এলোমেলো হাওয়ার দিনে

জামার পকেট থেকে টিকিটটা গড়িয়ে পড়ার সময় গল্পটা শুরু হতে পারতো। কিন্তু আরও একটু আগে থেকে শুরু করলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না।

বেশিদূর যেতে হবে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাঁচমিনিটের হাঁটাপথ। একটা বড় বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তথাগত অনুভব করলো আজও এলোমেলো হাওয়াটা বইছে। এইসব দিনে তথাগত কিছু না কিছু বিপদে পড়ে। এসব কথা বৌকে জানায়নি কখনও। কিন্তু এসব দিনে তথাগত সতর্ক থাকার চেষ্টা করে। কোন দিক থেকে সমস্যা আসবে বোঝার চেষ্টা করে। খুব একটা লাভ হয় না অবশ্য।

গতসপ্তাহে অফিসে অডিট নিয়ে ঝামেলা চলছিলো। ফাইলের স্তুপে ডুবে যেতে যেতেও সে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো লুপহোলগুলো সারানোর। সে বড় হ্যাঙ্গামের কাজ। তবে তথাগত প্রায় সাত আটবছর অডিট সামলে এখন কিছুটা গ্রিপে এনে ফেলেছে। বসও বেশ সন্তুষ্টই ছিলো। কিন্তু শুক্রবারে এসে সব ঘেঁটে গেলো। একটা পুরনো প্যারা কে যেন ভাসিয়ে দিয়েছে, বজ্জাত চ্যাটার্জিই নির্ঘাত। অর্ডার, ফাইল কিছুই পাওয়া যায় না। এদিকে সন্ধের মধ্যে দিল্লীতে মেল না পাঠাতে পারলে বস ঝাড় খাবে। সে ব্যাটা সিগারেটে ঘন ঘন টান দিতে দিতে লম্বা করিডোরে পায়চারি করছে আর তথাগতর টেবিলের দিকে মিসাইলের মতো নজর ছুঁড়ে দিচ্ছে। সব ঝামেলা মেটাতে মেটাতে রাত আটটা বেজে গেলো। বাস পেতে পেতে সাড়ে আটটা। প্রায় দশটা বেজে গেলো বাড়ি ঢুকতে। মনোরমা চুপচাপ তোয়ালে হাতে ধরিয়ে আবার সোফায় গিয়ে বসলো। স্নান করে মাথা মুছতে মুছতে মনে পড়লো আজ মনোরমার জন্মদিন। সন্ধ্যায় একটু বেরোনোর কথা ছিলো। ছেলে মেয়েরা একটু আনন্দ করবে, কাছের রেস্টুরেন্টে ডিনার করবে, কিছুক্ষণ নদীর ধারে বেঞ্চে বসবে। এই। মনোরমার হতাশ মুখটা দেখে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সকালে বাসস্টপে হাওয়া বইতে দেখেই বোঝা উচিৎ ছিলো, কিছু গোলমাল হবে।

এরকম মাঝেমধ্যেই হয়। কখনও বসের ঝাড় জোটে, কখনও বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়, কখনও বা হয়ত ছেলের স্কুলে গার্জেন কল হয়। হবেই কিছু একটা। ব্যাপারটা যেন খানিকটা অভ্যাসই হয়ে গেছে।

আজ সকালে যখন হাওয়াটা উঠলো আর বাসে উঠতে গিয়ে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের পা মাড়িয়ে দিলো তখনই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ঝামেলাটা শুরু হবে। কিন্তু ভদ্রলোক একবার তথাগতর দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে নেমে গেলেন। তিনটে স্টপ পেরিয়ে তথাগত বসার জায়গা পেলো। জানলার ধারেই। যাক, আধঘন্টা শান্তিতে যাওয়া যাবে। খোলা জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আমেজে তথাগতর চোখ বুঁজে এলো। হঠাৎ পাশ থেকে একটা প্রশ্ন এলো কানে – আমার হাতটা একটু ধরবেন, প্লিজ! তথাগত চমকে তাকিয়ে দেখলেন, পাশের ভদ্রলোক কখন উঠে গেছেন। একটি অল্পবয়েসী যুবতী বসে আছে। বেতসলতার মতো শরীর। পরিপাটি করে শাড়ি পরা। পানপাতা মুখে অল্প দুঃখ কুমকুমের মতো আটকে আছে। মেয়েটি আবার বললো – আমার হাতটা একটু ধরবেন?

তথাগত যারপরনাই অবাক হলেন। এ আবার কীরকম আবদার! চেনা নেই, জানা নেই। বাসভর্তি লোক কী ভাববে? কতরকম ধান্দবাজ গিজগিজ করছে চারদিকে। হয়ত ওর সঙ্গীসাথী এই বাসেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আবার কথা না শুনলেও হয়ত চিৎকার করে লোক জড়ো করবে। মহা মুশকিলে পড়া গেলো!

মেয়েটা এর মধ্যে নিজে থেকেই ওর হাতে তথাগতর হাত জড়িয়ে নিয়েছে। কী নরম! কী ঠাণ্ডা! তথাগতর শরীর থেকে সব উষ্ণতা যেন হু হু করে মেয়েটার করতলে ছড়িয়ে  যাচ্ছে। মেয়েটা চোখ বুঁজে রয়েছে। গলার সরু চেন নিঃশ্বাসের তালে তালে উঠছে, নামছে। অন্যমনস্ক থাকার জন্যও বটে আবার পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক করার জন্যও তথাগত মেয়েটির সঙ্গে খুচরো আলাপ জমানোর চেষ্টা করতে লাগলো। নিজের অফিস সম্বন্ধে, বাড়ির লোকের ব্যাপারে নানা গল্প করতে লাগলো। মেয়েটা কোনো কথা বলছে না। কিন্তু শুনছে যে তা মাঝেমাঝে ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসি থেকে বোঝা যাচ্ছে। আধঘন্টা কেটে গেলো এভাবে। তথাগতর স্টপ আসতেই মেয়েটা হাত ছাড়িয়ে নিলো। আপনার স্টপ এসে গেছে। তথাগত ঘাড় নেড়ে নেমে এলো। অফিসে ঢুকে খেয়াল হলো, বাসে আজ টিকিট কাটাই হয়নি। ছি ছি ছি! কনডাক্টর হয়ত ভুলে গেছে। কিন্তু ও কীকরে ভুললো! হাওয়া বইলে ঝামেলা কি হবেই!

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবারই মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। ওই ঠাণ্ডা হাতের পাতা, বুকের ওপর পড়ে থাকা চেন, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা অদ্ভুত হাসি তথাগতকে কাজে মন বসাতে দিচ্ছে না। তবু রোবটের মতো কাজ করে যায়। আচ্ছা, মেয়েটি কি কোনো বিপদে পড়েছিলো? কিন্তু সেক্ষেত্রে তথাগতর সঙ্গেই নেমে যাওয়া স্বাভাবিক ছিলো না! মেয়েটি বিবাহিতা না অবিবাহিতা তাও বোঝা গেলো না। শুধু মনে আছে, আঙুলগুলো সরু, নরম, ভেজা পাথরের মতো ঠাণ্ডা।

দুপুরে টিফিনের পরে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে গিয়ে পকেট থেকে একটা বাসের টিকিট পড়ে গেলো। আরে, এই বাসেই এসেছে তো আজ! টিকিট কাটতে ভুলে গেছিলো তো! টিকিটটা ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখে পেছনে খুদি খুদি অক্ষরে কীসব লেখা। জানলার ধারে আলোর কাছে এসে পড়লো – আজকের টিকিটটা আমিই কেটে দিলাম। আজ আর কোনো ঝামেলা হয়নি তো! কাল আবার হাতটা ধরবেন, প্লিজ।

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় টিকিটটা আঙুল গলে উড়ে গেলো ময়দানের দিকে। গল্পটা এখান থেকেও শুরু হতে পারে।

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse