উত্তরা

 

কাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টি পড়ে চলেছে। বেলা বাড়লেও তার যেন ক্লান্তি নেই, রাস্তায় এরই মধ্যে কোথাও কোথাও বেশ খানিকটা জল দাঁড়িয়েছে। রেনি’ডের স্কুল ফিরতি ছেলেবেলার দিকে তাকিয়ে খানিকটা উদাস হল উত্তরা। এরকম বৃষ্টির দিনগুলো বড় মন খারাপ করে দেয়। পাপুনকে মনে পড়ে খুব, এই জানলাতে বসেই বৃষ্টি দেখত ছেলেটা, রঙিন কাগজের নৌকা বানিয়ে আলতো করে নিচে ফেলে দিত। জলের তোড়ে যখন সেটা ভেসে চলত, ওর চোখে মুখে তখন বাঁধহারা খুশির উচ্ছ্বাস। ওর আনন্দের রেশ বোধহয় উত্তরার গায়ে এসেও লাগত। আচ্ছা, পাপুন কি এখনও স্কুলে যায়, নাকি সেই গণ্ডি পেরিয়ে ছেলে এখন কলেজে? মনে মনেই ভাবল উত্তরা।

 

আজকাল পল্লব যেন ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে যায়। সারাদিন এই জানলাটায় অপেক্ষা করে উত্তরা, পাছে যদি একবার পল্লব ঘুরে দেখে, কথা বলে। কিন্তু কোথায় কী? পল্লব যেন আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছে। দূর থেকে দেখে উত্তরা, পল্লব ভুল করেও এদিকে তাকায় না আর। পল্লব প্রথম থেকেই খানিকটা ওরকম, মন খুলে কোনোদিনই কথা বলতে পারে না। তবে আগে ও উত্তরাকে শুনত, উত্তরা অনর্গল বকবক করে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নিত না। উত্তরা তো নিয়ম করে প্রতি রাতে সব গল্প ওর কাছে উজাড় করে দিত। পাপুন যে’বার চলে গেল, সারারাত কত কেঁদেছে উত্তরা। পল্লব কাছে আসতে না পারলেও উত্তরার মনে হয়েছিল কেউ একজন  যেন জেগে আছে ওর সাথে। উত্তরাও খুব চাইত পল্লব মন খুলে কথা বলুক ওর সাথে, সেই যে বার তিতলি ওকে ছেড়ে গেল তারপর থেকেই পুরো চুপ হয়ে গিয়েছিলো পল্লব। আলো নেভার পরে উত্তরা জানলায় গিয়ে বসত, সারাদিনের ফিরিস্তি শোনাত পল্লবকে, যদি একটু হাসে, যদি একটু মনটা ভালো হয় ওর। আবার যেদিন নতুন একটা মেয়ে এল ওর জীবনে পল্লবের স্মিত হাসিটা যেন ফিরে এল, উত্তরা দেখেছিল ওর উজ্জ্বল অভিব্যক্তি । কী সুন্দর পিছুটান ভুলে নতুন জীবনে মানিয়ে নেয় পল্লব, উত্তরার ভয় হত একদিন হয়তো ওকেও ভুলে যাবে পল্লব।

 

বৃষ্টিটা কিছুটা ধরেছে। রাস্তায় লোক বাড়ছে। চারিদিকটা হঠাৎ করেই বেশ সবুজ হয়ে উঠেছে। নিজের দিকে তাকালে মনটা কেমন কেঁদে ওঠে উত্তরার। একা একা এই কদিনে কী বিশ্রী হাল করেছে নিজের, সারা গায়ে যেন ধুলোর আস্তরণ। আর কিছুদিন পর হয়ত একা থাকাটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন আর এসব কিছু মনে হবে না। জানলাটা দিয়ে আবার তাকালো উত্তরা, না পল্লবের কোনো পাত্তা নেই। তবে সুন্দরী মেয়েটা ওর জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে, ওর চুলগুলো অগোছালো, উড়ছে। উত্তরার শরীর জুড়ে একটা হিংসের গাছ বেড়ে ওঠে, জানলাটা থেকে সরে আসে ও। দরজায় একটা আওয়াজ হচ্ছে, কেউ আসছে বোধহয়। নড়েচড়ে বসে উত্তরা।

 

বর্ষা পেরিয়েছে। শরতের ফুরফুরে সন্ধ্যেয় সেজেগুজে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তরা। ধুনোর গন্ধ মেখে একটা হাওয়া ভেসে আসছে, দুর্গামণ্ডপে বোধহয় সন্ধ্যারতি শেষ হলো। আজ অষ্টমী। পুজোর আমেজে চারপাশ মুখরিত হলেও পল্লব কেমন যেন ঝিমিয়ে রয়েছে, পুজোর আলো ওর চেহারা অব্দি এসে পৌঁছায়নি। সেই মেয়েটাকেও অনেকদিন দেখেনি উত্তরা, ও-ও বোধহয় গেছে তাহলে। উত্তরা যদিও আজকাল খুব একটা ভাবুক নয় পল্লবকে নিয়ে, গত কয়েকমাসে কোনো কথাই হয়নি ওর সাথে। অবশ্য সময়ই বা কোথায়!

 

সিগারেটের গন্ধটা উত্তরার নাকে এসে লাগছে। অভি একটু আগেই বেরিয়েছে, অ্যাস্ট্রেতে সিগারেটটা এখনো নেভেনি। খালি ওয়াইনের গ্লাসটাও জানলায়। অভি আসার পর থেকেই উত্তরার যেন আমূল পরিবর্তন হয়েছে। নিজেকে আবার সাজিয়ে নিয়েছে ও। খাঁ খাঁ জানলাটায় এখন আর অপেক্ষা জেগে থাকে না, ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে ওটা। অভির গাছের শখ, ওই যত্ন করে। অবশ্য আরেকটা শখও আছে, কবিতা লেখার। ওটা উত্তরার বেশি প্রিয়। ডায়রির পাতা থেকে ঘরের দেওয়াল, অভির অক্ষরগুলোয় ভরে ওঠে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে উত্তরা, কী স্নিগ্ধ, কী গভীর!

“মেঘলা আকাশে বিকেল ঘনালে

তোমাকে খুঁজি।

বুকের আলগা বোতামগুলো অস্থির হয়,

অস্থির হয় মনের যত অবাধ অসুখ।

কবিতার পাতায় বৃষ্টি নামে, অনেক রাতে

শরীর ভেজে না, তবুও জানি জ্বরের পারদ উর্দ্ধমুখী।”

 

অভি পেশায় আর্কিটেক্ট, নতুন একটা প্রজেক্টের কাজে এখানে এসে উত্তরার সাথে আলাপ। কাজপাগল ছেলে। সারাদিনের পর কবিতা নিয়ে বসে, সাথে ওয়াইন আর সিগারেটটা কমপ্লিমেন্টারি। আজকাল এই মুহূর্তগুলোরই অপেক্ষা থাকে উত্তরার। ও যখন লেখে, মাঝে মাঝে কেমন ভাবুক হয়ে জানলাটার দিকে তাকায়, উত্তরার খুব ইচ্ছে করে জানতে, কোথাও কি ও মিশে আছে? এই এতগুলো কবিতার কোনোটাও কি ওকে ভেবে লিখেছে অভি? প্রশ্নটা যদিও কোনোদিন করা হয়নি তবে ওর একাকী জীবনের আজ একমাত্র সঙ্গী অভি। অভি যখন কাজে বেরিয়ে যায়, উত্তরার খুব ইচ্ছে হয় – পল্লবকে আবার আগের মতো সারাদিনের মুহূর্তগুলোর গল্প শোনাবে। পল্লব দিন দিন আরও ম্লান হয়ে পড়েছে, উত্তরার এই জৌলুস আর বোধহয় নিতে পারবে না। পল্লবের জানলার পর্দাগুলোও রোদ খেয়ে ফিকে হয়ে পড়েছে। থমকে দাঁড়ায় উত্তরা, ওর এই হাল বোধহয় মনে মনে ওকেও বিধ্বস্ত করে তুলছে।

 

ডিসেম্বরের শহর, ঠান্ডাটা এবারও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। উত্তরার আজকাল কেমন যেন অস্থির লাগে মাঝে মাঝে, এই চার দেওয়ালে দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারলে বেশ হয়। অভির কবিতাগুলো, ওর অভ্যাসগুলো কেমন যেন বিরক্তিকর হয়ে উঠছে দিন দিন। ওর উপস্থিতি উত্তরাকে আর আনন্দ দেয় না।

বসন্ত আসন্ন। আর কিছুদিনের মধ্যেই লাল হলুদ আগুন লাগবে গাছের পাতাগুলোয়। পল্লব আর নেই। ওর সমস্ত অস্তিত্বটুকু নিয়ে হারিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় উত্তরার, কিছু করতে পারল না ও পল্লবের জন্য, সবকিছু বুঝে উঠবার আগেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। শুরুর দিনগুলো আজকাল খুব বেশি করে মনে পড়ে। উত্তরা এ পাড়ায় তখন নতুন, নামটা বোধহয় প্রোমোটারেরই দেওয়া। দোতলার পশ্চিমের জানালাটা থেকে ওপাশের বাড়ির জানলাটা দেখা যায়। পেস্তা রঙের দেওয়াল, গেটের ওপর একটা মার্বেলের গায়ে লেখা ‘পল্লব’। বাড়ির মালিক বোধহয় বহুদিন দেশছাড়া, মাঝে মাঝে কিছু ভাড়া আসতো, কেউই স্থায়ী নয়। উত্তরার দোতলার পশ্চিমদিকের ফ্ল্যাটটাও তাই, এত বছর ধরে শুধুই ভাড়াবদল হয়ে গেছে। তবুও তাতে কারোরই খুব একটা সমস্যা হয়নি, পল্লব আর উত্তরার হাওয়ায় ভাসানো খোশ গল্পগুলো বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। উত্তরার বকবক আর পল্লবের চুপচাপ শুনে যাওয়া। রাত্রে সব আলো একে একে নিভে এলে এই দুটো জানালা জেগে উঠতো তাদের সারাদিনের রসদ নিয়ে। দুর্গাপুজো থেকে দীপাবলি যখনই আলোয় সেজে উঠতো উত্তরা, ওর স্নিগ্ধতায় পল্লব যেন ডুবে যেত। তারপর হঠাৎই একদিন….। শেষে  বোধহয় ও-ও কিছু ঠাহর করতে পেরেছিল, তাই গুটিয়ে আনছিলো নিজেকে।

 

একটা দমকা হাওয়ায় পশ্চিমের জানলাটা খুলে গেল। হঠাৎ খুব শীত করছে উত্তরার। ওপাশে তখন ক্রেনের আওয়াজ, নতুন ভিত উঠছে। উত্তরা কাঁপা কাঁপা পায়ে জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। অভি কতগুলো লোককে হাত নেড়ে নেড়ে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। নতুন একটা মার্কেট কমপ্লেক্স উঠবে পল্লবের কবরের ওপর দিয়ে। এই প্রজেক্টটার কাজেই অভির এখানে আসা। অভির হাতের সিগারেটটা শূন্যে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। আওয়াজটা বাড়ছে। উত্তরার সারা শরীর বেয়ে ক্ষোভ, কষ্ট, ঘেন্নার গাছটা বেড়ে উঠছে।

 

তারিখঃ জুলাই ৫, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse