কাটাকুটি
রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়
বল কে?
বিকট শব্দে দরজা দেওয়ার আওয়াজের চেয়েও জোরে চীৎকারটা যেন আছড়ে পড়ল প্রতিমার ওপর।
প্রতিমা চুপ করে আছে কিন্তু বিন্দুমাত্র বিব্রত নয়। ওর দুচোখে এক চিলতে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
চুপ করে আছিস যে?
প্রতিমা তবুও কোন কথাই বলছে না। যেন প্রশ্নকর্তাকে আরো একটু উদ্বিগ্ন করে দিতে চাওয়ার মজাই পেতে চাইছে সে।
তুই বলবি না কি…
না কি? আচমকাই গম্ভীর হয়ে প্রতিমার পাল্টা জিজ্ঞাসায় প্রশ্নকর্তা যেন থতমত খেয়ে গেছে। নরম স্বরে জানতে চাওয়া হল, ‘আমি কি জানতে পারি না?’
প্রদোষ!
ঘরের ভেতর যেন মেঘহীন আকাশ থেকে এক অপ্রত্যাশিত বজ্রপাত হল। পাথরের মত স্থানু হয়ে গেছে উপস্থিত দুজনেই। নিকষ নৈঃশব্দের গভীরে, আরো গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ছাদের ওপর থেকে ভেসে আসা পায়রাদের একটানা ডাকে দুপুর ফুরিয়ে আসছে, আলোও। সত্যের ধারালো ফলার ওপর এই অবস্থানে একচুল এদিক ওদিক হলেই অবধারিত রক্তপাত।
#
মা, ও মা, কোথায় গেলে?
খুশীতে উদ্ভাসিত মুখে প্রতীক এসে সুখবরটা দিল। ইউনিভার্সিটি অফ কেম্ব্রিজে গবেষক-শিক্ষকের পদে ও আবেদন করেছিল। ওর শিক্ষাগত মান, এযাবৎ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, ইংরেজী বাচনক্ষমতা ইত্যাদি বহু মাত্রার নিরিখে তা মজ্ঞুর হয়েছে। আগামী মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে ওকে যোগদান করতে বলে অ্যাসাইনমেন্ট লেটার এসেছে। বেশ কিছু দরকারী কাজকর্ম সেরে ফেলে ওকে কয়েকদিনের মধ্যেই প্রস্তুত হতে হবে। চৌধুরী বংশের ছেলে বিদেশ যাচ্ছে। প্রতিমা স্বাভাবিকভাবেই উৎফুল্ল। কিন্তু আনন্দের ভেতরদিকের দালানে এক ছায়ামেদুর প্রতিফলনের তেরছা রশ্মিপাত!
প্রদোষের কথা মনে পড়ছে। আজীবন দাদা তার জন্য সবার অলক্ষ্যে যা করেছে, তার জন্য প্রতিমার প্রস্তাবে দুবার ভাবেনি সে। আর প্রতাপ তো সবসময় তাকে নিঃশর্ত সমর্থন যুগিয়ে গেছে।
#
প্রতাপের সঙ্গে প্রতিমার বিয়ে হওয়ার সময় নামের মিল দেখে সকলেই রাজযোটক বলেছিল। দিগন্তপুরের ডাকসাইটে চৌধুরী জমিদার বংশের উত্তরপুরুষ হয়েও প্রণব নারায়ণ চৌধুরী লোহার ব্যবসায় নাম করেছিলেন। বিশাল তিন মহলা চৌধুরী ভবনেই থাকতেন সপরিবারে। পারিবারিক রমরমা ঝরে গিয়েও কম ছিল না। তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রমিতা বড়। তারপর প্রতাপ ও ছোট ছেলে প্রদোষ। প্রমিতা ও প্রতাপ পিঠোপিঠি, বছর দুয়েকের ব্যবধান ওদের। প্রদোষ অনেকটাই ছোট, প্রতাপের চেয়ে প্রায় চার বছরের।
প্রতাপের যখন ষোল বছর বয়স, তখন ক্যানসারে আক্রান্ত প্রণব নারায়ণ মারা গেলেন বিস্তর চিকিৎসার পরেও। পরের বছর ওনার স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরীও হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিল প্রমিতা। মাত্র আঠারো বছরের হলেও প্রমিতার চরিত্রে অদ্ভুত এক ধাতব কাঠিন্য ছিল। দিনে দিনে ধার আরো বাড়ছিল। সংসার ও ব্যবসার এতদিনকার ঢিলে গিঁটগুলো আঁটোসাটো হয়ে উঠছিল তার হাতে। প্রতাপের এসবে কোন ভ্রূক্ষেপ ছিলনা। স্টার মার্কস পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করার পরও প্রতাপের পড়াশোনা আর এগোয় নি। প্রমিতার মনে হয়েছিল সংসারের এই অবস্থায় পড়াশোনা চালানোর মত বিলাসিতা করা যায়না। যদিও প্রমিতার সাথে প্রতাপের বন্ধুত্বের প্রলেপ মাখানো সম্পর্কটায় সেভাবে কোন আঁচড় পড়েনি।
ঊনিশ বছরের জন্মদিনের দুপুরে প্রতাপকে এক বিশেষ উপহার দিতে চেয়েছিল প্রমিতা। কেন যে তার এমন ইচ্ছে হয়েছিল ঈশ্বর জানেন! হয়ত অনাদৃত বইটিরও ইচ্ছে হয় পাঠক তাকে হাতে তুলে নাড়াচাড়া করুক, বাঁধাইয়ের আঠার গন্ধ নিক, শেষপর্যন্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে পড়ে ফেলুক এক নিঃশ্বাসে। কি পরিমাণ দুর্লভ কল্পনাতন্তুতে মহার্ঘ্য অক্ষরমালা গাঁথা প্রতিটি পৃষ্ঠায় – এসব বিদগ্ধ তত্ত্বকথা বুঝতে না চেয়েই সে মরিয়া হয়ে ওঠে একবার কেউ অন্তত মলাট থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আসুক!
কিন্ত একুশ বছরের গনগনে আগুনের সামনে দাঁড়িয়েও যখন পাড় ভেঙে নদীটা দুর্দান্ত দামাল হয়ে উঠল না, লোকালয় ভাসিয়ে নিতে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে এলনা, প্রমিতা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল এ বোধহয় লাজুক প্রতাপের আড়ষ্টতা, বন্ধুর মত হলেও দিদি তো! শেষে সত্যটা উপলব্ধি করে প্রতাপকে জড়িয়ে ধরে সে হাউহাউ করে কেঁদেছিল। সে কান্নাই ছিল জন্মদিনের উদযাপন। কান্নারও যে কত ডাকনাম হয়!
প্রকাশ্যে প্রতাপ ও প্রমিতার প্রথাগত সম্পর্ক এরপরও স্বাভাবিকই থেকেছে। বিচ্যূতির দাগ লুকিয়ে রাখতে চাওয়াই তো যাপনের অপ্রকাশ্য বর্ণমালা। কখনো কখনো স্নান সেরে আসার পর ভেজা কাপড় লেপটে থাকা শরীরের দিকে বা বুকের খাঁজের দিকে বা অনাবৃত ধপধপে পায়ের ডৌলের দিকে প্রতাপের চকিত দৃষ্টিপাতে উপোসী প্রমিতার মধ্যে জেগে উঠতে চাইত ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার অপ্রতিরোধ্যতা, কিন্তু সব স্রোতই কি ভাসানের হয়!
মুহূর্তের ভুল থেকে আর কোনো অবধারিত রক্তপাত ঘটেনি বটে। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত ইচ্ছেরা গোপনে এক অন্য আশ্রয়ে বেড়ে উঠছিল। দুর্জ্ঞেয় মন কখন যে গতিপথ বদলে ফেলে বিপর্যের মূর্তিমান প্রতীক হয়ে ওঠে, কে রাখে তার খোঁজ! প্রতাপ প্রিয় শখ পড়াশোনার গভীরে ডুবে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডীতে না ঢুকেও প্রতাপের পড়াশোনার পরিধি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল, কারো জন্য নয়, নিজের জন্যই সে জ্ঞানসাগরে মুক্তোসন্ধানী হয়ে বেঁচে ছিল। প্রমিতার ছিল সর্বময় কর্তৃত্ব করাতেই আনন্দ।
#
নিজের সঙ্গে একা হওয়ার মুহূর্তগুলোয় প্রমিতার মনে পড়ত একটি মুখ। প্রমিতার বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন তিনেক আগে পেছন মহালের মেহগনি জঙ্গলে যেদিন শেষবার দেখা হয়েছিল মানুষটার সাথে, সেদিন দুজনের মাঝখানে উপস্থিত হয়েছিল জমাট অশ্রুর একটা আস্ত কেলাস, এত ভারী যে তাকে কিছুতেই সরাতে পারেনি ওরা। কোথায় যেন একটা ডাহুক ডেকে উঠেছিল সেসময়। করুণ নিস্তব্ধতা আরো ঘনিয়ে উঠেছিল। দুজনের কেউ কারো দিকে তাকাতে পারেনি, অসমাপ্তি রেখেই ফিরে গিয়েছিল অব্যক্ত শূন্যতার সুনসান পথ ধরে। এই দেখা হওয়া যেন একটা সম্পর্কের এপিটাফ ছিল। যার সামনে নীরব আর্তিতে একটি টাটকা গোলাপ রেখে ফিরে যেতে হয়। প্রমিতার বিয়ে আটকানোর বা তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মত নায়কোচিত ক্ষমতা মানুষটার আদৌ ছিলনা। এ তো তার অপরাধ নয়, সে তো এভাবেই গড়ে ওঠা একজন নিপাট সাদামাটা মানুষ। এই নিস্তরঙ্গ আটপৌরে ঝিলটাকেই তো একদিন ভালোবেসেছিল প্রমিতা। প্রমিতার দুঃসাহসী স্বভাবের পাশে মুখচোরা মানুষটার অবস্থান যেন বড় বেমানান ছিল। তবু ভালোবাসার তিরতিরে ঠোঁটে অস্তরাগের মায়াবী আভায় যখন এক অমর্ত্য বর্ণালী সৃষ্টি হত, পরিণতির কথা না ভেবেই মাতোয়ারা হওয়ার ধুন উন্মন নিরুদ্দেশের দিকে ধাবিত হত।
এসব কিছু প্রমিতার নখদর্পণে ছিল। তবুও সেদিন তার রাগ হয়েছিল, উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল সব। দুঃখও হয়েছিল। ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল গোটা দিগন্তপুরকেই। একেক সময় যুক্তি, বুদ্ধিরও স্বেচ্ছায় হার মেনে নিতে ইচ্ছে করে। জ্যৈষ্ঠর ঠা ঠা রোদে খা খা পুড়ে যেতে থাকে একা মাঠ…তার কোন সাথী নেই! দীর্ঘশ্বাসে লেখা থাকে সব!
প্রমিতা বিধবা হয়ে যখন এ বাড়িতেই ফিরে এল, তার আঠারো হতে তখনও তিনমাস বাকি। দিব্য আবার তার বিয়ের বন্দোবস্ত করা যেত। কিন্তু প্রণব নারায়ণ তখন রোগশয্যায়, আর জ্ঞানদাসুন্দরী এতবড় দায়িত্ত্ব নিতে পারতেন না। প্রমিতার পরিণতির জন্য নিজেকেই দায়ী করে প্রণব নারায়ণ যেন মৃত্যুকে এগিয়ে এনেছিলেন। এরপর প্রণব নারায়ণ ও জ্ঞানদাসুন্দরীর কদিনের ব্যবধানে মৃত্যুতে গোটা পরিবার এমনভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে প্রমিতার কথা ভাবার আর কারো ফুরসত রইল না।
বিয়েটা প্রমিতার কাছে ছিল ক’দিনের বাসাবদল। এমন একটা দুর্ঘটনা যার কোন স্মৃতি থাকতে নেই। প্রণব নারায়ণের বন্ধুর ছেলে দিবাকরের সাথে ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছিল প্রমিতার। কিন্তু রোজ রাতে একজন মাতালের কদর্য বিকৃতির স্বাক্ষী থাকত প্রমিতা। সকাল হলেই কিছু সংকীর্ণমনা, ঈর্ষাকাতর মানুষের সাথে একসাথে থাকার দমবন্ধ করা দগদগে স্মৃতি ছাড়া বিয়েটা প্রকৃতপক্ষে প্রমিতাকে কিছুই দেয়নি। দুর্বিষহ ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠার মুহূর্তগুলোয় প্রমিতার ভেতর থেকে ঘৃণামিশ্রিত এক দুর্দমনীয় ইচ্ছে জেগে উঠত যে, আপদটাকে আজই…. তাকে পাপের ভাগী হতে হয়নি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে এক ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্টে দিবাকর মারা গেল। সকলের অলক্ষ্যে প্রমিতার আশরীর এক বৈধব্য শান্তি!
দিগন্তপুর ফিরে প্রথমেই খোঁজ নিয়ে প্রমিতা জেনেছিল তার মানুষটা তখন দিব্য সুখে সংসার করছে একজনের সাথে। অপেক্ষা করার কোন নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি না থাকলেও নিরুচ্চারে কি কোন কথাই ছিলনা! সে পারত না কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে! প্রমিতার নাহয় ছিল বাবার কথা দিয়ে ফেলার বাধ্যতার দায়। তার কি ছিল! আঘাত ফেরত এল বিচিত্রমূর্তি হয়ে। এরপর হঠাৎ একদিন মানুষটা হারিয়ে গেল। তার আর কোন খোঁজ পাওয়া গেলনা। প্রমিতা আশ্চর্যভাবে নির্বিকার রইল।
কোন ঘটনার পরতের পর পরত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে বিস্মৃতির অর্ধভেদ্য পর্দায়। কোনও কোনও দিন সেই পর্দা ফুঁড়ে ঘটনার জলছাপ ভেসে ওঠে…বিশ্লেষিত হয় সাম্প্রতিকের দৃষ্টিভঙ্গীতে।
#
ফুলশয্যার রাত্রেই এক অনাত্মীয় ধাক্কায় প্রতিমার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া। কিন্তু যে মানুষটা প্রথম রাতেই তার নববিবাহিতাকে নিঃসঙ্কোচে জানিয়ে দিতে পারে, ‘আমি কিন্তু বিয়ে করতে চাইনি, বিশ্বাস কর। আমি জানি আমার স্ত্রীকে সবকিছু দিতে পারলেও শরীর দিতে পারব না। কিন্তু দিদি আত্মহত্যার হুমকিটুমকি দিয়ে এমন কান্নাকাটি করল যে…ভাবলাম এই রাজি হওয়া যদি দিদিকে শান্তি দেয়…তোমার জন্যও আমার খারাপ লাগছে। তুমি চলে যেতে চাইলে, যেতেই পারো। বাধা দেব এমন সামর্থ্যই বা আমার কোথায়!’ সেই অকপট মানুষটার প্রতি এক গভীর মায়া বোধ হয়েছিল প্রতিমার। ও শুধু মুখ ফুটে কোনক্রমে বলতে পেরেছিল, ‘যাব না।’ প্রতাপের দু’চোখে ছিল এক হেরে যাওয়া পুরুষের কৃতজ্ঞতা।
কেন যে সমর্পিত হয়েছিল সেদিন, প্রতিমা জানেনা। গরীবের ঘরের মেয়ে হলেও রেললাইন তো ছিলই। রফিক চাচার ক্ষেতে ছড়ানোর বিষ কোথায় রাখা থাকত, তাও অজানা ছিলনা ওর। এরপর ওপাশ ফিরে নিঃশব্দ কান্নায় গলে যেতে যেতে সোনার গয়নাগুলো খুলে ফেলা, ফুলের সাজ ছিঁড়ে ফেলা, ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে থাকা মুখময় চন্দনের আল্পনা। আজকের রাতটা নিয়ে বান্ধবীরা বলে দিয়েছিল, ব্যাথার মধ্যেই নাকি তৃপ্তি লুকোনো থাকে! সহ্য করার মধ্য দিয়েই নাকি স্বর্গসুখের হদিশ! কত কি! ও নিজেও কি এক কল্পনার রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাখেনি! সব ও স্বেচ্ছায় ভেসে যেতে দিল…সব…এছাড়া ওর আর কোন উপায়ও তো ছিলনা।
#
প্রথমবারের জন্য কবে ফিরতে পারবি আশা করছিস?
আগে যেতে তো দাও!
দ্যাখ, তোকে যে সবকিছু জানিয়েই ওরা ডেকেছে, এটা অন্তঃত বুঝি। পড়তে না জানলেও লিখতে তো জানি। যদি মাকে তোর জানাতে ইচ্ছে না করে, তাহলে থাক।
ওফ মা! আজকাল তুমি এত অল্পেই রিঅ্যাক্ট করে ওঠো যে…তুলিকে একবার তোমার প্রেসারটা দেখে যেতে বলব।
হ্যাঁ, তুলিকাকে কাল একবার আসতে বলিস তো।
কালই!
দরকার আছে। ভুলে যাবিনা তো? তুই তো এখন ব্যস্ত! নাহলে আমিই ডেকে নিই ওকে।
জানি না। যা ভালো বোঝ কর। প্রতীক রাগ দেখিয়ে চলে যায়। প্রতিমার দুচোখে এক চিলতে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ছেলেটাকে এভাবে খুশী দেখতে বড় ভালোলাগে প্রতিমার। ওর বরাবরের স্বপ্ন ছিল বিদেশের কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবে। স্বপ্ন ছুঁতে পারার আনন্দে প্রতীকের বিভোর হয়ে পড়াটা প্রতিমাকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে তোলে। ঠিক ভুলের হিসেব গুলিয়ে গিয়ে আজ যে আনকোরা প্রতিপাদ্য মিনারের মত সটান উঠে দাঁড়ায়, সেখান থেকে দূরের সবকিছু একই রঙের দেখাচ্ছে। প্রতিমা উপলব্ধি করেন বৈষম্য মুছে আসাই সারসত্য।
#
ফুলশয্যার পরদিন প্রতিমা তার অভ্যাসমত ভোর হতে না হতেই উঠে পড়ে। ঘর লাগোয়া ছাদে যখন ও এসে দাঁড়ালো তখন নবার্কের আলোর পেন্সিলে প্রকৃতির স্লেটে ফুটে উঠছে দিনের হরফ। বিশাল ছাদটার চারপাশে চওড়া রেলিংয়ে পায়রাগুলো বসে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। একটা মিষ্টি হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। চিলেকোঠার পাশটাতেই পায়রাদের বাসার গা বেয়ে ওঠা একটা টুনিফুল লতার ঝিরিঝিরি সবুজ পাতার মাঝে মাঝে গাঢ় লাল ছোট ছোট ফুলগুলো ফুটে আছে। বাড়ির গা ঘেঁষে চলে যাওয়া বাঁধানো রাস্তার ওপাশে ফসল কেটে নেওয়া আদিগন্ত মাঠ, অনেক দূরে একটা নদীর আবছা সিল্যুয়েট…সবাই যেন একসাথে বলছে, চলে যেও না…চলে যেও না…
প্রতিমা অস্ফুটে উচ্চারণ বেরিয়ে এল, যাব না!
ছাদ থেকে ঘরে এসে প্রতাপকে দেখতে পেল না। একজন কাজের লোক ওর চা নিয়ে এলে প্রতিমা বলে দিল, কাল থেকে এখানে দিয়ে যেতে হবেনা। সে মাথা নেড়ে চলে গেল।
প্রতিমা চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় প্রমিতা এলেন।
প্রতিমা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো, সে দৃষ্টিতে আগুনে ক্রোধ স্পষ্ট।
প্রমিতা কি যেন বলতে গিয়েও বললেন না, চলে গেলেন। প্রতিমা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো আবার।
#
এ বাড়ি ঘুরে দেখতে চেয়েছিস শুনলাম। কমলিকে বলে দিয়েছি। ওই দেখিয়ে দেবে সব।
আমি একাই পারব।
তা আবার হয় নাকি? তুই একা পারিস কখনো!
তোমার কি সোজা কথা সোজাভাবে বুঝতে অসুবিধে হয় দিদি?
প্রতিমার জিজ্ঞাসার চাছাছোলা ধরণে প্রমিতা থমকে গেলেন। এ বাড়িতে কেউ আমার সাথে এভাবে কথা বলে না।
এখন থেকে আমিই বলব ধরে নাও। যদি শুনতে না চাও, আমার থেকে দূরে দূরে থেকো। তোমারই ভালো হবে।
ভেতরে ভেতরে এক তীব্র জ্বলন নিয়েও প্রমিতা চুপ করে রইলেন। এই মেয়েকে প্রতাপের বউ করে আনা কি তার আরেকটা ভুল হয়ে গেল!
#
প্রতিমা শাণিত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বুঝে গেল কেউ একজন অনেকক্ষণ ধরেই তার ওপর নজর রাখছে। একবার ছায়াটা সরে যেতে সামান্য দেরী করে ফেলায় ও নিশ্চিত হয়ে গেল। খিড়কির দোরটা দিয়ে ঢুকে ওপাশে যাওয়ার ভান করে প্রতিমা পাশের ভাঙা পাঁচিলের ফাটলের ভেতরে শরীরটাকে নিঃশব্দে সেঁধিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চারপাশ। কাউকে দেখা গেলনা। এরপর একটা শরীর প্রকাশ্যে এল। যেন ওর গতিপথ আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। গদাই! প্রতিমা অবাক হল। সোজা বেরিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। গদাই মাথা নীচু করে জোড় হাত করে বলল, আমার দোষ নিওনা বৌরানী। দিদি বলেছে।
প্রতিমা কঠিন মুখে বলল, এখন থেকে তোমাকে আমার কথামত চলতে হবে। দিদি জানবে তুমি ওনার হয়েই কাজ করছ। পারবে? নাহলে তো অন্য কিছু ভাবতে হবে, গদাই।
গদাই অপরাধীর মত বলে উঠল, আমাকে ক্ষমা করে দাও, বৌরানী। তুমি যা বলছ, তাই হবে। তবে এসব জায়গায় বিষধর সাপখোপ আছে। সাবধানে চলাফেরা কোরো।
পরেরবার তোমাকে সঙ্গে নিয়েই আসব। ঠিক আছে? গদাই হাসিমুখে মাথা নেড়ে চলে গেল। প্রতিমা মনে মনে বললেন, বিষধর সাপখোপ আর থাকবে না। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর।
কিছুক্ষণ পর প্রতিমা ফেরার রাস্তা ধরল পেছন মহলের দিক দিয়ে। জায়গাটা সত্যিই বেশ গা ছমছমে এই দিনের বেলাতেও। অন্ধকার সিঁড়িটার কাছাকাছি যখন এসেছে, ও স্পষ্ট শুনতে পেল একটি পুরুষ কন্ঠের ডাক – বৌরানী। প্রতিমা চমকে গেল প্রথমে। নিশিডাকের কথা একঝলক মনে এসেও ও উৎকর্ণ হয়ে রইল। আবার শোনা যেতেই ওর মনে হল ডাকটা আসছে ওপরের দিক থেকে। সেদিকে তাকাতে ওর মনে হল দোতলার একটি বন্ধ জানলার চিলতে ফাঁকটুকু দিয়ে কেউ একজন দুটো আঙুল বের করে যেন ওর নজর আকৃষ্ট করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ছোটবেলা থেকেই ডাকাবুকো প্রতিমা কিছুতেই দোতলায় উঠে যাওয়ার আকর্ষণ এড়িয়ে যেতে পারল না। দিনের বেলাতেও সিঁড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। বোঝাই যাচ্ছে লোকজনের আনাগোনা এখানে যথেষ্ট কম। দোতলায় চওড়া দালানের একপাশে সার সার ঘর, অন্যপাশে জাফরি দেওয়া রেলিংয়ের ওপর খসখসের বদলে ছাদ অবধি ইট গাঁথা। ও বাড়ির মতই গড়ন, শুধু অব্যবহার্য থাকতে থাকতে, ধুলো জমে এবং ভেঙেচুরে গিয়ে পোড়োবাড়ি মনে হচ্ছে। জানলাটা অনুমান করে ও একটা ঘরের বন্ধ দরজায় গিয়ে আলতো টোকা মারল। ভেতর থেকে এক গম্ভীর কণ্ঠের উতলা জিজ্ঞাসা শোনা গেল, বৌরানী?
প্রদোষ, দরজার তালা খোলার চাবি কোথায় থাকে?
দরজার নীচে ফাঁকা দিয়ে একটি চাবি বেরিয়ে এল।
প্রতিমা ভেতরে ঢুকল। ঘরে কোন ইলেকট্রিক আলো, পাখা নেই। একটা মোম, দেশলাই, খাওয়ার জলের কুঁজো ইত্যাদি জীবনযাপনের যৎসামান্য আয়োজন। ধুলায়িত মেঝেতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে এক রাজপুত্র। চুল দাড়ির মলিনতা ভেদ করেও অম্লান সৌম্যকান্তি।
আমি তোমাকে যেতে দেখে জানলার ফাঁকটায় চোখ রেখে কখন থেকে বসে আছি জানো। যদি এদিক দিয়ে ফেরো…
প্রতিমার কান্না পেয়ে গেল। শুধু বলল, তুমি কেমন আছ এখন?
ভালো আছি। না না ভালো নেই। ভালো নেই। তুমি যাও, বৌরানী।
আবার আসব। খুব তাড়াতাড়ি। কাউকে বোলোনা আমি এসেছিলাম।
প্রতিমা বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা একইভাবে ভেতরে ছুঁড়ে দিল।
#
আমি কি তোর জন্য অপেক্ষা করব, প্রতীক?
মানে!
ইউনিভার্সিটি অফ কেম্ব্রিজে পড়াতে যাচ্ছিস তুই। জীবনে একটা নতুন মোড়ক জড়াতে চলেছে। পুরোনো সবকিছু আর কি মনে থাকবে তোর?
হোয়াট রাবিশ! আমি এই দিগন্তপুরকে ভুলে যাব? মাকেও মনে রাখব না?
এই আবেগ পাঁচ বছর পরও যদি থাকে তাহলে এক্সেপশন প্রুভস দ্য রুল হতে পারে!
আমার যাওয়াটা তোকে খুশী করেনি তুলি?
আমার কথা থেকে তোর এমনটাই মনে হচ্ছে?
এছাড়া আর কি মনে হওয়ার আছে বল? কোথায় আজ আমরা আনন্দ করব, তা না…প্রতীকের গলাটা বিষন্ন শোনালো।
তুলিকা এবার হো হো করে হেসে ওঠে। ‘কেমন দিলাম বল!’
প্রতীক অবাক চোখে ওর দিকে তাকালে তুলিকা বলে ওঠে, তোকে জাস্ট চমকে দিলাম একটু। ওখানে গিয়ে এগুলো মিস করবি, তুই?
গাঢ় গলায় বলা তুলিকার শেষ কথাগুলো যে চমকে দেওয়ার জন্য ছিল না, স্পষ্ট বুঝতে প্রতীকের কোন অসুবিধে হলনা। কিন্তু ও কিছুই বলতে পারল না। ওর মনে হচ্ছিল ওপরে ওঠার সময় এভাবেই কি ফিকে হয়ে আসে নীচের সবকিছু? প্রতীকের জানা নেই ওর এই চুপ করে থাকাকী বার্তা নিয়ে এল তুলিকার কাছে। ওদের পায়ে পায়ে ফুরিয়ে আসছিলো হাঁটাপথ। নিস্তব্ধতাই যখন একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে বড় অসহায় লাগে, অচেনা মনে হয় সবকিছু।
শোন, মা একবার দেখা করতে বলেছে তোকে। সময় করে চলে যাস। চল চা খাওয়া যাক? প্লীজ তুলি, বি প্র্যাকটিকাল। তুই এভাবে মনখারাপ করলে আমার কি ভালোলাগে বল?
তুলি সামান্য হাসল। সে হাসির ভেতরটা কান্নার কুয়াশায় সাদা হয়ে আছে। প্রতীক অনুভব করতে পারল অথচ ওর কোন কথা এল না। মনে মনে বলল, এই কুয়াশার কাছেই তো ফিরে আসব আমি, দেখিস। এর কাছেই তো ফিরে আসে অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতিরা।
#
একটা কথা বলব?
প্রতাপের বলার ধরণে প্রতিমা অনুমান করল, কি বলতে চাওয়া হচ্ছে। ও জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো প্রতাপের দিকে।
এই যে ভরদুপুরে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াও, তোমার ভয় করে না?
এই বক্তব্যের অনেকগুলো অভিমুখ। উত্তরও অনেকভাবেই দেওয়া যেতে পারে।
প্রতিমা অল্প হেসে বলল, আমি গ্রামের মেয়ে, ভয় করবে কেন!
গাছপালা, তাদের ছায়া, বড় দিঘী এসব মিলিয়ে যে প্রকৃতি, তার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। নৈঃশব্দে সে ভাষা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। বুঝেছি, তোমার সেই বাঙ্ময়তা অনুভব করতে ভালোলাগে। তাই না?
প্রতিমা একটু হাসল। মনে মনে বলল, তুমি ভুল করে এই পৃথিবীতে চলে এসেছো, প্রতাপ!
#
আজ প্রতিমা সাথে একটা টর্চ এনেছে।
একটা বোটকা গন্ধ ঘরটার ভেতর আগের দিনই পেয়েছিল। গা গুলিয়ে ওঠার বদলে প্রতিমার এক বেপরোয়া ঘোর লেগে গেল। কথায় কথায় কতক্ষণ কেটে যায় খেয়াল থাকেনা। অতীতের বড় একটা চাঁইয়ের তলায় চাপা পড়ে থাকা অনেকটা অন্ধকার উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিমা বুঝতে পারে ও ঠিক পথেই এগোচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে আসা অল্প কিছু খাবার মেঝের ওপরেই রাখে।
এভাবে মাঝেমাঝেই আসতে থাকলে দিদি সন্দেহ করবে না তো?
আসতে তো হবেই। স্বগতোক্তির কোন দৃশ্যত সেতু থাকে না বলে আর্তির শিকড় কতটা ভেতরে প্রবিষ্ট উপলব্ধি করা যায় না।
#
প্রতাপের সঙ্গে প্রতিমার সম্পর্কটা যেন কাচঘরে এক পরী! বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মায়াবী জৌলুশ অথচ অতিরিক্ত কৌতুহলে সবকিছু উধাও হয়ে যেতে পারে এক নিমেষে! প্রতাপ জানত। আর তাই প্রতিমার প্রতি তার কোন জিজ্ঞাসা বা নিষেধ ছিল না। তার মনে হত গভীর ভালোবাসায় ডুবে না গিয়েও যে তাকে এতটুকু ঘেন্না করেনি, অভ্যাস পালনের মত লোকদেখানো দাম্পত্যে সেই দোসরের প্রতি ভরসাটুকু যেন তাকে ছুঁয়ে থাকে। রোজ রাতে প্রতাপ ও প্রতিমার একই ঘরে দরজা দেওয়ার কথা কানাঘুষো হতে হতে ছড়িয়ে যেতে দেরী হলনা। দিগন্তপুর ধরেই নিল যে এতদিনকার জেনে থাকাটা সঠিক ছিলনা!
এমনকি প্রমিতাও…জন্মদিনের দুপুরবেলা তার কান্নার প্রতিটি বিন্দুতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জ্বালা যেমন ছিল, প্রতাপের প্রকৃত পরিচয় পাওয়াটাও তো ছিল! অথচ…এই মেয়েছেলে কীভাবে বশ করল যে…গদাই, কমলিদের কাছ থেকেও তো সেভাবে কিছু জানা যাচ্ছেনা!
#
স্পর্শে এত বিদ্যুৎ থাকে! আশরীর ধুলোকেও মনে হয় পরাগরেণুর প্রলেপ! উল্লাসগামীতায় আরোহী এ মন যখন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায় চতুর্দিকে, কে সেই টুকরোগুলো কুড়িয়ে রাখে মুঠোভরে! এ নশ্বর শরীর নিছক সম্পর্কের এক বাহ্যিক খোলসমাত্র। অন্তরমহল ছুঁয়ে থাকা দিঘীটির জলপৃষ্ঠে ভেসে ওঠা রূপোলী আঁশে আচ্ছাদিত মাছটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ওৎ পেতে থাকা আকাঙ্খার নীল মাছরাঙা। এই ছোঁ মেরে ঠোঁটে তুলে নেওয়াটির কাছেই আনত থাকে প্রাণের নিরন্তর প্রবাহ – “সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বমাত্মবশং সুখম্” – অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন সবই দুঃখের, নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন সব কিছুই আনন্দের উৎস। একটি ফুলের কাছে পতঙ্গের নিষিক্ত করাই কাম্য। তার ঠুনকো পরিচয়ে ফুলের কীই বা এসে যায়! ফুলজন্ম বিস্তারের এই শাশ্বত প্রক্রিয়ায় মালিরও শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। এভাবেই চিরন্তন আবর্তিত হওয়ার গল্পে চরিত্ররা কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে যুগ যুগ ধরে।
#
প্রতিমা ওর অপছন্দের কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে গ্রাহ্য করেনা। এতে ওর সাজি ভর্তি নিন্দা জুটেছে। ও নিস্পৃহ। প্রতাপকে বাধিত করার জন্যই এ বাড়িতে ও থেকে গেছে, এমনটা নয়। ওর প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল প্রতাপ একজন পড়াশোনা নিয়ে থাকা আদ্যন্ত সৎ মানুষ। পৌরুষহীন হয়েও সে প্রতিমাকে এমন এক কমনীয়তায় ওতপ্রোত জড়িয়ে রেখেছে যে, তাকে অস্বীকার করা যায়না, কাউকে বোঝানোও যায়না। প্রতিমার কেবলই মনে হত, এক অন্য পরিচয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে মৃত মরুভূমি।
এই বাড়ির দীর্ঘদিন ধরে সমাধা না হয়ে পড়ে থাকা রহস্য উন্মোচনের দিকে প্রতিমা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এখন অনেকটাই পরিষ্কার কেন প্রতাপকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়নি, প্রতাপের অসামর্থ্য জেনেও কেন ওকে বিয়ে দেওয়া হল, কেন পাগল সাজিয়ে প্রদোষের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দেওয়া হল – এই ‘কেন’গুলোর কারক খুঁজে পাওয়া গেলেও প্রতিমা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা প্রকৃত উদ্দেশ্য।
#
তোর সাথে আমার কথা আছে, প্রতাপ। দুপুরে একবার ঘরে আসিস তো।
আজ তো হবেনা। কাল থেকে একটা নতুন বই ধরেছি। সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে বইটা। এত ভালো! কোলকাতা থেকে আনিয়েছি। আজ শেষ না করে উঠতে পারব না। এখন বলা যাবে না?
এখন যদি বলাই যেত তাহলে কি আর দুপুরে ঘরে আসতে বলতাম? বউ বুঝি মানা করেছে আমার ঘরে আসতে? প্রমিতা বিষ ঝাড়লেন।
প্রতাপ অল্প হেসে বলল, আয়নার পেছনে অস্বচ্ছ আস্তরণটা কেন থাকে জানিস? যাতে সাধারণ কাঁচের স্বচ্ছতাকে রোধ করে আলোর প্রতিফলন ঘটানো যায়। আর এভাবেই আমরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। যদি প্রতিবিম্ব দেখতেই চাই, তাহলে অস্বচ্ছতাকেও মান দিতে হবে বৈকি।
সাত চড়ে রা কাড়ত না যে ছেলে, আজ…নতুন বৌ জাদু জানে দেখছি! বিষ কাজ করছে না জেনেও বৃথা প্রয়োগ করার লোভ সামলাতে পারলেন না প্রমিতা।
কোনদিন তো কিছুই বলিনি। আমাকে বলতেও দেওয়া হয়নি। আমার অক্ষমতাকেই সবটা ধরে নিয়ে আমাকে ত্যজ্য করে রাখা হল সবকিছু থেকে। পড়াশোনাকে এত ভালোবেসেও চৌধুরী বংশের ছেলের বিদেশে পড়তে যাওয়া হয়নি। কেন বলতে পারিস? প্রদোষটার ওইরকম দশা। প্রতিমাই আমার অপদার্থতাকে একমাত্র ধরেনি। আমাকে ও মান্যতা দিয়েছে। আমার পড়াশোনাকে সম্মান করেছে। বন্ধুর মত রয়েছে আমার সঙ্গে। ভুল বলিসনি, ও সত্যিই জাদু জানে। আমার ঘরভর্তি বই এতদিনে যা শেখালো, তার বাইরেও ওর থেকে আমি অনেক শিখেছি। আজ আমার কোনো গ্লানি নেই। কোনো হীনমন্যতা বোধ নেই।
যেদিন মুখ পুড়বে, বুঝবি। প্রমিতার গমনপথের দিকে তাকিয়ে প্রতাপ স্মিতহেসে মনে মনে বলল, আগুনে ছ্যাঁকাও লাগে, ওমও মেলে। আগুন নিজেকে বদলায় না, আমরা নিজেদের অবস্থান বদলে নিই শুধু।
#
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে প্রমিতা ঘেন্নায় মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠলেন, ছিঃ!
ছিঃ কেন!
প্রদোষের সাথে…তোর লজ্জা করছে না?
নিজের ভাইয়ের সাথে যেদিন শুতে গিয়েছিলে, সেদিন তোমাকে ছিঃ বলেছিল কেউ?
প্রমিতা হাঁ হয়ে গেছে। দুচোখ যেন ফেটে বেরিয়ে আসবে।
প্রতাপের চরিত্রে কালি দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই তুমি বেছে নিয়েছিলে সেই দুপুরকে। ওর আসল পরিচয় পেয়ে তোমার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। তখন ওর বিয়ে দিলে। হয় বৌ চলে যাবে, গোটা দিগন্তপুরের কাছে প্রতাপ হয়ে উঠবে তামাশার পাত্র। বৌ থাকতে বাধ্য হলেও তোমারই মত জ্বলবে সারাজীবন এবং প্রতাপকেও উঠতে বসতে হেয় করতে করতে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করবে। সাঙ্ঘাতিক ছক কষেছিলে! প্রদোষের ডাক্তার বলেনি, নিয়মিত চিকিৎসায় ও ভালো হয়ে যেতে পারে? প্রণব নারায়ণ চৌধুরীর ছেলেদের নাকি অর্থাভাবে পড়াশোনা হয়নি, চিকিৎসা হয়নি-পাগলেও বিশ্বাস করবে? বিবেক বিসর্জন দেওয়ার জন্য তোমাকে কেউ ছিঃ বলার ছিল না।
বেশ করেছি। আমার মাকে প্রণব নারায়ণ চৌধুরী কোনদিন স্ত্রীর সম্মান দিয়েছে? পাগলের চিকিৎসা করাতে রেখে দিয়েছিল এক বন্ধুর অ্যাসাইলামে। মা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে এল এ বাড়িতে। ওই জ্ঞানদাসুন্দরী আমাকে পড়াশোনা করতে দেয়নি পর্যন্ত। কাজের লোকের মত ছিলাম। একটা লম্পটের সঙ্গে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল। কোন এক অচেনা গুহামুখ খুলে গিয়ে ঝাঁকেঝাঁকে বিছে বেরিয়ে আসছে, আজ ওরা একটা বিষাক্ত লন্ডভন্ড ঘটাবেই!
প্রতিমা বুঝতে পারল ঘটনাগুলো সত্যি হলেও ব্যাখ্যায় ভুল হচ্ছে কোথাও। কিন্তু যে ছাঁচে প্রমিতার মন ঢুকে গেছে, তাকে আর বদলানো যাবে না কোনভাবেই। তবুও সে চেষ্টা করল।
সে জন্যই তুমি ধ্বংস করে দিতে চেয়েছো এই চৌধুরী পরিবারকেই? নিজের জীবনটা নষ্ট হয়েছে বলে, আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে আনন্দ পেতে চেয়েছো? আর সুধাংশুদা? তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে কার জন্য অপেক্ষা করত? ভালোবাসলে কারো ক্ষতি করা যায়! অবশ্য তুমি এসবের কী বোঝ!
আমার সঙ্গে সারা জীবন ধরে যা যা হয়েছে, এতে আমার কী কোনো দোষ ছিল? সুতরাং আমি যা করেছি এতেও কোন দোষ নেই। যেন এক সরীসৃপ হিসহিস করে উঠল…এই সম্পত্তি, ব্যবসা সবই এখন আমার নামে। তোরা এখান থেকে চলে যা।
প্রতিমা এবার হেসে বললেন, উকিল কাকা তোমার মত বিশ্বাসঘাতক হতে পারেননি। আগেই সব জানিয়ে রেখেছিলেন। তোমার কোন কাগজপত্রই আইনের চোখে বৈধ নয়। কারণ বাবার গোপন উইলের কথা তোমার জানা ছিল না। চাইলে তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করানোই যায়। যাইহোক…নতুন দলিলে তোমাদের তিনজনের নামেই সবকিছু সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রদোষ ওর অংশ রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। স্বর্গীয় প্রণব নারায়ণ চৌধুরীর হাজারিবাগের সম্পত্তিটি তোমাকে দেওয়া হয়েছে। যেদিন ইচ্ছে চলে যেতে পারো। তবে যে কদিন এখানে থাকতে চাও, তোমাকে প্রদোষের ঘরটায় থাকতে হবে ঠিক যেভাবে ও ছিল এতদিন।
আমার দীর্ঘশ্বাসে তোর ভালো হবে না, নোংরা মেয়েছেলে!
প্রতিমার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। বরফের মত শীতল স্বরে ও বলল, আজ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সম্ভবত মহাভারত পড়া নেই তোমার। ঈশ্বরের ইচ্ছেকে আমি তুমি বদলে দেওয়ার কে!
এরপর গদাইকে ডেকে বলে দেওয়া হল, দিদির সব জিনিসপত্র যেন আজই ও বাড়িতে চলে যায়।
প্রমিতা কাঁদতেও ভুলে গেছে যেন! খেলা এভাবে ঘুরে যাবে, আন্দাজও ছিলনা তার।
#
কাকীমা ডেকেছো?
আয় তুলি। মুখটা এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন রে?
হসপিটাল, চেম্বার মিলিয়ে খুব প্রেশার।
হ্যাঁ রে, প্রতীক যাওয়ার আগে কী বলল?
কী ব্যাপারে?
কবে বিয়েটিয়ে করবি তোরা? এবার পাগলটার দায়িত্ব নিয়ে আমায় রেহাই দে।
তুলিকা ম্লান হাসলো।
প্রতিমা যার অর্থ জানে না।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২
মানবমনের গভীরে কতই না আলোছায়া ,ভাবলে অবাক হতে হয়। অন্যরকম একটি লেখা পড়লাম,ভালো লাগলো।