ইচ্ছেযাপন

 

চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরবর্তী পরিকল্পনা রামজীবনের অনেক আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। সেটি বাস্তবায়িত করার দিন গুনছিলেন কেবল। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পাঁচেক আগেই। ছেলে ও মেয়ে দুজনেই তাদের নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তিনি আসলে পশুপাখিদের জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। বাচ্চাদের ছোট থেকে বড় করে উড়তে, দৌড়তে কিংবা শিকার ধরতে শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন যে যার নিজেদের মতো করে বেড়ে ওঠো আর জীবন সাজিয়ে নাও। বাবার প্রতি কোনো কর্তব্যের দায়ভার তাদের রাখতে হবে না। সে উনি নিজের ভালোমন্দের ব্যবস্থাটুকু এতদিন যেভাবে করে এসেছেন, সেভাবেই করে নেবেন। তারা যেন নিশ্চিন্তে নিজেদের জীবনতরী এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

 

রামজীবন ঠিক করেছেন তাঁর এই অবসরকালীন lonelinessকে solitude-এ পরিণত করে একাকিত্বের উদযাপন করবেন। এতকাল কর্মব্যস্ততার মাঝে চোখ এড়িয়ে যাওয়া ছোট খাটো ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাঁর মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় দেখা তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’ সিনেমার একটি গান- ‘আমি দেখতে ভালোবাসি / আমি নয়ন ভরে দেখতে ভালোবাসি / নয়ন যদি ভরে তবু / ভরে না তো মন কভু…’। রামজীবন এখন থেকে শুধুই দেখবেন।

 

রোজ সকালে তিনি কফি বানিয়ে পুবের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন। তিন কাঠা জমির উপর বাগানসহ এই বসতবাড়িটি তৈরির সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রামজীবনের। সরকারি চাকরি পেয়ে নিজেদের পৈতৃক ভিটের অংশটুকু বিক্রি করে এখানে নিজের মতো করে সবটুকু সাজিয়েছিলেন। বাবা তো সেই কোন স্কুলবেলাতেই গত হয়েছিলেন। তাঁর সেই নিজস্ব এক বাড়ি হওয়ার অপূর্ণ ইচ্ছেটুকু মা যেন নিজের চোখ দিয়ে ধারণ করেছিলেন। একান্নবর্তী সংসারে কোনোদিন কিছু দাবী না করা কিংবা সামান্য উঁচু গলায় কথা না বলা তাঁর মায়ের ঘোমটা সরানো মুখটার সে অনাবিল উজ্জ্বলতা তিনি আজও ভুলতে পারেন না।

 

উঠোনের চালতা গাছটির পাতায় পাতায় সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলে। রামজীবনের মুখেও আলোছায়া খেলা করে। এ বয়সে এসে শুধুই ইতিহাস ভিড় জমাতে থাকে। সে যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। কোন স্মৃতি কার আগে ভেসে উঠবে! নববধূ সাজে এই তো সুরমা আলতামাখা পা ফেলে এগোচ্ছে তুলসীমঞ্চের দিকে। সুরমার সঙ্গে বিয়েতে মায়ের একদম মত ছিল না। কেবল ঠাকুমার দেওয়া কথা রাখতে তাঁর এ বাড়িতে বউ হয়ে আসা। মায়ের অপছন্দের কারণ ছিল সুরমা ছিল সাংঘাতিক মুখরা। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো সারাজীবনে সুরমা তাঁর এই ‘মুখরা’ স্বভাব সবার সঙ্গে বজায় রাখলেও রামজীবনের সঙ্গে ভুলেও কোনোদিন ঝগড়া করেননি। আর তিনি নিজেও শান্ত স্বভাবের মানুষ। সুতরাং ঝগড়ার মেঘ তাঁদের জীবনে জমাট বাঁধেনি কোনোদিনই। মারা যাওয়ার আগে হাসিমুখে সুরমার এই ছিল শেষ কথা। “জীবনবাবু, তোমার এই শান্ত মুখখানি দেখে সারাজীবন তোমার সঙ্গে আর ঝগড়াই করে ওঠা হলো না। এই ঝগড়াটুকু বাকি রয়ে গেল বলেই আমায় আবার পৃথিবীতে জন্মাতে হবে।” কথা কয়টি বলে সুরমা শান্তভাবে দু’চোখের পাতা বুজেছিলেন। ঠিক যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন এমন। এমন শান্তভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে এক আভিজাত্য আছে। এমনটাই তখন মনে হয়েছিল রামজীবনের। সুরমার জন্য কি তাঁর মন খারাপ করে? তিনি কি সুরমাকে ভালোবাসতেন? নাকি এতদিন একসঙ্গে থাকার একটা অভ্যাসজনিত মায়া? চোখটা কি ঝাপসা হয়ে এলো? হতেও পারে। আসলে ‘মায়া’ শব্দটির মায়া যে বড় মায়াবী।

 

আমগাছে মুকুল এসেছে। এবছর প্রচুর আম হবে আশা করা যায়। কোকিলটা কী নরম সুরে ডেকে চলেছে! আচ্ছা, যুগ যুগ ধরে কাকের মত বুদ্ধিমান প্রাণীকে কোকিল কীভাবে বোকা বানিয়েই যাচ্ছে? ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত মনে হয় তাঁর। বাগানের গাছগুলিতে জল দেওয়া হয়েছিল। একটি ছোট গর্তে এখনও সেই জল খানিক জমে আছে। সেই জমা জলে একটি শুকনো পাতা ভাসছে। আর সেই পাতার ওপর বসে একটি ফড়িং। মৃদু হাওয়ায় পাতাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। ফড়িংও সেই তালে দুলছে। আহা কী সুন্দর! পূর্বদিকে বাগানের দিকটায় বেড়াকলমির প্রাচীর দেওয়া। গাছগুলি তরতরিয়ে লম্বা হয়ে যায়। হালকা বেগুনী রঙয়ের ফুলগুলি যেন নাকে নথ পরা নববধূ। তারা হাওয়ার ছন্দে দোলে, একবার এদিক একবার ওদিক। এসব দেখে যেন তৃষ্ণা মেটে না রামজীবনের। ভাবেন, জীবন তাহলে এতটাই সুন্দর! কিন্তু সময় যে কমে আসছে। নিজের মধ্যে এক বহির্মুখী টান অনুভব করতে থাকেন তিনি।

 

এইসময় দুপুরের দিকটা বেশ গরম লাগে। উঠোনে বসা যায় না। পড়ার ঘরে বসে রামজীবন বইয়ের আলমারি থেকে একটার পর একটা বই নামিয়ে পাতা ওল্টান। সারাজীবন এই বইই তাঁকে সুখে-দুঃখে আশ্রয় দিয়েছে। পুরোনো হয়ে যাওয়া লালচে বইয়ের পাতায় হাত বুলিয়ে তিনি গল্পের কাহিনী মনে করার চেষ্টা করেন। আঙুলের স্পর্শে বইয়ের পাতাগুলি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। ওরা যেন মনে করিয়ে দেয়, কবে কোনখানে ওই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয়েছিল। এ এক ভারি মজার খেলা। কখনও কোনো একটি বই নিয়ে বসেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। আহা! পাবলো নেরুদার সেই ‘Clenched Soul’ কবিতার তিনটি লাইন… ‘We have lost even this twilight.

No one saw us this evening hand in hand

while the blue night dropped on the world…’। হাতের ভাঁজে বইটি বন্ধ করে চোখ বোজেন তিনি। অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে হারিয়ে যান কিছুক্ষণের জন্য। কত কবি, কত কবিতা ভিড় জমাতে থাকে মনে। ওঁর একটা ডায়েরি ছিল। প্রিয় কবিতাগুলি সেখানে লেখা থাকতো। কবে যে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল আর সেই অভিমানী ডায়েরীর পাতাগুলি কোথায় যে মুখ লুকিয়ে রয়েছে আজ, তা আর মনে করতে পারেন না তিনি।

 

বিকেলটা আর বাড়ি বসে থাকতে ভালো লাগে না ওঁর। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পেরিয়ে নদীর অপর পারে চলে যান। বহু বছরের এক পুরোনো ঘাট আছে নদীর পাড়ে। সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত ওখানেই বাঁধানো ঘাটে বসে থাকেন। এই সময়টা রামজীবনের বড় প্রিয়। সূর্যের আলো দিগন্তের দিকে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর তীব্রতা কমে আসতে থাকে। হঠাৎ করেই যেন মনে হয় চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছে। উনি জানেন এটি নিতান্তই তাঁর মনের ভুল। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন ভ্রমে থাকতে ভালো লাগে আজকাল। অস্তমিত সূর্যের সোনালি রঙ জলের সঙ্গে মেশে। চারপাশ কেমন অন্ধকারের উদযাপনে মেতে ওঠে। নদীর পাড়ে এসময় বেশ ভিড় থাকে। বিভিন্ন বয়সের লোকজন এসে বসে, গল্পগুজব করে। রামজীবন কারোর সঙ্গে ভাব জমান না। ওঁর কারোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। কথা বলে আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না। একদিন দেখলেন, তাঁর উল্টোদিকে একটি ছেলে এসে বসল। ছেলেটি কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ঝোলা থেকে একটি মশা তাড়ানোর ধূপ আর লাইটার বের করলো। তারপর ঝোলা পাশে রেখে লাইটার জ্বালিয়ে ধূপ ধরালো। ধূপ নামিয়ে রেখে ঝোলা থেকে মোবাইল বের করে আবার তাতে মন দিল। মিনিট পাঁচেক পরে ছেলেটির বয়সী একটি মেয়ে এসে ওর পাশে বসল। মেয়েটি বসে ছেলেটির একটি হাত হাতের মধ্যে রেখে, কাঁধে মাথা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে রইল চুপচাপ। রামজীবন কেমন যেন বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। একেই কি তবে প্রেম বলে? রামজীবন তো কোনোদিন সুরমার কোনো অসুবিধার দিকে খেয়াল করে দেখেননি। কিছু করে দিতে বললে করে দিয়েছেন অবশ্যই। অসুস্থ হলে সেবা যত্নও করেছেন। কিন্তু কোনোদিন তো বিছানা করে সুরমার অপেক্ষা করেননি। কিংবা কখনও তো একসঙ্গে চুপ করে বসে নীরবতাকে উপলব্ধি করেননি। সুবিধা অসুবিধার ভাবনা সুরমা ভাববে এটাই নিয়ম বলে জেনে এসেছেন। এর বাইরে যে অন্যকিছু ভাবা যেতে পারে এসব তাঁর মনে হয়নি কখনও। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নদীর অপর পারে জ্বলে ওঠা আলোগুলো দেখতে লাগলেন। কিছু ভাবনা শুধুমাত্র ভাবা হয়ে ওঠে না বলে যুগ যুগ ধরে একই গতানুগতিক ধারণার জালে আটকা পড়ে থাকতে হয়।

 

রামজীবনের এখন কচুরিপানার জীবন। কোথাও পৌঁছনোর তাড়া নেই। শুধুই ভেসে চলা। কোথাও কোনো পথে বাধা এলে সেটি সরিয়ে অন্য পথে যাত্রা হবে আবার। কারোর প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ নেই। জীবনের প্রতিটি দিন যেভাবে তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যাবে, ঠিক সেভাবেই উনি মোহনার দিকে এগিয়ে যাবেন। রাতে বাড়ি ফিরে আলো নিভিয়ে উঠোনে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ বসে থেকে বোঝেন অন্ধকারেরও একটা নিজস্ব আলো আছে। একটু একটু করে অন্ধকার আকাশে একটি দুটি করে তারা ফুটে ওঠে। মাধবীলতার ঝাড়টি এবার নিজেকে উজাড় করে ফুল ফুটিয়েছে। সেই সুবাসে রামজীবন বহুকাল আগের ফেলে আসা ছেলেবেলায় ফিরে যান। এইরকম রাত্রিবেলায় পুরোনো বাড়ির ভেতর উঠোনে বসে ভাইবোনেরা ঠাকুমার গা ঘেঁষে গল্প শুনতো। ঠাকুমার গায়ে, জামাকাপড়ে কেমন এক ভালোবাসার গন্ধ পাওয়া যেতো। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসতো মাটির উনুনে রান্না হওয়া ভাতের কিংবা ডাল সাঁতলানোর গন্ধ। গল্প শুনতে শুনতে তাঁরা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তেন। ঠাকুমা একটা বড় থালায় ভাত মেখে ঘুমন্ত মুখগুলোর সামনে ধরতেন। সেই ধোঁয়া ওঠা ভাতের গন্ধ বুঝি আজও পান রামজীবন। উঠোন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। পা ভারী হয়ে আসে। এবাড়িতে আসার পর এই উঠোনে ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসতেন মাঝে মাঝে। তাদের সেই আধো আধো কথার কাকলিতে যেন মুহূর্তে নিস্তব্ধ উঠোনটি কলকল করে উঠল। তবে কি চোখ লেগে এসেছিল তাঁর? চোখ মেলে তাকালে হঠাৎ যেন বড় ফাঁকা লাগে তাঁর। ঘাসের উপর শিশির জমেছে নিঃশব্দে। চাঁদ ধোওয়া জ্যোৎস্না আর রাত চুপিসাড়ে এক অলীক দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়। রামজীবন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েন। বারান্দার আলো জ্বেলে ঘরে যান। প্রতিদিনের একরকম ছন্দে চলা জীবন তাঁর আর ভালো লাগছে না।

 

আজকাল একটা ভাবনা বেজায় ঘুরপাক খায় তাঁর মনে। ঝুপ করে ‘এই আছি এই নেই’ এমনভাবে উবে যেতে ইচ্ছে হয়। একদিন সকাল হবে উনি শুধু জুতো পরে বেরিয়ে পড়বেন। অবশ্য সকালেই বেরোতে হবে এমন কোনো কথা নেই, রাতে কিংবা বিকেলেও বেরোনো যায়। মোট কথা সেই যে বেরোবেন আর ফিরবেন না। ওঁর তো কোনো পিছুটান নেই। তবে কীসের মায়ায় আটকে থেকে যাচ্ছেন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে? অথচ মানুষ কিংবা প্রকৃতি দেখার ইচ্ছে তো ওঁর প্রবল। একদিন হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়তেই হবে তাঁকে। মনের মধ্যের মনটা যেন চুপিচুপি তাঁকে ডেকেই চলেছে, ‘আয় আয়…’।

 

চাকরি, সংসার সামলে কোথাও বেরোনো হয়ে ওঠেনি। দেখা হয়নি স্রোতের টানে নোনা জলের যাওয়া আসা, নিঃস্ব পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যোদয়। কিংবা বোঝা হয়নি জঙ্গলে পথ হারিয়ে পথ খুঁজে ফেরার আকুল আকুতি। সম্প্রতি দেখা ‘Into the wild’ সিনেমায় উল্লেখিত একটি লাইন মনে পড়ে রামজীবনের, “So many people live within unhappy circumstances and yet will not take the initiative to change their situation because they are conditioned to a life of security, conformity, and conservatism, all of which may appear to give one peace of mind, but in reality nothing is more dangerous to the adventurous spirit within a man than a secure future.” কী হবে এই রোজের নিয়মমাফিক তিনবেলা খাওয়ার খেয়ে ডাল-ভাতের জীবন আর পুরোনো অতীত নিয়ে জাবর কেটে? আরাম, আয়েশ তো করলেন এত বছর ধরে। মনে তবু এখনও এতো তৃষ্ণা কেন তাঁর? নাকি এমন অপ্রাপ্তিবোধে জর্জরিত হওয়া একধরণের দুঃখবিলাস? ভেবে চলেন রামজীবন।

 

যেদিন চলে যাবেন সেদিনও চালতাগাছের ফাঁকে রোদের আলো ঝিকিমিকি করে উঠবে, পাতার ফাঁকে গুটি আম দেখা দেবে, উঠোনে রাখা ছোট জাবনায় শালিকগুলো গা ভিজিয়ে স্নান করবে, দুপুরের শনশনে হাওয়ায় বাঁশপাতার উদাসী সুর ভাসবে, বিকেলের সূর্য দিগন্তে গড়িয়ে পড়লে শিমুলগাছে পেঁচাটা ঘরে ফেরার ডাক দেবে, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে পোকামাকড়েরা পালা করে রাত পাহারা দেবে, চাঁদের রুপালি আলোর বন্যায় উঠোন পিছলে যাবে, হাস্নুহানার সুবাসে বাতাস মাতাল হয়ে উঠবে, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনের সুরে বাতাস উদাস হয়ে যাবে। শুধু ঘরের জানালা-দরজার মধ্য দিয়ে বাতাসের নির্বাক যাওয়া আসা তাঁর অনুপস্থিতির জানান দিয়ে যাবে। একটা মানুষের থেকে যাওয়া আর চলে যাওয়ায় প্রকৃতিতে কোনো পার্থক্য ঘটে না। প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে নৌকা বাইতে থাকে। থেকে যাওয়া আর চলে যাওয়ার মাঝে শুধুমাত্র এক পা ব্যবধান। মনের অন্তর আর বাহিরের ব্যবধান যেদিন মিটে যাবে সেদিনের অপেক্ষায় থাকেন রামজীবন। ঘরে হোক কিংবা বাইরে, বাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত চোখ ভরে নতুনভাবে দেখে নেবেন উনি। কোনো গন্তব্যে পৌঁছনোর নেই, শুধু মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থেকে যাওয়া। ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ায় গাছপালা বিপর্যস্ত। ওই দূরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। রামজীবন বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে এলেন। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুষ্ক মাটি তা নিমেষে শুষে নিচ্ছে। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে তিনিও ভিজতে লাগলেন। আঃ কী শান্তি! বৃষ্টির ধারা চোখ, মুখ ভিজিয়ে গলা বেয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তবুও যেন শরীর ভিজছে না। ধোঁয়ার মত বৃষ্টিতে আর কিছু ঠাহর হয় না। কেবল এক তৃষ্ণার্ত উপস্থিতি বৃষ্টির সব জল শুষে নিতে থাকে। বাতাস, মরসুমের প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে। তপ্ত জলের ধারা জলচক্রের নিয়ম পূরণ করার তাগিদে উঠোন, মাঠঘাট পেরিয়ে নদীর দিকে দৌড়োতে থাকে। রামজীবনের জীবনচক্রও জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে এভাবেই আবর্তিত হতে থাকে।

তারিখঃ এপ্রিল ২৩, ২০২৪

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse