উত্তরাধিকার
চিরন্তন ভট্টাচার্য
মদনদা উড়ছে। আমরা তলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছি আর হাততালি দিচ্ছি। মদনদা আরও উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। এখন দেখাচ্ছে একেবারে পাখির মতো। বড় খোকন আমার পাশে দাঁড়িয়ে উঁচুর দিকে তাকিয়ে বললো ‘সুধীরদা, দাদার স্টান্সটা খেয়াল করলে? একদম বাজ পাখির মতো গোঁত্তা মেরে ওপরে উঠে গেলো!’ আমার কেন জানি না উপমাটা ঠিক জুতসই মনে হলো না। বাজ পাখি নয় আমার মনে হচ্ছিলো চাঁদিয়াল ঘুড়ি। বাতাসে ডাইভ মারতে মারতে ওপরে উঠছে। বাজ পাখি আরও মসৃণভাবে ওঠে। আমি আপাততঃ বড় খোকনের ভুলটা ভাঙালাম না। মদনদা ওপর থেকে নামবার সময় বাতাসে তিনটা ডিগবাজি খেলো। সেই দেখে জগা ব্যাগ থেকে একটা পেটো বার করে একটু দূরে ঝোপের গায়ে ছুঁড়ে মারলো। পাহাড়ের গায়ে ইকো হতে হতে শব্দটা মিলিয়ে গেলো। বাতাসে বারুদের গন্ধ মিহি হয়ে যাওয়ার আগেই মদনদা’র পা মাটি ছুঁলো। আমি জগার দিকে একটু রাগ চোখে তাকিয়ে বললাম ‘এই ওড়ার ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোপন থাকে জগা। তুই ভালো করেই জানিস। তাও পেটো ফাটিয়ে শব্দ করলি কেন?’ জগা ওর এবড়ো খেবড়ো দাঁতগুলো বার করে কানে হাত দিয়ে বললো ‘ভুল হয়ে গেছে গুরু। দাদার কেরামতি দেখে ফুল ঝটকা এসে গিয়েছিলো প্রাণে!’ তারপরে মদনদা’র দিকে তাকিয়ে বললো ‘তবে যাই বলো সুধীর দা, আমাদের দাদার পায়ের আওয়াজ পেটোর চেয়েও বেশি জোর!’ মদনদা এইসব তাপ্পি মারা কথাগুলো খুব এনজয় করে আমি জানি। মদনদা ওর দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললো ‘আর বেশি ঝটকা আনিস না জগা। সাংবাদিকরা জেনে গেলে আমার পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকবে।’ মদনদা’কে আমরা কখনো রাগতে দেখিনি। মুখের মধ্যে সবসময় একটা মোলায়েম মাখন হাসি লেগে থাকে। এই জন্যই মদনদা হলো নেতা।
মদনদা ছিলো আমাদের এই বীরনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান। ছিলো বলছি তার কারণ এটা নয় যে মদনদা ভোটে হেরে গিয়েছিলো। মদনদা’কে হারাবার মতো কেউ এই বীরনগরে কোনোদিন জন্মাবে না। মদনদা এখন কেন্দ্র সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাই বীরনগর পৌরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান আমি। সুধীর চাকি। মদনদা’র ডানহাত। কিন্তু এই বীরনগরের নেতা একজনই আর সে হলো মদনদা। অনেকে মদনদা’কে বলে বীরনগরের রবিনহুড। কিন্তু আমরা বলি তা নয়। কেন না, রবিনহুড গরীবদের সেবা করতো ডাকাতি করে আর মদনদা গরীবের সেবা করে নিজের কষ্টার্জিত ব্যবসার টাকা থেকে। বরং রবিনহুডকে লোকে বলুক শেরউড বনের মদন। আমি, বড় খোকন, জগা, পান্তুয়া, কেলে বাপি, ছানা আর পিংপং – আমরা হলাম মদনদা’র সবচেয়ে কাছের চ্যালা। আরেকজনও অবশ্য আছে, সরস্বতী। মদনদার ব্যক্তিগত সচিব। পড়াশোনা জানা মেয়ে। আমরা ওকে ডাকি চমচম বলে। দিল কি চমচম! কিছুদিন আগেও লোকে আমাকে বাঁটুল বলে ডাকতো। আমার হাইটটা একটু কমতির দিকে সেইজন্য। এখন অবশ্য সে সাহস আর কেউ নেই। আমারও পেটে কিছু বিদ্যে ছিলো তাই মদনদা আমাকে কিছুটা খাতির করে। তাই আমি এখন পৌরসভার চেয়ারম্যান।
আমার কথা থাক। বরং মদনদা’র কথাই বলি। ভোটের সময় এলে আমরা স্লোগানে স্লোগানে মাত করে দিতাম আকাশ, বাতাস আর মাটি। আমাদের কাছে মদনদা’ই দেশের সেরা নেতা। আমরা মনে করি মদনদা যেদিকে তাকায় সেদিকেই দিন হয় আর যেদিকে মাথা রাখে সেদিকেই রাত নামে। আমরা স্লোগানে স্লোগানে ভরিয়ে তুলতাম ‘সূর্য ওঠে কোনদিকে? মদনদা তাকায় যেই দিকে।’ সূর্য নিয়ে আমাদের এত আদিখ্যেতা করার কারণ ছিলো মদনদা তথা আমাদের দলের নাম ‘তরুণ সূর্য’। আমরা সর্বভারতীয় হওয়ার চেষ্টায় হিন্দিতে স্লোগান দিতাম ‘দেশ কি লিডার ক্যায়সা? মদনদা য্যায়সা।’ বাবারও বাবা থাকে। মদনদারও একসময় একজন নেতা ছিলো। তরুণদা। তখন মদনদা ছিলো তরুণদার দল ‘সাম্যের গান’ পার্টিতে। তরুণদার দলের ছিলো আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য, সাম্রাজ্যবাদ এসব বেফালতু বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা আর আন্দোলন । পাকিস্তানে হোক কি সিয়েরে লিওনে, গরীব মানুষের ওপর অত্যাচারের কোনো খবর এলেই তরুণদা’র দল একেবারে শকুনির পালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো। মিছিল, স্লোগান ইত্যাদিতে মুখর করে তুলতো এই শহর, গ্রামের আকাশ-বাতাস। মদনদা পরে ওই দল ছেড়ে নিজের এই দল তৈরি করে। দলের নামের সঙ্গে অবশ্য তরুণদা’র কোনো সম্পর্ক নেই। নামের মিলটা নেহাতই কাকতালীয়। মদনদা বলে ‘চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। আগে নিজের দেশ। দেশের মাটি। দেশের ইতিহাস। দেশের সংস্কৃতি। সবার আগে দেশের মানচিত্র। তারপরে সারা দুনিয়ার কথা ভাববো। আগে নিজের ঘরের কথা ভাবতে হবে তারপরে অন্য লোকের কথা ভাববে।’ মদনদা এই কথাটা শুধু মুখের কথা হিসেবে বলতো না নিজের জীবনে আত্মস্থও করেছিলো। তরুণদার দলে থাকার সময়ে মদনদার নিজের বলতে ছিলো কাঠা ছয়েক চাষের জমি আর একটা মাটির বাড়ি। কিছুদিন পরে মদনদা’র জমির পরিমাণ বাড়লো। মাটির বাড়ি পাকা হলো। মদনদা যখন নতুন এই দল তৈরি করলো তখন মদনদা’র পাকা বাড়ি দোতালা হয়েছে। নদীর ধারে পঁচিশ বিঘে ধানী জমি দখলে এসেছে। আর লক্ষ্মীপুরে একটা চাল কলের মালিক হয়েছে। আরও পরে যখন এই বীরনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান হলো তার কয়েক বছরের মধ্যে মদনদা’র অক্লান্ত পরিশ্রমে জমির পরিমাণ নামে বেনামে গিয়ে দাঁড়ালো দুই’শ বিঘেতে। ততদিনে মদনদা নতুন একটা বাংলোর মালিক হয়েছে। শিলিগুড়িতে একটা আবাসন বানাচ্ছে। বীরভূমের সিউড়ির কাছে আর মালদায় একটা করে তেলকলের মালিক হয়েছে। এত সম্পদ থাকা সত্বেও মদনদা কিন্তু বিয়ে করেনি। মদনদা বলতো ‘আমার সম্পদ দেশের সম্পদ। দেশের থেকে দারিদ্র্যতা একদিন দূর করতেই হবে। আমার শেষ নিশ্বাসটুকুও আমি দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য দান করে যাবো।’ তবে মদনদা কিন্তু শিকড় ভোলেনি। মদনদার খাস চেম্বারে আজও তরুণদার ছোট একখানা ছবি টাঙানো আছে। তরুণদা কয়েক বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মদনদা আজও বলে ‘তরুণদার দর্শন আমার থেকে আলাদা হতে পারে কিন্তু তরুণদার হৃদয় ছিলো খাঁটি।’
আমার আগে মদনদা’র প্রধান সাকরেদের এই জায়গাটায় ছিলো বিনয় সাউ। রগচটা, গোঁয়ার কিন্তু অতি ধুরন্ধর। মদনদা আদর করে ডাকতো বিনু। আমরা অবশ্য ডাকতাম বুনো। মদনদা বুনোর ওপর যেমন ভরসাও রাখতো তেমনি বুনোও প্রত্যেকটা অপারশন নিখুঁত ভাবে শেষ করে তার প্রতিদান দিতো। যেমন তরুণদা’র কেসটাই ধরা যাক। গোটা পৃথিবী জানে সাম্যের গান পার্টির সম্পাদক তরুণ সেনগুপ্ত বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়ে বজ্রাঘাতে মারা গেছে। পরদিন সকালবেলা পাহাড়ের ঢালে তরুণদা’র মৃতদেহ পাওয়া যায়। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ইলেকট্রিক শক বা তড়িতাহত হয়ে মৃত্যু হয়েছে। ঠিক ওই সময়ে ওই জায়গায় একটি বজ্রাঘাতের ঘটনাও ঘটেছিলো। তাই আর কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কিন্তু আমরা মাত্র কয়েকজন জানি কি অসম্ভব ধৈর্য আর নিখুঁত পরিকল্পনা করে ঠিক ওই সময়ে বুনো তরুণদা’কে হাই ভোল্টেজ ব্যাটারির ইলেকট্রিক শকটা মেরেছিলো। সত্যি বলতে কি বুনোর ওই নিখুঁত কাজের জন্যই মদনদা আজ আকাশে উড়তে পারছে। আর উড়তে পারছে বলেই কিন্তু মদনদা আজ কেন্দ্রের মন্ত্রী। মদনদা বলে প্রত্যেক সফল রাজিনিতীকের কোনো না কোনো একটা গুপ্ত গুণ থাকে। কেউ আকাশে পাখির মত উড়তে পারে আবার কেউ জলের তলায় মাছের মত ডুব সাঁতার কাটতে পারে। কিন্তু এই গুণগুলো কেউ নিয়ে জন্মায় না। অর্জন করতে হয় উত্তরাধিকারী হিসেবে। মদনদা এই আকাশে উড়তে পারার গুণ অর্জন করেছিলো তরুণদা’র উত্তরাধিকারী হিসেবে। সোজা পথে নয় যদিও। বাঁকা পথে। মদনদা অবশ্য বলেই যে রাজনীতি কখনো সোজা পথে চলে না। কিন্তু রাজনীতি তখনই সাফল্য অর্জন করে যখন অতি আঁকাবাঁকা পথকে কেউ সোজা, সরল আর সমতল পথ বলে চিনিয়ে দিতে পারে।
প্রথমেই বলেছি মদনদা’র একটা বিশেষ গুণ আছে। মদনদা আকাশে পাখির মত উড়তে পারে। কিন্তু মদনদা’র পাখির মত কোনো ডানা নেই। ওড়ার বিষয়টা গুপ্ত। এখন এক মাত্র আমিই জানি বিশেষ একটি বাক্স আছে যার মধ্যে কিছু একটা আছে যার সাহায্যে মদনদা আকাশে উড়তে পারে। এই বাক্স আগে ছিলো তরুণদা’র হাতে। কিন্তু তরুণদা কোনোদিনও আকাশে ওড়েনি। তরুণদা বলতো , ‘একদিন সারা বিশ্বের সমস্ত মেহনতি মানুষ আকাশে উড়তে পারবে। সেদিন আমিও ওদের সঙ্গে একসাথে আকাশে উড়বো।’ মদনদা অবশ্য আড়ালে বলতো ‘ভার্টিগো’! মদনদা আমাদের শেখাতো তরুণদা’র ভুলটা কোথায় – বলতো ‘একটা মেহনতি মানুষ যে মুহূর্তে বিনা আয়াসে আকাশে উড়তে শিখে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই মানুষটা তার পূর্বের চরিত্র হারিয়ে একটা বুর্জোয়াতে পরিণত হয়ে যাবে।’ আমি আর বুনো ছাড়া মদনদা’র আর কোনো সাগরেদ ‘ভার্টিগো’, ‘বুর্জোয়া’ এইসব ভারী ভারী শব্দ বুঝতে পারতো না তবে ওরাও বুঝদারের মত হাসতো খুব। কেন না মদনদা মজার কথা বললে যে সামনে থাকে তাকে হাসতে হয় এটা এই বীর নগরের প্রাচীন নগর প্রবাদ। তরুণদা যেহেতু উড়তে চায় না তাই ওই বাক্সটা তরুণদা’র কাছে থাকা মানে একটা বিরাট শক্তিকে মানব কল্যাণে না লাগিয়ে অপব্যবহার করা। তরুণদা মারা যাওয়ার পরে মদনদা বাক্সটা পেয়ে যায়। তবে বাক্স হাতে পেলেই যে কেউ উড়তে পারে না। যদি তুমি উড়তে চাও তাহলে বাক্সের ডালা খোলা রাখতে হবে আর ফিরে এসে বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু এই খোলা আর বন্ধ করার যে অঙ্ক তা মিশরের পিরামিডে নামার চেয়েও বেশি গোলকধাঁধার অঙ্ক। মদনদা ওই অঙ্কটা জানে বলেই মদনদা নেতা। আমরা শুধুই মদনদা’র সাগরেদ। মদনদা’র স্যাটেলাইট।
তরুণদা মারা যাওয়ার ঠিক এক বছর চার মাস তেরো দিনের মাথায় বুনো খুন হয়ে গেলো। ধারালো ছুরির আঘাত ওর গলার নলিটাকে দুই টুকরো করে দিয়েছিলো। লাশটা পাওয়া গিয়েছিলো সাম্যের গান পার্টির একটা দলীয় কার্যালয়ের তালা বন্ধ দরজার ভেতরে। তরুণদা মারা যাওয়ার পরে ওদের পার্টি অফিসগুলো প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। আমরা অবশ্য বুনোর খুনের দায় ওদের পার্টির ওপরেই চাপিয়ে দিয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টার শান্তিপূর্ণ বীরনগর বন্ধের ডাক দিলাম। হরতালের সময় ওষুধের দোকান, দুধের দোকান, খবরের কাগজ থেকে শুরু করে সমস্ত রকম বাণিজ্যিক পরিষেবা স্তব্ধ করে দিলাম। মদনদা তখনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়নি। তখনও বীরনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান। মদনদা নিজের ঘরে বসে শান্তির জন্য একটা ভাষণ দিলো – “আপনারা জানেন আমার নিজের কোনো সংসার নেই। নিজের কোনো সন্তান নেই। এই দেশের তথা এই শহরের আপদে বিপদে যে ছেলেগুলো নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই বিনু, সুধীর, জগা, ছানা ওরাই আমার সন্তান। তাই বিনুর এই মৃত্যু আমার কাছে সন্তান হারানোর মত দুঃখের। আমার ছেলেরা তাদের ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক পালনের জন্য শহর বন্ধের ডাক দিয়েছে। আমি সেই বন্ধ সমর্থন করি। তবে মুমূর্ষু মানুষের ওষুধ বা শিশুদের খাবার জন্য দুধ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। এই দুইদিন যার যা ওষুধ লাগবে বা যার বাড়িতে যতটা দুধের প্রয়োজন আছে তা পৌরসভার অফিসে এসে আমার কাছ থেকে বিনা পয়সায় নিয়ে যাবেন। যারা এই পরিষেবা নেবেন আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। পরিশেষে জানাই আমরা রাজনীতি করি মানুষের সেবা করার জন্য। কিন্তু যারা খুনের রাজনীতি করছে ঈশ্বর তাদের সুমতি দিন। দেশের আইন ও শাসনের প্রতি আমি আস্থাশীল। দোষী ধরা পড়বেই।” সেই দুইদিন অকাতরে লোক মদনদা’র কাছে এসে হাত পেতেছিল আর আমরা দেখেছিলাম মদনদা’র সেই কল্পতরু রূপ।
‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’ – এটা মদনদা’র বাণী নয়। এটি একটি আপ্তবাক্য সেটা সকলেই জানেন। কিন্তু বুনোর মৃত্যুর আগের দিন সন্ধেবেলায় মদনদা ঠিক এই কথাটাই আমাকে, বড় খোকন আর জগাকে বলেছিলো। মদনদা খুব দরদী গলায় বলেছিলো ‘সন্তান দোষ করলে তাকে শাস্তি দিতেই হয় তারই ভালোর জন্য। আমি কিছু বলবো না। তোরা যেমন ভালো বুঝছিস তেমনই কর। তবে বুনো আমার খুব আদরের ছেলে। শুধু একটাই অনুরোধ করবো তোরা দেখিস ও যেনো বেশি কষ্ট না পায়।’ কষ্ট পাওয়ার প্রশ্নই ছিলো না। জগার ছুরি গলার ওপর এত মসৃণভাবে নেমে আসতো যেনো মাখনের ওপরে ছবি আঁকছে। আমি তো বলতাম ‘জগা রে তুই খুনে না হয়ে ডাক্তার হলে অনেক বেশি নাম করতিস!’ বুনোর যে এই পরিণতি হবে তা আমি জানতাম। সবটাই ছিলো আমার পরিকল্পনা। বুনোর চেয়েও নিখুঁত। কেউ যদি এটা ধরে নেয় যে আমি বুনোকে স্রেফ পাজল চ্যালেঞ্জ করেছিলাম আর ও সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলো তাহলে সে মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। বুনোকে অতটা ইনোসেন্ট ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি ওকে বলেছিলাম মদনদা’র সমস্ত শক্তি ওই বাক্সের মধ্যে। যার ডালা খোলা অতি অসাধ্য কাজ। বুনো জানতো ওই বাক্স খুলতে পারলেই মদনদা’র সাম্রাজ্য ওর হাতে। আর আমিও জানতাম ওই বাক্সের ডালা বুনো যতই সাবধানে খোলার চেষ্টা করুক মদনদা জানতে পারবেই। মদনদা’র নেটওয়ার্ক অতটা শক্তিশালী বলেই মদনদা নেতা। আমি অবশ্য পুরো প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। শুধু ওই শাস্তি বা শাসনের ব্যাপারটা মদনদা’র আদেশ ছিলো বলেই নিজের হাতে তুলে নিতে হলো। বীরনগর বাজারের কাছে রূপমতির ঘর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই জগার ছুরির ব্লেডটা আলো আর অন্ধকার মিলিয়ে একটা আলপনা এঁকে দিলো। তার মধ্যখানটায় আবার লাল রঙের ছিটে। ঠাণ্ডাটাও কদিন ভালোই পড়েছিলো। রাত একটা’র সময় মানুষতো দূরের কথা রাস্তায় কোনো কুকুরও ছিলো না। সাম্যের গান দলের পার্টি অফিসের তালাটা আগেই ভেঙে রেখেছিলাম। লাসটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে একটা পুরনো তালা মেরে চাবিটাকে অনেক দূরের একটা খালের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
মদনদা উড়ছে। মদনদা প্রতিদিনই এরকম ওড়াউড়ি করে। অনুশীলনের মধ্যে না থাকলে মানুষের ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু আজকে মদনদা’র ওড়ার রূপটাই যেনো আলাদা। এমনিও আজকের আবহাওয়া বড় মনোরম। পাহাড়ের চুড়ায় লেগে থাকা আকাশের গায়ে কাশফুলের মত সাদা সাদা মেঘ। মদনদা যেন তার মধ্যে একটা ভেলার মতো ভেসে ভেসে চলেছে। আমি বড় খোকনের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম ‘ফোনটা চেক করে দ্যাখ। চমচম কোড পাঠিয়েছে?’ বড় খোকন আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যের হাসি হেসে বললো ‘একটু আগেই পাঠিয়েছে সুধীর দা। তুমি পারবে তো?’ আমি ওর ফোনটা হাতে নিয়ে কোডটা চেক করে বললাম ‘চেষ্টা করে দেখি। এনক্রিপটেড কোড। ব্রেক করতে হবে।’ মদনদা বড় একটা মেঘের মধ্যে ঢুকে গিয়ে ডাইভ মেরে বেরিয়ে এলো। জগা আর পিংপং হাততালি দিচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ বাক্সটা নিয়ে কসরত করে বড় খোকনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তারপরে ডালা বন্ধ বাক্সটা ওর হাতে দিলাম। মদনদা জগাদের হাততালিটা ভালো করে দেখার জন্য অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। ঠিক তখনই বড় খোকন মদনদা’কে চিৎকার করে ডেকে বন্ধ বাক্সটা দেখালো। মদনদা মনে হয় দেখতে পেয়েছে। খুবই দ্রুত নেমে আসছে মদনদা। মনে হলো যেনো ভারহীন অবস্থায় পড়ছে। বাক্সর নিয়ম অনুযায়ী এটাই হওয়ার কথা। বাক্সর ডালা বন্ধ হয়ে গেলে মদনদা আর উড়তে পারবে না।
বীর নগরের বাতাস ভারী করে মদনদা চলে গেছে। বীর নগরের কিংবদন্তী মদনদা’র স্মরণে আমরা বীরনগর পৌর সভার পক্ষ থেকে মদনদা’র বিরাট একটা মূর্তি বানিয়েছি। আমাদের ইচ্ছে ছিলো একটা পাহাড়কে কেটে হিন্দুকুশ পর্বতের গায়ে বামিয়ানের বুদ্ধদেবের মূর্তির মত মদনদা’র মূর্তি বানাবো। কিন্তু এখনকার যুগে তেমন কারিগর আর কোথায়! মদনদা’র মৃত্যুতে বনধ ডাকতে হয়নি। কেন না ডাক্তারি রিপোর্ট অনুযায়ী মদনদা’র মৃত্যু হয়েছিলো স্বাভাবিক। সাডেন হার্ট অ্যাটাক। হৃদযন্ত্রের সমস্যা আগে থেকেই ছিলো। মদনদা সেদিন নেমে এসেছিলো ঠিকঠাকই। আমি বলতে চাইছি নামবার সময় কোনো আঘাত লাগেনি। কিন্তু নেমেই দ্রুত বড় খোকনের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ডালাটা খোলার চেষ্টা করছিলো। আমি সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু পারছিলো না। আসলে আমি কোডটা পাল্টে দিয়েছিলাম। ওই বাক্স আমার এর আগে অনেকবার খোলা আর বন্ধ করা হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে চমচমের পাঠানো কোড দিয়ে আমি কি করেছিলাম সেদিন? ওটা ছিলো একটা ধাপ্পা। স্রেফ চমচম আর বড় খোকনকে দলে টানবার জন্য ওই ভাঁওতা দিয়েছিলাম। যাতে ওদের মনে হয় যে আমি ওদেরকে দলে নিচ্ছি। মাথার মধ্যে ঘিলু বলতে ওই দু’জনেরই আছে। বিশেষ করে চমচম। উড়বার জন্য বাক্স লাগে এটাও ছিলো স্রেফ একটা ধাপ্পা। উড়তে হয় নিজের কৌশলেই। মদনদা ভালো ভাবেই সেটা জানতো। কিন্তু আমি মহাভারতের কাহিনী জানতাম। কাদায় রথের চাকা আটকে যেতে মহাবীর কর্ণ পর্যন্ত নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে অস্ত্র চালাতে ভুলে গিয়েছিলো। মদনদা’র ক্ষেত্রেও তাই হলো। বাক্সের ডালা খুলতে না পেরে মদনদা’র দুর্বল হৃদযন্ত্র স্নায়ুর চাপ সহ্য করতে না পেরে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
বাক্সটা এখন আমার জিম্মায়। তবে আমি নিজে উড়ি না। আমাদের দল এখনও কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কোয়ালিশনে আছে। দল এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। দেশের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য এখন আমাদের দলের। আমাদের দলের প্রতিনিধি হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এখন তপতী টুডু। আদিবাসী উপজাতীয় মহিলা। মদনদা’র সমস্ত সম্পত্তি এখন একটা ট্রাস্টের নামে। সেই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বড় খোকন। ওর নিজেরও ব্যবসা বাড়ছে। আমি নিজে উড়ি না কিন্তু ইচ্ছেমতো অন্যদের ওড়াই। আমি নিজে ডুব সাঁতার কাটি না কিন্তু ইচ্ছেমতো অন্যদের জলের নীচের পৃথিবী ভ্রমণে পাঠাই। আমার কোনো পোর্টফোলিও নেই। কোনো পদ নেই। আমার কোনো সম্পত্তি নেই। এমনকি বসবাসের জন্য একটা বসত বাড়িও নেই। আমি পার্টি অফিসের একটা ঘরে থাকি। পরনের সাদা আলখাল্লাটুকুই আমার নিজস্ব সম্বল। আর আছে কয়েকটা বই। আমি সুধীর চাকি। মন্ত্রী নই। পৌরসভার চেয়ারম্যানও নই। এম পি বা এম এল এ কোনটাই নই। দলের সভাপতি? সে তো চমচম। সরস্বতী কর্মকার। আমার কাছে শুধু মদনদা’র উত্তরাধীকার। ওই ওড়ার বাক্স। তাই আমি যেদিকে দিক নির্দেশ দেখাই সবাইকে সেদিকেই দেখতে হয়। আজকের যুগে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হলে পাখির মত উড়তে জানতে হয় না। মাছের মত সাঁতার কাটতেও জানতে হয় না। বরং মানুষের মত দাঁড়িয়ে থাকতে জানতে হয়। যার মুখের রেখায় থাকবে বৈরাগ্য। কিন্তু চোখ আর কান থাকবে জলে, স্থলে আবার আকাশেও।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২