একটি ব্যক্তিগত সেতাররঙা ঝড়

একান্ন, বাহান্ন, তেপান্ন… আহসানের চিরকুট পড়া গুনতে, গুনতে, গুনতে কেমন এক ঝিম আসে চোখে। যেমন ঝিম লাগে পাটিতে স্থবির শুয়ে কৃষ্ণপক্ষের নক্ষত্ৰ গুনার কালে। সেই যে তখন থেকে চিরকুট হাতে বসে আছে মানুষটা, যেন প্রাচীন মেগালিথ, পৃথিবীর মহান পাথর।

 

ছোট্ট বিরতির মতো দেয়ালের সেতার বাজানো রিয়াকে চোখ দিয়ে দুলিয়ে দিচ্ছে এক কি দুটো বার। আর চিরকুট বুঝি এক ধাঁধা, মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে আনমনে।  চিরকুট বলতে ধার করা প্ৰেসক্ৰিপশন প্যাডে লেখা একটা লিস্ট। হাতের লেখাটা ভাই দিহানের তবে জানানগুলো রিয়ার-

 

হীরের বাগদান আংটি

দুটো সরু হার

দাদীমার দেয়া সীতাহার

বালা দুই জোড়া

জোড়া সাতেক সোনার দোল

দুজনের ছ’টা সোনার আংটি

তেত্রিশটা শাড়ি (গোলাপী জামদানিটা বাদে)

পয়ত্রিশ হাজার টাকা- নীলগিরির জন্য

 

আর মোটে দশ দিন, আট ঘন্টা, ঊনিশ মিনিট, আটান্ন সেকেণ্ড পর ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কত পরিকল্পনা আহসানের, গোছগাছ, কত নামতা পড়া। রিয়া এখনও পাহাড় দেখেনি। কাঠখোট্টা বস ছুটি না দিলে এমনিই চলে যাবে, থোরাই কেয়ার। সম্ভাব্য পরিকল্পনা বাদ দিয়েও আজকের দিনটা একটা গতানুগতিক রোমাঞ্চকর দিন হওয়ারই কথা ছিল। টেবিলে তিনশ পঞ্চান্নতম প্রেমপত্র কিংবা ছোট একটা কবিতা থাকার কথা ছিল। কথা ছিল আজও টিপটা আহসানই পড়িয়ে দেবে, শাড়ির কুচি ঠিক করে পেটের তিলে ছুঁয়ে দেবে খানিকটা ঘূৰ্ণিঝড়, আরও বৃষ্টি হলে তুমুল ভিজে ঠাণ্ডা বাঁধাবে। বোন তিহানের হাতে কিছুটা ধাতস্ত হওয়া শোবার ঘরে কোথাও হয়ত এখনও ছিটকে আছে গোলাপি জামদানীটা, পায়ের জমিনে যার উপচে পড়া ফুল। সন্ধ্যায় শ্যামলের বউভাতে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। বিয়ের আগে এইসব সামাজিকতা আনুষ্ঠানিকতা বরাবর এড়িয়েই গেছে আহসান। এখন আর অমন পারে না বলে বড় ভাবী ওর এই বদলে যাওয়ায় খোঁচা দেয়, ‘সুন্দরী বউ থাকলে সবারই অমন বদল হয়। লোককে সুন্দরী বউ দেখানোয় গর্ব আছে না?’

 

 

আহসান ওসব চোরাকাটা গায়ে মাখে না। ভালোবাসাকে প্ৰশ্নবোধক চিহ্নের সামনে দাঁড় করানোর জন্য লোকের অভাব হয় না। এই যেমন কাঠখোট্টা লেখকও ঢুকে পড়েছে ওদের ব্যক্তিগত ঝড় ন্যাতানো ঘরে। অবশ্য আর সব ঘরের মতো এ ঘরে ঝড়ের জোড়ালো ছাপ নেই। এটা রিয়ার রেওয়াজের ঘর। এক জানলা রোদবৃষ্টি, জ্যোৎস্না আর  রিয়ার বেড়াল ‘বাগদান’ ছাড়া কে আর অমন হাতপা এলিয়ে বসেছে এখানে! ওদের ভালোবাসা? যে ভালোবাসাকে আহসান নিংড়ে নিতে চেয়েছে, শুষে নিতে চেয়েছে তার সমস্ত জলকণা। তিন শব্দের বিবাহকে ও করতে চেয়েছে প্রেমের পুরাণ। রিয়া ওর কোলে বাতাসে দোল খাওয়া ফুলের মতোন হেসে উঠে বলতো, ‘তোমার ভালোবাসার একটা পরীক্ষা হওয়া উচিত।’ জয়ী হবে সে ভরসা নয় অহংকারই ছিল আহসানের। কেবল ঝড়ে আটকা পড়ে অফিস ক্যাফেতে  স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি খাওয়া অমন কিস্তি দিতে পারে না! হিমেল ভাই ফেরার পথে ফোঁড়ন কেটেছিলেন, ‘ঝড় নয়, মিস আনিকা ম্যাডামই আহসানের মতো বউ পাগলকেও একটা কফির অজুহাতে আটকে রাখতে পেরেছে।’

 

আহসান জানে ওসব মিথ্যে বাতাস, উড়িয়ে নিতে চায়। সমুদ্ৰকে ভালোবাসে যে নাবিক, সমুদ্রের ঝড়ের সাথেও তাকে বোঝাপড়া করতে হয়। সত্যি তো এই- রিয়ার তৃষ্ণায় বুক হয়ে আছে সাত মরুভূমি। সেই যে‌ দেখেছিল একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে চার্চের ফোয়ারায় ভিড় করেছিল বাহান্নটা তৃষ্ণার্ত কাক। কী যে অস্থিরতা! যদি তলোয়ার পেত ওরা, একজন আরেকজনের মাথা কেটে বুঝি পান করতো লাল জল।

 

তেমন তৃষ্ণা নিয়ে সেও তো খুঁজে চলেছে ফোয়ারা।‌ সত্যি তো এই- ঠিক এই মূহুর্তে একেকটা ফেসবুক নোটিফিকেশনের শব্দ শিলা বৃষ্টির মতো ঢেকে দিচ্ছে তার মগজ। ‘তুমি উড়ে গেছ আমার আকাশে মেঘের গল্প পুষে’- ক্যাপশান জুড়ানো ওদের যুগল ছবিতে কত লাইকস, ঈর্ষা পড়লো এবার? পাঁচশো, এক, দুই হাজার?

 

‘কী করতেছে দামড়াটা বউয়ের কাছে না গিয়া? আমারে নিয়া চল নাতবউয়ের কাছে। গজব পড়ুক, গজব পড়ুক, এত বড় ক্ষতি করলো। আহারে অমন কোমল বউটা।’- তিনতলা থেকে নেমে আসার ভারের সাথে আরও সব ভার নিয়ে বুড়ো দাদী চেঁচায়, বিলাপ করে। আহসানও ভাবে কী করছে ও এখানে! অতল তৃষ্ণায় বুক না তার হয়ে গেছে বাহান্নতম কাক! বাগদানটা সেই কখন থেকে নিথর পড়ে আছে, বোধকরি ওকেও ডক্টরের কাছে নিতে হবে। রিয়াকে বাঁচাতে বাগদানও যখন যুদ্ধ করছে, আহসানের মন তখন ভাসছিল এক কাপ কফির উষ্ণতায়!

 

ডাকাতের ঘটনা, লোকগুলোর নিখুঁত বিবরণ, যা নিয়ে গেছে সব পুলিশকে বলা হয়ে গেছে। তেহান বলছিল ভাবী সব করেছে- আশ্চর্য মনের জোর। বলাৎকারের পড়েও হাসপাতালে শুয়ে থাকা রিয়া তো এমনই। আহসান যতটা উপচে পড়া, রিয়া ততটাই গভীর। তবু লিস্টে আর কিছু বাদ পড়লো কি না আহসানকে দেখে নিতে বলেছে রিয়া। সে বধুয়া কেমন করে বুঝে যায় পুরুষের ভেতর? কী করে বুঝে নিয়েছে ওদের সত্যি দীর্ঘ এক পাহাড় পাড়ি দেয়ার আছে!  রিয়া একদিন চিঠিতে লিখেছিল- পুরান দিনে ভালোবাসা নামে সত্যি এক নারী ছিল। একদিন দস্যুর হাতে আটকা পড়েছে নারী, ছুটে চলেছে তার যুবরাজ উদ্ধার করতে। ভালোবাসা তখন চিঠি লিখেছিল মেঘে, ‘আমি অপেক্ষায়। তোমার পথে দ্বিধা, সন্দেহ, মোহ- বল্লম হাতে ওরা একেকটা যোদ্ধা। যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তুমি পাবে মৃত ভালোবাসা। যদি বড়ো বেশি দেরী করো, হয়ে যাব স্বাতী নক্ষত্রের আলো, জনম জনম সহস্ৰ করুণ ঝিনুকের সাথে উঠে আসতে হবে তোমাকে বৰ্ষার রাতে শুধু এক ফোঁটা আমাকে ছুঁবে বলে, আর যদি নির্বাসন দাও…’ জানো, এখানেই ছুটে যায় মেঘের বাকিটা চিঠি অনন্ত ধাঁধা রেখে।

 

অথচ আহসান চিরকুটে চোখ রেখে খুঁজে চলেছে কি নেই ওর। চিরকুটের চারপাশে বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে একেকটা প্রশ্ন, একেক জন লাল সেপাই। ওর যে মালা গাঁথার ছিল। কত যত্নের পরে ও দেখে ওরা চলে গেছে থালার শেষকটা ফুল নিয়ে। আহসান ক্ৰোধে, ক্ষোভে, বিপন্নতায় একটা আধুরা মালা নিয়ে ডুকরে উঠে ‘আমার খোয়া গেছে ফুল। ওরা আমার ফুল নিয়ে গেছে, ফুল’… কিছু শেষ করুণ মিঞাও ডেকে ওঠে পাশে। থেমে যাওয়ার পরেই ঝড় বুঝি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। ঝড়ের শেষেই বোঝা যায় ঝড় কতোটা ব্যক্তিগত হয়। মধ্যবর্তী গাঢ় ঝড়ে ওপাশের রিয়াকে কেমন ঝাপসা মনে হয়। রিয়া যেন ভেঙে ভেঙে হয়ে গেছে অজস্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তারপর মিশে যাচ্ছে ঐ লাল সেতারে, তোলপাড় হচ্ছে গান- “তুমি মোর পাও নাই পরিচয়/ তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়”…

 

বাগদানের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্নে তলিয়ে যাওয়ার কালে আহসান হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় ঐটুকু মায়াবী সেতার। কিন্তু সেতার- সেও আজ লাল সেপাই। ভালোবাসার শরীরে বল্লম হাতে খুঁচিয়ে তুলেছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন-  ক্লান্ত, দেরী, নাকি নির্বাসন?

তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse