এয়ো স্ত্রী
সাগরিকা মুখার্জি
।১।
-“হাউ ডেয়ার ইউ! আই হ্যাভ পেড ফরটিসেভেন বাকস ফর দিস রিচুয়াল অ্যাণ্ড ‘এয়ো’স। অ্যান্ড হোয়াট ডিড ইউ ডু?” দম নিতে থামল রোহিত গাঙ্গুলী, তাঁর টকটকে ফর্সা মুখ রাগে গনগনে আঁচের মত।
– “আপনি একটু শান্ত হন স্যার, ডোন্ট ওরি স্যার,আমি দেখেছি।” কাঁচুমাচু মুখে অপ্রস্তুত সুজয় মজুমদার, ‘ফ্রেন্ড ইন্ডিড’ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশনের টিম লিড।
– “কি ডোন্ট ওয়রি হ্যাঁ?কোথা থেকে জোগাড় করেন অল দিস রেন্….? আজকের এই থালি গার্ল যারা, তারাই পরশুর এয়ো স্ত্রী? একটু খেয়াল করবেন তো কাদের আনছেন এইসব রিচুয়ালস করতে। একটা এথিক্স থাকবে না?বোগাস!!” ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে ঔদ্ধত্যের নিশান।
“আমার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে আমি কোনো নোংরা মহিলাকে অ্যালাও করবনা কিছুতেই।” ডিজাইনার পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে ঘোষণা করল কন্যাকর্তা।
– “কেন স্যার, এরা সবাই ম্যারেড ত। কার ব্যাপারে আপনার প্রবলেম স্যার ?” নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া সুজয়।
-“ওই যে ও, পিকক ব্লু শাড়ি, কটা চোখ, দ্যা ফেয়ার ওয়ান, থার্ড ফ্রম দ্যা লেফ্ট ,আই নো হার ভেরি ওয়েল” উত্তেজিত রোহিতের উত্তর।
– “হ্যাঁ স্যার দেখছি, আমাকে জাস্ট আজকের দিনটা সময় দিন”। তাড়াতাড়ি বলে সুজয়।
– ” আজ সঙ্গীত, ইটস ওক্কে। কাল সকালে ওকে এই চত্তরে দেখলে আই উইল নট স্পেয়ার ইউ, মাইন্ড ইট।” হিসহিস করে বলল রোহিত।
-” স্যার, আপনি একদম চিন্তা করবেন না, আমি এক্ষুনি বাপনের সাথে কথা বলছি স্যার। ও-ই আমাদের এইসব ‘এয়ো টেয়ো’ সাপ্লাই দেয়। খুব এফেক্টিভ ছেলে স্যার। ও ঠিক অন্য এয়ো জোগাড় করে দেবে। দরকার হলে আপনার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি” টাই এর নট ঠিক করতে করতে বলে সুজয়।
– “হ্যাঁ তাই দিন।”ঝাঁজ মিশিয়ে বলেন রোহিত।
উফ সেই মেয়ে ।হ্যাঁ, সেই মেয়ে! ওই কটা চোখ ,ওই ঠোঁটের ওপরে তিল, ওই পাকা গমের মত গায়ের রং। কোনোদিন ভুলবে না রোহিত।ভুলবে না ওই কটা চোখের তিরস্কার, কটাক্ষ।রোহিত গাঙ্গুলিকে অবজ্ঞা করে? এত বড় সাহস? পাতি তো একটা রেন্…বিরক্তিতে মুখ বেঁকে যায় তার, অপমানের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে কপালে।
।২।
আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে বছর সাতাশের রোহিত গাঙ্গুলি পাকাপাকি পাড়ি দেয় ডালাসে। যাদবপুরের স্কলার, আই আই টির মাস্টারডিগ্রি ছুঁয়ে সরাসরি মার্কিন মুলুকে। টুকটুকে রং, দীর্ঘ চেহারার রোহিতের বরাবর মেয়েমহলে প্রবল চাহিদা ছিল। নিজেও ফ্লার্ট করত বেশ গুছিয়েই। পরে অবশ্য বাপের সুপুত্তুরটি হয়ে ভবানীপুরের বনেদি ঘরের মেয়ে সুনন্দিতার সাথে বিয়েটা সেরেছিল। ছেলের এই গুণটি সম্বন্ধে বাবা-মা অবহিত ছিলেন, তাই সাগর পার করবার আগে ছেলের বিয়েটা দিয়েই দিয়েছিলেন।
তবে স্বভাব বড় একটা বদলায়নি রোহিতের। কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের সাথে নারীসঙ্গও চলছিল বহাল তবিয়তে। রূপে ব্যক্তিত্বে পৌরুষে কথায় আচরণে সহজেই নারী-মন জয় হয়ে যেত। যথেষ্ঠ খাতির পাওয়াটা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সেই অহং-এ তৈরি শিসমহলে আঘাত হেনেছিল এই মেয়ে। প্রথম প্রত্যাখ্যান।
।৩।
সুনন্দিতার সাথে রোহিতের সম্পর্কের শীতলতা বাড়তে বাড়তে রূপ নিয়েছিল হিমশৈলের। কিন্তু তা চাপা ছিল বাহ্যিক সম্পর্কের সমুদ্রের তলায়। প্রায় বছর পাঁচেক হল সুনন্দিতাও হাঁটুর বয়সী ছেলে অরিত্রর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রথমটায় সংসার, সুন্দর বর, বৈভব,মেয়ে জিনিয়া, গানের স্কুল এইসব নিয়ে সে মেতেছিল। বুঝেও বুঝতে চায়নি রোহিতের স্বভাব। দাম্পত্যের চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে যেতে তার হাত ধরে টেনে তোলে আত্মজা, জিনিয়া। কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ততদিনে বাবাকে চিনেছে, যদিও ওদেশে ওসবে কিছু যায় আসে না। কিন্তু মায়ের ক্রাইসিস বুঝে মাকে নতুন করে বাঁচার দিশাগুলো দেখিয়েছে। একই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী সহস্র যোজন দূরের বাসিন্দা, অথচ বাইরের বিশ্ব তা সেভাবে টের পায়নি।
এইরকম একটা অবস্থায় রোমির আবির্ভাব। কে জানে, নামটাও বোধ হয় আসল নয়। মুখ বিকৃত করে ভাবে রোহিত।
বছর তিনেক আগে রোহিতকে কলকাতায় পাঠায় তার কোম্পানি, এক বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টে। মাস খানেক থাকতে হয়েছিল কলকাতায়। কাজের ব্যাপারে সে বরাবরের পেশাদার। কাজ তুলে নিতে দেরি হয়নি। ক্লায়েন্ট রোমি নামের কটা চোখের মেয়েটিকে ভেট হিসাবে পেশ করেছিল তার কাছে।
জীবনে বহু নারীসঙ্গ সে করেছে। কিন্তু এ মেয়ে একেবারে আলাদা। ফর্সা রং, কটা চোখ, পাতলা ঠোঁটের উপর যুৎসই তিল, দুরন্ত ফিগার, লম্বা চুলের মেয়েটির মধ্যে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা ছিল। অথচ এই মেয়েই বিছানায় ছিল অসম্ভব বন্য। এমন নারীর হাতে জন্ম জন্মান্তর সঁপে দেওয়া যায়। তিনদিন তিনরাত তারা একসাথে ছিল মন্দারমনির এক ফাইভস্টার রিসোর্টে।
রোমিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল রোহিত। বড় টাকা অফার করেছিল। কলকাতায় তার এক-কামরার ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল রোমিকে। চাইলে ওদেশে কাজ জুটিয়ে দেবার কথাও বলেছিল।
কিন্তু সে প্রস্তাব ফুৎকারে উড়িয়েছিল সেই মেয়ে। মাছি তাড়াবার মতো করে বলেছিল “রক্ষিতা করতে চাও সাহেব? অত সহজ? টাকা নিয়ে কাজ করেছি। তোমার রক্ষিতা হয়ে ঠকাতে পারব না পেশাকেও , স্বামীকেও।”
স্তম্ভিত রোহিতের মুখে কথা যোগায়নি কিছুক্ষণ। দাঁত চেপে ঘড়ঘড়ে গলায় সে কেবল বলতে পেরেছিল “বেশ্যার আবার স্বামী!!”
অপমানে লাল সেই মেয়ে খর চোখে কেটে কেটে বলেছিল “শোনো সাহেব, পয়সা দিয়ে দেহ পেয়েছ, মনের অধিকার তোমার নেই, সে জমা রেখেছি কেবল একজনের কাছে। তোমরা যারা মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি কর, তারা কি বুঝবে স্বামী স্ত্রীর বন্ধন? পেটের দায় এ পথে এসেছি, যা প্রাপ্য তার চেয়ে এক পয়সা কমও নেব না বেশিও নেব না। পয়সা দিয়েছ বলে মাথাটা কিনে নাওনি আমার।” পেমেন্ট নিয়ে পিঠ টানটান করে, মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেছিল রোমি, রোহিতকে বোকা করে।
।৪।
সন্ধ্যের মধ্যে রোহিতের সাথে দেখা করে বাপন। শোনায় এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী।
বাপ মা হারা মেয়ে রমা জ্যাঠার বাড়িতে মানুষ। পিডফিলিক জ্যেঠা আর অত্যাচারী জেঠির হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বিয়ে করে গৃহশিক্ষক বীরেনকে। ভালই চলছিল সংসার , পড়াশুনো। কিন্তু বাধ সাধে বীরেনের অ্যাকসিডেন্ট। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে অফিস থেকে সাইকেলে ফেরার পথে ট্রাকের ধাক্কায় হারায় সে তার ডান পা। সাথে হারায় ছবির মতো সংসারের রঙ, রূপ, স্থিরতা, আনন্দ, নিরাপত্তা।
সেই অস্থির সময়ে অসাধ্য সাধন করে রমা ।নানাভাবে টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করে সে। জ্যাঠার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। খুব অল্প সময়ে অনেকগুলো টাকা জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে সে মন প্রস্তুত করে , যে কোনো কাজের জন্য। স্বামীকে বাঁচাতে সে বিসর্জন দেয় তার সমস্তটুকু। বুড়ি শাশুড়ির মুখ-নাড়া, পাড়ার লোকের গঞ্জনা — কিচ্ছু দমাতে পারে না তাকে। দুটো অপারেশনের খরচ, কাঠের পা সব জোগাড় হয় রমার উপার্জনে।
বীরেন এখন সুস্থ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলে মেয়ে পড়ায়। রমা নাম লিখিয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে — বিয়ে পৈতে অন্নপ্রাশন এইসব অনুষ্ঠানে কাজ করে। যখন কাজ থাকে না, বাড়ি বসে সেলাইয়ের কাজ করে।
কেমন ঘোরের মতো লাগে রোহিতের। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে দোলে সে। মেলাতে পারে না কিছুতেই।পরের দিন খুব ভোরে খানিকটা কৌতূহলী হয়েই সে যায় বাপনের সাথে।
বাপনের বন্ধুর বহুতলের দোতলা থেকে দেখা যায় রমাদের এক চিলতে বাড়ির প্রায় সবটাই। রোহিত দূর থেকে লক্ষ করে রমার টালির চালের ঘর। খুব ভোরে উনুনে আগুন দিয়ে রান্না বসায় আটপৌরে শাড়ি পরা রমা। স্বামীকে কাঠের পা পরিয়ে দিয়ে জল তুলে রাখে কলঘরে। স্নান সেরে ঠাকুর পুজো করে, স্বামীর শাশুড়ির খাবার ঢেকে রেখে খেতে বসে সে।
স্নানের স্নিগ্ধতায়, ভিজে চুলে দেবীর মতো লাগে রমাকে।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার গনগনে রূপের ওপর। দরমা ঘেরা দাওয়ায় ভাত চটকায় সে, আটটা বারোর লোকাল ধরতে হবে। স্বামী চা নিয়ে বসে তার পাশে। হাতপাখায় বাতাস টানে। হাসতে হাসতে খেতে থাকে রমা। সুখের হাওয়া বইতে থাকে জীর্ণ ঘরটি ঘিরে। সূর্যদেবও মুচকি হেসে নরম রোদ নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নিকোনো উঠোনে, ভালবাসার ওমে উষ্ণ হতে দেয় সম্পর্ক।
রোহিতের অহং আত্মাভিমান পুড়ে খাক হয়ে যায় ভালবাসার সেই তাপে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায় দাম্পত্যের জলছবিতে।
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১