কাকতালীয়

 

ফোনের আওয়াজটা শুনেই রান্নাঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো বিয়াস। ধুর, সেই একই টেলিকম কোম্পানি, জ্বালিয়ে মারলো। ফোনটা কেটেই আরও একবার কল লিস্টটা দেখে নিলো ও। নাহ্ কোনো মিসডকল নেই। মশলা রাখার সেলফটার এক কোণে ফোনটা রেখে আবার বাসনগুলোয় হাত লাগালো। তবু মনে মনে একটা চরম অস্বস্তি, ওর চোখ মুখেও সেটা ভীষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।

ঘড়ির কাঁটা বলছে বিকেল তিনটে। আর একটু পরেই তিন্নির বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যাবে। মেয়েটাকে সকালে যা হোক করে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে, টিফিন বানানোরও সময় হয়নি। ফলগুলো কেটে রাখলো বিয়াস, তিন্নির আবার পেয়ারা প্রিয়। কলকাতার গরমে শরৎটা আজকাল আর বিশেষ বোঝা যায় না। রোদটা ঢলে পড়লেও এখনও ভালোই তেজ। আরও একবার ফোনটা দেখলো বিয়াস। এখনও কেন ফোনটা এল না! আয়নাতে চোখ পড়তেই কপাল আর চোখের দু’পাশ জুড়ে লেগে থাকা গাঢ় জমাট রক্তের দাগগুলো ভেসে উঠলো। তার সাথে জানান দিলো – আরেকটু অপেক্ষা বিয়াস, আরেকটু; তারপরই তো মুক্তি।

কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফলের আগেই বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মোটা মাইনেপত্র, দেখতে শুনতেও খারাপ না। নাম মাত্র একটা বিয়ে, অ্যাকসিডেন্টে বউটা মারা যায় গতবছর । বিয়াসের মা প্রথমে কিছুটা কিন্তু কিন্তু করলেও পুরোপুরি আপত্তি করেননি। অবশ্য আপত্তি করার সাহসও ছিলো না। ভাইয়ের সংসারে এতদিনের আশ্রিতা মা, মেয়ে। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে তার বেশি স্বপ্ন দেখার সাধ্য বা সাহস কোনোটাই ছিলো না। আর বিয়াস! আলাদা করে ওর মতামত অবশ্য কেউই জানতে চায়নি। বিয়াস বেশ বুঝেছিলো কলেজের গণ্ডীটা পেরোলেই এ বাড়ির চৌকাঠটাও চিরকালের জন্যে পেরোতে হবে। অন্তত মামীর হাবভাবে সেটা বেশ স্পষ্ট ছিল।

বিয়ের একটা বছর পরেও তন্ময়কে ঠিক বুঝতে পারতো না বিয়াস। এই ভালো তো এই খারাপ। ওর চাকরি, বাইরে থাকা, টাকার হিসেব এইসব নিয়ে প্রশ্ন করলেই এড়িয়ে যেত। আর নিতান্তই এড়িয়ে যেতে না পারলে ঝগড়া, চেঁচামেচি, এমন কী গায়েও হাত তুলতো। তিন্নি হওয়ার পর এগুলো কিছুটা কমতে শুরু করলো। বিয়াসও আর যেচে ঝামেলা বাড়াতো না। তিন্নিকে নিয়েই ব্যস্ততা শুরু হলো।

এরমধ্যেই আরেকটা বিষয় নিয়ে বেশ মেতে উঠলো বিয়াস। তিন্নি তখন বছর দুয়েক। টাইফয়েড থেকে সদ্য সেরে উঠেছে বিয়াস। তন্ময়কে অনেক বলার পর অবশেষে একটা কাজের লোক রেখেছে। তা ছাড়া এখন তিন্নিও রয়েছে, সব কাজ একা সামলানোটা বেশ দায় হয়ে পড়ে। রিমঝিম পাশাপাশি আরও দুটো বাড়িতে কাজ করে সব শেষে ওদের বাড়ি আসে। স্বভাবে চনমনে হলেও বেশ গুছিয়ে কাজ করে মেয়েটা। বিয়াসের থেকে বয়সে ছোট অথচ দুই ছেলের মা। বড়োটা থ্রি , ছোটটা এই স্কুলে ঢুকেছে। বরটা কোনো কাজ করে না। আগে তাও স্কুলভ্যান চালাতো, বাচ্চা পাচারের কেসে ফেঁসে তাও গেল। অনেকদিন জেলে ছিলো, এখন সারাদিন চোলাই চুল্লুতে ডুবে থাকে। যে কটা টাকা রিমঝিম কাজ বাড়িগুলো থেকে পায়, তাতেও ওর নজর। এই সব গল্প রিমঝিমের কাছেই শোনা। কাজের পর চায়ের গ্লাসটা নিয়ে বারান্দায় বসলে চাওয়া না পাওয়ার এই আক্ষেপগুলো গড়গড় করে বলে যায় ও। যেদিন রিমঝিমের জ্বর হয়, বিয়াস জানে বরটা আবার মেরেছে। পরের দিন ঠোঁট আর মুখ জুড়ে কালশিটে দাগ নিয়ে কাজে আসে মেয়েটা। বিয়াসের খুব ইচ্ছে হয় ওর জন্য কিছু একটা করতে, তবে সবসময় ইচ্ছে থাকলেও যে উপায় হয় না। আর যেখানে ওর নিজেরই হাত বাঁধা। বেশ কিছুদিন ধরে ভাবার পর বিয়াস ঠিক করলো ও লিখবে। আর কিছু পারুক না পারুক অন্ততঃ কলমের আঁচড়ে কিছুটা প্রতিবাদ তো হবেই। বাংলার ছাত্রী বিয়াস, লেখার আগ্রহটা সেই ছোট থেকেই। তবে সেভাবে এক্সপ্লোর করার সুযোগ পায়নি, এখনও পায় না। আর আজ হঠাৎ করেই রিমঝিম আর রিমঝিমের কষ্টগুলো ওর এই ইচ্ছেটাতে নতুন করে চাগাড় দিলো।

বাস্তবের রিমঝিম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখতো, বিয়াস তাদের গায়েই ডানা লাগালো। জিতিয়ে দিলো এই ছাপোষা মেয়েটাকে। গর্জে উঠলো ও, বেরিয়ে এলো এঁদো গলির ভ্যাবসা ঘরটা থেকে। দুই ছেলেকে নিয়ে আরেকটা লড়াই শুরু হলো। ঠিকে কাজ ছেড়ে একটা ছোটো গুমটি দোকান। হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই হলো শুরুটা। কচ্ছপের গতিতে এগোতে থাকলো একটা কাঙ্খিত জীবন। অবশ্য বাস্তবটা বদলালো না, দিনের শেষে সেই একই রোজনামচার গল্প রিমঝিমের।

মাসখানেক পরেই একটা ব্যস্ত সকালে ফোনটা এলো, লেখাটা সম্পাদক নিয়েছেন। আগামী মাসেই গল্প সংকলনটি প্রকাশ পাবে। তন্ময়কে খবরটা দিলেও ওর মধ্যে খুব একটা উৎসাহ দেখলো না বিয়াস। তিন্নি অবশ্য খুব খুশি সেদিন। ও তো ড্রেসও ঠিক করে নিয়েছে, কোনটা পরে যাবে বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে। রিমঝিমের পাত্তা নেই সকাল থেকে, ওদিকে বিয়াসের আর তর সয় না। কতক্ষণে জানাবে ওকে, গল্পের নায়িকা তো সেই। সারাদিন মেয়েটা এল না, বিকেলে তিন্নি ফিরলে বিয়াস ওকে নিয়ে একটু বেরোলো সামনের পার্কটাতে। আর ওখানেই কিছু পরিচিত লোকের মুখে শুনলো – রিমঝিমের বরের একটা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে সেদিন সকালেই। নেশায় ছিল, অন্যদিকে একটা লরি, হাসপাতাল অব্দিও নিয়ে যেতে পারেনি।

এরপরে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। বিয়াসের এখন বাড়ি ভর্তি পড়ুয়া। বাংলা পড়তে আসে, নিজেরও একটু চর্চা হয়। হাতে কিছু টাকাও আসছে, তন্ময়ের না শুনতে শুনতে ক্লান্ত বিয়াস একটু একটু করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। তিন্নি এখন টু পেরিয়ে থ্রি’তে। রিমঝিম এখনও আসে, তবে এখন শুধু বিয়াসের কাছেই কাজ করে। বাকি কাজগুলো ছেড়ে দিয়েছে। সেলাই শিখছে, পিকো, ফলস ছেড়ে এখন ব্লাউজেও হাত দিয়েছে । পুজোর আগে তো বেশ কয়েকটা অর্ডার পেয়েছিলো। বিয়াসও চেনা জানা কয়েকজনকে জোগাড় করে দিয়েছে। তন্ময়ের সাথে দূরত্বটা আরও বেড়েছে। এখন তো প্রায়ই একগলা গিলে বাড়ি ফেরে। অধিকাংশ দিনই ডিনারটা বাইরে বরাদ্দ। বাড়ি ফিরলে, ওর গায়ে তখন অন্যরকম একটা গন্ধ। বিয়াস চেনে ওটা, আজকাল প্রায়ই এই উগ্র পারফিউমের গন্ধটা নাকে আসে ওর। ঘেন্নার গাছটা ওর শরীর বেয়ে বাড়তে থাকে।

সেদিন সারাদুপুর ঘুম এল না, গরমটাও বেড়েছে। ডায়রি আর কলমটা নিয়ে বসলো, অনেকদিন কিছু লেখাও হয় না। মাথার মধ্যে একটা বিষয় কয়েকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বুড়ি দিদা, ওদের ফ্ল্যাটের পাশের গলিতেই আরও দুটো বাড়ির পরেই থাকে। একটা টালির বাড়ি, জরাজীর্ণ অবস্থা, পেছনে কিছুটা খোলা জায়গা। বুড়ি দিদার ভালো নামটা অবশ্য কখনও জানা হয়নি। পাড়াশুদ্ধ লোক ওই নামেই ডাকে। খুব ভালো ডাল-বড়ি বানায়। বিয়াস তো মাঝে মাঝেই ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসে। কখনও আবার দামও নেয় না, বলে – “এটা আমার তরফ থেকে খাওয়ালাম।” আজকাল বড় ফ্যাসাদে পড়েছে মহিলা। ভাইপোটা প্রায়ই এসে হুমকি দিয়ে যায়। প্রোমোটারের কাগজে সই না করলে বাড়ি থেকে উঠিয়ে দেবে বলেছে। একটাই ছেলে ছিল, তাও গতবছর মারা গেছে। নার্ভের কোনো একটা অসুখে ভুগছিলো বহুদিন। বুড়িদিদার কাছেই বিয়াস ওর ভাইপোর কথা শুনেছে। সামান্য কয়েকটা টাকা দিয়ে ওরা পুরো বাড়িটা লিখে নিতে চাইছে, তারপর প্রমোটারকে দিয়ে দেবে। শপিং কমপ্লেক্স উঠবে। বুড়িদিদার সম্বল বলতে এই সামান্য বাড়িটাই। নিজে একটা ঘরে থাকে, বাকি দুটো ঘর ভাড়া। ভাইপোটা ইদানীং ভাড়াটিয়েদেরও হুমকি দিতে শুরু করেছে। বিয়াস বলেছিল পুলিশে জানানোর কথা, তবে ওরা যা, থানা পুলিশ এইসব নিশ্চয় আগেই সেটিং হয়ে গেছে। কলমের পেছনটা কামড়াতে কামড়াতে বিয়াস ভাবলো গল্পের বুড়িদিদাকে কীভাবে সুরাহা দেওয়া যায়। ব্যস, অনেকক্ষণ ভাবার পরে ঠিক করলো বুড়িদিদার এক পাড়াতুতো পাতানো ভাই, তার লম্বাহাতের প্রয়োগে মন্ত্রী অব্দি খবরটা পৌঁছে দিলো। ব্যস বাকিটা এর মধ্যেই সেট হয়ে যাবে। আর পাড়াতুতো ভাইয়ের সাথে আলাপের ক্রেডিট বুড়িদিদার “স্পেশাল চানাচুর”, সব সত্যি লিখতে নেই।

বিকেল থেকে লোডশেডিং। বাইরে বৃষ্টিটা এখনও কমেনি। তিন্নিকে ডিনার করিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে কিছুক্ষণ হলো। তন্ময় এখনও ফেরেনি, অবশ্য এটা ওর সন্ধ্যে। মোম আলোর শিখাটার মতোই বিয়াসও কাঁপছে। ওর গোটা শরীরে একটা অস্বাভাবিক অস্বস্তি হচ্ছে। একটু আগেই খবরটা জানতে পেরেছে। ওদের পাড়ার হোয়াটস্যাপ গ্ৰুপেই কেউ একজন লিংকটা দিয়ে লিখেছিল – “কী সাংঘাতিক ব্যাপার, তাও আবার পাড়াতেই। শুনলাম ওর বউটার নাকি কারোর সাথে কিছু চলছিল, সেই দুঃখেই নাকি গলায় দড়ি নিয়েছে। অবশ্য পাপ যাবে কোথায়? বুড়িদিদাকে কম জ্বালিয়েছিলো?” কাঁপা আলোয় নিজের মুখটা আয়নায় দেখতে পেল বিয়াস। ওর যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখে মুখে বারবার হাত দিচ্ছে, এটা স্বপ্ন নয় তো! ড্রেসিং টেবিলের ওপর সম্পাদকের চিঠি, বুড়িদিদার গল্পটা তাদের বসন্ত সংখ্যায় মনোনীত হয়েছে।

এরপর বহুদিন কিছু লেখেনি বিয়াস। লেখার সূত্রে যে কয়েকজন চেনা জানা হয়েছিলো তারা অবশ্য মাঝে মাঝেই তাগাদা দেয়। তবুও সাহসে কুলোয়নি ওর। রিমঝিমের বর, বুড়িদিদার ভাইপো, এই সব মৃত্যুগুলোই কি কাকতালীয়? গল্পগুলো মনোনীত হওয়ার সাথে সাথেই ওর গল্পের ভিলেনরা হঠাৎ করেই…. আচ্ছা লেখার সময় ও নিজেও কি মনে মনে এটাই চেয়েছিল! এসব কথা অবশ্য কাউকে বলা যায় না, কে কী বুঝে বসবে কে জানে! আপাতত ঠিক করেছে এইসব গল্প আর লিখবে না। এবার পুজো সেপ্টেম্বরে, তিন্নির পরীক্ষাটা হলেই কোথাও একটা ঘুরে আসবে ভাবছে বিয়াস। তন্ময় অবশ্য রাজি হবে না ও জানে, তা না হোক ওরা নিজেরাই যাবে। টিউশনির টাকা থেকেই হয়ে যাবে। এখন আর তন্ময়ের কাছে হাত পাততে হয় না।

সেদিন তন্ময় আগেই বাড়ি ফিরেছে। ডিনারের পরে টেবিলেই বসেছিলো, বোতল আর গ্লাস নিয়ে। বিয়াসের ফোনে আইআরসিটিসির মেসেজটা ঢুকতেই ফোনটা খোলার চেষ্টা করলো তন্ময়। দু’চোখ ভরা সন্দেহ আর কৌতূহল। অনেকরকম প্যাটার্ন দিয়েও যখন ফোনটা আনলক করতে পারলো না , চিৎকার শুরু করলো। “কোথায় যাবে? কেন যাবে? না কোথাও যাওয়া হবে না” – এইসব অজস্র প্রশ্ন আর কথার পর শুরু হলো জেদ। নেশাও তখন তুমুলে। বিয়াস শুরুর দিকে পাত্তা না দিলেও তন্ময়ের অসভ্যতা ওকেও বোধহয় পেয়ে বসলো, ও-ও চেঁচিয়ে উঠলো -“বেশ করবো, একশোবার যাব। অন্য মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে যখন ফেরো… ” ওর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই এক গ্লাস স্কচের আকস্মিক ঝাপটা এসে পড়লো মুখের ওপর আর তার সাথেই তন্ময়ের হাতের একটা সপাট আঘাত। হাতটা উঁচু করতে গিয়েও পারলো না বিয়াস। দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে ততক্ষণে।

অনেক রাতে বিছানা ছেড়ে উঠলো বিয়াস। তন্ময় মরার মতো পাশে ঘুমোচ্ছে। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে বিয়াস। তন্ময়ের পাশে আর শুতেও ইচ্ছে করে না ওর। ফোনটা নিয়ে বারান্দায় এলো। একটা টেক্সট করলো অনির্বানকে, ”দেশের গল্প” পত্রিকার সম্পাদক। লেখালেখির সূত্রেই ওদের আলাপ। বিয়াস টাইপ করলো – কালকের মধ্যেই পুজো সংখ্যার লেখাটা পাঠাচ্ছি অনির্বাণ’দা”। বারান্দার আলোটা জ্বেলে ফোনের notepad-টা খুলে বসলো, ও জানে তন্ময় ভোরের আগে উঠবে না। মনস্থির করলো গল্পটা ও লিখবে।এই গল্পটা আরও ভালো করে গুছিয়ে লিখতে হবে, কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। এটা যে ওর খুব কাছের গল্প, নিজের গল্প।

আরেকটু বিয়াস, আরেকটু, তারপরই তো মুক্তি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও বিড়বিড় করে উঠলো বিয়াস। ও জানে আজ কিছু একটা হবেই। সকালে অনির্বাণদা ফোনে বললো, “লেখাটা এবার পুজো সংখ্যায় থাকছে।” আর তারপরই ওর উত্তেজনা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কত কী তো হয় এই শহরটায় , একটা অ্যাকসিডেন্ট আজ না হয় বেশিই হলো।

সারাদিন কোনো কাজের ফোন বা মেসেজ কিছুই এলো না, তিন্নি সময়ে বাড়ি ফিরলো। তন্ময় এখনও ফেরেনি। ওর অবশ্য ফেরার কোনো সময়ও নেই। এখনও আশা ছাড়েনি বিয়াস, একটা দুর্ঘটনা হোক না। অনেক রাতে কলিং বেলটা বাজলো, আইহোলে চোখটা রেখেই চমকালো বিয়াস। কোনোমতে নিজেকে সামলে দরজাটা খুললো।

“কী হয়েছে তন্ময়ের?”
“আরে ভাববেন না বৌদি, একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে অফিস পার্টিতে। তাই ওপর অব্দি ছেড়ে গেলাম। শুইয়ে দিন। আর চিন্তা করবেন না, সকালে একদম চাঙ্গা হয়ে যাবে।”

শরৎ হলেও আজকাল বারোমাস নিম্নচাপ। আজও সকাল থেকেই বৃষ্টি। তিন্নির ঘুম ভাঙলে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো ও, ছ’টাও বাজেনি। পাশে মাম্মাম বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মাম্মামকে অনেকদিন পরে বিছানায় নিজের পাশে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো তিন্নি। মাম্মামের গায়ের গন্ধটা প্রাণ ভরে নিল। চোখের কোণের ফোলা জায়গাটায় একবার আলতো করে ছুঁলো। মনে মনে বললো – ”বাবানটা কেন তোমাকে এভাবে মারে গো! তোমার তো কষ্ট হয় বল? বাবান কি বোঝে না!”

তিন্নি উঠে বাথরুমে গেল একবার। সকালে ঘুম ভাঙলেই এটা ওর রোজকার অভ্যাস। ভোরের আলো ছায়া জানালার কাচের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে মেঝের ওপর। বাইরে একনাগাড়ে বৃষ্টির টিপটিপ।

বাথরুমে ঢোকার আগেই হোঁচট খেলো তিন্নি। নিজেকে সামলাতে গিয়ে চিৎকার করলো –
“মাম্মাম বাবান পড়ে গেছে, মাম্মাম রক্ত, মাম্মাম। ”

তিন্নির চিৎকারটা শোনার আগেই বিয়াস উঠে পড়েছিল। শুধু অপেক্ষা করছিলো। ও জানে মেয়ের মতোই ওর বাবারও একটা স্বভাব আছে, চারটের আশেপাশেই বাথরুমে যায়, প্রতিদিন। বিয়াসও তার ঠিক আগেই বাথরুমে গিয়েছিলো। আসাবধানতায় অলিভ-অয়েলের শিশিটা কখন যেন হাত লেগে পড়ে যায়। বাথরুমের ফ্লোরটা তেলে ভেসে যাচ্ছিলো। খুব সাবধানে পা ফেলে ফিরে এসেছিলো তিন্নির বিছানায়, ঠোঁটের কোণায় লেগেছিলো একটা ক্রুর হাসি। ভোররাতে একটা আওয়াজও পেয়েছিলো, তন্ময়ের গলা। কান্না, সাথে গোঙানি। তবু ওঠেনি বিয়াস। এবার তিন্নির চিৎকারটা এই ব্যাপারটাই আরও নিশ্চিত করলো।
কোলের বালিশটা চেপে মনে মনে বললো বিয়াস – সরি তিন্নি, তোর মাম্মাম আর কাঁদবে না। এবার লড়াইটা আমাদের।

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Utsa Dey
Utsa Dey
2 years ago

অনবদ্য একটা লেখা ❤.. এইভাবেই কলম চলুক তোমার ❤

Subhra P Sanyal
Subhra P Sanyal
2 years ago

Oshadharon, shobta jodi KAKTALIO hoyeo thake, tobuo drishti nikhyep ta jothajoto, bhishon thrilling, monta bhore galo, will wait till next

Mousumi
Mousumi
2 years ago

শক্তিশালী লেখনি।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse