খাদেম
ফাহিম ফয়সাল
কখনও মনে হয় মেঘের আড়ালেই সুখ, কখনও মনে হয় মেঘবিহীন নীলাকাশ কতই না সুন্দর। কখনও মনে হয় উষ্ণ দিনে বাতাসেরা ঘরে ফিরুক আবার কখনও সেই বাতাসই ঘরের ছাদ নিয়ে চলে যায় দূরের কোনো খামারবাড়িতে। সব সেই মহীয়ানের লেখা নিয়ম। তাঁর বানানো এ ধরণীতে কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি আছে মানুষের ভেতর। ত্রুটি আছে মানুষের পাপে। এত বড় এ দুনিয়ার বড় বড় নিয়মে মানুষের কিছু কষ্ট লুকিয়ে থাকেই। দুনিয়ার নিয়মে দুনিয়া চলে। মানুষের নিয়মে মানুষ। আব্দুল করিমের দুনিয়া চলে তার নিয়মেই। তবে তা আট দশজনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। করিম নতুন এসেছে এ মসজিদে। আগে অন্য আরেক জায়গায় মুয়াজ্জিন ছিল। বড় সুন্দর গলা তার। আজান যখন দেয়, কণ্ঠ দিয়ে যেন মায়া ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। সাদা কালো দাড়ি। শুকনো শরীর। সারাদিন মসজিদে থাকে। মসজিদের আঙিনা, মেঝে পরিস্কার করে রোজ। রাস্তার পাশে মসজিদ, তাই ঘনঘন ধুলোবালিতে ঢেকে যায়। ছেলে তালহা বাবার সাথে থাকে। পাঁচ বছর বয়স। বড় লাঠির আগায় আড়াআড়িভাবে আরেকটা ছোটো দণ্ড লাগিয়ে তাতে ত্যানা জড়িয়ে যখন মেঝে পরিস্কার করে তখন তালহা লাঠির মাথায় বসে থাকে। ভার বাড়ানোর জন্য। আর করিম ছেলে সহ লাঠি ঠেলে ঠেলে পুরো মসজিদ পরিস্কার করে। সে দৃশ্যটা বড় অকৃত্রিম। পাশে একটা মাদরাসা। ছেলেরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে এখানে আসে। তারা বলাবলি করে করিমের মাথায় নাকি সমস্যা আছে। প্রায়ই নাকি হঠাৎ করেই চিৎকার মেরে ওঠে আর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে থাকে। ফজরের আগে প্রতিদিন চিৎকার করে করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ জপে। পাশের কয়েক বাড়িসহ মাদরাসার ছাত্রদের ঘুম ভাঙে তার আওয়াজে। আওয়াজটা কেমন অদ্ভুত। আজানের মত এখানে সুর নেই কেমন যেন এক ভয়ানক ডাক। আল্লাহর নাম খুব ভয়ে ভয়ে ডাকে করিম। তার সারাদিনের রুটিন হল পুরা মসজিদ পরিস্কার করা। ঠিকঠাক রাখা। যেন কেউ তার কাজের ভুল ধরতে না পারে। কিন্তু একদিন মসজিদ কমিটির সভাপতি নামাজ পড়তে এসে দেখে বারান্দার এক জায়গায় ময়লা। ওমনি পাশে তালহাকে পেয়ে মারে এক ধমক।
“ঐ ছ্যাড়া তর বাপ কই? ডাক জলদি। এগ্লা পরিস্কার কর তাড়াতাড়ি।”
তালহা অনেক ভয় পেয়ে যায়।দৌড়ে গিয়ে বাবার পাঞ্জাবির পেছনে গিয়ে লুকায়। আব্দুল করিম ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে এসে বলে
“স্যার পরিস্কার করসিলাম কিছুক্ষণ আগে আবার ময়লা পড়সে”
“তে কিয়ামত পর্যন্ত পরিস্কার থকবো নাকি? ময়লা পড়সে আবার পরিস্কার করবি।”
করিম আবার ময়লা তুলে ফেলে দেয়। সে আগেও কয়েকবার চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। মসজিদ কমিটির কারণে। কখনো বেতন দেয় না। কখনো ব্যক্তিগত কাজ করায়। আবার কখনো খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করে। সে তো কারো ব্যক্তিগত চাকরি করে না।সে মসজিদ দেখাশুনা করে। করিম এসব সহ্য করতে পারে না। শুরুর দিকে ধৈর্য্য থাকলেও পরে ধৈর্য্য ধরে রাখা হয়ে ওঠে না। করিমের স্ত্রী জয়নব অসুস্থ রুগী। রোগের নামটাও ওর মনে থাকে না। শশুড়বাড়িতে বউকে রেখে ছেলেকে নিয়ে চাকরি করে। বিয়ের পর থেকে জয়নবের অসুখ। বিগত দুই বছর হল বিছানায়। হাটা চলা করে না। আগের চাকরি ছাড়ার কারণে শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক গালাগালি শুনতে হয়েছে। স্ত্রী জয়নব স্বামীকে অত্যন্ত ভালোবাসে। সে অনেকবার চেয়েছে বাপের বাড়ি থেকে চলে যেতে কিন্তু করিম তা করতে দেয়নি । করিমের পরিবার নাই। এতিম খানায় মানুষ। স্ত্রীকে রাখার মত তার কাছে কোনো জায়গা নাই। শেষবার আসার সময় জয়নব তার হাত ধরে ছিল অনেক্ষণ। আসতে দিতে চায়নি। যয়নবের কথা মনে হলেই আত্মা মোচড় দিয়ে ওঠে করিমের। প্রতি মাসে ওষুধের জন্য টাকা পাঠায় বাড়িতে। নিয়মিত ওষুধ খেলে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে ডাক্তার বলেছে। করিমের মুখে হাসি ফিরে আসে তখন। ছেলেটা বড় হচ্ছে। ওকে কোথাও ভর্তি করে দিতে হবে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়। মাগনা মাগনা কে পড়াবে তাকে। চিন্তায় পড়ে। একদিন ছেলেকে নিয়ে মাদরাসায় যায়। যদি মাগনা পড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে এ আশায়
এক হুজুরের সাথে দেখা করলে সে বলে,
“ওরে আমার কাছে পাঠায়েন। সবার সাথে ও পড়বে। আমি পড়ামু। তবে প্রিন্সিপাল ভর্তি করা ছাড়া থাকতে দিবে কিনা এটা নিয়া একটু ভয় আছে। আপনে বড় হুজুরের সাতে একটু কতা কয়া দেখেন।”
বড় হুজুর হল মসজিদ কমিটির মেম্বার। তার সাথে কথা বলার পর বড় হুজুর একটি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আর বলে,
“ভাল বুদ্দি বাইর করসো মুয়াজ্জিন সাব, চাকরির সাথে পোলার পড়াশোনা ফ্রি বাহ্। এমন বিলাসিতার চাকরি আমি তো দেহি নাই। বেতন বাড়াই নাই জন্য নয়া ফন্দি আঁটসো না? হইবো না হইবো না। তবে তোমার বেতন যদি অর্ধেক করো তাইলে বাকি অর্ধেকের বিনিময়ে তোমার পোলারে ভর্তি করতে পারো। যদিও তা যথেষ্ট না তবু তোমার জন্য ছাড়। হাফ বেতনে চলবো মুয়াজ্জিন সাব? “
করিম চলে আসে সেখান থেকে। এ বেতনেই ওষুধ কেনার টাকা হয় না তার। মাদরাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় ছেলেপেলে জড়ো হয়ে পেছন থেকে বলতে থাকে পাগলা! পাগলা! পাগলা!
তালহা বারবার পেছন ফিরে তাকায়। করিম বারবার তার মাথা সামনে ঘুরিয়ে দেয়।
এভাবেই দিন যায় ওদের বাপ বেটার। দুজন মিলে মসজিদ পরিস্কার করে। বাবা মেঝে মোছে তো ছেলে জানালা পরিস্কার করে। ত্যানা চেপার সময় এক প্রান্ত ধরে থাকে তালহা। কচি হাতে বারবার ফসকে যায়। পানি ছিটে গায়ে লাগে। করিম হাসে। পরক্ষণেই চুপ করে যায়। এদিকে বড় হুজুর এ মসজিদে ইমামতি করে। একদিন এক ছাত্রের বাড়ি দাওয়াতে যায় বড় হুজুর। ইমাম হিসেবে পাঠায় অন্য আরেক শিক্ষককে। যার সাথে আব্দুল করিমের কথা হয়েছিল। যে তার ছেলেকে মাগনা পড়াতে চেয়েছিল। মুয়াজ্জিন তাকে দেখতেই এগিয়ে এসে সম্মান করে। কিন্তু সে হুজুর বলে আজ আপনে নামাজ পড়ান। আপনার আজান মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। পিড়াপীড়ির পরও মুয়াজ্জিনকে দিয়ে সেদিন নামাজ পড়ায় সে হুজুর। মুয়াজ্জিনের কেরাত সত্যিই সুন্দর। কি সুন্দর করে কুরআন পাঠ করে। নামাজের পর জনগণের কেউ কেউ হুজুরকে প্রশ্ন করে নতুন ইমাম নিয়োগ হয়েছে নাকি। হুজুর হেসে বলে কেন? পছন্দ হয়েছে? মানুষ বলে অবশ্যই। তার পড়া অনেক সুন্দর। কেউ খেয়ালই করে নি সেটা মুয়াজ্জিন ছিল। হুজুর বলে আল্লাহ চায় তো আপনাদের আশা পূরণ হবে।
এদিকে জনমনে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে নতুন ইমামের। বড় হুজুর আসার পর ঘটনা শুনে তার ভাল লাগল না। মানুষের মনে তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ পেতে থাকে। কারণ তার কণ্ঠ তেমন ভাল ছিল না। নতুন ইমামের প্রতি মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা দেয়।
এদিকে রমজান মাস শুরু হয়ে যায়। রমজানে মসজিদে মুসল্লীর সংখ্যা বাড়ে। ইফতারের আগ মুহূর্তে মুয়াজ্জিন কুরআন তেলাওয়াত করত। মানুষ তার কুরআন পাঠ ও তার কণ্ঠ সম্পর্কে আরো অবগত হল। এভাবে বড় হুজুরের হিংসার পাত্রে পরিণত হতে লাগল মুয়াজ্জিন। কিন্তু এসব নিয়ে করিমের কোনো চিন্তা ছিল না। সে শুধু অপেক্ষায় ছিল কবে সে তার যয়নবের সাথে দেখা করবে। তার কাছে যাবে। তার চিবুক ধরে আদর করবে। ঈদের সামনে তার জন্য কী কিনবে। সে হয়ত আগের চেয়ে সুস্থ। কিন্তু কী বা কিনবে? তার কাছে তো টাকা নাই। তালহাকে অনেক কষ্টে একটা পাঞ্জাবি সেট বানিয়ে দিয়েছে রমজানে মানুষের কিছু হাদিয়ার টাকা জমিয়ে। যয়নব কালো মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করে। ঈদের দিন কালো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবে বাড়িতে। করিম এইসব অপেক্ষায় বিভোর। তবে দুই তিন মাস হল তার ঠিকমত ঘুম হয় না। মাথা প্রচণ্ড ব্যাথা করে। ছেলেকে নিয়ে প্রচুর চিন্তা তার। বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে বড় হয়ে কী হবে? এসব ভাবনায় সে আরো চেকন ও শুক্নো হয়ে গেছে। এভাবেই সময়ের পিঠে ভর করে চলে আসে কাঙ্খিত ঈদ। ঈদের নামাযের শেষে কিছু হাদিয়া পায় করিম। মসজিদ থেকে তিনদিন ছুটি পায় ঈদের জন্য। ছেলেকে সাজিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনে তার অনেক শান্তি আজ। জয়নবের অসুস্থতাও কমেছে এতদিনে হয়ত। সে তার জন্য একটা শাড়ি কেনে। হোটেল থেকে কালো মিষ্টি কেনে। ছেলেকে নিয়ে পরের দিন সকালে বাড়ি পৌছে। লম্বা পথ। যয়নব চিঠি লিখতে পারে না। তাই তাদের মধ্যে কথাও হয় না। এক দুইবার কাকে দিয়ে যেন চিঠি লিখিয়েছিল। বলেছিল আগের চেয়ে সুস্থ।
বাড়ি পৌছে দেখে বিছানায় জয়নব নেই। মন খুশিতে ফেটে পড়ে করিমের। জয়নব সুস্থ হয়েছে। হঠাৎ অনুভব করে পেছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। ফিসফিস আওয়াজে বলছে কেমন আছেন আপনে? করিমের তপ্ত আত্মা এক নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে যায়। শরীরের লোমের প্রতিটি গোড়ায় যয়নবের নামের শিরশির জাগে। পেছনে ফেরে করিম। দেখে কেউ নেই। দুষ্ট হেসে নিজেকে তাচ্ছিল্য করে। রান্না ঘরের দিকে ছোটে করিম। সেখানেও যয়নব নেই। কোথায় যে যায় যয়নব সে জানে না। সুস্থ হওয়ার পর একটু বেশিই নড়াচড়া করছে পাগলিটা। মনে মনে ভাবে করিম। হঠাৎ দমকা হাওয়া করিমের মুখে এসে পড়ে। তার মুখ ফিরে যায় বাড়ির আঙিনায়। সামনে কে? করিম শিহরিত। আম গাছের নিচে এটা কার কবর ? আঙিনা জুড়ে নিস্তব্ধতা। ওপাশ থেকে শাশুড়ি আসে। চোখে মুখে প্রশ্ন করিমের। নিস্তব্ধতাই যার উত্তর। সাথে সাথে করিম বাড়ি ত্যাগ করে ছেলেকে রেখে। এক মুহূর্তও দেরী করে না সেখানে। মসজিদের পথ ধরে। চোখ জলশুন্য তার। মুখ যেন এক কেজি ওজনের শক্ত পাথর। গভীর রাতে মসজিদে ফেরে করিম। ওজু করে। আজান দেয়। আল্লাহু আকবার বলে টান দেয়। যেন পৃথিবীর সকল ব্যথা তার কণ্ঠে গচ্ছিত। এ এমন এক ডাক যেন তার কথা আসমান জমিন বিদীর্ণ করে আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌছাচ্ছে। যেন আল্লাহকে বলছে কেন? কেন?
গলার রগ ফুলে উঠছে তার।চোখ দুটো যেন বের হয়ে আসছে। এত আওয়াজে সে কখনো আজান দেয়নি। আজকের আজানে তার সুর নেই। আছে অসহায়ত্ব। আছে মিনতি। আছে এক রাশ অভিমান। কণ্ঠ থেকে ঝরতে থাকে হাজার কম্পনের ধুন। যেখানে কান্না ও বেদনার মিশ্রণে এক অনুভূতিময় আবেশ তৈরী হয়। রীতিমত কাঁপতে থাকে তার গলা। পাশের বাড়ি থেকে একজন মুসল্লি চলে আসে মসজিদে। ঢুকে দেখে মসজিদের ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটায়। এ অসময়ে আজান? সে বুঝতে পারে না। হঠাৎ সামনের কাতার থেকে লাফ দিয়ে হিঁচকিয়ে ওঠে মুয়াজ্জিন। চিৎকার করে হেঁচকাতে থাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নামে। মাথা সামনে পেছনে তিব্র বেগে দুলাতে থাকে। সাথে কি যেন জয়নব নামের আবোলতাবল কিছু আওড়াতে থাকে। তাকে ডেকেও কোনো সাড়া পায় না মুসল্লি। অনেক্ষণ চেষ্টার পরও একই অবস্থা। বুঝতে আর বাকি থাকে না লোকটা আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। করিম তার দুনিয়া পরিবর্তন করে ফেলে। যে দুনিয়া সাধারন মানুষের না। মানুষের দুনিয়ায় সে হয়ত এখন পাগল কিন্তু তার দুনিয়ায় সে শুধুমাত্র কষ্টপ্রাপ্ত একজন সুস্থ মানুষ। রাত গভীর হয়। করিম তার নিজস্ব দুনিয়ায় আরো তলিয়ে যায়। যার নিয়ম নীতি সবই আলাদা। যার নিয়মের সাথে এত বিশাল এ দুনিয়ার কোনো মিল নেই। এ এমন এক দুনিয়া যেখানে কখনো ভোর হয় না। কিন্তু এ দুনিয়াই তার কাছে প্রিয় কেননা এখানে জয়নব আছে।
তারিখঃ এপ্রিল ২৫, ২০২৪