কমলাফুলি

 

ইশ, এবারের পুজোটা একদম বানভাসি। দেবীর নৌকোয় আগমন, এবার বৃষ্টি হবে জানাই ছিল। কিন্তু তাই বলে এমন সাতদিনে সাতদিন! রাস্তায় প্যাচপ্যাচে কাদা, মণ্ডপের উঠোনে জল-কাদা, মায়ের একমাত্র পুরোনো গরদের শাড়ির আঁচলেও কাদার ছিটে।

 

ফুলির মনটা আনচান করে। এবারের পুজো নিয়ে তার মনে অনেকগুলো সুন্দর ছবি আঁকা ছিল। সপ্তমীর রোদ ঝলমলে সকাল। ফুলি তার নতুন নরম গোলাপী জামাটা পরে মায়ের পিছুপিছু ছোট্ট নৈবেদ্যের থালাটি নিয়ে মণ্ডপের দিকে যাচ্ছে। তার ভেজা কালো চুলের রাশ পিঠে থাক থাক গড়িয়েছে। জামাটা তার গায়ে একদম মাপ মাপ, বিশাল ঢোলা অথবা বিশ্রি রকমের টাইট নয়। কেউ তার দিকে তাকিয়ে আড়ালে মুচকি হাসছে না অথবা কেউ বলে উঠছে না, “কী রে! এই জামা কোথায় পেলি!” সন্ধ্যারতির বাজনার তালে তালে ছেলেরা ‘কমলাফুলি! কমলাফুলি!’ বলে চেঁচাচ্ছে না।

 

এই পুজোর আগ পর্যন্ত ফুলির একটাই ভাল জামা ছিল। কমলা ছিট কাপড়ের উপর ছোট ছোট হলুদ ফুলছাপ জামাটা মায়ের হাতে বানানো। জামাটা ফুলির পছন্দের ছিল, কিন্তু ওটা পরে বের হলেই পাড়ার ছেলে ছোকরা সব

“কমলাফুলি, কমলাফুলি, কমলা লেবুর ফুল

কমলাফুলির বিয়ে হবে, কানে মোতির দুল!” বলে ছড়া কাটতে থাকে আর ফুলির খুব রাগ হয়। ওর বয়স মাত্র ছয় পেরিয়ে সাতে পড়েছে, তাই ওকে নিয়ে ছেলেরা ছড়া কাটলে বড়রা কিচ্ছু বলে না, বরং হাসতে থাকে। ওর ষোলবছর বয়সী দিদি মালাকে দেখে যখন কেউ “মালা, তুমি কে? তুমি কে?” বলে আওয়াজ দেয়, তখন কিন্তু সবাই চোখ রাঙায়। ফুলি বুঝে উঠতে পারে না মালাকে আবার “মালা, তুমি কে?” জিজ্ঞেস করার মানেটাই বা কী! মালা অবশ্য এটা শুনলেই কেঁদেকেটে চোখ ফুলোয় আর তখন তাকে দেখতে আরও সুন্দর লাগে।

 

ফুলি অথবা মালা কেউই প্রতি পুজোয় নতুন কাপড় পায় না। ওদের অত টাকা নেই। আবার ‘ভদ্রলোক’ বলে চেয়ে-চিন্তেও নেয় না ওরা। তবে অনেকসময় পাড়া প্রতিবেশি কাকিমা মাসিমারা ওদের মেয়েদের পুরোনো কাপড়গুলো মালা-ফুলিকে ডেকে দিয়ে দেয়। সেগুলোর কিছু বড়, কিছু ছোট, কিছু আবার রঙ জ্বলে যাওয়া। একদম নিজস্ব একটা জামার জন্যে ফুলির মনটা অনেকদিন ধরে আকুল হয়ে ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে কতবার প্রার্থনা করেছে সে, “ঠাকুর, এবার যেন পুজোয় বাবা আমায় একটা নতুন জামা দেয়, না, না, আমাকে আর মালাকে নতুন কাপড় দেয়। আচ্ছা, আর মাকেও দেয়। আর বাবার জন্যে জুতো হয়। বাবার জুতোজোড়া একদম ছিঁড়ে গেছে।” শেষপর্যন্ত ঠাকুর তার প্রার্থনার কিছুটা শুনলেন। একরাতে ঘুমে ঢলে পড়ার আগে সে শুনল মা বাবাকে চুপিচুপি বলছে, “ফুলির জামাটা আর গায়ে লাগছে না, এবার পুজোয় ওর জন্য…”। এটুকু শুনতে শুনতেই সে ঘুমের রাজ্যে। ঘুম থেকে উঠে সেকথা সে ভুলেও গেছে। কিন্তু পুজোর এক সপ্তাহ আগে মা যখন তার গায়ে ফিতে বসিয়ে মাপ নিল তখন থেকেই তার বুক ধুকপুক। জামা হবে, নতুন জামা! কী রঙ হবে, কেমন দেখতে হবে! ইশ, কমলা রঙ যেন নাহয় আবার!

 

তারপর যষ্ঠীর দিন মা তার গায়ে জামাটা পরিয়ে দেখল ঠিকমত হয়েছে কিনা। তখনও বোতাম বসানো বাকি, কিন্তু কী সুন্দর জামাটা! গোলাপী রঙের জমিনে নানা রঙের চক্কর। ফুলোফুলো হাত, মা বলে ‘ঘটি হাত’। মায়ের সেলাইয়ের হাত খুব ভাল, সবাই বলে। সেরাতে ফুলি খুশির চোটে ঘুমোতেই পারে না। মা বলেছে আজ রাতেই বোতাম বসিয়ে দেবে। কালকে সকালেই সে নতুন জামাটা পরে পুজো দেখতে যাবে। কিন্তু সেদিন মাঝরাতেই ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মহাসপ্তমীর সকাল যেন জন্মাষ্টমির সকালের মত, ঘন মেঘে ঢাকা আর মুষলধারে বৃষ্টি। মা বলল, “এই বৃষ্টিতে বের হয়ে জ্বর বাধাবি ফুলি, আজকে যাস না। কালকে মহাষ্টমির অঞ্জলি দিতে যাব বরং, ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে যাবে।” অষ্টমি এল, কিন্তু বৃষ্টি ধরল না। বাবা মায়ের চোখে ছায়া ফুলি পড়তে পারে। ওদের ঘরটা নিচু জায়গায়, প্রতি বর্ষায় ডুবে যায়। মা কোনমতে জল ছপছপিয়ে গিয়ে অঞ্জলি দিয়ে এল, কিন্তু ফুলি আর মালাকে নিল না। মালার নাকি শরীর খারাপ, সে পুজোবাড়িতে যাবে না। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলে কিনা শরীর খারাপ! আবার ফুলিকে বলে, “তুই এখনও ছোট, ওসব তুই বুঝবি না!” হুঁহ্! দিদি এসেছেন একখান! শরীর খারাপ না কচু! আসলে নতুন কাপড় পায়নি বলেই… এটুকু ভাবতেই ফুলির আবার দিদির জন্য মন খারাপ হয়, “ইশ, সবার জন্যে নতুন কাপড়-জুতো হতো যদি!”

 

নবমীর দিন ফুলি রীতিমত কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। পুজো শেষ হয়ে গেল, এখনও একদিনও সে নতুন জামা পরে বের হতে পারল না। মা বলল, “উঠোন ভরা জলকাদা, এর মাঝে নতুন জামা পরে বের হবি কেমন করে? আজ একটা পুরোনো জামা পরেই চল, কাল সকালে দশমীর অঞ্জলিতে সবাই আসবে, তখন নতুন জামাটা পরিস।” কিন্তু ফুলি কিছুতেই রাজি হয় না। পুরোনো জামা পরে সে যাবেই না। আজকে কালকে দুদিনই সে নতুন জামাটাই পরবে। তার কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে মা শেষে জামাটা বের করে দিল। মাথার চুলে দুটো কলাবেণী করে দিয়েছে মা গোলাপি ফিতে দিয়ে। পুরোনো ঘোলা আয়নাটায় নিজেকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করে সে, কিন্তু বাইরে এমন মেঘ, ঘরের ভেতরটা একদম আঁধার ভরা। মালাকে একা ঘরে রেখে যাবে না বলে মা গেল না। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়েছে, কিন্তু যেকোনো সময় আবার আকাশ ভেঙ্গে নামতে পারে। বাবা তাই বারবার তাড়া দিচ্ছে, “ও ফুলি, তাড়াতাড়ি আয় মা!”

আয়নায় শেষবার নিজেকে দেখে নিয়ে পায়ে চপ্পলজোড়া গলিয়ে বাইরের উঠোনে পা দিতেই হড়াৎ করে পা পিছলে গেল। এক নিমেষেই নতুন জামা সহ সে কাদায়। বাবা এসে টেনে তুলল, কান্না শুনে মা আর মালা ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। ফুলির বুকটা কষ্টে একদম ফেটে যেতে চাইছিল। অত সুন্দর জামাটা কাদা লেগে একদম বিশ্রি হয়ে গেছে। ঐ দাগ কী উঠবে আর! আর উঠলেও বা কী! নতুন জামা আর ধোয়া জামা কী একরকম!

 

সারাটা দিন সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মা সাথেসাথেই জামাটা খুলে নিয়ে সাবানজলে ভিজিয়েছে। এই বৃষ্টিতে কাপড় শুকোনোও মুশকিল।

 

পরদিন সকালে দূর্গাবাড়ির ঢাকের শব্দে ফুলির ঘুম ভাঙ্গল। ঢাক বলছে –

“ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ ঠাকুর যাবে বিসর্জন!

ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ/ ঠাকুর যাবে বিসর্জন!”

চোখ খুলে দেখল বাইরে এক টুকরো মেঘভাঙ্গা রোদ। মা ডাকছে, “ফুলি, উঠে পড়! অঞ্জলি দিতে যাবি না!” ফুলি উঠতে গিয়ে আবার ঝুপ করে শুয়ে পড়ে। না, এবার সে দুর্গামা-কে দেখতে যাবেই না। কেন মা তার ছোট্ট একটা আবদার শুনল না! কেন সে তার গোলাপি জামাটা পরে পূজো দেখতে যেতে পারল না! যাক, দূর্গামা দলেবলে দোলায় চেপে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক, ফুলি তো আর কিছুতেই তাকে বিদায় জানাতে যাবে না!

 

মালা এসে তাকে টেনে তুলল। উফ, লাল জমিনের শাড়িটায় দিদিটাকে কী সুন্দর লাগছে! “এই দিদি, নতুন শাড়ি কোথায় পেলি? আর তোর না শরীর খারাপ? সেজেগুজে কই যাস?”

“আরে, ওঠ তো তুই! চল স্নান করিয়ে দিই চট করে! আমাকে ভেজাবি না কিন্তু, অল্প অল্প করে জল ঢালবি।”

কিছু ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই মালার তত্ত্বাবধানে তার দাঁত মাজা আর স্নান পর্ব সারা। গায়ে গামছা জড়িয়ে মালা ওকে শোবার ঘরে নিয়ে এল। নতূন শাড়িতে, সিঁদুরে, জ্বলজ্বলে মা নৈবেদ্য গুছিয়ে নিয়েছে। বাবাও পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবীতে মণ্ডপে যাবার জন্যে তৈরি। বিছানার উপর কাগজের প্যাকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা টুকটুকে লাল জামা! কী সুন্দর! কী সুন্দর! নিচে ঘাগড়ার মত ঝালর দেওয়া, গায়ে, হাতে ছোট ছোট আয়না বসানো, একদম স্বপ্নের মত একটা জামা! কেমন করে, কোথা থেকে এল? মা এসে হাত লাগায় এবার। জামা পড়িয়ে, চুল আঁচড়ে দেয়। পুরোনো আয়নাটার উপর একফালি রোদ এসে পড়েছে। লাল লাল আদুরে জামাটায় ফুলিকে যেন কোন দূরের দেশের রাজকন্যার মত দেখাচ্ছে। সাজিয়েগুজিয়ে দিয়ে মা ফুলির কপালে একটা চুমো দেয়। মা সবসময় ঘোমটা দেয় না, কিন্তু মন্দিরে বা পুজোমণ্ডপে যাবার আধঘোমটা দেয়। আজ যেন ঘোমটা একটু বেশিই লম্বা, মাকে কেমন অন্যরকম লাগছে। হঠাৎ করেই দেখে ঘোমটার নিচে মায়ের কানজোড়া খালি। ছোট্ট সোনার কানফুলজোড়া নেই। “ওমা! তোমার কানফুল কই গেল? হারিয়ে ফেলেছ?” মা হাত ধরে টেনে বলে, “আয় তো তুই এখন! দেরি হয়ে গেলে অঞ্জলি দিতে পারবি না!” দূর্গাবাড়ির ঢাকটা বোল পাল্টেছে। ঢাক যেন বলছে-

“কানে মোতির দুল/ কানে মোতির দুল!”

তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse