতে দিইনি। মানে- আমি যে বুঝেছি, জানতে পেরেছি তার প্রেমের কথা- এটা। শারমিন যদি বুঝে ফেলে আমার কাছে আর গোপন নেই তার প্রেম, তাহলে সে ঘাবড়ে যাবে। তাকে ঘাবড়ে দিতে চাইনা আমি, কারণ তার হৃদযন্ত্র দুর্বল। ধরা পড়ার ভয়ে, লজ্জায় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, মৃত্যুও বিচিত্র নয়। খুব টেনশন করে সে সবকিছু নিয়ে, এটাও তার একটা রোগ, এই অপ্রয়োজনীয়, বাজে টেনশন।
কিন্তু আমি বুঝতে পারি না- একজন দুর্বল হৃদযন্ত্রের রোগী, যে কিনা জীবনের ছোটোখাটো প্রায় সবকিছু নিয়েই টেনশন করে, সে প্রেমে পড়লো কীভাবে। এ এক বিরাট রহস্য আমার কাছে।
শারমিনের টেনশনের একটা নমুনা দেয়া যাক। বাবলু, মানে আমাদের একমাত্র ছেলে, যার বয়স এখন ছয়, সে একবার হারিয়ে গিয়েছিলো। না না, তেমন কিছু নয়, স্কুলের ছুটির পর শারমিন তাকে আনতে গেছে, আমি তখন অফিসের কাজে বগুড়া, আমার জরুরি মিটিং চলছে, দুপুর প্রায় বারোটার সময় আমার মোবাইলে শারমিনের ফোন।
ফোন ধরতেই শারমিনের আর্তচিৎকার-
– বাবলুকে পাওয়া যাচ্ছে না।
– পাওয়া যাচ্ছে না মানে?
– সত্যি নেই, আমি সারা স্কুল খুঁজেছি। কী হবে এখন? কেউ নিয়ে গেলো বাবলুকে?
– কে নিয়ে যাবে? ভালো করে দেখ। দারোয়ান কী বলছে?
– আরে দারোয়ান বলছে সে দেখেনি। আর ছেলেটা এমন বোকা, অচেনা কেউ চকলেটের লোভ দেখালেই তো তার সাথে বেরিয়ে যাবে।
– স্কুলের অফিসে বলেছো?
– অফিসে বলে কী হবে? ওরা কি কোনো কিছু দেখে? প্রিন্সিপালকে বলেছিলাম, উনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করলেন যে দোষ আমারই। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো, একটা ব্যবস্থা কর। আমি কিচ্ছু জানি না।
এই শারমিনের আরেকটা বৈশিষ্ট্য। ছোটো ঝামেলা থেকে বড় বিপদ যাই হোক, এর সামনে পড়লে ‘আমি কিচ্ছু জানি না’ বা ‘আমি কিচ্ছু করতে পারবো না’ বলে তার মস্তিষ্কের কার্যক্রম সে বন্ধ করে দেয়। তখন আমাকেই যা করার করতে হয়। এই যে আমাকে সে বলছে ‘তাড়াতাড়ি চলে এসো’, তার মানে তার মস্তিষ্ক বলছে আমি তার কাছাকাছিই আছি; অথচ আমি তখন বগুড়া, আমার মিটিং চলছে। শারমিনের সে সব খেয়াল নেই, কখনও থাকেও না।
বগুড়ার একটা হোটেলের কনফারেন্স রুমে মিটিং চলছিলো আমার, মিটিং-এর মাঝেই ফোন পেয়ে লবিতে চলে এসেছিলাম, আমার সেক্রেটারি শাহানা (এর কথা পরে বিস্তারিত বলছি, এই শাহানা আরেক অদ্ভুত) দেখি উদ্বিগ্ন মুখে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আমাকে আবার মিটিং-এ যেতে হবে।
শারমিন ফোন কেটে দিয়েছিলো। আমি শাহানাকে ইশারা করে জানালাম- আসছি। সে যাওয়ার পর হোটেলের বাইরে চলে এলাম, তারপর সিগারেট ধরালাম। এবার কী? তখন মনে পড়লো রমনা থানার ওসির সাথে কোনো এক কাজের সূত্রে পরিচয় হয়েছিলো। বাবলুর স্কুল ঐ থানার আন্ডারে পড়ে না? মোবাইলে ওসির নম্বর সেভ করা আছে? চিনতে পারবে আমাকে?
ফোন করলাম। ওসি সাহেব চিনতে পারলেন, বোধহয় থানা থেকে দুজন কনস্টেবলও পাঠালেন স্কুলে। তারপর সে এক বিরাট হইচই। পরে শুনেছি- বাবলু স্কুলের পেছনে একটা মুদি দোকানে গিয়েছিলো চকলেট কিনতে, কবে তাকে পাঁচটা টাকা দিয়েছিলাম, তাই নিয়ে। স্কুলে কেন পুলিশ এলো- এ নিয়ে প্রিন্সিপালের রাগারাগি, বাবলুর মায়ের প্রচুর চোখের জল, বাবলুর গালে চড়- এইসব ঘটনা ঘটছিলো যখন, আমি তখন আবারও মিটিং-এ। ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম, মিনিটে মিনিটে এসব ঘটনা জানাতে পারেনি বলে শারমিন কখনও ক্ষমা করেনি আমাকে।
•
হ্যাঁ, গল্পটা আমার স্ত্রীকে নিয়ে। তার প্রেমিককে নিয়ে। শারমিন, আমার স্ত্রী, বছর সাতাশের যুবতী, এক বাচ্চার মা, টেনশনপ্রিয় নারী- প্রেমে পড়েছে। লোকটা আমার বন্ধুর শালা। বিচিত্র সম্পর্ক। এরকম হওয়ার কথা নয়। তার আগে বলি শাহানাকে নিয়ে। দেখুন, এটা কাকতালীয় নয় কি যে- শাহানা, শারমিন- দুটো নামই ‘শ’ দিয়ে, পাকেচক্রে আমার নাম শওকত এবং কাহিনীতে একটা শ্যালকও ঢুকে পড়েছে। তা এটাকে ‘শ’-এর চতুর্ভুজ গল্প বলা যেতেই পারে। আমি এরকম কোইনসিডেন্সের ভক্ত, কিন্তু কী থেকে কী কথায় এসে পড়েছি, এরকম ঘটবে, আমার কিছু করার নেই, আপনাদের বিরক্ত লাগলে ক্ষমাঘেন্না করে এখানেই পড়া থামিয়ে দিতে পারেন।
বগুড়ায় মিটিং ছিলো দুদিনের, আমি একটা প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাখার জিএম, অনেক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে এই আমি, জনাব শওকত হোসেন, যে কিনা মুখে রক্ত তুলে খাটছি, ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি, দুটো গাড়ি মেইনটেইন করছি, স্ত্রীর সাধ পূরণে জানামতে কোনো খামতি রাখছি না, যদি এইসব বিজনেস ট্যুরে, দেশে এবং দেশের বাইরে, কাজের ফাঁকে যদি কোনো ক্লাবে যাই, দুগেলাস খেয়ে ফেলি, তাতে কী এসে যায়? এসব করেছি, নিয়মিত নয়, এ বয়সে হুল্লোড় ভালো লাগে না। চল্লিশ হতে চললো, আর কত? শুধু একটু অঙ্কে শয়ন করার ব্যাপার, শাহানা আছে, তাতেই চলে যায়। এটাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি না, এরকম হতে পারেই। আরে বাবা আমি কি আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি, শারমিনকে বলছি ডিভোর্স দাও? শারমিনকে তো বলাই যাবে না, তার হার্ট থেমে যেতে পারে। সে আমার বাচ্চার মা, তাকে এইজন্য বাঁচিয়ে রাখা কর্তব্য। শারমিনকে ভালোবাসি না? না, এটাও ঠিক নয়। শাহানা সংক্রান্ত জটিলতা অফিসের কয়েকজন জানে বলে অনুমান করেছি, কিন্তু আমি এবং আমার পিএস শাহানা দুজনই জানি এতে কোনো জটিলতা নেই। আমরা পরস্পরের জন্য কাতর নই, মোবাইলে কাজের কথা ছাড়া কথা বলি না, কোনো মেসেজ আদানপ্রদান হয় না। এদিক দিয়ে আমি পরিষ্কার। মাঝে মাঝে কাজের চাপ বেশি পড়লে শরীর-মন দুই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আমি অফিসে বলে ট্যুর প্ল্যান বানিয়ে নিই, শাহানাকে শুধু বলি এরকম- ‘আগামী সপ্তাহে চিটাগং-এ মিটিং রেখেছি’, শাহানা বুঝে যায় কী করতে হবে, সে চমৎকার তৈরি হয়ে যায়, মিটিং-এর ফাইলপত্র গোছগাছ করে ফেলে নিখুঁতভাবে, নিজেকেও তৈরি করে নেয় আমার জন্য। শাহানার একটা ভালো দিক- সে অবিবাহিতা, হয়তো তার এক্সট্রা রোজগার পরিবারের কাজেই লাগায়, আমি জানতে চাইনি, সেও জানায়নি। শাহানার সাথে কোনো কোমল বাক্য বিনিময় হয় না আমার, কথা দেয়া টেয়ার প্রশ্নই নেই, কিন্তু যেরকম হয়- এধরনের সম্পর্কে না চাইলেও কিছু দুর্বল মূহুর্ত সৃষ্টি হয়ে যায়। হয়তো হোটেলের ঠাণ্ডা ঘরে ডিমলাইটের মৃদু আলোয় শাহানা আমার খোলা বুকে মাথা দিয়ে পড়ে আছে, সেরকম মূহুর্ত। শাহানা মেয়েটা অন্তত একটা বিষয়ে অদ্ভুত, এরকম সময়গুলিতেই সে জানতে চায় আমার স্ত্রীর কথা, কেন তা জানি না। নিজেকে শারমিনের সাথে তুলনা করতে চায়? জানতে চায় বাড়িতে সুন্দরী স্ত্রী থাকার পরও কেন তার কাছে আসি? কিছু কিছু কথা বলেওছি তাকে হয়তোবা। শারমিনের প্রেমে পড়ার খবর বলেছি? তার হৃদয়দৌর্বল্যের কথা? বোধ হয় না। বলিনি- ধরে নিচ্ছি।
•
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম- আমার পিএস শাহানার সাথে একটা শারীরিক চুক্তিতে আছি আমি, যেটা শারমিন, আমার স্ত্রী জানে না; আর শারমিন যে প্রেমে পড়েছে, সেটা আমি জানি বলে শারমিন জানে না, শাহানাও না।
শুরুটা এমন। এক ছুটির দিনে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু আলম তার শ্যালককে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। শ্যালক হায়দার দীর্ঘকাল প্রবাসী, কি কাজ করে ঠিক নেই, নানান দেশ ঘুরে এখন ফিনল্যান্ডে। ছুটির সন্ধ্যায় আড্ডা জমে ওঠে আমাদের, আলম আর হায়দার শারমিনের হাতের চায়ের প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে, শারমিনকে সুখী দেখায়, তার গর্বে গর্বিত আমিও। হায়দার, শ্যালকটি, এই আড্ডার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সে এক লম্বাচওড়া পুরুষ, বয়স পঁয়ত্রিশের আশেপাশে, অবিবাহিত এবং প্রবাসী বলেই বোধহয় ভেতো বাঙালীর ছাপ পড়েনি চেহারায়, চওড়া কাঁধ আর চকচকে মুখ। বেশি কথা কী, পুরুষদেরও মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে হায়দার লোকটির- এমনই তার আকর্ষণ। তাই এটা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম যে- আলম আর হায়দার চলে যাওয়ার পর শারমিন নানান প্রশ্ন করবে আমাকে এই হায়দার বিষয়ে, এবং তা করেও। বেশি কিছু জানতাম না বলে কথা এগোয়নি আর।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে বিকেলের মুখে বারান্দায় চা নিয়ে বসেছি, শারমিন আমার পাশে, বাবলু নিচে ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে খেলতে গেছে। এসময় শারমিন আবার প্রশ্ন করে হায়দারকে নিয়ে, কেন সে বিয়ে করেনি, কোথায় পড়ালেখা করেছে- ইত্যাদি। আমি কিছুটা অবাক হই, শারমিনের নাকের ডগায় ঘাম দেখি, উজ্জ্বল মুখ দেখি, এবং বিরক্ত হই। কয়েকদিন আগে আমার জন্মদিন ছিলো, শারমিন উপহার দিয়েছিলো একটা কবিতার বই, আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পড়ছিলাম-
একা আছি, শূন্যতায় আছি
বুকে ওড়ে বিতৃষ্ণার মাছি
মনের সংলাপ থেকে যা কিছু বাসনায় বাছি
জলে টলোমলো
কখন আসছো তুমি বলো?
বিকেলের এই সময়টাতে আলো নরম হয়ে আসে, সাত তলার বারান্দা থেকে আকাশটাকে অলৌকিক দেখায়, আমি চোখ তুলে চাই শারমিনের দিকে, সে আমার বিরক্তি বুঝে চুপ করে যায়। এটা ছিল শারমিনের প্রেমে পড়ার শুরু।
•
হায়দারের আসার কথা ছিল না আমার আর শারমিনের জীবনে, আমার নিজের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে শাহানা নামের একটা মেয়ে আছে, সেটা এমন কিছু নয়। আমি সবদিক মানিয়ে চলছিলাম। বাড়ি, অফিস, ট্যুর- সব ঠিকঠাক। বোধহয় দশ বারো দিন পর, শারমিন আমাকে জানায় সে বসুন্ধরায় শপিং-এ গিয়েছিলো, সেখানে হায়দারের সাথে দেখা। হায়দারের আমন্ত্রণে কফি খেয়ে এসেছে। আমি জানতে চাই- সে কি এখনও দেশে? শারমিন বলে- হায়দার তাকে বলেছে সে আর ফিরে যাবে না, এখানেই ব্যবসা ট্যাবসা করবে এবং বিয়ে করবে। শারমিন কি পারবে একটা মেয়ে খুঁজে দিতে?
এবার আমার সত্যিই অবাক হবার পালা এবং এই বিস্ময়বোধে খাদ নেই। দ্বিতীয় দিনের দেখায় ভগ্নীপতির বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে বলে কে? হায়দারের আচরণ, কথাবার্তায় তাকে গড়পড়তা বাঙালী পুরুষ বলে মনে হয়নি ঠিকই, কিন্তু এটা একটু বাড়াবাড়ি নয়? মনের ভাব চেপে আমি জিজ্ঞাসা করি,
– তুমি কী বললে?
– আমি আর কী বলবো? বলেছি কেমন মেয়ে চাই?
– তারপর?
– জানো হায়দার ভাই (আমি, মনে মনে- এটা ভাই হলো কবে থেকে!) এমন মজার মানুষ, বলে কী না- ভাবী, আপনার মতো হলেই চলবে।
– তারপর?
– আমি খুব রাগ করেছি। এমন করে কেউ বলে? বললাম- আপনি অতদিন দেশের বাইরে ছিলেন, বাঙালী মেয়ে পছন্দ হবে? অনেক দেশের মেয়ের সাথে নিশ্চয়ই চেনা আপনার। তা বলে কী – বাঙালী মেয়ে বিয়ে করবো বলেই তো এদেশে থেকে যাচ্ছি।
সেদিন শারমিনের সাথে এ নিয়ে কথাবার্তা এ পর্যন্তই। বুঝতে পারছিলাম- শারমিন আসলে ‘খুব রাগ করেছি’ কথাটাকে মেঘ বানিয়ে তার আড়ালে খুশি লুকোচ্ছে। আর কে না জানে- বিবাহিত দম্পতির দুজনই দাম্পত্যের একটা সময় পার হলে অন্য পুরুষ বা রমণীর মুখে প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। এটাতে হালকা প্রেম প্রেম ভাব মিশে থাকতে পারে, তবে তাতে দোষ নেই। কিন্তু আমাকে খুঁজে বার করতে হবে- শারমিন কি প্রেমে পড়েছে? হায়দারের? অন্যদিকে হায়দার এই শারমিনের? নাকি তার দিক থেকে শুধুই ফ্লার্ট?
আমি কি বাড়াবাড়ি করছি? বোধহয় না। নিস্তরঙ্গ জীবনে এসব ঝামেলা ভালো লাগে না আমার। আমার জীবন পরিশ্রমের, তাতে আপত্তি নেই, সে পরিশ্রমের ফলে শারমিন আর বাবলু নিশ্চিত জীবন পেয়েছে, আমি নিজেকে এজন্য মাঝে মাঝে রিওয়ার্ড দিই- এজন্য শাহানা আছে- ব্যস এইটুকু।
•
পরদিনই আলমের অফিসে যাই আমি। আমার অফিস ধানমন্ডিতে, তার উত্তরায়। এগারোটার পর জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পৌঁছুতে প্রায় দেড়টা বেজে গেলো, আলম তখন লাঞ্চে। ফোন করেই গিয়েছিলাম, আলম তার কামরায় এসে আমার দিকে তাকায়, চোখে প্রশ্ন। আমি আলমের টেবিলের ওপর থেকে সিগারেট নেই, ধরাই এবং বিনা ভূমিকায় বলি-
– তোর শালা হায়দার কেমন আছে?
আলমের ভুরু দুটো কপালে উঠে যায়।
– এটা জানতে এসেছিস?
– হ্যাঁ, কেমন আছে?
– ভালোই আছে।
– তোর বাসায়ই থাকছে?
– হ্যাঁ। ব্যাপারটা কী?
– হায়দার কি বিয়ে করবে? আমার বৌয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো কাল, বললো তখন।
– বিয়ে? হায়দার বলেছে? আমাকে তো বলেছে- বিয়ে টিয়ে আরও দুবছরের আগে করবে না। কেন জানতে চাইছিস?
– বিয়ে করবে না এখন? তাহলে শারমিনকে বললো কেন? আবার মেয়ে খুঁজে দিতে বলেছে।
– বলিস কী! আমি আর তার আপা কয়েকদিন ধরে তাকে বিয়ের কথা বলছি, সে তো পাত্তাই দিচ্ছে না। শারমিন ভাবীকে হায়দার বলেছে বিয়ে করবে? তুই কি সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিস?
– না।
আলমের সাথে কথা বলে আমার সন্দেহ গাঢ় হয়। ব্যাপারটা একতরফা নয় দেখছি। বাড়িতে বোন-দুলাভাইকে বলেছে বিয়ে করবে না, অন্তত দুবছরের আগে নয়, এদিকে শারমিনকে বলছে বিয়ে করবে এখনই। আবার শারমিনের মতো মেয়ে চাই। আলমকে আর কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ি কাজের কথা বলে, আলমকে বিভ্রান্তির মাঝে রেখেই।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হয় আমার, কারণ অফিসে ফিরে গিয়েছিলাম, অনেকগুলি কাজ বাকি ছিল। বাড়িতে ফিরে দেখি- বাবলুর হাতে নতুন খেলনা, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির চলাফেরা ঘরজুড়ে, বাবলু নিজেই জানায়- নতুন মামা হায়দার মামা দিয়েছে। শারমিন হেসে হেসে আমাকে বলে- বিকেলে হায়দার এসে উপস্থিত, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো, কী মনে করে চলে এসেছে।
এই নিয়ে তিনদিন। মনে মনে বলি। এবার বিনা নিমন্ত্রণে একেবারে বাড়িতে। আর বাচ্চার মায়ের মন জয়ে বাচ্চাকে উপহার দেয়াই প্রশস্ত পথ। এসব জানা আছে আমার।
•
শারমিনের সাথে কি আমার ঝগড়া হয়? না, হায়দার বিষয়ে ঝগড়া করার স্টেজ আসেনি এখনও, কিন্তু অন্য বিষয়ে? শেষবার কবে ঝগড়া হয়েছিলো? মনে করতে পারছি না। আসলে আমি এসব ঝগড়া টগড়া এড়িয়ে চলি, আর শারমিন একবার ঝগড়ার উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তখনই ধরা পড়ে তার হার্টের রোগ। সেই থেকে আমি সাবধান। হালকা ঝগড়া যে হয় না তবুও, তা নয়, কিন্তু কখনও তা মাত্রা ছাড়ায় না। শারমিন একটা স্কুলে পড়াতো, বাবলুর জন্মের পর আমরা দুজনই সিদ্ধান্ত নেই এবং শারমিন চাকরি ছেড়ে দেয়। শারমিনের অদ্ভুত প্রতিভা হচ্ছে মৃদু ঝগড়ার সময়ও সে এটা নিয়ে আমাকে দায়ী করতে থাকে এবং আরও নানান ছোটোখাটো বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দেয়, যা হয়তো আমি ভুলে গেছি কবেই, শারমিন ভোলে না। আমি প্রতিবাদ করি না, কারণ, দরকারটা কী? শারমিনের সুস্থতা আমার বাবলুর জন্য দরকার, পরিবারে ঝামেলাও পছন্দ নয়। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম- একটা বড় ঝগড়া আসন্ন। এই শারমিন ইদানিং যা করছে, সেটা এমন- মাঝে মাঝেই হায়দারের সাথে তার দেখা হয়ে যাচ্ছে পথে, হায়দার আসছে আমার বাড়িতে, আমি উপস্থিত না থাকলেও। হায়দারের সাথে এই দেখা হওয়া কিংবা বাড়িতে তার আসা- শারমিন কিছুই লুকোচ্ছে না আমার কাছে, কেন, তা বুঝতে পারছি না। এক্ষেত্রে লুকোনোটাই স্বাভাবিক। বুঝতে পারছি না বলে রাগ হচ্ছে আমার, শারমিনকে যা চিনি, তাতে তার প্রেমে পড়ার লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ কিন্তু এই টেনশনবিলাসী মেয়েটি তা সামাল দিচ্ছে খুব দক্ষতার সাথে। শারমিনই বরং অবাক করে দিচ্ছে আমাকে আজকাল।
আলমকে এবার বলার সময় এসেছে আমার। আমি একদিন তাকে ডেকে পাঠাই। বলি- হায়দার আমার বাড়িতে আসে, সে জানে কি না। আলম বলে- জানে। এটাও আমাকে অবাক করে। আমি আলমকে জানাই আমার সন্দেহের কথা, বদলে যাওয়া শারমিনের কথা, বলি আমার সাথে কথা অন্য কথা বলার সময় শারমিন যেমন তেমন, কিন্তু হায়দারের প্রসঙ্গে সে উচ্ছ্বসিত, তার চোখমুখ বদলে যায়। আলম আমাকে পাগল ঠাওরায়, হেসে ওঠে বেহায়ার মতো, আমাকে মাথার চিকিৎসা করার উপদেশ দেয়। এতটা আলম করতেই পারে, সে আমার স্কুলের বন্ধু তাই। আমি কিন্তু রেগে যাই, আলমকে চুপ করতে বলি এবং চলে যেতে বলি। আলম হাসিমুখে বিদায় নেয়, যাবার আগে বলে যায়- আগামী সপ্তাহে সে নিজে আমাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। আমি গুম হয়ে বসে থাকি নিজের চেয়ারে।
এখন আমার শাহানাকে দরকার। অফিসের কাজের জন্য নয়। অফিসের কাজের চাপ কী এমন যে আমার বিবেচনা কমে যাচ্ছে? আলমের কথাগুলো ভাবতে থাকি। ভেবে কোনো উপসংহারে যেতে পারি না আমি। ফোন তুলে শাহানাকে বলি- পরশু কক্সবাজার যেতে পারবে কি না।
•
কোম্পানির মূল অফিসে আমার ট্যুর প্ল্যান জানিয়ে গিয়েছিলাম, তাতে কখনও সমস্যা হয়নি, এবারও হলো না। কক্সবাজারে কেন যাচ্ছি, তা অফিসের কেউ কেউ বুঝতে পারে। বুঝুক, চিন্তার কিছু নেই। বৃহস্পতিবারে যাওয়া, শুক্রবার সাইট ভিজিট, নতুন অফিস হচ্ছে একটা, কেমন হবে তা নিয়ে লোকদেখানো ইনস্পেকশন, এবং সমুদ্র। শাহানার সাথে আমার সম্পর্ক এমন নয় যে- তাকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটবো। সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয় আমি একা একাই লাবণী পয়েন্টে ঘুরে বেড়াই, বুক ভরে লবণ-বাতাস নিতে নিতে ভাবতে থাকি- শারমিনের কথা, হায়দারের কথা, আলমের হেসে ওঠার কথা। সাগরের শব্দে আমার কানে তালা লেগে যায়; প্রবল বাতাসে আমার শার্ট এলোমেলো হয়ে যায়, চুল এলোমেলো হয়ে এবং ভাবনাগুলোও এলোমেলো হয়ে যায়। অনেক রাত করে হতাশ হয়ে ফিরে যাই হোটেলে শাহানার কাছে, যেজন্য এসেছি।
•
শনিবার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। আটটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম ঢাকায়, এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে পৌঁছতে পাক্কা দু ঘন্টা। বাবলু শুয়ে পড়েছিলো, আমাকে দেখে শারমিন শীতল। খাবার টেবিলে কথা বলছিলো না। আমি ভাবছিলাম- শারমিন কি একটা ডিসিশন নিয়েছে হায়দারের ব্যাপারে? আজ বলবে না কাল? টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছিলাম, সাড়া পাচ্ছিলাম না। ক্লান্ত হয়ে শুতে গেলাম শেষ সিগারেট পুড়িয়ে, দেখি শারমিন চেয়ারে বসে আছে। হাত দুটো বুকের ওপর জড়ো করা। ধরে নিলাম- আজই বলবে। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম- মাথা ঠাণ্ডা রাখবো, হায়দারকে গালাগাল দেবো না, শারমিনকেও না। আজ শুনবো শুধু, যা বলার কাল।
শারমিন কথা বললো।
– তোমার সেক্রেটারিকে নিয়ে গিয়েছিলে কক্সবাজার?
আমি পাথর। জানলো কীভাবে? কেউ বলেছে অফিসের? এটা সামলাতে হবে।
হাসিমুখে বলি আমি,
– হ্যাঁ, সে তো মাঝে মাঝে যায় আমার সাথে, এবার জরুরি কিছু মিটিং ছিলো, নতুন অফিস হচ্ছে না একটা, বলেছি তোমাকে?
– আমার বান্ধবী লিমা ফ্যামিলি নিয়ে গিয়েছিলো, দেখেছে তোমাদের।
আমি ভেতরে ভেতরে ঘামতে থাকি। এই লিমা কতটুকু দেখেছে? আমার সাথে কথা বলতে আসেনি কেন? আমার বুকে শব্দ হতে থাকে, শুনতে পাই।
– কোথায় দেখলো?
– একই হোটেলে। তোমাদের ফ্লোরেই ছিলো সে, হোটেল সি-প্যারাডাইজ না?
আমি খাটে বসে পড়ি। সেদিনের পত্রিকা, যা আমার পড়ার প্রয়োজন ছিলো না তখন, হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে তুলে নিই। শিরোনাম পড়ছি- ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়’, ‘আগামী ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরায় মানা’, ‘যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ ফ্রান্স’… শারমিন বলে-
– একই রুমে ছিলে তাই না?’
– অ্যাঁ, কোথায়?
– তোমার সেক্রেটারির সাথে হোটেলের একই রুমে ছিলে?
– কী বলছো এসব?
হাত থেকে পত্রিকা ফেলে দিই আমি। রেগে যাবার ভান করি। ‘তোমার মাথা খারাপ হয়েছে?’
– মিথ্যে বলো না। লিমা আজ সকালে ফোন করেছিলো আমাকে, কথায় কথায় বলেছে।
– লিমার কথাই বিশ্বাস হলো?
– আমি হোটেলে ফোন করেছিলাম। তোমাকে চাইছিলাম। তোমরা দুজন তিনশ বারোতে ছিলে না?
আমি জবাব দিই না। জবাব দেবার কিছু ছিলো না আমার। আমার মৌনতার কী অর্থ শারমিন করেছিলো জানি না, তারপর কী কী উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়েছিলো আমাদের, সে সবের বর্ণনা অবান্তর। আমার কথা নয় আসলে, কথা শারমিনের। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত আমি সে রাতেই নিয়েছিলাম- নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম হায়দার সম্পর্কে আমার সন্দেহের কথা কোনোদিন বলবো না তাকে, অথচ এটা কি স্বাভাবিক ছিলো না- ধরা পড়ার পর শারমিনকে হায়দারের কথা বলে আমার আক্রমণ করার? আমি সেটা করিনি। শারমিনকে ভেঙে পড়তে দেখে আমার ভেতর মায়া জন্মেছিলো কি? ভালোবাসা? অথচ আমি তো যৌনস্বাধীনতায় বিশ্বাসী লোক, এতে কী এসে যায় ভেবে সংসারকে এক চুল বিব্রত না করে চালিয়ে গেছি নিজেকে নিজের মতো করে। নিজেকে সে রাতে ব্যাখ্যা করতে পারিনি আমি। একটি যুক্তিও আসেনি আমার মাথায়।
•
শারমিন পরদিন বাবলুকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। হায়দারও মুছে যায় আমার জীবন থেকে। আমার সন্দেহ সত্য ছিলো কি না- সেটা আজও আমি জানি না। কারণ সেই সময়টাই পাইনি। আমি আগের মতো অফিস করতে থাকি, শাহানাও অফিসে আসে। আমাদের যৌথ পেশাদার সম্পর্কে ছেদ পড়ে না, কারণ আমি মহাপুরুষ নই। এর দায় আমার একার নয়। জীবনের দায়িত্ব ঠিক রেখে জীবনকে সাজাতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মনের ও শরীরের বিশ্রামের জন্য আমার নেয়া পথ এই ধর্মজ্ঞানী সমাজের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিলো। এসব প্রিমিটিভ ভাবনা আমার পছন্দ নয়। কী করা যাবে, আমি এইরকম। আমি যে এইরকম, সেটাই এখন বোঝাতে যাই আমার স্ত্রীর কাছে, শারমিন আমাকে বসতে দেয় তার নতুন আবাসে, কিন্তু সে বোঝে না, ফিরেও আসে না। আমাদের দুজনের মাঝখানে হায়দার থেকে যায় একটা গোপন প্রেমের অসফল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১