কণ্ঠই যাঁর নাম 

 

রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে কে না ভালোবাসেন! এ এমন এক গান যা যে কোনো পরিস্থিতিতে গাওয়া যায়, শুনেও শান্তি। আর যাই হোক, রবীন্দ্রসঙ্গীত যেমন কোনোদিনই ফুরিয়ে যাওয়ার নয়, কবিগুরুর বিকল্প খুঁজে বের করা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে যখন ইসরো চাঁদে পাড়ি জমিয়েছে তখনও নিছক পাগলামিরই নামান্তর। রবীন্দ্রনাথের গান তাই চিরদিনের গান, প্রতিদিনের গান ইন্টারনেটের যুগে এসেও আজও সেই ততটাই নতুন যতটা ছিল দাদু-ঠাকুমার যুগেও। বাঙালি-অবাঙালি অনেক শিল্পীই বিশ্বকবির গান গেয়েছেন, যুগে যুগে শ্রোতাদের মনও জয় করেছেন। আসুন এবার একটু পুরানো দিনে ফ্ল্যাশব্যাক করি। পাঠকরা আমার সঙ্গে চলুন সেই ১৯৭৫ সালে আগস্ট মাসে। কলকাতা দূরদর্শনের আরম্ভ পর্বে। না, সময়টা আমার জন্মেরও বেশ কিছু আগে। আমাদের থেকে আরও বছর পনের-কুড়ি আগে যারা পৃথিবীতে এসেছেন তাঁদের অনেকেরই হয়তো স্মরণে থাকবে হাই পাওয়ার মোটা ফ্রেমের চশমা, ধুতি-শার্ট পরা একজন সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন- ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘ওই ঝঞ্ঝার ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে’, ‘জীবনে আমার যত আনন্দ’। অথবা দুরদর্শনের ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই প্রথম গান গাওয়ার (তাও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত! কতটা রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক ব্যাপার!) দুর্লভ সম্মান পেয়ে আরেক প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেনের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘আজি এ আনন্দসন্ধ্যা’। সাদাকালো টিভির দিনের ওইসব গানগুলো নিজস্ব গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে সেদিনের মতো আজও আপামর শ্রোতাকুলকে মুগ্ধ করে যায়। আমরা যারা ভীষণভাবে নস্টালজিয়ায় ভুগি, তাদের কাছে ইউটিউবে দেখা ওইসব সোনার ভিডিওগুলো এই রঙিন দিনে এসেও আজও পুরানো মনে হয় না।

 

সহজ সাবলীল অথচ খুব মিষ্টি গলা। বড়োদের মুখে শুনেছিলাম অনুষ্ঠানগুলো সবারই খুব ভালো লেগেছিল। তখন মোবাইল ফোন আসেনি, রেডিও ছাড়া আর কিছু বিনোদনের উপকরণ আর কিছু ছিল না। টিভিতে ডিডি ন্যাশনাল, আর কলকাতা দূরদর্শন এই দু’খানা মাত্র চ্যানেল (আর হ্যাঁ, টাকিতে বাড়ি হওয়ায় বাংলাদেশের কিছু চ্যানেল বুস্টারে সহজেই ধরা দিত, ওদের নাটক, অভিনয়গুলো এত ন্যাচারাল ছিল যে অস্পষ্ট হলেও স্মৃতিগুলো কিন্তু আজও একেবারে মরে যায়নি) আজকের কেবল টিভির ভাবনা সেদিনে দাঁড়িয়ে যা চিন্তারও অতীত।

 

অনেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন, এখনো গাইছেন, যশস্বীও হয়েছেন, কিন্তু ওঁনাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই বলছি এমন কণ্ঠ নিয়ে কিছু বলার থাকে না, শুধুই অনুভাবের ভাবসাগরে ডুবে যেতে হয়, আর উঠতেই ইচ্ছে করে না। কার কথা বলছি বুঝতে পারলেন! সাগর সেন। ব্যস, এই নামটাই যথেষ্ট, সেখানে আর কিছু দরকার পড়ে কি?

এমন একজন শিল্পী যাঁর ১৯৬৮ সালে ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ গ্রামোফোন থেকে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে মানুষের এতই ভালো লাগে, যে এই গানের পাশে সাগর সেন ছাড়া আর কারো কথা ভাবাই হতো না, এই গান শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত আবেশে জারিত হয়ে শ্রোতারা নিজেদের মধ্যেই নিজেদের হারিয়ে ফেলতেন। আজও তাঁর গান শুনলে আমার কীরকম যেন হয়, লিখে বোঝাতে পারব না। শুধু কণ্ঠের সহজ ব্যপ্তি দিয়েই আমামর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রেমী মানুষের মনের এত কাছাকাছি পৌঁছানো যায়, তা যেন স্বয়ং সাগর সেনই পারেন।

১৯৩২ সালের ১৫ ই মে কলকাতার বরানগরে জন্ম হলেও আদিবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে জমিদার বংশে। বাবা বিজনবিহারী সেন, মা নয়নমঞ্জরী সেনের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। ছোটোবেলা বাংলাদেশে কেটেছে। কলকাতা চলে এলেও নাড়ির টান কিন্তু বজায় ছিল। তবে বাকি জীবনটা কিন্তু কলকাতাতেই অতিবাহিত হয়েছে। পড়াশুনা কলকাতার তীর্থপতি ইন্সটিটিউশন এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। সেইভাবে কারোর কাছে গান না শিখলেও ‘রবিতীর্থ’ -র দ্বিজেন চৌধুরী, এবং ‘আলি আকবর স্কুল অব মিউজিক’ -এ অনেক দিন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতও শিখেছিলেন।

১৯৫৮ তে রেডিওতে প্রথম গান গাওয়া। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে সারা দেশে উৎসব পালনের হিড়িক। মেগাফোন কোম্পানি থেকে সাগর সেনের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড -‘নূপুর বেজে যায়’, আর ‘ওগো জলের রাণী’। সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় ১৯৬৬ সালে রবীন্দ্র কথিকা ‘শাপমোচন’, ১৯৬৭ সালে গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ -য় কণ্ঠদানও করেছিলেন।

এরপর শুধুই ইতিহাস।

আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পেশাগত জীবনে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাইমারী স্কুলে গানের মাস্টারমশাই হিসাবে কাজ করলেও সঙ্গীত ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান আর নিজে হাতে করে তৈরি করা ‘রবিরশ্মি’ গানের স্কুল ছিল সাগর সেনের প্রাণের জায়গা। খুব অল্প দিনেই ‘রবিরশ্মি’-র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাজার অতিক্রম করে যায়। কলামন্দির, শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্রসদনে ‘রবিরশ্মি’-র অনুষ্ঠানে বাণী ঠাকুর, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখরা অংশগ্রহণও করতেন। ‘গানের ঝর্ণাতলায়’, ‘স্বদেশী নেয়ে বিদেশি খেয়া’ এইভাবে গানের নাম দিয়ে ‘রবিরশ্মি’-র অনুষ্ঠানগুলো বেশ প্রশংসা পেত, এরমধ্যে ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের কত প্রতিশ্রুতিবান শিল্পী যে সুযোগ তাঁর হাত ধরে তাঁর সসঞ্চালনায় মঞ্চে নৃত্য এবং গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

বিদেশ থেকেও বেশ কয়েকবার গান গাইবার ডাক এসেছে। ১৯৬২ তে মায়ানমারে( তখনকার ব্রহ্মদেশ), নিজের দেশ বাংলাদেশে তিনবার, ১৯৭৬ য়ে কানাডা, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকায় অনুষ্ঠানও করে এসেছেন।

জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেও নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপন কিন্তু একদমই বদলাননি। নিয়ম করে সকালে উঠে রেওয়াজ করা, গলা ঠিক রাখার জন্য ঠাণ্ডা মশলাদার জিনিস একেবারেই না খাওয়া এইসবের প্রতি ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। নিজে বাঙাল ছিলেন তাই চিংড়ি ইলিশ মাছ ছিল খুব পছন্দের। ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। তাছাড়া নিজে একা হাতে বাংলাদেশের বাড়ির একচালা দুর্গা ঠাকুর বানাতেন, ভালো ঢাক বাজাতেন। অনেকেই জানেন না যে নিজের করা পাবলিক ফাংশনের লব্ধ অর্থ কত দুঃস্থ মানুষের কাজে লেগেছে তা বাড়ির লোককেও জানতে দেননি। সত্তর সালের বন্যায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে অনেক টাকা অর্থসাহায্য করেছিলেন। সবার প্রিয় ‘সাগরদা’-র মন ছিল সত্যিই সাগরের মতো বিশাল।

প্রায় একশো খানা মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। ‘ আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি’, ‘সখী বয়ে গেল বেলা’, ‘প্রথম আদি তব শক্তি’, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’, ‘ওগো ডেকো না মোরে’, ‘ওই মালতীলতা দোলে’, ‘অলি বার বার ফিরে যায়’, ‘তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও’- তাঁর কণ্ঠে এসব গানের এখনো কোনো তুলনা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার ব্যাপারেও যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন এবং আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ওনার বেশ কিছু গানে যন্ত্রানুসঙ্গ বানাতেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস। পাঠকরা চিন্তা করতে পারছেন! যখন দেবব্রত বিশ্বাস যথেষ্ট বিতর্কিত, তাঁর মতো কালজয়ী শিল্পীর গান বিশ্বভারতী নানা অছিলায় ব্যান করছে, তখন সাগর সেন সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে এই দুঃসাহসিক কাজে এতটুকু পিছুপা হননি। চারিত্রিক দৃঢ়তা মনে হয় একেই বলে!

নিজে মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন বলে অন্যান্য গান নিয়ে তাঁর কোনো গোঁড়ামি ছিল না। সব ধরনের এমনকি বিদেশি ভাষার গানও বেশ ভালো লাগা নিয়েই শুনতেন। স্বরবিতানের নোটেশন ধরে গাওয়ার বিষয়েও যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। যা গেয়েছেন প্রায় সবই হিট। পঁচিশ বছরের সঙ্গীত জীবনে কিছু আধুনিক গানও গেয়েছিলেন, যেমন সলিল চৌধুরীর সুরে ‘ কি হলো চাঁদ কেন মেঘে ঢেকে গেল’, বা ‘এই জীবন এমনি করে আর তো সয় না’। কিছু ফিল্মেও গান গেয়েছেন। ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘পরিচয়’, ‘পাকা দেখা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে নিজে গেয়েছিলেন, তেমনি ‘আবির্ভাব’ সিনেমায় নিজেই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ছবিটি অন্য নামে অনেক পরে মুক্তি পেয়েছিল। তাছাড়া আরও দুটো সিনেমায় তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করলেও সেগুলো পরে আর রিলিজ হয়নি। সাগর সেনের সুরেও ভূপেন হাজারিকা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা প্রভৃতি শিল্পীরাও কণ্ঠদানও করেছিলেন। সাগর সেন নিজেও অল্প কিছু আধুনিক গান গেয়েছিলেন। প্রসার ভারতীর আর্কাইভেও সাগর সেনের প্রচুর রবীন্দ্রসঙ্গীত সংরক্ষিত করে রাখা আছে। ‘পরিচয়’ সিনেমায় ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ -এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য বিএফজিএ প্রাইজ পান।

ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী সুমিত্রা দেবী এবং তিন ছেলে প্রিয়ম, প্রীতম ও প্রমিতকে নিয়ে ভরা সংসার হলেও সাগর সেন যখন খ্যাতির মধ্যগগনে তখনই এমন পরোপকারী কর্মযোগী এই নিপাট ভালো মানুষটির শরীরে ১৯৮১ সালে রাজরোগ বাসা বাঁধে। শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করেও সমান তালে মানুষটা গান গেয়ে গেলেও অবশেষে নিয়তির কাছে হার মানতেই হলো। ১৯৮৩ সাল ৪ জানুয়ারি। দিনটায় বোধহয় শীতের আকাশে সঙ্গীতের সূর্যও তাড়াতাড়ি অস্তমিত হয়েছিল। পঞ্চাশ বছর কি চলে এমন শিল্পীর যাওয়ার বয়স! বেঁচে থাকলে হয়তো আরও অনেক ধরনের গান আমরা তাঁর থেকে শুনতে পেতাম। যা হওয়ার নয় আজ আর তা বলে কী হবে! উল্লেখ্য কনিষ্ঠ পুত্র প্রমিত সেন আজ একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী। কিন্তু ছাতাটাই যেখানে মাথার ওপর নেই, সেখানে সন্তানেরা সেই ছায়াটা আর কোথায় পাবে, আর পাওয়াটাও কি আদৌ সম্ভব! এত সুন্দর যাঁর গলা তিনি আরও বেশ কিছু দিন আমাদের সবার মধ্যে থাকলে খুব বিশাল একটা কি ক্ষতি হয়ে যেত! আজ ওঁনাকে নিয়ে লিখতে বসে একটাই প্রশ্ন খালি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ভগবান এইসব মানুষগুলোকে এত তাড়াতাড়ি উপরে টেনে নেয় কেন?

কৃতজ্ঞতা:

‘সাগরের মৃত্যু নেই, সে অমর, সাগর সেনের অকালপ্রয়াণে লিখেছিলেন সুচিত্রা মিত্র’: সরকার, শুভজিৎ, স্বর্ণেন্দু রায়চৌধুরী আর, মুঠোযন্ত্রের দু মুঠো জ্ঞান-অন্ন থেকে যতটা জানা গেছে

 

তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse