খনন

আশফাক সাহেব – বয়স বাষট্টি, বিপত্নীক। বয়সের তুলনায় এখনও সুদর্শন এবং স্বাস্হ্য বিষয়ক জটিলতা নেই বললেই চলে।স্ত্রী ছন্দার অনন্ত যাত্রার পর একরকম জোর জবরদস্তি করে একমাত্র কন্যা প্রেমাঞ্জনা ওর সংসারে নিয়ে এসেছে। প্রেমাঞ্জনার বাড়ি তিনতলা। একতলায় বহু বছরের পুরোন ভাড়াটিয়া এবং দোতলাতে ওদের সাজানো সংসার।ছাতের ওপর একটা ঘর করা হয়েছিল কিন্তু ওটা তালাবন্ধই থাকে।এ বাড়িতে আসবার পর থেকেই আশফাক সাহেব বায়না ধরলেন তাঁকে ছাতের ওপরের ঘরটাই দিতে হবে। তিনি নিজের মতো করে একাকী থাকতে চান। প্রেমার আপত্তি সত্বেও তিনি তাঁর জেদ নিয়ে অটল, অনমনীয় হয়ে রইলেন।অগত্যা প্রেমাকেই আপোষ করতে হলো।

আশফাক সাহেব নিজের বাড়ি থেকে কিছু পছন্দের আসবাবপত্র নিয়ে এসেছেন এবং এর মধ্যে বংশ পরম্পরায় পাওয়া মেহগনি কাঠের আলমারিটা তাঁর বিশেষ প্রিয়।অবসর কাটে বই পড়ে, লং প্লেতে পুরোন দিনের গান শুনে, আর গভীর রাতে সরোদ বাজিয়ে। সারাদিনের মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে অগুনতি বার প্রেমা ওপরে ওঠে বাবাকে সময় দিতে।কখনও কখনও রাতে, দুধেল পূর্ণিমায় খোলা আকাশের নিচে আশফাক সাহেব মগ্ন হয়ে থাকেন চোখ বুঁজে— শীতলপাটি বিছিয়ে হয়ত বা সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন কোনোদিন। কখনও বা শখের টেলিস্কোপে খোঁজেন কালপুরুষ, সপ্তর্ষী অথবা অন্য কোনো নক্ষত্র। বাবাকে প্রেমা কখনও এভাবে আবিষ্কার করেনি।মাঝেমাঝে তাই সে নি:শব্দে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। রাতের অন্ধকারের নি:স্তব্ধ মুহূর্তগুলোকে ছাপিয়ে শনশন শব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে প্রেমার ফুসফুস থেকে।একাকী যাপন নাকী স্বেচ্ছানির্বাসন … প্রেমা সত্যিই বুঝতে পারেনা।

আশফাক সাহেবের ছিল রোদেলা দুপুরের মতো শৈশব ও কৈশোর, তারুণ্য ছিল প্রানপ্রাচুর্য্যে পরিপূর্ণ। উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে সাফল্যের শিখর ছুঁয়েছেন নিজ কৃতিত্বেই। ঘুরেছেন দেশ বিদেশ।উপভোগ করেছেন জীবনকে।সেদিন দুপুরে খেতে বসে ইংল্যান্ডের নানারকম অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলেন।পিকাডিলি সার্কাসে বিকেলগুলো কেটে যেতো ছন্দা এবং ঝাঁকবাঁধা কবুতরের বাকুম বাকুমে। বিয়ের পর ডেপুটেশনে ছিলেন লন্ডনে দু’বছর। ঝিরিঝির বৃষ্টি ওখানে লেগেই থাকে বলে, হয় রেইনকোট নয় একটি ছোট্ট ছাতা অবশ্য সঙ্গী হয়ে ওঠে সবার।

“বুঝলি, তোর মা ছাতা নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করত না একদম!”

আশফাক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ভাবমেদুর দু’চোখে স্মৃতির ধুসর মেঘ।মনে পড়ল, প্রথম দিকে একটু অপ্রস্তুত লেগেছে ঠিকই কিন্তু নরম রোদে একটুখানি ভিজে যাওয়ার অনুভূতিটা দারুণ ছিল।ডবল ডেকার বাসে করে প্রায়ই শহর ঘোরা এবং অনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যে নেমে পড়ে সন্ধ্যের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছন্দার খুব প্রিয় ছিল।

আজও সকাল থেকেই বৃষ্টি।ছাতে একটা ঢালু জায়গায় বেশ কিছুটা বৃষ্টির জল জমেছে।আশফাক সাহেব দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন জলের ফোঁটাগুলো ভাতের বলকের মত ফুটছে। ধবধবে সাদা হাঁসগুলো যেন এখনই নামবে সাঁতারে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের হুইসেল।বৃষ্টিভেজা বাতাসে মিশে গেছে ইন্জিনের ধোঁয়ার গন্ধ। ধীরে ধীরে টেনে নিলেন বালিশের পাশে রাখা খাতাটা। দুটো পাতা ছিঁড়ে প্রবল আগ্রহ নিয়ে যত্ন করে বানালেন দুটো কাগজের নৌকা।তারপর ছেড়ে দিলেন জমে থাকা জলে।চোখদুটো ঝিকিমিকি আনন্দ সজল। তিরতির করে বেয়ে চলেছে হলদে রঙ এর দুটো কাগজের নৌকো।ঘোর লাগা দুপুরে পাশে এসে বসেছে কুমু। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।

-চুপ কর কুমু ! মাথা ধরে গেল তোর বকবকানিতে।
– মাথাই যখন ধরে তখন এক বেলা না এলে খবর পাঠাও কেন?
– কেন পাঠাই সেটা জানিস না?

কুমকুমের খেজুরকাঁটা বেণী তখন ছুঁয়ে আছে তাঁর কাঁধে আর মেথি ভেজানো তেলের সুগন্ধ ম ম করছে ভেজা বাতাসে।ঝগড়া করতে করতে কুমু আরো কাছে ঘনিষ্ট হয়ে বসল।দুহাতের পাতায় কুমুর টলটলে মুখ ধরে ফেলতেই হঠাৎ বদলে গিয়ে সেটা ছন্দার মুখ হয়ে উঠল।

-শুনছো, এমাসের চালটা ভালো না। কেমন যেন একটা পুরোন গন্ধ আছে।
– আহা ছন্দা, তুমি কি চাল ডাল তেল নুন ছাড়া আর কোনো কথা বলতেই জানো না?

-বাবা, বাবা…..দুর থেকে ভেসে আসে চেনা আদুরে কন্ঠস্বর। ট্রে হাতে প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে চায়ের কাপ আর প্রিয় মুড়ি বিস্কুট নিয়ে।

-কার সাথে কথা বলছিলে বাবা?

মেয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন আশফাক সাহেব যেন অন্য এক জগত থেকে জবাব দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,

“তোর মা বললো এমাসের চালে নাকি পুরোন গন্ধ? তুই পেয়েছিস? আমরা সবাই তো সেটাই খেলাম আজ। কই পেলাম না তো! “

বিড়বিড় করতে থাকলেন আশফাক সাহেব। খুব একটা পরিষ্কার না বুঝলেও প্রেমাঞ্জনার মনে হলো ওর বাবা বেশ কবার “কুমু ” নামটা আউড়ে গেলেন।মা, কুমু পিসিমনি, দুজনের কেউ বেঁচে নেই ।কুমুপিসি দিনাজপুরে থাকতেন।কানাঘুষোয় প্রেমা শুনেছিল, বাবা কুমুপিসিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুজনের প্রথম প্রেম পরাজিত হয়েছিল দুটো ভিন্ন ধর্মের মিথ্যে আভিজাত্যের অহমিকায়।প্রেমার বুকটা কেঁপে উঠল। বাবা কি অসুস্হ হয়ে পড়ছেন ? এটা হ্যালুসিনেশন না ডিমেনসিয়া? খুব তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে এই বিষয়টা নিয়ে।

স্মৃতির জাফরি কাটা জানলা গলে ঢুকে এভাবেই ঢুকে পড়ে আশফাক সাহেবের শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের সোনাঝুরি সময়ের হীরে মোতির আলোর ঝাড়বাতি।বর্তমানে ফিরে এলে, বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে তখন তাঁকে দীর্ঘক্ষণ ধরে।ঝুপ করে নিজেকে কোথাও লুকিয়ে ফেলতে চান তিনি। যেমন, এ বাড়ির সামনের পোর্চে স্তুপ করে রাখা ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর মধ্যে, অথবা ঐ যে শিমুল গাছটা … ইচ্ছে করে ওর ছায়ায় মিশে যেতে। রাতের নিস্তব্ধতায় মিশে থাকে তাঁর প্রৌঢ় বিবাদ।তিনি জীবন ধারন করেছেন ভালো ছেলের, কর্তব্যপরায়ণ স্বামীর, স্নেহময় পিতার।হয়ে উঠতে পারেননি দোয়েল ফড়িং বা একজন বেপরোয়া প্রেমিক।সামাজিক ঘেরাটোপের জীবনে বাঁধা পড়ে গেলে জীবন কি আর যাপন করা হয়?

প্রায় শীত পড়ে গেছে।সেদিন সকালের নাশতার পর পর রোদে বসে ছিলেন তিনি।খোসা ছাড়ানো কমলার মিষ্টি গন্ধ হাওয়ায় মিশে আছে।শীত করছিল, মাঝে মধ্যে। আলমারিটা খুলে গায়ে দেয়ার জন্য শাল বের করবেন বলে একটা পাল্লা খুলেছেন।হঠাৎ করে পরিষ্কার দেখতে পেলেন, আলমারির ভেতরে তাদের পুরোন বাড়িটা।কারুকাজ করা ভারি কাঠের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি।রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ডালে বাগার দেয়ার সুগন্ধ। মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন।পড়ার ঘরে কিশোর আশফাক কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।মা আলুভর্তা সর্ষের তেলে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেবার জন্য জোরাজুরি করছেন।ও’ঘর থেকে বাবার হাঁকডাক। কলেজ ক্যাম্পাস।গাঢ় ঘুম জড়ো করা ক্যালকুলাস ক্লাস।মনোরঞ্জন স্যারের ডিফারেন্সিয়াল ফরমুলা তখন চোখের পাতায় ভারি হয়ে নেমেছে… বইয়ের ভেতরে কুমুর নীল চিরকুট…

“বাড়ি ফেরার পথে একবার এসো”

স্মৃতিরা যেন এক দীর্ঘ রেলগাড়ি কিংবা একটা দীঘি।এক একটা কাল ঠেসে রাখা আছে বগিগুলোর ভেতরে। কিংবা পুরোনো গল্পগুলো ছোট ছোট ঢেউ হয়ে অনুরণন তুলছে দীঘির জলে।সেইসব ছোট গল্পে মিশে আছে সুখের কলরব, যন্ত্রণার খই, আদর সোহাগের গ্রহণ, শোক সন্তাপ।

আশফাক সাহেব একাকিত্বকে ভীষণ ভালবেসে ফেলছেন আজকাল।নি:সঙ্গ মায়াজমে খুঁজে পেয়েছেন সুখ।মগ্নতায় পাখা মেলে তাঁর কল্পিত জীবন যা তিনি যাপন করতে চেয়েছেন। আলমারির পাল্লা খুলে প্রায়ই তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন, বিড়বিড় করেন, ফিক করে হেসে ফেলেন।দীঘির কোলজুড়ে অসমাপ্ত ছোট গল্পগুলো ঢেউ তোলে।তিনি সেই পৃষ্ঠাগুলোকে জল থেকে তুলে নিয়ে রোদে শুকোতে দেন। সময় কমে আসছে। গল্পগুলো শেষ করার তাগিদ বোধ করেন। পিকচার পারফেক্ট এক সফল জীবনে তাঁর অপ্রাপ্তি, অসফল অধ্যায়গুলো নিয়ে কোনোদিন তিনি কিছু বলেননি।বলতে পারেননি। এখনই সময়…

এক, দুই, তিন….

হিসেব হারিয়ে ফেলেন আশফাক সাহেব। নড়ে চড়ে বসেন শুরু থেকে আবার ঢেউ গোনার জন্য।

“Alone, all alone
Nobody, but nobody
Can make it out here alone”-

Maya Angelou.

তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse