উত্তরাধিকার

 

বাবা…বাবা, কি, ঘুমিয়ে পড়েছো?

না, না, আপনি ডাকুন। ঠিক সাড়া দেবেন। ডক্টর সিনহার কথায় অনির্বাণ চমকে উঠে পেছনে তাকালে উনি বলে চলেন – অ্যাকচুয়ালি এ ধরণের পেশেন্টকে অ্যাক্টিভ রাখাটা জরুরী। সবসময় একটা স্টেডি ড্রাউজিনেসের ভেতর থেকে যাচ্ছেন। মাঝেমাঝেই রেসপন্স ফেল করছেন। এভাবে চললে…

এভাবে চললে?

দেখুন মেডিকেল সায়েন্সেরও একটা লিমিট আছে। সবই তো বোঝেন। উই আর পুটিং আওয়ার বেস্ট এফোর্ট। বাট ইফ দ্য পেশেন্ট ইজ আনউইলিং, নাথিং উড বি ফ্রুটফুল। আপনার বাবা এখন সেই স্টেটের মধ্য দিয়ে চলেছেন, যখন হারানো বা পাওয়ার আর কিছুই থাকেনা।

অনির্বাণ চুপ করে থাকে। এরপর ইনফ্যাক্ট কিছু বলারও থাকেনা। এতক্ষণ রয়েছে, বাবা একবারের জন্যও চোখ খোলেনি! ভিজিটিং আওয়ার্সের এই চল্লিশ মিনিট সময়টুকু যেন অনির্বাণের কাছে এক সব পেয়েছির আসর। শুধু বাবার জন্য, বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর এমন সুযোগ তো সচরাচর ঘটেনা। অ্যাট লিস্ট রিসেন্টলি ঘটেনি। ও ডক্টরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এমন সময় ডক্টর সিনহা নিজেই বলে উঠলেন – আজ আর বোধহয় চান্স নেই। অনির্বাণ বুঝতে পারল, ওকে চলে যেতে বলা হচ্ছে।

আপনার ছেলে চলে গেছে, অমলকৃষ্ণ বাবু। এবার চোখ খুলুন। সিস্টার এসে আলতো স্বরে বলল।

কিন্তু বেড নাম্বার থার্টি থ্রি-এর পেশেন্ট চোখ খোলেননি। সিস্টার দরকারী কিছু কাজকর্ম করতে করতে খেয়ালই করেনি যে পেশেন্ট রেসপন্স করেনি। হঠাৎ ঘুরে অমলকৃষ্ণ বাবুকে দেখেই সিস্টার কিছু একটা আন্দাজ করল এবং দ্রুত পালস রেট মাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মনিটরিং স্ক্রিনের দিকে তাকালে হয়ত বুঝে যেত অনেক আগেই…

অনির্বাণ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে অনুচ্চ স্বরে জানিয়েছিল – বাবা, আমি ধর্মান্তরিত হচ্ছি। অমলকৃষ্ণ বাবু দু বেলা উপাসনা করা শাক্ত। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনেককিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই ধর্মবিশ্বাসটুকু রয়ে গেছে অমলিনভাবে। বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের সময় অপর পরিবারটি শাক্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী কিনা যাচাই করে নেওয়া, আজও এ পরিবারের রীতি। অনির্বাণ বিদেশে চাকরী পেয়ে চলে যাওয়ার আগে অমলকৃষ্ণ বাবু ওকে বলেছিলেন – সব হারিয়ে যেতে চাইলেও পারিবারিক ঐতিহ্যকে হারাতে দিওনা। মনে রেখো এ তোমার শক্তি। এই শক্তিকে উপেক্ষা করলে একদিন না একদিন তার মাশুল গুণতে হবেই।

আজ এই দিনে আমাকে কি শুধু এটুকুই বলার আছে, বাবা? তুমি কি খুশী নও?

খুশী তো অবশ্যই। একথা বলছি কারণ আমাদের বংশে এর আগে কেউ বিদেশে চাকরী করতে যায়নি। তুমিই এই বংশের সর্বাপেক্ষা মেধাবী। আর মেধার চলন কখনো কখনো প্রথাগতর পরিপন্থী। এটা মানবে তো? আমি ভুল প্রমাণিত হলে সবচেয়ে আনন্দিত হব আমিই।

বাবার এই সংশয় অনির্বাণকে আহত করেছিল ভেতরে ভেতরে। অমলকৃষ্ণ বাবু জানতেন তার বড় ছেলে ছোটবেলা থেকেই প্রবল সুযোগসন্ধানী। আর সে কারণেই তাঁর সংশয় ছিল যে এই বংশের প্রথম অসবর্ণ বিবাহের ঘটনা ঘটতে চলেছে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তানের হাত ধরেই। কনিষ্ঠ সন্তান অরিন্দম এক অদ্ভুত মানসিক স্তরে বিচরণ করে। কোনকিছুতেই তার জড়িয়ে থাকা নেই। এ বাড়িতে কী হল, কী হলো না, সেসব থেকে বহুদূরে থাকা যেন এক আগন্তুক সে। কেউ তার ওপর কোনদিন একচিলতে ভরসাও রাখেনি। তার দাদা যে তাকে ভবিষ্যতে আদৌ দেখবে না, এই স্থির সিদ্ধান্তে অমলকৃষ্ণ বাবু পৌঁছেছিলেন, তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতায়। আর তাই অরিন্দমের একটা বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব দান করেছিলেন যোগসত্য মিশনকে এই শর্তে যে, তাঁর মৃত্যুর পর ছোটছেলের সব দায়িত্ব নেবে মিশন। তারা স্বেচ্ছায় রাজী হয়েছিল। অনির্বাণকে জানিয়েওছিলেন সে কথা। অন্য জগতের অভিবাসী হওয়ার চিন্তায় মশগুল অনির্বাণ এই সামান্য প্রাপ্তি হারানোয় মোটেই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়নি।

দুপাশে ম্যাপল গাছের পাতাগুলোয় রং ধরেছে। সারার সঙ্গে চুপচাপ সেই নিঃশব্দ বিথী বরাবর হেঁটে যেতে যেতে অনির্বাণ ভাবছিল, এই কি জীবনের সংজ্ঞা! সারা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, হোয়াট আর ইয়্যু থিঙ্কিং ডিয়ার?

নাথিং বাট ইয়্যু, মাই হার্ট। অনির্বাণের মোক্ষম জবাব।

সারা আবার জিজ্ঞেস করল, আর্নট ইয়্যু রেডি ইয়েট টু ম্যারি মি?

অনির্বাণের উত্তর ছিল, আর্নট উই অলরেডি ম্যারেড, মাই ডার্লিং? আস্ক ইয়্যোরসেল্ফ হু ইয়্যু আর। আনডাউটেডলি উইল গেট দ্য রিপ্লাই ফ্রম দ্য হার্টকোর, ইয়্যু আর মাইন।

সারা অনির হাতের তালু ছেড়ে গোটা হাতটাকেই ব্রততীর মত আঁকড়ে ধরল। রাস্তা এসে থামল এক বিশাল প্রাসাদের সামনে। সারাদের বাড়ি। গেটের সামনে লেখা রয়েছে – জর্জ উইলিংস্টোন, শার্লট উইলিংস্টোন, সারা উইলিংস্টোন। চারদিকে অপূর্ব বাগানের মাঝখানে, সামনে মখমল সবুজ ঘাসের প্রবেশপথ নিয়ে বাড়িটি যেন একটি পিকচার পোস্টকার্ড। অনির্বাণ জাস্ট হাঁ হয়ে গেল। সারা আবার হাত ধরে টানল – প্লিজ কাম অনির্বাণ। সারার মধুর বিকৃতিতে অনির্বান সম্বিত ফিরে পেয়ে হেসে বলল – সিওর।

অনির্বাণ যে কলেজে লেকচারার, সে কলেজের ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম জর্জ উইলিংস্টোন। সারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পেছনে অনেকগুলো অঙ্ক মিলিয়েছিল অনির্বাণ। লেকচারার হিসেবে তার জনপ্রিয়তা অল্প কয়েকদিনেই এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, অন্য অনেকের মতই সারাও আকৃষ্ট হয়েছিল এই সুপুরুষ ও বাগ্মী প্রফেসরের প্রতি। অনির্বাণ সকলকে ছেড়ে সারার প্রতি ঝুঁকেছিল। সেই কারণের কাছে অমলকৃষ্ণ বিশ্বাসের কথার ছ্যাঁকাও উপশম বয়ে আনে। সারার মা শার্লট অনির্বাণকে প্রথমেই ‘মাই সান’ ডেকে নিখাদ আন্তরিকতায় মুড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জর্জ উইলিংস্টোনের পাইপ ঠোঁট থেকে সরেনি। চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে অনির্বাণকে দেখে নিয়ে হাতে ধরা নিউজপেপারেই মনোনিবেশ করা সমীচীন মনে করেছিলেন তিনি। সারাকে আর ওর মাকে অনির্বাণ তার অপূর্ব বাক্যজালে জড়িয়ে ফেলেছিল স্বভাবমতই। ডিনারের পর জর্জ উইলিংস্টোন সরাসরি অনির্বাণকে বললেন, ইয়্যু উইল হ্যাভ টু বি কনভার্টেড টু ম্যারি সারা।

অনির্বাণের উত্তর যেন ঠোঁটের গোড়াতেই ছিল। ও ফটাস করে বলে বসল – উই লাভ ইচ আদার অ্যান্ড দেয়ার্স নো কোশ্চেন অফ কনভার্শন নেসেসারী। জর্জ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে অনির্বাণ আবার বলল, স্টিল আয়্যাম রেডি হোয়াট ইয়্যু সে, স্যার, বিকজ মাই রিলিজিয়ন টিচেস টু এমব্রেস এনি ফর্ম অফ প্রেয়ার টু রিচ দ্য অলমাইটি। জর্জের মুখে বিজয়ী হওয়ার নির্বোধ উদ্ভাস। অনির্বাণের ঠোঁটেও একটা ক্রুর হাসি খেলে গেল। সারা একটি পাখির মত খুশীতে খলবল করে উঠল। শার্লটও দৃশ্যতই খুশী।

অমলকৃষ্ণ বাবু একটাও কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন, এ আমার পাপ। আমারই পাপ। এরপর ওখান থেকে উঠে চলে গেছিলেন। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘদিনের বয়স্ক আশ্রিত দীনুকাকা এসে বলেছিল, তুই এখন আয় বড়বাবু। বুঝতেই তো পারছিস, এই ধাক্কাটা নিতে সময় লাগবে।

অনির্বাণ কিছু না বলে বেরিয়ে এসেছিল। আবার ঢুকে গিয়ে দীনুকাকার হাতে কিছু টাকা আর ওর ফোন নাম্বার লেখা কাগজের টুকরোটা দিয়ে বলেছিল, বাবাকে বলতে হবেনা আমি দিলাম। তোর কাছে রইল দীনুকাকা। সময়ে অসময়ে লাগতেও তো পারে। যেকোন দরকারে আমাকে ফোন করতে দেরী করবি না।

কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেও অনির্বাণ ভিজিটার্স লাউঞ্জে বসে ছিল একাই। ওর পুরনো সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বাবা ছোট থেকেই অরিকে বেশী প্রেফার করে এসেছে। অথচ অনির্বাণ পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। এর কারণ ও কখনোই বোঝেনি। বাবা যেদিন সব সম্পত্তি অরির নামে করে দেবে বলে জানালো, সেদিনও এর ইমপ্যাক্ট ফিল করতে পারেনি। আজ উইলিংস্টোন প্যালেসের মালিক, চার্চভিল স্কুল অফ ইকনমিক্সের ভাইস চ্যান্সেলর, ফুটফুটে দুই সন্তানের পিতা, সারার মত অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী এবং যাবতীয় জাগতিক ঐশ্বর্যের বিপুল ভান্ডার নিয়েও অনির্বাণ কি কোথাও একা! ওর ধর্মান্তরিত হওয়াকে বাবা যে মেনে নিতে পারেনি, এ বলার অপেক্ষা রাখেনা। নিতে পারার কথাও নয়। কিন্তু জীবনে ওঠার রাস্তা থেকে দু একটা পাথরের টুকরো খসে যায়ই। তাছাড়া বাবা তো কখনোই অনির ওপর ভরসা করেনি। যদিও ওর দুই ছেলেকে বাবা দেখতে চেয়েছিল। দীনুকাকা জানিয়েছিল। ভেবেছিল এবারই সারা ও দুই ছেলেকে নিয়ে আসবে। হয়ে উঠল না। আর কি সুযোগ হবে কখনো?

মিঃ অনির্বাণ বিশ্বাস একবার ডঃ এ. সিনহার চেম্বারে দেখা করবেন। যান্ত্রিক ঘোষণায় চমকে উঠে অনির্বাণ।

আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে দিন মিঃ বিশ্বাস। হি ইজ নো মোর। অনির্বাণ গভীর বিষাদে ডুবে যেতে যেতে উপলব্ধি করল, অভিমানের সুতোটাও ছিঁড়ে গেল শেষ পর্যন্ত।

অরিন্দম ছোট ছেলে, কিন্তু ও-ই বাবার মুখাগ্নি করবে। নার্সিংহোমের সব খরচ অনির্বাণ করলেও ও আজ বাবার ছেলে নয়। হিন্দু রিচ্যুয়ালসে একজন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীর কোন অধিকার থাকতেই পারেনা। অরিন্দম এসে অনির্বাণের কাছে চুপ করে দাঁড়ালো।

কিছু বলবি, অরি?

দাদা।

হ্যাঁ, বল।

আমার ভাললাগছে না। আমি এসব করতে পারব না। কথাটা শেষ হতে না হতেই অরিন্দম দৌড় লাগালো। শ্মশানে উপস্থিত সকলকে হতচকিত করে বাবার দাহকার্যের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে নিয়মের গণ্ডী ছাড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সন্তান। যে রয়েছে, সে ত্যজ্য। কয়েকজন ছুটল অরিন্দমকে ধরে আনতে। অনির্বাণের মনে হল, বাবা ওকে তো বটেই, অরিকেও কখনো ভালবাসেনি। কেন বাবা?

অনির্বাণের পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। বের করে দেখল, ওর বড় ছেলে পিটার হোয়াটসঅ্যাপ করেছে – গ্র্যান্ডপাস ফিউনারেল ইজ ওভার?

অনির্বাণের দু চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে নেমে আসছে গালের ওপর দিয়ে। মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে ও চশমা খুলে চোখ ঢেকে ফেলল। খুব কান্না পাচ্ছে। খুব…

দীনুকাকা এসে ওর কাঁধে হাত রাখল।

মিশনকে খবর দিয়েছিস, দীনুকাকা? বৃদ্ধ নীরবে মাথা হেলিয়ে জানালো, দেওয়া হয়েছে। পুরোহিত এসে জিজ্ঞেস করল, কী করা হবে এখন? আর বেশিক্ষণ ডেডবডি রাখা যাবেনা।

এর উত্তর অনির্বাণের জানা নেই।

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse