কানহা’র অন্দরে
লীনা রায়চৌধুরী
সালটা ২০১০—
নাম না জানা চিরল চিরল পাতায় হলুদ থোপা ফুল দু’হাত ছড়িয়ে আকাশের সাথে আলিঙ্গনে মত্ত। তার বুকে শেষ বিকেলের ছায়াচ্ছন্ন গভীরে, ছোট্ট টিলার ঢালে খয়ের গাছের চিকন ছায়ায় আদুরে পোষ্যের মতো জড়িয়ে আছে ‘ইয়ুথ হস্টেল’– আমাদের কয়েকদিনের ঠিকানা। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি, অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে একবুক ঘাসের মধ্যে একটা দলছুট ঢোল (বুনো কুকুর), আর গর্বিত ময়ূর।
সারারাত ঝাঁকে ঝাঁকে চিংকারা হরিণের খসখস ,ধুপধুপ আওয়াজে সন্ত্রস্ত ক্লান্ত রাত। বাথরুমের বারান্দায় লোহার রডের ঘেরাটোপের ওপারে একদল চিতল হরিণের ঝলসানো চোখের নিরীহ দৃষ্টি আর হাঁড় কাঁপানো শীতের চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করে সারাদিনের পথশ্রান্ত দু’চোখে ঘুম নেমে এল। ডরমিটরির দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজের ছড়িয়ে পড়া রেশ, জঙ্গুলে নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে রাতচরা পাখির তীব্র কর্কশ ডাক আর শুকনো পাতায় সড়সড় আওয়াজ তুলে জঙ্গলের স্বাভাবিক মন্থরতাকে উদ্বেল করে অজানা শব্দে কান পেতে থাকা।এই হল কানহা আর জঙ্গলের কোর এরিয়ায় কিসলির ‘ইয়ুথ হস্টেল'(Dormitory)। বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তিদের বদান্যতায় সংরক্ষণ করা ‘Baghira Log Huts’ এর স্বত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে আমাদের। কারণ তারা দশদিন পর ঐ কটেজেই আসবেন।অনেক রঙ আর গন্ধ বুনে বুনে কিসলির ঠাসবুনোন ‘বাগিরা লগ হাটস্’ নিজেকে মেলে রেখেছে বনস্থলীতে। কিন্তু কী আর করা।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অজানা কোনো জানোয়ারের অস্থির ডাকে।আবছা আলোয় জ্বলজ্বলে ঘড়ির কাঁটা ঘোষণা করছে রাত দুটো। ক্যান্টিনের পিছনে যেখানে সাফারির গাড়িগুলো বাঁক নিয়ে জঙ্গলের কাছে প্রবেশের অনুমতি নেয় তার রাজ্যে অনাহূত আগমনের, ঠিক সেখানেই শুকনো ঘাসের বিশাল প্রান্তর জুড়ে টিটি পাখির টিটিরটি ডাক যেন কিসের সঙ্কেত বয়ে নিয়ে এল।কী দেখেছে ওরাই জানে।অজানা জানোয়ারের চাপা গোঙানি ক্রমশ কাছে হচ্ছে, হাঁলো বা বানজার নদীর শীর্ণ সোঁতা বেয়ে জমা জলের ঝোরা পার হয়ে যেন খুব কাছে চলে এল সেই ডাক। একটা গা ছমছমে ভয়াবহ অনুভবে কেঁপে উঠছি ডরমিটরির দুটো কম্বল আর রুম হিটারের নিরাপত্তায়ও।গভীর জঙ্গলে শীতের শিশির ভেজা নিশুতি রাতে ঐ ডাক বড় কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।
চাঁদের স্বপ্ন দেখা রুপো গলা জ্যোৎস্না আর দূরের ক্যান্টিনের টিমটিমে কমলা বাল্বের আলো অরণ্যের অন্ধকারের মতোই সর্বগ্রাসী নিস্তব্ধতায় ঝিম ধরিয়ে দেয়।এই জঙ্গল যেন যুগযুগান্ত ধরে অনেক কথাই জমিয়ে রেখেছে তার বুকের মধ্যে।হাসি,গান,দীর্ঘশ্বাস, কান্নাও অনেক। মনের মধ্যে তোলপাড় করছে কানহা,পেঞ্চ,রুডইয়ার্ড কিপলিং, জাঙ্গলবুক,মোগলি আর মধ্যভারতের দুর্গম জনপদ ও অরণ্য ।প্রাণের এত বৈচিত্র্য বুঝি ভারতের অন্য কোনো জঙ্গলে নেই।অনেকক্ষণ ঘুম এল না। ঝিঁঝিদের ঝিম ধরা নিস্তব্ধতায় কেবলই মনের চোখে ভেসে উঠছে বিকেলের সাফারির সেই ছবি। একটা বড়ো গাছের গুঁড়ির সামান্য আড়ালে সাদা পেট আর হলুদ কালো ডোরার এক রাজকীয় বিশ্রাম। থেকে থেকে দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজে বাচ্চাদের ডেকে নেওয়া। ঠিক তখন অরণ্যের বুকে মোহ আবির ছড়িয়ে সূর্যদেব পাটে বসার তোড়জোড় করছেন।একটু বাড়তি বখশিশের লোভ বা প্রয়োজন থাকলেও মাঘের ছোটদিন, সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই পর্যটক নিয়ে ফিরতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে হলেও।রাতের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে পার্বত্য কানহা।পিছনে অস্তগামী সূর্য গোধূলির সোনারঙ ছড়াচ্ছে গভীর অরণ্যের গাঢ় নীল ওড়নায় আর পাশে রাজদর্শন।
মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা রেঞ্জের মৈকাল পাহাড়ের সতেজ অরণ্য, ‘কানহা ন্যাশনাল পার্ক’, ‘সেভ দ্য টাইগার’ প্রোগ্রামের একটি অন্যতম প্রধান অংশ।যেখানে বাঘে মানুষে নির্বিবাদে একাকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। বণ্যপ্রাণ, বন আর ভূমিপুত্র এক বিচিত্র রূপকথা!
৯৪০ বর্গকিলোমিটার ধরে বিস্তীর্ণ শাল গাছের সবুজাভ,বাঁশের ঝাড় আর গড়ানো তৃণভূমি বিভোর করে দেয়। পাহাড়ি চরিত্রের এই জঙ্গলে শালগাছের প্রাধান্যই বেশি। তবে মাঝে মাঝেই ঘাসের উপত্যকা সবুজ হলুদের ফুলছাপ মখমলি চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সেই ঘাসবনে চিতল,বারসিঙ্গা,কোটরা,কৃষ্ণসার, শেয়াল,ভাল্লুক, ঢোল,বনশুয়োর আর রয়্যাল উপস্থিতি কানহার মহারাজার।
‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে” কথায় আছে, কিন্তু বাস্তবের কঠোর শাসন বুঝি মাঝে মাঝে প্রবাদ এবং গল্পকেও ছাপিয়ে যায়। দুটো কম্বল,জাম্পার এবং রুম হিটারের শীতকে আয়ত্তে আনার নিষ্ফল চেষ্টার মধ্যে দিয়েই দরজা জানলার আনাচ কানাচের ফাঁক গলে দিনের আলোর উঁকিঝুঁকি। আমরা দু’বোন নিঃশব্দে কম্বলের স্বরচিত উত্তাপ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম হস্টেলের বাইরে। দুধেল ভোর তখনও আড়মোড়া ভেঙে তাকায়নি।চারপাশে এবং গাছের গায়ে রাতের ঘুম লেগে আছে।আবছা আলোর ঘোর সইয়ে নিতে হয় চোখ দুটোকে।জঙ্গল বুঝি সম্মোহন জানে। আর তার অনির্দেশ্য টানে সমস্ত বারণ শাসন ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম হস্টেলের তত্ত্বাবধানে থাকা বছর পঁচিশের সেই দেহাতি মেয়েটার সমস্ত নিষেধ।লিমা বাই,বছর পঁচিশের লিমা।বড়ো কঠিন ছিল তার জীবন।মুক্কির গা-ঘেষে বাফার জোনে তাদের ঘর গৃহস্থালি।জঙ্গলের ধারে বাস-“ভাবনা বারোমাস” , জঙ্গলের সাথেই সমঝোতা করে নিয়েছে তাদের জীবন।ভারী কাঠ,বাঁশ সংগ্রহ করার দায়িত্ব পুরুষদের। কিন্তু রোজের লকড়ি, কেন্দুপাতা, ফলপাকুড়, জড়িবু টি আনতে মুহুর্মুহু বনে ঢুকতে হয় মেয়েদেরই।আর এমনই একদিনে প্রাচীন শালগাছের গোড়ায় ‘পুটপুরা’ (একধরনের ছত্রাক,স্থানীয় নাম) আর শুকনো কিছু কাঠ কুড়াতে যাওয়াই তার কাল হল।সামান্য ‘পুটপুরা’ তো কতই হয়ে আছে।কোনো কাজে লাগে না জঙ্গলের।কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা একটা পরিবারে ভাতের পাতে একটু ভাজা একদিনের জীবন ধারণের রসদ হয়ে থাকে।দেখতে পেয়ে নালিশ ঠুকে দিল বনকর্মীরা। তাই নিয়ে ঘোলা হল বহু জল এবং স্থানীয় আদালত অবধি পৌঁছাল ঘটনা।যা আজও মেটেনি।বারবার হাজিরা দিতে হয়।সংরক্ষিত অরণ্যের কোথায় কোর কোথায় বাফার লিমাদের বোধের বাইরে।কোনও এক বন-কর্তার মানবিক ইচ্ছায় এই হস্টেলে তার কাজ হয়েছে।আদালতে হাজিরার এবং দৈনন্দিন খরচের কিছুটা উঠে আসে এইভাবে।এইসব জনজাতির কেউ কেউ অভিমানে জঙ্গলে ঢোকাই ছেড়ে দিয়েছে। কেই বা তার খোঁজ রাখে। জঙ্গল যাদের রক্তে, মজ্জায় সমস্ত অস্তিত্বে।জঙ্গল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের দিক থেকে।বনেদি সুখে,আতিশয্যে হয়ত! একের পর এক গ্রাম দখল নিয়েছে বনদপ্তর। উৎখাত করেছে ভূমিপুত্রদের। বনের কোর এরিয়ার মধ্যে থাকা ঝোলার,সিজোরা,বেণ্ডা,আজানপুর,লি ঙ্গা,জামি, সুখরির মতোই বহু জঙ্গল সংলগ্ন গ্রাম আজ আর জনপদ নেই।সভ্যতার চলার পথে এ এক আশ্চর্য সমস্যা,সংকটও বটে।একদিকে বণ্যপ্রাণ এবং জঙ্গল টিকিয়ে রাখার উদ্দাম উদ্যোগ,অপরদিকে সৃষ্টির সেরা উপহার মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে বিপন্ন বিহ্বল।

নদীর ধারে রয়্যাল-উপস্থিতি (বাঘের)
একদল হরিণকে সাথে নিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এলাম রাস্তায়।জঙ্গলের তখনো ঘুম ভাঙেনি।আড়মোড়া ভেঙে তৈরি হচ্ছে সে।সরকারি সাফারি জীপ বা প্রাইভেট পেট্রল-জিপসী তখনও চলা শুরু করেনি।হাত চারেক চওড়া রাস্তাটা ক্রশ করে ছোট্ট একটা কালভার্টের এদিকে এসে দাঁড়ালাম।পাশেই পিপল,শিমুল আর একটা মহুয়াগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।রাস্তার পাশ থেকেই শুরু হয়েছে বিস্তৃত ঘাসজমি।একটা দিক পরিস্কার করে ক্যান্টিনে যাতায়াতের পথ করা হয়েছে।ক্যান্টিনের পিছনেই গভীর জঙ্গলে ঢোকার মূল গেট,কিসলি জোনের।যদিও গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে অনেক আগেই।শীতের প্রকোপে শুকিয়ে যাওয়া এলিফ্যান্ট গ্রাসের কোমর ছাপানো সোনালী স্নিগ্ধতায় মন জুড়িয়ে যায়।হরিণের দল নেমে গেল সেই ঘাস জমিতে। তিনদিকে ভয়ঙ্কর সুন্দর পাথুরে জঙ্গল নিয়ে দেড়শো মিটার দূরেই সেই ঝোরা।রাতে তার মোহিনী মায়ার কথা ভাবলে এই দিনের আলোতেও কাঁপুনি ধরে।শীতের সকালের বনের স্নিগ্ধ সুগন্ধি হিমেল নিশ্বাস প্রাণ ভরে টেনে নিলাম।দূরে ছোট ছোট দু’একটা ঝুপড়ি।স্থানীয় মাটির স্পর্শে রঞ্জিত সবুজের আঁকিবুকি!

বনের পথে বাঘের পায়ের ছাপ
আমরা আস্তে আস্তে কথা বলছি।না- বলা কথাই যদিও বেশি।জঙ্গল কয়েকদিনে এই সুন্দর অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে।হঠাৎ চোখে পড়ল অনেক দূরে,রাস্তার বাঁকে,যেখানে ঝোরা আর ছোট্ট পাহাড়ি ঢাল দু’জন দু’জনের স্পর্শের আশায় উন্মুখ হয়ে আছে।সেই ঢাল বেয়ে একটা কালো বিন্দু এগিয়ে আসছে এদিকে। অদ্ভুত ভাবে দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না।সমস্ত কার্যকারণ ভুলে জমে রইলো পা দুটো।বিন্দুটা বড়ো হলে বুঝতে পারলাম সাইকেল চড়া দু’জন স্থানীয় মানুষ।পুরুষের পরণে সবুজ ছাপা প্যান্ট।গায়ে খাকি জামা।পিঠে স্লিং এর সঙ্গে বাঁধা একটি রাইফেল।মাথার হেলমেটে একটু আশ্চর্য হলাম।বনকর্মী পরিচয় দিলেন, সাথে ওর বউ।আঁধার না কাটা দুধেল ভোরে এই জীবন্ত ত্রাসের রাস্তায় ওরা বেরিয়ে পড়েছে জীবনের তাগিদে।আমাদের হস্টেলে ফিরতে বলা ওদের অস্থির দৃষ্টি আমার চোখ এড়াল না।আমার কৌতূহলের উত্তরে বা জায়গার ভয়ঙ্করতা বোঝাতে তার হেলমেট খোলা বীভৎস চেহারা দেখে সাময়িকভাবে হলেও আমার মাথা টলে গেল। ভ্রুর একটু উপর থেকে সমস্ত মাথা জুড়ে সেলাইয়ের দাগ।এমনভাবে উঁচু হয়ে আছে-যেন মাথাটা ওখানে আলতো করে বসানো হয়েছে।বাঘের বাচ্চার ছোটোখাটো দুষ্টুমির আর খেলার সামগ্রী হয়েছিল ঐ মাথা।তাই এই হেলমেটের আড়াল।ওঁরা চলে গেল সতর্কবাণী শুনিয়ে।
মনে পড়ল কাল সাফারির সময় দেখা সেই মেয়েটার কথা।মালভূমি আকৃতির জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের মাঝে একটা জীপ চলার মতো সরু রাস্তা।বড়ো আদিম বণ্য সেই ছোট ছোট ঢাল।যেখানে অদ্ভুতভাবে নিবিড় পাথরের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার গুহা বা রকশেল্টার।যেন প্রাগৈতিহাসিক সময়ের ভার বহন করে চলেছে ।নিঃসন্দেহে বণ্য প্রাণের শেল্টার।এমনই এক পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সেই মেয়েটা।খা-খা জঙ্গলের নিভু নিভু আলোয় মাথায় সামান্য পরিত্যক্ত শুকনো কাঠের বোঝা নিয়ে সে চলেছে। ড্রাইভার কৌশিকের নজর সে এড়াতে পারেনি।জীপ ছুটিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটার কাছে ।চাপা অস্থির বকুনির সাথে সাথে আমাদের গাড়িতে ওকে নেওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ তার চোখে।আমরাও সেটাই চাইছিলাম।নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদ তাকে জঙ্গলে নিয়ে এসেছে।জঙ্গল যার রক্তে সে তো জানেই সময় এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব।জেনে নিলাম, ওর বাবা ‘গোন্দশিল্পী’ ছিলেন।বাতিল কাঠ আর স্থানীয় পাথর দ্বারা নির্মিত হস্তশিল্প।গোন্দ শিল্প-স্থাপত্য মধ্যপ্রদেশের নিজস্ব কৃষ্টির পরিচয় বহন করে।কাঠ সংগ্রহে জঙ্গলে যাওয়া রামকলি ধুরুইয়ে একদল জঙ্গলি কুকুর বা ঢোলের আক্রমণে বেঁচে ফিরলেও চলচ্ছক্তিহীন।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আমরা দু’বোন।হয়তো নিজের মনের সাথেই চলছে এই কথোপকথন।আমরা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হঠাৎ পাশের পিপল গাছে হর্ণবিলের চিৎকার (হয়তো) বাঁদরের অস্থির দাপাদাপি আর পাখির কর্কশ আওয়াজে চমকে উঠলাম।দেখি,ইতিমধ্যে আমাদের সামনে ঘাস খেতে থাকা হরিণগুলো আর নেই। দৌড়ে চলে যাচ্ছে ঝোরার দিকে আর কৌতূহলী চোখে বারবার পিছন ফিরে কিছু দেখার চেষ্টা করছে।মাথার মধ্যে ফিসফিসিয়ে উঠল গাইডের কথা, ‘হরিণের সাথে বাঘ দৌড়ে কখনোই এঁটে উঠতে পারে না।হরিণের তীব্র অনুসন্ধিৎসু মনই ওদের মৃত্যুর কারণ’।আমাদের থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে থাকা মা-হরিণটাকে দেখতে পেলাম না।হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল । বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, ঘাসের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে দুটো কান।ঘোর আচ্ছন্নতার মধ্যেও ফিসফিসিয়ে উঠলাম কান কান।সমস্ত শরীর টানটান ।দুজনে নিশ্বাস চেপে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছি সেদিকে।ভুলে গেছি পারিপার্শ্বিকতা।ভুলে গেছি পালিয়ে আসার কথাও কোনো সম্মোহন শক্তির ইচ্ছায়।পলকের মধ্যে হরিণের বাচ্চার তীক্ষ্ম আর্তনাদ এবং হায়নার হিম ধরানো হাসি।আমার চোখ,আমার কান কোনও ভুল দেখেনি,ভুল শোনেনি।মাথার মধ্যে এলার্ট এলার্ম বাজতেই সেই স্তম্ভিত অবস্থা কাটিয়ে আমরা একপ্রকার দৌড়ে হস্টেলে ফিরলাম।এতক্ষণে জেগে উঠেছে হস্টেল এবং ক্যান্টিনের কর্মীরা।ওরা বাধা দেওয়া সত্ত্বেও সদলবলে আরো একবার ফিরে গেলাম সেখানে।কিন্তু নীলকণ্ঠ অরণ্যভূমি নিঃশব্দ ধ্যানে মগ্ন।
পরিস্থিতির রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি তখনও। ক্যান্টিনের বাঙালি ম্যানেজারের কথায়(ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে গবেষণা করা দিদির ছেলের মুখেও একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে) শিউরে উঠেছি সকলে, ‘হায়না কখনো শিকার করে না।শিকারীকে ছলে-বলে চমকে দিয়ে, অস্থির করে শিকার চুরি করে। অর্থাৎ কান দুটো হায়নার নয়।
“একদিকে অরণ্য, অন্যদিকে বণ্যপ্রাণ–রক্ষা করতে হবে দুটিকেই।মানুষের মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য নয়,বোধহয় নিজের বাঁচার তাগিদেই।আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন লিপিতে যা উৎকীর্ণ ছিল তার বীজ ছিল উপলব্ধিতে ,দর্শনে।আজ সেই উপলব্ধি ক্রমে আত্মরক্ষার তাগিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” সমস্ত অরণ্য জুড়ে ফিসফিসিয়ে উঠল সেই অমৃত বাণী, আত্মার অনুভব।
তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১
Subscribe
Login
0 Comments
Oldest