কুমিরা’র দক্ষিণরায়

 

লাল-কালো জাফরি কাটা টানা বারান্দা থেকে নীচের উঠোনে পা রেখেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়ল মজুমদার বাড়ির বড় কর্তা জিতেন মজুমদারের।কুমিরার মজুমদার বংশের পারিবারিক কৌলিন্য ঋদ্ধ ছ’ফুট উচ্চতার শালপ্রাংশুভুজ বড় ছেলেটি সকলের স্নেহধন্য। বিনয়ী, উদার, কর্তব্য পরায়ণ জিতেন্দ্র মজুমদার কখন যে আদরের জিতু বা জিতেন হয়ে গেছে-সকলের কথা বাদ দিলেও সে নিজেই আর মনে করতে পারে না। আজ তো সে এই সুবিশাল পরিবারকে বটবৃক্ষের স্নেহ-সিক্ত ছায়া দিয়ে রেখেছে, প্রয়োজনে থেকেছে ঢাল হয়ে ।

 

কপালের ভাঁজ সোজা হওয়ার আগেই আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন, – ‘শরৎ গিয়ে হেমন্ত এলেও,এত তাড়াতাড়ি এমন অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সময় তো এখন নয়’ ! সবে দীপান্বিতা কালী পুজো গেছে। বাতাসের শীত শীত আমেজ এখনও বড় আরামদায়ক। কার্তিকি অমাবস্যার ঠিক পরের অমাবস্যা – চরাচরের দখল নিতে একটু যেন তাড়াহুড়ো করে। তবুও এসব ভরা অমাবস্যার দিনে চারপাশের প্রকৃতিও বড় অচেনা হয়ে যায়। চিন্তাক্লিষ্ট মনে এগিয়ে গেলেন বার বাড়ির উদ্দেশে।রাঢ়ী পাড়ার গোপীনাথ মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি আর শীতল ভোগের সময় হয়ে এসেছে। সকালের বৃষ্টির জল ইটের খাঁজে খাঁজে-দেখে চলতে হচ্ছে। এই বর্ষার আগে মনি লোক লাগিয়ে ইট পেতে দিয়েছে বড় দালান থেকে একদম বৈঠকখানা টপকে সদরের গেট পর্যন্ত। ইচ্ছে ছিল সিমেন্ট করে বাঁধিয়ে দেবে। কিন্তু বৃষ্টি আর সে সুযোগ দিল না। এবার যেন একটু আগেভাগেই চলে এসেছে বর্ষা, কিন্তু ভরা হেমন্তেও তার ফিরে যাবার নামটি নেই। । গগন ঝাউয়ের সারি দেওয়া পথ ছাড়িয়ে একটু দাঁড়ালেন। বার উঠোনের বাঁদিকে খলিশখালি জমিদারের দ্বিতীয় প্রজন্মের দু-ঘোড়ার ফিটন গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে,বাড়ির বড় মেয়ে এসেছে আজ, জমিদার বাড়িরও বড় বউ সে।ছোট বোন টুরিও এসেছে ছোট মেয়ে হাসিকে নিয়ে। ওদের টুকরো টুকরো হাসি আর কথা বাড়িটাকে আজ বড় ঝলমলে করে তুলেছে। বার-বাড়ির বাঁ-কোণা বরাবর কাছাড়ি ঘর তার গা-ঘেঁষে টিনের ছাউনি আর সরু সরু লোহার রড, মুলি-বাঁশের বিনুনি কাটা দেওয়ালের পালকি ঘরের পাশেই ঘোড়াদুটো বাঁধা। আনমনেই একবার তাকিয়ে দেখে কপালের ভাঁজ আরো গভীর হয়ে উঠল জিতেনের , বড্ড অস্থির যেন ঘোড়া দুটো। ছোলার বস্তায় মুখ ডুবিয়ে রাখলেও বারবার মুখ তুলে বুঝিয়ে দিচ্ছে আজ খাওয়ায় মন নেই। দুপাশের লাল কুঞ্জলতার আলতো বিস্তার ছাড়িয়ে দেবদারু আর বাঁশের নিপাট বেড়-এর অবসর পেরিয়ে বাহির বাড়ির গেটে এসে দু-দণ্ড দাঁড়ালেন। অস্থির – অস্পষ্ট চিন্তাটা ক্রমশ আকার নিয়ে দখল নিচ্ছে মনের। বুকের কাছে জড়ো করা বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের আড়াই প্যাচে পৈতৈ জড়িয়ে সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে গেটের বাইরে এলেন নির্ভীক, নির্বিরোধী জীতেন্দ্র। রাস্তার ওপাশেই বাড়ুইদের পানের বরজ। যার বিস্তৃতি বহুদূর,শেষ দেখা যায় না। আদিগন্ত শুধুই সবুজ।

দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে।আড়ং-ঘাটের শ্মশান কালী পুজো আজ।আড়ং-ঘাট গ্রামের প্রধান ঘাট। যেখানে শুধু ছোটনৌকা পারাপার হয় না।পারাপার হয় হাটুরে নৌকা, বড় বড় বজরাও এখানে নোঙর করা হয়। কুমিরা এবং বর্ধিষ্ণু গ্রাম কাশিপুর, তৈলকূপি, পাটকেলঘাটার দুর্গা বিসর্জনও হয় এই ঘাটে। তৈলকূপির বড় বড় ব্যবসাদারের কাছে এই ঘাট যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। কার্তিক মাসের শ্যামা পুজো মিটতেই, ঠিক পরের অমাবস্যায় অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে পূজিত হন গ্রামের একমাত্র শ্মশান কালীমাতা আড়ং-ঘাটের পূব দুয়ারে।পুজোর সমস্ত দায়িত্ব ছিল তালুকদার পরিবারের। তারও আগে ঠিক কবে শুরু হয়েছে এই পুজো তা সঠিক জানা যায় না। তবে শ্মশান সংলগ্ন ঐ পাকুড় গাছ বহু দিনের।প্রতি কালীপুজোর আগে তাকে পুজো করা হয় শিব জ্ঞানে।সেখানে আগে পুজো সম্পন্ন করে কালীপুজোয় বসেন সিদ্ধ তান্ত্রিক বাচস্পতি মশাই। মোহন তালুকদার স্বপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার পর এই পুজোর সমস্ত দায়ভার খলিশখালি গ্রামের সকলের।

 

সূর্য অস্ত গেছে বহুক্ষণ। বিকেলের গন্ধ মেখেই এক-পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। চারপাশে এখনও ভেজা শীতার্থ প্রকৃতির কেমন ঝিম ধরা সুর আর ঝিঁঝির তান। পাতলা সরের মতো কুয়াশা আর অমাবস্যার নিকষ কালো মিলেমিশে প্রকৃতি আজ অপরূপা। আজ যেন অমাবস্যার রাত তার সবটুকু মাধুর্য ঢেলেছে নিজেকে সাজাতে। তবে বড় সচেতন সে, কোনো ধার করা আলো যেন ওকে লোভী না করে তোলে সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি !

 

বাঁহাতে ঘটি ভরা জল আর ডান হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ, গলায় গৃহদেবতা নারায়ণ ছোট্ট কাপড়ের বটুয়ায় – জিতেন মজুমদারের পথের সঙ্গী।প্রতি রাতেই এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু হয় না। শুধু মাঝে মাঝে পূজারির স্থান বদল হয় মাত্র। মজুমদার বাড়ির পর রায়, চ্যাটার্জি আর দত্তদের বাড়ি পরপর। তবে মজুমদার আর দত্ত বাড়ি অনেকটা জমি নিয়ে। তাই গাছপালা আর অযাচিত ঝোপের আড়ালে সেভাবে বাড়িগুলোর আলাদা করে চোখেই পড়ে না, মজুমদার বাড়ির উঁচু চূড়োটুকু ছাড়া। পথের দুধারে ঘন পানের বরজ-যেখানে দিনের বেলায়ও সামান্যতম আলো প্রবেশ করে না, আম- কাঠালের দঙ্গল, দূরে দূরে নিভু নিভু কিছু আলোর হাতছানি শূন্যতাকে যেন আরো প্রকট করে তুলেছে।এই পথ একদম রাঢ়ী পাড়ার গোপীনাথ মন্দিরে গিয়ে উঠেছে।একটু দীর্ঘ হলেও তুলনামূলক চওড়া রাস্তা,একটু গিয়েই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট নেওয়া পথের তুলনায়। তবে এই রাস্তাটারও মাটি দেখা যায় না হেমন্তে। ঝরা পাতা, ফুল আর কুটোয় ভরে থাকে সমস্ত পথটুকু। তারপর পাট আর শুকোতে দেওয়া খড়ি তো আছেই–এক আশ্চর্য গালিচা পেতে রেখেছে পথময়। কার যে সম্পদ সে আর বোঝা যায় না। আজ বাড়ি থেকে বেরোনোর পর থেকেই ঘ্রাণেন্দ্রিয় আমোদ করে রেখেছে এক বুনো বুনো গন্ধ। জঙ্গল আর মাটির আদরে লালিত গ্রাম বাংলায় এ তো ভীষণ স্বাভাবিক। তবুও কোথাও যেন কিছু ছন্দ পতনে ক্রমশ আবারও দীর্ঘ হল জীতেন ঠাকুরের কপালের ভাঁজ।

 

ঘাটলা নদীর কূলে তিলপানি গ্রাম থেকে কয়েকঘর বানভাসি চাষী সম্প্রদায়ের মানুষ অস্থায়ী বসত বুনেছে তালুকদারদের ছেড়ে যাওয়া পোড়ো জমিতে।এদের মধ্যে কেউ কেউ বারুইপাড়ার নিমাই হালদারের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। জল নামলেই হয়তো ওরা চলে যাবে এমন কথা আছে। বেশ অনেকরাত অবধি এরা জেগে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনা করে। মাঝে মাঝে দোলের কাছে অঙ্ক বুঝতে আসে। দোলও খুশি হয়। কলেজের পরীক্ষা শেষ। রেজাল্টের আগে কলকাতায় ফিরবে না।

রাস্তা থেকে একটু নেমে সামনের ঘরটা হারাণের।ঘরের লাগোয়া জমিতে ছোটোখাটো সুন্দর এক একটা সব্জি বাগান তৈরি করেছে ওরা। ওখানে হয়তো ফলনের প্রাচুর্য নেই কিন্তু পরিশ্রম আর আন্তরিককতা আছে। উচ্ছে, লাউ, কুমড়ো, পেঁপে–কতরকমের যে গাছ। প্রায়ই ঝুড়ি ভরে বাড়ির সদর খুলতেই ওরা দিয়ে যায়। শত অনুরোধ, বোঝানোতেও কোনো কাজ হয় না। কিছুতেই তাদের হাতে সামান্যতম মূল্যও ধরানো যায় না।তাদের ধারণা ঠাকুর বাড়ি কিছু দেওয়ার অর্থ ঈশ্বরকে নিবেদন করা। কিন্তু এই বাড়ির বড় দুই ছেলের অপছন্দ সেখানেই।সব হারিয়ে ওই মানুষগুলোর কঠিন লড়াই এখন জীবনের সাথে। তবুও পাটকেলঘাটা বাজারে ছোটখাটো একটা কাপড়ের দোকান আছে হারাণের। আর সবাই তো একেবারেই নিঃস্ব। জমি আর ফলন নির্ভর ওদের জীবন।বন্যা আর কপোতাক্ষ এবার সবটুকু কেড়ে নিয়েছে তার। কিন্তু কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকা ঐ মনের উপর তো আর ভারি ভারি কথার শাসন চলে না। তাই মজুমদার বাড়ির ছোট ছেলে খগেন্দ্র মজুমদারের কবিরাজি চিকিৎসায় সেই কর্তব্যটুকু থাকে। রাস্তার উপরেই হারাণের ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। কেরোসিনের টেমির আবছা আলোর দোলাচলে মা আর ছেলে বসে আছে পাটিপাতা মেঝের উপর, দরজাটা খোলা।হয়তো এখনো হারাণ ফেরেনি। হাটের দিনে পাটকেলঘাটা বাজারে ওর দোকান থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে সঙ্গীসাথী থাকলেও বেশিরভাগ দিনই একা আসে।কুমিরার দক্ষিণে কপোতাক্ষের থেকে বেরিয়ে আসা সূতি খালটার গা দিয়ে উত্তর – দক্ষিণ বরাবর ঘিরে রেখেছে বাদাবন।এবার বর্ষার পর খুব বাঘের উৎপাত বেড়ে গেছে। সবাই সতর্ক করেছে হারাণকে, দলবেঁধে ছাড়া আসতে নিষেধ করেছে। তবুও সে বেশিরভাগ দিনই একা আসে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারের বড় হাটের দিনে। প্রয়োজন যে বড় বালাই। এমনিতেই দীর্ঘদিন ঘরছাড়া ওরা।

হারাণের বউ যেন কী সেলাই করছে আর ওর ছেলেটা পড়তে পড়তে একটা কাঠি নিয়ে বারবার টেমির জ্বলন্ত পলতের গায়ে লেগে থাকা ভুসোর কণাগুলো ছাড়িয়ে দেওয়ার খেলায় মেতেছে।পাট আর চাঁচের বেড়ার পলকা ঘর। আগুন লাগার ভয় তো থেকেই যায়। মনে মনে শঙ্কিত হল জিতেন ঠাকুর।স্মৃতি- বিস্মৃতি নিয়ে ফিরে দেখলেন নিজের ছেলেবেলা।সব শৈশব বুঝি একই আলোয় বাঁধা!সেখানে নেই কোনো পারিবারিক ভেদ, নেই কোনো উঁচু – নীচুর কালিমালিপ্ত যুক্তি।

 

একটু এগোতেই কলিম শেখের টঙঘর। তার গা ঘেসে চলে গেছে কালীখাল। এখান থেকে চারশো মিটার পূবে গেলেই গোপীনাথ জিউ’র মন্দির। মন্দির কে ডাইনে রেখে প্রসন্ন রায়ের একলা ভিটে কাটিয়ে সুধার বাড়ি। সন্ধ্যা আরতি সাধারনত সুধার স্বামী হরি’ই দেয়। গোপীনাথের সেবার দায়িত্ব এখন তারই। ঘর বাড়ি স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি এবং প্রতিপত্তি ফেলে রেখে ভারতে বরাবরের মতো চলে যাওয়ার সময় জিতেন্দ্রর দুটো হাত জড়িয়ে কথা নিয়ে ছিলেন প্রসন্ন বোস-গোপীনাথের সেবার।” আমার প্রাণ থাকতে গোপীনাথের অ-মর্জাদা হতে দেব না, তাঁকে অভুক্ত থাকতেও দেব না।তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পার”। কষ্টিপাথরের তিনফুটের সেই অপরূপ ঈশ্বর মূর্তি জীতেনের আদরে আজও তাঁর সোনার বাঁশিটি নিয়ে পথ চেয়ে থাকে উপাসকের। কয়েকদিন হল হরি সাতক্ষীরা গেছে। বড় মামা শ্বশুর জিতেন মজুমদারের আশ্বাসে গোপীনাথের সেবার দায়িত্ব তাকে দিয়ে।

 

জঙ্গুলে শর্টকাট রাস্তাটা এখানে এসে অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তাটায় মিশেছে। এদিকটা বড় দুর্গম।ভারত থেকে বিনিময় করে চলে আসা কয়েক ঘর মানুষ আছে ঠিকই, কিন্তু ভারতে চলে যাওয়া মানুষের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি, সুন্দরী, গরান, গর্জন ও হেতাল, বলাসুন্দরী–সকলে মিলে জড়াজড়ি করে জায়গাটাকে আরো বেশি আঁধার আর দুর্গম করে তুলেছে। আরো নিবিড়ভাবে স্যাঁতসেঁতে আর দুরধিগম্য করেছে তিন-দিকে শিবসা, কপোতাক্ষ আর পশর থেকে কেটে আসা কালীখাল।কপোতাক্ষ এখানে একটানা দক্ষিণে সাগর মুখে এগিয়ে গেছে। কারো মতে গোপীনাথ জিউ’র মন্দির প্রসন্ন বোস-এর দাদুর আমলে প্রতিষ্ঠিত, আবার কারো মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে-এই মন্দির প্রতাপাদিত্যের বিজয় স্মারক। কিছুদিন আগেও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এই স্থান, মন্দিরের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। হঠাৎ করে দক্ষিণরায়ের আনাগোনা এবং হাঁকডাক একটু বেড়ে গেছে এই অঞ্চলে। তাই কুমিরা স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে দায়িত্ব নিয়ে গ্রামের কিছু স্বচ্ছল মানুষের অনুদানে স্যামুয়েল ফ্রয়েডের ঐকান্তিক চেষ্টায় সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরের। বিনাশ করা হয়েছে রাস্তা আটকে রাখা ঝোপঝাড়। তবে বিষধর সাপখোপ, বুনো শুয়োর, ভাম, বাঘরোলের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। তাদের নিশ্চিন্ত আস্তানা হয়েছে ফেলে রেখে চলে যাওয়া পরিত্যক্ত ছাপড়া ঘরগুলো।মন্দিরের গায়েই ছিল পেশায় শিক্ষক ফ্রয়েডের বাংলো। ফ্রয়েডও আজ বহুদিন দিন হল স্কটল্যান্ডে ফিরে গেছেন অকস্মাৎ স্ত্রীর মৃত্যুর পর।

 

আর একটু এগোলেই মন্দির। ভেজা পাতার নরম গালিচায় পা পড়লে নিজেই তো কেঁপে ওঠে মানুষ। তার উপর ভরা অমাস্যার এমন বনজ গন্ধে মাতাল করা ভিজে রাত! জীতেন্দ্র’র বড় প্রিয় এই চলার পথটুকু। নিজের সাথে কথা বলার অতি অমোঘ সময়-এমন আর খুব একটা মেলে না। তবে আজ যেন কেমন সব এলোমেলো। কিছুই ঠিক সমে যাচ্ছে না। বারবার তাল কেটে যাচ্ছে। বড়ই বেসুরো, বেতালা আজ এই আঁধার-পক্ষ!মন্দিরের পথে অনেকটাই চলে এসেছেন। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় পরিজন। সকলেই নবান্নের আগে এই সময়টায় একসাথে হয়। পুরো পরিবারকে কাছে পাওয়া যায়। হাসিটা বড় নেওটা হয়ছে তার। কিছুতেই বড়মামাকে সে ছাড়বে না। পিতৃহীন অতটুকু মেয়ের প্রতি বড় মায়া তার। অনেক কষ্টে টুরিকে বলে চুপি চুপি চলে এসেছেন। একটু দোনামনায় ছিলেন বিকেল অবধি। কাশিপুর থেকে ডাক্তার বন্ধু ভূপেন্দ্র চ্যাটার্জির আজ আসার কথা ছিল। কথা ছিল তিনি আজ স্বপরিবারে আসবেন আর আজ রাতটা সকলের সাথে কাটাবেন।কিন্তু একে অমাবস্যা, তারপর অসময়ের বৃষ্টি, সাথে কিছু কানাঘুষো হয়তো তাকে নিরস্ত করেছে।জিতুকেও আজ বাড়ির কেউ ছাড়তে চায় নি। কিন্তু নিরুপায় তিনি। কর্তব্য বড় দায়। গোপীনাথের সন্ধ্যা আরতি তো আবেগের দুর্বলতায় বন্ধ হতে পারে না। তবুও মনটা কেমন খচখচ করছে–আজ শ্মশান কালি পুজো, অগ্রহায়ন অমাবস্যা।পিছন ফিরতে আত্মমর্যাদা কেমন ক্ষুন্ন হয়, সম্মানে বাধে, এগুতেও শঙ্কা জাগে। এক অদ্ভুত টান তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল। ডাইনে পানের বরজের জমাট অন্ধকার আর বাঁয়ে মন্দিরের স্তিমিত আলো–এক অপার্থিব, অলৌকিক রূপে সেজেছে যেন সময় আর প্রকৃতি। মন্দিরের লোহার গেটে কখনো তালা দেওয়া থাকে না। গোপীনাথের সোনার বাঁশি, সোনার মুকুট আর গা – ভরা অলঙ্কার। যদিও বছরের উৎসব ছাড়া সবকিছুই মজুমদার বাড়ির সিন্দুক বন্দি হয়ে থাকে-সোনার বাঁশি আর মুকুটটি ছাড়া। তবুও বাঁশি, মুকুট আর মন্দির ভরা কাঁসা পিতলের বাসন-একটাও আজ অবধি বে-হাত হয়নি। কখনো কোনো চোর ডাকাতের সাহস হয়নি হাত দেবার।

মন্দিরের দেড়-মানুষ সমান উঁচু খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আনমনেই গেটটা দিয়ে দিলেন জিতেন। আচমন, জলশুদ্ধি, শীতল ভোগ ও সন্ধ্যা আরতির পর পর্দা ঢেকে গোপীনাথের রাতের পরিচর্যা শেষ করে আবারও দুয়ার ভেজিয়ে টর্চ, ঘটি আর নারায়ণ শিলাকে বুকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।অমাবস্যার ঘোর ঘোর সময়েও আকাশ যেন নিজের আলোয় মগ্ন থাকে। সে এক অপার্থিব নীল আলো! কিন্তু আজ আকাশের পশ্চিম কোণ বরাবর বেশ বড় একখণ্ড মেঘ ঝুলে আছে মন্দিরের মাথায়।যেতে যেতে পথে হয়তো আরো এক পশলা বৃষ্টি ভেজাবে তাকে। আদ্যাস্তোত্র উচ্চারণের সাথে সাথে পা বাড়ালেন গেট অভিমুখে।মনে মনে বলে উঠলেন, আজ কিছু ঠিক নেই গোপীনাথ, সব এলোমেলো’।না-হলে বারবার সুর কেটে যায় আদ্যাস্তোত্রের! মূল মন্দিরের সিঁড়ি থেকে নেমে কয়েক পা গেলেই মন্দিরের লোহার গেট।গেটে এসে দাঁড়াতেই এক ঝাপটা জোলো বাতাসের সাথে চঞ্চল হয়ে উঠল এই বনজ চারপাশ! সেই বুনো বুনো গন্ধে কেমন থমথম করছে।

গেটটা খুলে সবে জিতেন মজুমদারের এক পা বাইরে–আর এগুতে হলো না। ভয়ঙ্কর ভাবে উল্টোদিকের পানের বরজটা দুলে উঠল। এক-কদম এগোতেই গাঁক শব্দে একেবারে মুখোমুখি। বিশ হাতের মধ্যে দক্ষিণরায়! এমন হিংস্র দৃষ্টির তীব্রতা আচম্বিতে স্তম্ভিত করে দিলেও মস্তিষ্ক তার কাজ ভোলেনি। কেমন করে যে হাতের পাঁচব্যাটারির টর্চটা ঠিক বাঘের চোখের উপর ধরলেন—।

জিতেন আড়ষ্ট হলেও হাত তার কাঁপেনি এতটুকু। সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরের মুখের নীচের দিকে স্পষ্ট রক্তের দাগ। কয়েক ফোঁটা বুঝি ঝরেও পড়ল। রোষকষায়িত কটাক্ষ আর চাপাগর্জনে প্রকৃতিও বুঝি নিথর।টর্চের এই বেপরোয়া আলো তার দুর্জয় শক্তি, বেগ ও ক্রোধকে কোনোমতে রুদ্ধ করে রেখেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য – কপালের তীব্র কালো রেখার কম্পন যেন সেই আদেশই দিচ্ছে। একহাতে ঘটি, গলায় নারায়ণ শিলা, ডান হাত টর্চের বোতামে।জিতেনের সর্ব অঙ্গ নিশ্চল হলেও মন তার সজাগ নির্দেশে। আলোকে যেভাবেই হোক জ্বালিয়ে রাখতেই হবে। দু-পক্ষই ধৈর্য ও শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছে যেন।কত সময় বয়ে গেছে হয়তো কোনো পক্ষেরই খেয়াল নেই। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল সেই মৃদু গর্জন। হিংস্র ও উগ্র দৃষ্টির সামনে এই স্তব্ধতা এবার আরো ভয়ঙ্কর মনে হলো।অবকাশহীন পলকে জিতুর বিস্ফারিত চোখের সামনে এক তীব্র হুংকারে লেজের বাড়িতে মাটি কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের তীব্রতায় উল্টো লাফে বরজের নিকষ অন্ধকারে মিশে গেল সেই কালো-হলুদ মৃত্যুদূত।মুহূর্ত অবকাশে বহু দূর থেকে কানে ভেসে এল কিছু ধাতব আওয়াজ আর এক চাপা চিৎকার, ‘ঠাকুরদা’ –সম্বিত ফিরে এলে তাকিয়ে দেখলেন বাঁদিকে একঝাঁক শরীরী ছায়া, হাতে জ্বলন্ত কুঁড়ো(মশাল), কারো হাতে টিনের ডোঙা আর কাঠের টুকরো। দু’ চোখের দৃষ্টি, মস্তিষ্কের সব ভাবনা আচ্ছন্ন হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চিনতে ভুল করেননি জিতেন।ওই তো তাঁর বরাভয়- ‘আমরা আসছি ঠাকুরদা ভয় নেই’-পাটকেলঘাটা হাট থেকে ফেরা হাটুরেদের আপ্রাণ চিৎকার।ঠিক মন্দিরের মুখেই টর্চের স্থির আলো দেখে ওদের মনে হয়েছে -‘ সব ঠিক নেই’। তাই চিৎকার করতে করতে এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। জিতেনেরও বুঝতে বাকি রইল না কেন দক্ষিণরায়ের মতো অপরাজেয় রাজা রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাদপসরণ করলে। হারাণকেও দেখতে পেলেন তিনি ওদের ভিড়ে। ওরা দলবেঁধেই হাট থেকে ফেরে আজকাল দিনের আলোয় ঘোর নামলেই। এতটাই বাঘের অত্যাচার বেড়েছে এবারের বর্ষার শেষ থেকে।

সকলের শত অনুরোধেও জিতেন অবিচল-একাই ফিরবে সে। –‘তোমরা সাবধানে চলে যাও। নজরের রাশ আলগা কোরো না’। হারাণের প্রবল আপত্তিকে সামান্যতম প্রশ্রয় না দিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন, ‘রাত হয়েছে হারাণ। বৌমা আর ছেলেটাও অপেক্ষা করছে’ । জিতেন্দ্র মজুমদারের কথার উপর কথা বলার স্পর্ধা এবং মন আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের কারোরই ছিল না।ঈশ্বরের বিশ্বাস তাকে চরিত্রগত ভাবে নরম এবং দৃঢ় করে তুলেছিল। কিছুটা পথ হৈ হৈ করে ওরা একসাথে গেলেও ভুতুর বাঁকে এসে ওরা ওদের পথ ধরল। অনেকটা প্রশস্ত ভুতুর বাঁক। পাশেই পুরো গ্রামের ধান মাড়াইয়ের জায়গা। গাছপালা এবং দীর্ঘ পানের বরজও একটু দূরে দূরে।

ওদের কথা, চলার আওয়াজ যখন থেমে গেল,আলো যখন ক্রমশ দূরে আর স্তিমিত, শ্মশান কালীর ঢাকের শব্দও থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা নেমে এল পথে, চারপাশের ঝোপঝাড়ে, গ্রামের আনাচ-কানাচে, যেন সমস্ত চরাচরেই। কেবল দূর থেকে কালী খালের বুকে জেলে নৌকার ছপছপ আর নদীর বয়ে-যাওয়ার কুলকুলানি শব্দ হঠাৎ স্পষ্ট হল রাতচরা পাখির ভয় – পাওয়া কর্কশ চিৎকার দূরে চলে যাওয়ার পর। নদীর মৃদু কুলকুল আওয়াজই একমাত্র শব্দ হয়ে কানে আসতে লাগল। জিতু কেঁপে উঠল এক সম্ভাবনায়, হয়তো দক্ষিণরায় এই অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে কোনো ঝোপের আড়ালে বা এই পানের বরজের নিকষ কালোয় সাময়িক গা-ঢাকা দিয়েছে তার শিকারের দিকে স্থির লক্ষ্য রেখে,খেলাচ্ছে তার শিকারকে চিরাচরিত অভ্যাসে! সে তাকে দেখতে পাচ্ছে না।বুজে এল চোখ-দুটো, অস্ফুট উচ্চারণ বেরিয়ে এল-‘নারায়ণ’ —

গোপীনাথের এই নিশ্চল পাথরের মূর্তির প্রতি কী আশ্চর্য এক মায়া, মোহ বা ভক্তি মনকে আবিষ্ট করে। ভুলিয়ে দেয় বিপদের ঝুঁকি, শত অনুরোধ, নিষেধ বা অতীত ও অনাগতকে।

 

ভয় জিতেনকে ছুঁতে পারে না ঠিকই, কিন্তু আজ তার পা-দুটোকে ভারি করে তুলেছে। দূরে বাড়ির আলোও তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।আর একটা বাঁক নিতেই বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে আবছা আলো-ঠাকুরানীর পুকুর, ঘোর অমাবস্যাও তার আলোকে কাড়তে পারেনি। মায়াবী সাদার কী অপরূপ তার রূপের ছটা! এই গ্রাম, এই জঙ্গল,পথ সর্বত্রই জীবনের স্পন্দন। কিন্তু এমন রাতে – বড় নিঃশব্দ সে স্পন্দন।পুকুরের চারপাশ ঘিরে কেঁচকী ঝাড়, দিনের আলো থাকলে তার অনন্ত রূপের সামনে চুপ করে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে কয়েকদণ্ড। হারাণের ছেলেটাকে কতবার যে বকাঝকা করে ঘরে ফেরাতে হয়েছে ঐ পুকুরের পাশ থেকে।ছোট্ট ছেলে তো! জানেই না যে, তার ঐ সবুজ সাম্রাজ্যে আরো এক ভাগীদারের প্রবেশ ঘটেছে। আর সেই ভাগীদার জীবনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও বোনে। সাদা-লাল কেঁচকী বীজ যে বাচ্চাদের বড় প্রিয় খেলার সাথী।

খড়মের শব্দটা আজ খুব কানে লাগছে। পথের স্বাভাবিক শব্দের সঙ্গে জুড়ি বাঁধতে পারছে না সে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। পায়ের নীচে শিশির ভেজা পাতা, কুটো আর ঠান্ডা মাটি। সময় এগিয়ে চলে অন্ধকারের বুকে অন্ধকারতর নিঃশব্দ এক দুঃস্বপ্নের মতো, থেমে থেমে, আস্তে অস্তে।

শীতার্ত, ভিজে,আনমনা পিছিল রাতে আবারও এক অপরিচিত অস্পষ্ট আওয়াজ!চমকে উঠল জিতু, ওর সাথেই কেঁপে উঠল যেন ঘুমন্ত গ্রাম। কেবল সাহসী শিশিরের শব্দ টুপটুপ করে। টর্চের বোতামে চলে গেল সতর্ক হাত। মুহূর্তের অবকাশে কানের পাশে ফিসফিস করে উঠল শ্যামল কণ্ঠ, স্নেহের অমূর্ত ধ্বনি–‘ঠাকুরদা’। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন জিতেন্দ্র মজুমদার – হারাণ আর ওর ছেলে বুদু। গলায় নারায়ণ বহন করা শরীরটাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল বুদু-‘দাদাই আমরা তোমাকে নিতে এসেছি’! ছোট্ট মনটা না-বোঝে ছোট-বড়, না-বোঝে জাতপাত, জানে না ধনী-দরিদ্র্যের শ্রেণীগত ফারাক। নিতাইয়ের দিকে মৃদু ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ফিরে তাকাতেই ঐ চোখের করুণ মিনতি, স্নিগ্ধ সুঠাম শরীরের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, শঙ্কাহীন শান্ত স্থির দুটো বড় বড় চোখ, অপলক দৃষ্টি – যেখানে আছে শুধু নিরহঙ্কার অর্পণ ! ‘ঠিক করোনি তুমি, ছোট্ট ছেলেটাকে এনে’–

‘ আমার বারণ শোনেনি ও ঠাকুরদা’।দীর্ঘ কপাল,সংগ্রামী জীবনের স্পষ্ট বাঁকা রেখা কপাল জুড়ে খোদাই করা, দু’ হাতে শাবল আর কাটারি, চোখে অনন্ত মিনতি–‘আপনি তো আমাদের জীবন দিয়েছেন ঠাকুরদা’। বজ্রকণ্ঠের দৃপ্ত আদেশ, ‘বাড়িতে যেন কেউ আজকের কথা না-জানে হারাণ’। আলতো ঘাড় হেলিয়ে সে সম্মতি জানাল। আনত চোখে অসীম কৃতজ্ঞতা—।

তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Saptarshi Roychowdhury
Saptarshi Roychowdhury
1 year ago

Osadharon

নিখিল কুমার চক্রবর্তী
নিখিল কুমার চক্রবর্তী
1 year ago

পথচলার এ গল্প অনন্য। শব্দের নিটোল বুননে তৈরি করা প্রতিটা লাইনে ভয়ঙ্কর সুন্দরের স্তব।

Moumita Chatterjee
Moumita Chatterjee
1 year ago

গল্প তো নয়, কালো অক্ষরের মায়ায় যেন শব্দ নয় নিখুঁত ফুটে উঠেছে একটা ছবি।
বিষয়বস্তু মন কেড়ে নিল। কুর্নিশ তোমায় বারবার।

সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী
সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী
1 year ago

খুব ভালো লাগলো গো, খুব খুব খুব ।চমৎকার বর্ণনা , বিষয়বস্তুও চমকপ্রদ। শুধু কয়েকটা টাইপো রয়ে গেছে , বাকিটা অস্সাধারণ

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse