ওথেলো তাপ

আমি নিঝুমকে খুব সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিই, মাথার পিছনে রক্ত মুছে দিই, ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে শুকনা কাপড় পরিয়ে দিই। দেখে মনে হচ্ছে খুব গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ওর নিথর শরীরটা বিছানায় পড়ে থাকে, ভোরের আলো ক্রমশ ফুটতে থাকে।
আমি বাথরুমের মেঝের সব রক্ত পরিষ্কার করে, হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে পরনের কাপড় চেঞ্জ করে ফেলি। তারপর ধীর পায়ে বারান্দায় যাই| গা শিরশির করা ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। এবার শীত আগেই এসে পড়েছে| সামনের একতলা বাড়ির ছাদে একটি কাক কী যেন খুটে খুটে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে ইঁদুর, নিশ্চই বিষ দেয়া হবে! আমি দৌড়ে ঘরের ভেতর যাই, ডাইনিং টেবিলে পড়ে থাকা নিঝুমের প্লেট থেকে ভাত নিয়ে একটি পলিথিনে ভরি, তারপর পাঁচতলা থেকে ছুড়ে দিই যাতে কাকটি ইঁদুরটাকে না খায়।
হঠাৎ করে আমার প্রচন্ড হাসি পায়, যে মানুষটি একটু আগে একটি আস্ত মানুষকে খুন করেছে; সে কিনা একটি কাককে বাঁচাতে অস্থির হয়ে যায়! হায় বিচিত্র মানুষ! হায়রে মানুষের মন! মানুষের মনের রূপ যদি তার চেহারায় ধরা পড়ত তবে দেখা যেত যে সেখানে কত রকম হিংস্র পশুর বসবাস।
আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি, কারণ একটু পরেই আমাকে এক বিরাট ড্রামা করতে হবে, সবাইকে বুঝাতে হবে যে, নিঝুম বাথরুমে পিছলে পড়ে যেয়ে মারা গিয়েছে। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নিঝুমের পেটটা কিঞ্চিৎ ফুলে আছে।এই পাঁচটি মাস আমি এক নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে পার করেছি। আসলে আমি কাকটিকে বাঁচাইনি, আমি আমাকেই বাঁচিয়েছি, নিজেকে কাকের মতো মনে হয়েছে এতদিন, তাই কাকের দুঃখটা যেন খুব বেশি করে উপলব্ধি করতে পেরেছি। একজন পুরুষের পক্ষে কাকের জীবনযাপন করা যে কতটা লজ্জার তা কেবল ভুক্তোভোগীই উপলব্ধি করতে পারে।
আমি ঘরে যেয়ে নিঝুমের পালস দেখি, নিশ্চিত হই যে ও বেঁচে নেই।| ফ্যানের বাতাসে ওর গায়ের চাদর সরে যায়, আমি ওর স্ফীত পেটের দিকে তাকিয়ে থাকি, বুকের ভেতর কষ্ট হতে থাকে, কেন বুঝতে পারি না। আমি হাসতে পারি না, কাকের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েও আমি হাসতে পারি না। ওর হাত স্পর্শ করি বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে, হাতে এখনো ইলিশ মাছের ঘ্রাণ। খুব স্বাদ করে সর্ষে ইলিশ রেঁধেছিল আজ, কিন্তু খাওয়া শেষ করতে পারেনি, প্লেটে অর্ধ খাওয়া মাছের চাকাটা পড়ে আছে এখনও।
আচ্ছা আমি কি সময়টা পিছিয়ে নিতে পারি? নিঝুমকে ইলিশ মাছটা শেষ করা পর্যন্ত সময় দিলে কেমন হয়? ইলিশ মাছ ওর খুব পছন্দ ছিল, বেচারা খেয়ে যেতে পারল না! ওর মুখটা দু হাতে চেপে ধরে বলি, কেন আমার সাথে প্রতারণা করলে? ভালোই তো ছিলাম আমরা। পৃথিবীতে সবাইকে কি বাবা-মা হওয়ার স্বাদ নিতে হবে?
আমি আমার শ্বশুরকে কল করি, আধঘন্টার ভেতরে ওরা দলবল নিয়ে হাজির হয়। আমার শাশুড়ি ঘরে ঢুকেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিঝুমের কাছে যায়, শ্বশুর এম্বুলেন্স কল করে, আমার শাশুড়ির আর্ত চিৎকারে বাড়ি ওয়ালা দৌড়ে আসে, আমি বলতে থাকি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় একটু আঘাত পেয়েছে, কিছুক্ষণ আগেও ঘুমাচ্ছিল। আমি নিঝুমের হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি|।ডাক্তার এসে নিঝুমের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
সাতদিন পর, আজ মিজান সাহেবকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছি পাশের রেস্টুরেন্টে, মিজান সাহেব বিমর্ষ মুখে ঢোকেন, হাতে একটি ব্রাউন খাম।
কী হয়েছে মিজান সাহেব, মনটা এতো খারাপ কেন? মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে দেবেন। মনে মনে বলি কোকিলের জীবন আর কত দিন মিজান সাহেব? আজই আপনার শেষ দিন। কাঁদুন, মন ভরে কেঁদে নিন।
স্যার ঠিক বলেছেন, আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। আপনাকে আমি বড়ো ভাইয়ের মতো মানি, আর ম্যাডামকে বড়ো বোন হিসাবে শ্রদ্ধা করতাম।আজ যদি উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে এই বিপদে নিশ্চই আমাকে একটা সুন্দর বুদ্ধি দিতেন। এতদিন আমার সংসারটা টিকে ছিল ম্যাডামের বুদ্ধিতেই। ওনার মতো ভালো মানুষ খুব কম দেখা যায়।
স্যার, আপনার মনে আছে আপনি প্রায়ই আমাকে ফাইল আনতে বাসায় পাঠাতেন, একদিন মন খারাপ দেখে ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমিও সব খুলে বললাম। উনি কত সুন্দর একটা সমাধান দিয়েছিলেন; কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ম্যাডাম আমাকে প্রায়ই এটা সেটা খেতে দিতেন, আপনার কথা বলতাম যে, স্যার রাগ করবেন দেরি হলে, পাঁচতলা থেকে তিনতলায় যেতে তো পাঁচমিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। ম্যাডাম কী বলতেন জানেন স্যার? বলতেন, ‘ আরে রাখো তোমার স্যার, তোমার স্যারের স্যার আমি।’ পরে তো আমাকে তুই করেই বলতেন, একটা বড়ো বোন পেয়ে আমিও নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। এই পাষান শহরে তবুও নিজের মতো কাউকে পেয়েছিলাম, যার কাছে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারতাম।
আমি ঘামতে থাকি, একটা খারাপ চিন্তা শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠানামা করে। কিন্তু মিজান সাহেব, আপনি তো আমাকে কখনো বলেননি এসব কথা , আমি তো আপনাকে দেরি হওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন বকাও দিয়েছি।
হ্যাঁ স্যার একদিন আপনি খুব বকেছিলেন, সেদিন আমি ম্যাডামের জন্য আমার বউয়ের তৈরী আচার নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনাদের সন্তান আসবে দেখে আমাদের মনে অনেক আনন্দ এসেছিল, আমরাও আশার আলো দেখেছিলাম, ভেবেছিলাম একদিন আমরাও সফল হবো|। সেদিন ম্যাডাম আমার সামনে বসে আচার খেয়ে, আমার বউয়ের সাথে কথা বলেছিলেন, দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি চলে গেলেন।
মিজান সাহেব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন, কিসের আশার আলো? কিসের সফলতা ?
স্যার আপনার কি মনে আছে, একদিন আপনার খুব মনখারাপ থাকায় আপনাকে সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন মন খারাপ? তখন আপনি আপনাদের বাচ্চা না হওয়ার কথা বলেছিলেন এবং আপনার প্রবলেমের কথা বলেছিলেন। এ কথাও বলেছিলেন যে আপনি ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন। কিন্তু বেশ কয়েক মাস পরে যখন আপনাদের সন্তান আসার কথা জানতে পারলাম তখন আমি আর আমার বউ দুজনেই যেন একটা আলো দেখতে পেলাম কারণ আমিও একই সমস্যায় ছিলাম। গোপনে আপনার ডাক্তারকেই দেখাতে থাকলাম।
আমার সমস্ত শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে, মনে হচ্ছে আমি চেয়ার থেকে পড়ে যাবো। আমার গলা পর্যন্ত একটি চিৎকার এসেও থেমে যায়, প্রচন্ড এক ঝড় আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। আমি মিজান সাহেবের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
স্যার আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে? লাগারই কথা, এমন একজন ভালো মানুষকে আপনি হারিয়েছেন, যে কখনো সন্তান না হওয়ার অজুহাত দিয়ে আপনাকে ছেড়ে যেতে চায়নি। আপনার মন খারাপ, আজ আমারও মন খারাপ। এই যে বাদামি খামটি দেখছেন এটা ডিভোর্স লেটার। শেষ সিটিংয়ে ডাক্তার যখন বলে দিলেন যে আমি আর কখনোই বাবা হতে পারব না তখন থেকেই আমার বউ পাল্টে গেল। আর আজ এই লেটার পাঠিয়েছে।
মিজান সাহেব আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, আজ আপনি একাই খান, আমি বাসায় যেয়ে একটু আরাম করি।
স্যার একটু পানি খান তাহলে ভালো লাগবে।
না মিজান সাহেব আপনি আমাকে জুসের গ্লাসটি দেন। না এটা না, আপনার গ্লাসটি দেন, ভুল করে আমার গ্লাসটি আপনার পাশে দিয়েছে, ওটা চিনি ছাড়া। আমি ঢক ঢক করে জুসটুকু খেয়ে নেই। মিজান সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসি। একটি নিরপরাধ প্রাণ বেঁচে যাওয়ায় এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করি। মিজান সাহেব কাল সকালে একবার দেখা করে যাবেন।আমি উঠে চলে আসি, পেছন থেকে মিজান সাহেবের গলা শুনতে পাই, স্যার ওটাই আমার গ্লাস ছিল, এটা তো চিনি ছাড়া! পরদিন সকালে মিজান সাহেব কিছু লোকজন নিয়ে দরজা ভেঙে আমার লাশ বের করে।

তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse