কানের পোকা

 

মাদের পাড়ায় বোদেদা একটা জনপ্রিয় নাম। ছেলে, বুড়ো সবার কাছেই বোদেদা। তার বাবা মার দেওয়া নাম যে বৈদ্যনাথ চাকলাদার তা অনেকেই জানে না। বর্তমানে বাবা মার কেউই ইহজগতে না থাকায় সে নাম মনে করিয়ে দেওয়ার দায়ও কারোর নেই। শুধু দায়ই বা বলি কেন, প্রয়োজনও পড়ে না। পাড়ার যে কোনো অনুষ্ঠানে বোদেদা থাকবেই। যে কোনো পুজো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও মুখে ভাত, বিয়ে, ছাদ্দ সব অনুষ্ঠানেই বোদেদাকে মুরুব্বিগিরি করতে দেখা যায়। বোদেদা নিজে থেকেই সাগ্রহে এই দায়িত্ব নিয়ে নেয়। আর বোদেদা দায়িত্ব নেওয়া মানে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়ে যাওয়া। সুতরাং আয়োজকও নিশ্চিন্ত। তার নিজের কোনো কাজকম্ম নেই বা নিজের কোনো সংসার নেই, এমন ভাবা মূর্খামি হবে। জমজমাট সংসার, রমরমে চাকরি। বাড়িতে বৌ এবং দুই মেয়ে আর রাজ্য সরকারের একটা আস্ত অফিস। শোনা যায় সেই অফিসের বস হিসাবেও বোদে স্যর খুব জনপ্রিয়। অফিস পিওন থেকে বড়বাবু সবাই বোদে স্যরের জন্য জান কবুল করে। যে কোনো কাজে যেমন বোদে স্যরের ‘না’ নেই তেমনি বোদে স্যর বললে ওভারটাইম না নিয়ে একস্ট্রা টাইম কাজ করতেও কারোর আপত্তি নেই। সমস্যা, বাড়ি নিয়ে। মেয়ে দুটো নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কোনো দিকে তাদের নজর নেই। আর গৃহিণী অলওয়েজ তার বিপরীতে। পান থেকে চুন খসলেই হলো, বাড়িতে কাক চিল বসার জো থাকবে না। বোদে গৃহিণীর উচ্চগ্রাম গলার আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে গেছে পাড়া। কোন অপরাধে এমন বিপ্রতীপ আচরণ তা বোদেদা জানে না। হতে পারে, তার জনপ্রিয়তাই গৃহিণীর রাগের কারণ। আবার বাড়িতে বোদেদাকে কম পাওয়ার জন্যও রাগ হতে পারে। তবে যাকে নিয়ে এই রাগ বা হিংসে সে এসবের পরোয়া করে না। আপন কক্ষপথেই তার অবিরাম বিচরণ।

 

তা, এহেন জনপ্রিয় মানুষটি একদিন এক চরম বিপদে পড়ল। এক চন্দ্রশোভিত ফুটফুটে সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে একটু দূরে চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে বোদেদা এক হাফ-বন্ধুর সাথে বেশ খোশমেজাজে কথা বলছিল, হঠাৎ বাঁ কানে হাত দিয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে শুরু করল। হাফ-বন্ধুটি অবাক। কী হলো রে বাবা? বোদেদা মাঝে মাঝেই নিজের বাঁ কানের পাটাটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে টানছে আর মাথাটা বাঁ দিকে কাত করে ঝাঁকাচ্ছে। কয়েক মিনিট এমন করার পর সটান নিজের বাড়ির দিকে দৌড়। বাড়িতে ঢুকেও নিস্তার নেই। কানের সমস্যা তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হলো গৃহিণীর বাক্যবান। বোদেদার হাল দেখে বলল

–যা তোমার কারবার, নিশ্চয়ই কেউ কষিয়ে কান মুলে দিয়েছে বা কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে একটা…

,ভগবানের আশীর্বাদে এবারে যদি কানের মাথাটা খেতে পার, তাহলে বাঁচি। না থাকবে কান, না থাকবে কানাই। পাড়ায় পাড়ায় প্রেম বিলোনো বন্ধ হবে।

হ্যাঁ, বোদেদার চেহারায় চটক আছে। উচ্চতা মেরে কেটে সাড়ে পাঁচ আর গায়ের রং কালো ঘেঁষা হলে কী হবে, মুখশ্রী আর কোঁচকানো চুলেই বাজী মাত! গৃহিণীর মতে পাড়ার অন্যান্য মহিলারা সবাই বোদেদাতে আসক্ত। বোদেদার এই যে উপকারের নেশা এ সবই ঐ রমনীমন আকর্ষণের কেতা! বিরক্ত হয়ে বোদেদা প্রথম প্রথম গৃহিণীকে বোঝাত।

–এমন ভাবে ভাবা মানে শুধু নিজেকে ছোট করা নয়, যাদের নিয়ে ভাবছ তাদেরও ছোট করা।

মাঝে মাঝে গৃহিণীকে একটু মাস্কা লাগানোর জন্য বলত

–আর তাছাড়া, তুমি রূপে কম কিসে? অন্যদের থেকে একদম হাটকে। তা কি বোঝ না? তাহলে আমার অন্য মহিলার দরকার কী?

কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! মানে, গৃহিণীর কানে ওসব কথা বেদনা দিত। তাই ওসব না বুঝে একনাগাড়ে একভাবে ব্যাটিং করে যাচ্ছে। এখনও নট আউট। শেষে বোদেদাও হাল ছেড়ে দিয়েছে।

 

 

আপাতত বোদেদার এমন হাল যে খুব বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারছে না। একভাবে কানের পাটা ধরে টান মারছে আর মাথাটা ঝাঁকাচ্ছে। গৃহিণী শেষে জিজ্ঞাসা না করে পারল না।

–এমন উচ্চিংড়ের মতো তিড়িং বিড়িং করছ কেন? কে কানের গোড়ায় দিল তা তো বলবে, নাকি?

বোদেদা জবাব দিল না। ড্রয়ার থেকে একটা জনসন বাড বের করে সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল। খুব সাবধানে বাঁ কানে সেটা ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে পাকাতে লাগল। গৃহিণী পর্যবেক্ষক। কিছুতেই কিছু হয় না। মাথা ঝাঁকানো আর কান ধরে টানাটানি অব্যাহত। ছোট মেয়ে “লি” নিঃশব্দে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও বোদেদার কারবার দেখে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে “লি” বলল

–তোমার কানে কি পোকা ঢুকেছে বাবা?

হঠাৎ চিৎকার করে বোদেদা বলল

–হ্যাঁ রে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম। একটা পোকা মিসাইলের গতিতে বাঁ কানে ঢুকে পড়ল। তখন থেকে কানের ভেতর অনবরত ফরফর করেই যাচ্ছে। কী যে অস্বস্তি হচ্ছে!

কথাগুলো গৃহিণীর পছন্দ হলো না। এত কম পানিশমেন্ট আশা করে নি। ভেবেছিল কেউ কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে একটা চড় কষিয়েছে। নিজের মনের সুপ্ত বাসনাটা অন্যের মাধ্যমে যদি চরিতার্থ হয়! কম সে কম কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার আশা ছিল। তা নয়! মুখ বেঁকিয়ে “ধ্যুত” বলে ঘরের ভেতরে সেঁদিয়ে গেল।

 

ও হ্যাঁ, বলা হয়নি বোদেদার দুই মেয়ের নাম বড় অদ্ভুত। বড়টির নাম “ঋ” আর ছোটটির নাম তো আগেই বলেছি। এই নিয়েও গৃহিণীর আক্ষেপের শেষ নেই। মেয়ে দুটো তো তারও বটে! তাহলে বোদেদার ঠিক করা এমন বিদখুটে নামই বা কেন বহাল থাকবে? অথচ তাই বহাল আছে। এই নিয়ে সুযোগ পেলেই গৃহিণী বোদেদাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। যাদের নাম নিয়ে এত ঝামেলা, তারা কিন্তু বেশ আছে! একটু আনকমন নাম নিয়ে বরং তারা বেশ আনন্দেই থাকে। ব্যাপারটা রেলিশ করে। বড় মেয়ে সামান্য চুপচাপ হলেও ছোট মেয়ের নেচার অনেকটা বোদেদার মতো। এমনকি বাবার সাথে মায়ের কথা কাটাকাটির সময় সে বাবার পক্ষই নেয়। এ নিয়ে গৃহিণী তাকে “বাপ সোহাগী”, “পাপাজ পেট” ইত্যাদি বলতেও ছাড়ে না। মোট কথা, বোদেদা আর দু মেয়েকে নিয়ে গৃহিণীর জীবন ঝালাপালা হয়ে গেছে। অন্তত এমনটাই গৃহিণীর দাবি।

 

লি,  দিদিকে গলা চড়িয়ে ডাকল।

–দিদি, নীচে আয়। বাবার কানে পোকা ঢুকেছে। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

দোতলা থেকে ড্রয়িংরুমে নেমে এসে ঋ গম্ভীর গলায় বলল

–ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী হবে? মা কে ডাক। বাবার “কানের পোকা” এক্ষুণি বের করে দেবে।

এত কষ্টের মাঝেও বোদেদার হাসি পেয়ে গেল। মেয়ে দুটো তাদের মাকে নিয়ে এত মজা করে! লি বলল

–চল দিদি, দেবাকাকুর কাছে যাই।

তারপর দিদির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল

–বাবার শরীরের কন্ডিশন ভাল না মা। দেবা কাকুর কাছে তারপর দিদির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল

–বাবার শরীরের কন্ডিশন ভাল না মা। দেবা কাকুর কাছে যাচ্ছি।

বলে রাখা ভাল, দেবাকাকু হলো ডাক্তার দেবাশিষ হাজরা। বোদেদার অভিন্ন হৃদয় লেঙোটিয়া দোস্ত। একই পাড়ায় কয়েকটা বাড়ি পরেই তার বাড়ি কাম চেম্বার। গৃহিণী বাইরে বেরিয়ে এসে বলল

–আমিও যাব। চল। আর শরীরের কন্ডিশন ভাল না মানে? কানে একটা ছোট্ট পোকা ঢুকেছে। তাতে এত শরীর খারাপ হওয়ার কী আছে?

লি গম্ভীর হয়ে বলল

–পোকাটা মনে হয় বিষাক্ত। নাহলে বাবার কানে এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন? কানে ইনফেকশন হয়ে বাবার শ্রবণশক্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেলে তোমাকেই তো ভুগতে হবে। বলো?

বোদেদা অবাক হয়ে ছোট মেয়ের দিকে তাকাল। কানে যন্ত্রণা তো হচ্ছে না! ভেতরটা মাঝে মাঝে ফরফর করছে মাত্র। লি ইশারাতে বাবাকে চুপ করালো।

 

বোদেদাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই গৃহিণী ঝাঁপিয়ে পড়ল।

–ও দেবাদা, ভাল করে দেখ তো, কানে কী ঢুকেছে। লোকটা তো যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ইনফেকশন হয়ে গেলে বিপদ! এমনিতেই লোকটাকে নিয়ে আমার ঝামেলার শেষ নেই, তার ওপর যদি বদ্ধ কালা হয়ে যায়, তাহলে আমি শেষ। ডাক্তার কিছু বলার আগেই লি বলল

–ও কাকু, আগে তুমি বাবার কানটা দেখ। তারপর আমি সব বলছি।

ডাক্তারকে কিছু বলতে না দিয়ে লি বাবাকে নিয়ে সোজা চেম্বারের লাগোয়া রুমটায় ঢুকে পড়ল। ঋ মাকে নিয়ে চেম্বারে বসল। ডাক্তারকে বলল

–কাকু তুমি বাবাকে সিরিয়াসলি দেখ। মা খুব টেনশনে আছে।

ডাক্তার বুঝে উঠতে পারছিল না, সিরিয়াসনেসটা কোথায়? ঋ এর দিকে তাকাতেই সে ভেতরে যেতে ইশারা করল।

 

বেশ কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেরিয়ে এসে গৃহিণীর দিকে তাকিয়ে বলল

–বৌঠান, বোদের কানে একটা ছোট্ট অপারেশন করতে হবে। কানটায় বেশ ক্ষতি করে দিয়েছে পোকাটা।

গৃহিণী আঁতকে উঠল।

–অ্যাঁ, অপারেশন? সে কি গো?

–হ্যাঁ। কানের যা ক্ষতি হয়েছে তাতে এরপরে বোদেকে কানের বেশ যত্ন নিতে হবে। কানের কাছে বেশি জোরে জোরে কথা বলো না যেন!

গৃহিণী বাধ্য ছাত্রীর মতো মাথা নেড়ে সায় দিল। ডাক্তার ঋ কে বলল

–মাকে সামলে সুমলে রাখিস।

 

প্রায় আধঘণ্টা পরে বোদেদাকে নিয়ে লি বাইরে বেরিয়ে এলো। বোদেদার বাঁ কানে একটা মস্ত বড় পট্টি। গৃহিণী হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে বোদেদাকে ধরল। লি বলল

–মা, তুমি বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। বাবার এখন রেস্ট দরকার। আমি আর দিদি দেবাকাকুর সাথে কথা বলে ফিরছি।

গৃহিণী কোনো কথা না বলে বোদেদাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর তারপরেই শুরু হলো তিনজনের হাসি। ঋ তার দেবাকাকুকে বলল

–বাবার কানে সত্যিই কিছু করতে হয়েছে নাকি? এত বড় পট্টি লাগিয়েছ কেন?

–আরে, অপারেশন করতে হবে বলেছি। পট্টি তো লাগাতেই হবে। নাহলে বৌদি তো সব বুঝে যাবে।

–পোকাটাকে কি করে বের করলে কাকু?

এবারে লি উত্তর দিল।

–কী অদ্ভুত, জানিস দিদি! কাকু ঘরটাকে পুরো অন্ধকার করে দিল। তারপর একটা জোরালো টর্চ বাবার বাঁ কানের কাছে কিছুক্ষণ ধরতেই পোকা বাবাজীবন বাইরে আলো দেখে কর্ণগহ্বর থেকে সুড়সুড় করে আলোর দিকে চলে এসে ফুরুৎ হয়ে গেল।

–তাহলে এতক্ষণ ধরে তোরা এখানে কী করছিলিস?

এবারে ডাক্তার কথা বলল

–অপারেশন কী আর এত তাড়াতাড়ি হয়? সময় লাগবে না? সময় কাটিয়ে তারপর এলাম আমরা।

লি হেসে বলল

–বাবার কানে পট্টিটা লাগিয়ে আমরা তিনজনে কফি খাচ্ছিলাম।

ঋ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল

–কাকু, আমি বাদ?

ডাক্তার হেসে ভেতরে গিয়ে ঋ এর জন্য কফি নিয়ে এল। তারপর হেসে বলল

–বৌঠান কিন্তু বোদের কান নিয়ে একটু ভয় পেয়ে গেছে। আশা করি এরপরে আর চিৎকার করে বোদের কানের পোকা বের করে দেবে না। অন্তত কিছুদিনের জন্য বোদের কান শান্তিতে থাকবে।

ওরা দু’ বোনে একসাথে হেসে উঠল।

তারিখঃ জানুয়ারি ১৯, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Saad Zaglul Abbas
Saad Zaglul Abbas
2 years ago

খুব সুন্দর

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse