গরাদ
সৌরীণ মুখার্জী
স্টাফরুম থেকে বেরোনোর সময় আবার লোকটার সাথে দেখা হলো। গত দু’দিন ধরেই এই মানুষটাকে দেখছি, আজ আবার দেখলাম। উস্কখুস্ক চুল, পরনে একটা অপরিষ্কার জামা, কাঁধে গামছা জড়ানো – উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, কিছু বলতে চায় বোধহয়। গত দু’দিন নিজে থেকেই এড়িয়ে গেছি, নিজের তাড়া ছিল, তার ওপর জায়গাটার সাথে এখনও সেভাবে পরিচিতি হয়নি – হুটহাট আগ বাড়িয়ে কথা না বলাই ভালো। আজ বোধহয় আর পালানো যাবে না, এদিকেই এগিয়ে আসছে।
“নমস্কার মাস্টার, আমি ভানু। আমার ছিলা থিরি কেলাসে পড়ে – নাম অমল। রোজ রোজ একই নালিশে ছুটে আইসতে হইচ্ছে, এমনিতে শান্ত বটে তবে খাতায় যে কী সব হাবিজাবি লিখে বুঝি নাই । আমি রিক্সা চালাই, পড়ালেখাও তেমন নাই। কষ্ট করে ছিলাটাকে মানুষ করছি আর উ দিখুন না কী সব লিখছে। বাংলার মাস্টার সব কাটে কুটে দিচ্ছে আর উ বলছে উ নকি ঠিকই লিখ্যাছে। তা শুনলাম বটে আপনিও নকি বাংলারই মাস্টার, ইকটু যদি আমার ছিলাটাকে দ্যাখেন বড় ভালো হয়।”
লোকটার কথার এই দেহাতি টানটা বেশ মানিয়েছে। এখানে অধিকাংশ লোকের ভাষাতেই মানভূমী ছোঁয়া রয়েছে। এই দুদিনেই আমার বেশ মনে ধরেছে, আমিও মাঝে মাঝে চেষ্টা করি তবে এভাবে বলতে পারি না। বড্ড মেকি শোনায় আমার ক্ষেত্রে।
আমি বললাম – “আপনি বরং বাংলার মাস্টারমশাই দীপেনবাবুর সাথে কথা বলুন। আমি তো এই আজ থেকেই ক্লাস শুরু করবো, তাই এ ব্যাপারে উনিই ভালো বলতে পারবেন। এতদিন তো উনিই ক্লাস নিয়েছেন।”
লোকটা খানিক অসহায় হয়ে আবার বলল – “দিখুন না মাস্টার আপনি বইল্যে যদি কিছু হয়। দীপেন মাস্টার তো বইল্যে দিয়েছে ইমনটা আর হইল্যে ইস্কুল থেকে আমার অমলকে তাড়ায় দিবেক।”
আমার ক্লাসের দেরী হচ্ছিলো। স্কুলে যদিও দুদিন হয়ে গেল, কিন্তু ক্লাসে আজ’ই প্রথম। অতএব ভানুকে ঘাড় নেড়ে ভরসা(?) দিয়ে একরকম পালিয়েই এলাম।
* * * * *
এদের ইউনিফর্মটা দেখলে আমার নিজের স্কুলের কথা মনে পড়ে। অবশ্য ওখানে প্রকৃতি এত উদার নয়, বা হয়তো আমরাই দমিয়ে রেখেছি প্রতিদিন। এখানে জানলা খুললেই দূরে জঙ্গল। এখন বসন্তের সময়, পলাশের আগুনে পুড়তে পুড়তে আমিও যেন কোথাও হারিয়ে যাই। ওদের কথায় ঘোর কাটে, “মাস্টার আজ থেকে তুমিই রোজ পড়াবে? দীপেন মাস্টার আসবে না?”
“মাস্টার, তোমার ঘর কি শহরে? ওখানে সিঁড়িগুলা দৌড়ায় বলো?”
“মাস্টার, তুমি জঙ্গলে গেছো? ওখানে হাতি আছে। জানো, মাঝে মাঝে এ’দিকেও নেমে আসে।”
“মাস্টার, তোমার হাতের ঘড়িটা খুব সুন্দর ।”
এদের এই আন্তরিক প্রশ্নগুলো আমার স্মিতহাসিটাকে আরও চওড়া করল। কী সহজ সরল এরা। প্রাণ খুলে কথা বলে, খিলখিল করে হাসে, কৌতূহলী চোখগুলো এক আকাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, একদম পেছনের বেঞ্চে একটা ছেলে চুপ করে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে। এই কোলাহলের ভেতর একটুও খেই হারায়নি। এদের মতো ওর চোখদুটোও কিছু খুঁজছে বোধহয়, তবে ক্লাসের ভেতরে না বাইরে।
হাঁকলাম- “এই, বাইরে হাঁ করে কী দেখছিস তুই? কী রে! হ্যাঁ,হ্যাঁ, তোকেই বলছি।”
একটু ভয়ে ভয়ে বললো- “কিছু না।”
আমি এগিয়ে গেলাম, তখনও দেখি বেশ ভয় পেয়ে আছে। বইয়ের খোলা পাতাটার দিকে তাকালাম।
“ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজছে দূরে,
তিনটে শালিখ ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে —”
ওর মাথাটায় আলতো করে হাতটা রাখলাম। খানিকটা ভরসা পেল বোধহয়। বললাম – “এবার বল তো কী দেখছিলি?”
“খুঁজছিলাম মাস্টার, শালিখ খুঁজছিলাম। আচ্ছা, বইয়েও দেখো দু’টো শালিখের ছবি আছে, আমি কখনও একসাথে তিনটে শালিখ দেখিনি। তুমি দেখেছো,মাস্টার?”
উত্তর খুঁজে পেলাম না। এই কবিতাটা প্রথম পড়ে আমারও খানিকটা এরকমই ভাবনা জেগেছিল। তবে তিন নাম্বার শালিখটাকে আজও খুঁজে পাইনি। একটা হাসির রেখা ফুটলো আমার মুখে। বললাম – “আমিও দেখিনি, তুই খুঁজে পেলে জানাস তো।”
ওর বইটা হাতে নিয়ে উল্টালাম। নাম – অমল মাহাতো,
শ্রেণী- তৃতীয়। বললাম- তোর বাংলা খাতাটা ছুটির পরে একটু দিয়ে যাস তো।
* * * * *
শালবনের মাঝ দিয়ে রাস্তাটা চলেছে। এখান থেকে আরেকটু এগিয়েই আমাদের স্টাফ কোয়ার্টার। পায়ের নিচে মড়মড় করে শুকনো পাতাগুলো ভাঙছে। দূরে কয়েকটা ময়ূর আমাকে দেখেই আড়াল হল । ফোনটা বেজে উঠল, অনেকগুলো মেসেজ একসাথে ঢুকলো হয়তো। এখানে নেটওয়ার্ক সবসময় পাওয়া যায় না। তবে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। এত লোকের এত অহেতুক প্রশ্নের উত্তর অন্তত আমাকে দিতে হচ্ছে না। খানিকটা যেন স্বস্তি আছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশিরভাগ মেসেজই ঝিলামের। দুটো মিসডকল অ্যালার্টও রয়েছে। একটা বাড়ির থেকে, আরেকটা ঝিলামের।
“চাকরিটা ছাড়ার আগে একবারও ভাবলি না? এভাবে পালিয়ে গেলি? ক’ টাকাই বা দেবে ওই গ্রামের স্কুল?”
“আর কিছুদিনের মধ্যেই একটা অনসাইট পেতিস। কত প্ল্যান করেছিলাম, অরিন, একসাথে নিজেদের মতো বাঁচবো। প্যারিস, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড কত জায়গা দেখার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কাজের চাপ কোথায় থাকে না, বল? তা বলে এরকম একটা সিদ্ধান্তই নিতে হল তোকে?”
“তুই ফিরে আয়, অরিন। না হলে আমি বাবাকে বলে দেব- তোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“উত্তর দিস, অরিন। চিন্তা করিস না, তোর যা কেরিয়ার গ্রাফ তা’তে অনায়াসে আবার একটা ভালো চাকরি পেয়ে যাবি। তুই শুধু ফিরে আয়।”
একঘেয়ে একই মেসেজ, একই কথা। আর ভালো লাগছে না। উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। আর পেরে উঠছিলাম না। ডেডলাইন, ক্লায়েন্ট মিটিং, বিজনেস ট্যুর, বসের হুমকি… কী ছিল ওখানে আমার জন্য? মাস গেলে মোটা টাকা আসতো ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতা? ইচ্ছে হলেই নিজের মতো দুদিন থাকা যেত না, ছুটি নিতে হলে দশবার ভাবতে হত। আবার বলে-কয়ে দুটো দিনের ছুটি ম্যানেজ হলোও যদি, সেদিনও ফোনের পর ফোন। বইপড়ার সময় নেই, কিচ্ছুটি লেখার সময় নেই, তাহলে আছেটা কী? আর যা আছে, তা তো আমি চাইনি। জার্মানি, প্যারিস, ইতালি দেখে কী হবে আমার? নিজের জায়গাটাই তো দেখা হয়ে উঠল না। ওই হাই-রাইজের ছোট্ট কেবিনটায় বসে যখন বাইরে তাকাতাম, নিজেকে খুব ছোট মনে হত। মনে হত- কেউ যেন শিকল দিয়ে আমার পা দুটো বেঁধে দিয়েছে, হাতের বলও ফুরিয়েছে। আমি চাইলেই উড়তে পারতাম না, দৌড়াতে পারতাম না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসত।
পাখিপাহাড়ের মাথায় লাল সূর্যটা তখনও রয়েছে। আর হয়তো কিছুক্ষণ। তারপর ঝুপ করে রাত নেমে আসবে। সব শব্দ ফুরিয়ে শুধু ওই ঝিঁঝিঁর ডাকটা জেগে থাকবে সমস্ত প্রেক্ষাপট জুড়ে।
* * * * * *
খাওয়ার পর মায়ের সাথে কথা হলো ফোনে। এমএনসি’র চাকরি ছেড়ে এই প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল মাস্টার- কারোরই খুব একটা সায় ছিল না। তবে আমি জানি, মা মুখে না বললেও আমার ইচ্ছেতে প্রশ্রয় দিয়েছে মনে মনে। রোজ এই একটা সময় মায়ের সাথে কথা হয় আমার। সারাদিনের গল্পগুলো জমে থাকে। ঝিলামকে আর ফোন করিনি। করার দরকারও বোধ করিনি। ওর ইচ্ছেগুলো এখন আর মেনে নেওয়ার ইচ্ছে নেই। কয়েকদিন না হয় নিজের ইচ্ছেয়, নিজের মতো বাঁচলাম।
ঘুম আসছিল না। নতুন জায়গায় প্রথম কিছুদিন এই সমস্যাটা আমার হয়। অমলের খাতাটা টেবিলের ওপর পড়েছিল। হাতে নিয়ে ওটাই ঘাঁটতে শুরু করলাম।
”আমরা চাষ করি আনন্দে”- আমরা কারা?
অমল: “আমরা সবাই। আমি, দিনু, পুলু, কানাই, আমরা সবাই কানাইয়ের বাবার জমিতে চাষ করি। কানাইয়ের বাবা আমার বাবার বন্ধু। বাবাও মাঝে মাঝে চাষ করে।”
”দারোয়ান গায় গান
শোন ঐ, রামা হৈ!”- কে গান গায়?
অমল: “সুদাম বাউল। ও সকাল হলেই গান ধরে। আমি পাকুড় গাছের পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনি।”
তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?
অমল: “কিছু না। একটা সাইকেল কিনবো, আর বাবাকে চাপিয়ে শহরে নিয়ে যাব।”
* * * * * *
স্টাফ রুমে হৈ হৈ পড়ে গেছে। প্রধান শিক্ষকও হাজির হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। দীপেনবাবু আর আমার মধ্যে বেশ কয়েকবার তর্কাতর্কি চলেছে। সকালে স্কুলে এসেই অমলের খাতাটা ওনার হাতে দিয়ে বলেছি – “এগুলোর কী মানে? ছেলেটা ঠিক কোন জায়গায় ভুল করেছে আমাকে বুঝিয়ে দিন।”
উনি হেসেই গেলেন, তবে আমি জানি উনিও চমকেছেন। আমি সোজাসুজি বললাম – “রবি ঠাকুর কি ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’ কবিতায় ‘আমরা’ বলতে শুধু চাষীদেরই বুঝিয়ে গেছেন? মানে আমার তো জানা নেই, তবে আপনাকে আলাদা করে বলে গেছেন নাকি? আচ্ছা,’দারোয়ান গান গায়’- এখানে দারোয়ানের নাম কি সুদাম হতে পারে না? ও হয়তো বাউল গান জানে তাই সুদাম বাউল। আর পাকুড় গাছটা না হয় অমলের কল্পনা। বড় হয়ে সাইকেল নিয়ে বাবাকে শহর নিয়ে যাওয়াও কিন্তু একটা বিরাট লক্ষ্য। এখানেও কোনো ভুল দেখলাম না। এবার আপনি বলুন তো আপনার আপত্তিটা ঠিক কোথায়?”
এক নাগাড়ে বলে এরপর থামলাম আমি। বসের ওপর রাগ, ডেডলাইনের ফ্রাস্ট্রেশন, ঝিলামের উত্তর- পায়ের শিকলটা ছিঁড়ে যেন বেরিয়ে এলো সবটা। এবার খানিকটা স্বস্তি হচ্ছে। দীপেনবাবু উত্তর দিলেন না। তবে অসম্ভব চটেছেন বুঝতে পারছি, প্রধান শিক্ষকও চুপ।
আমি আবার বললাম – “এভাবে এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর ভাবনাগুলোকে গলা টিপে মারবেন না দয়া করে। ওদেরকে ওদের মতো ভাবতে দিন। আমরা ওদের গাইড করব অবশ্যই, তবে নিজেদের ভাবনার বোঝটা ওদের ওপর চাপাবো না। বাধহীন চিন্তাগুলো থেকে দেখবেন অনেক কিছু উঠে আসবে, তা’তে হয়তো আমরাও নতুন কিছু শিখতে পারব।”
ক্লাসে যাওয়ার সময় দেখলাম, ভানু দাঁড়িয়ে আছে দূরে। মনে হলো ওর গাল আর চোখের কোণটা চিকচিক করছে। ঘাম না অন্য কিছু ঠিক বুঝলাম না।
* * * * *
সকালের দিকে ঠান্ডাটা এখনও আছে। গায়ে শালটা জড়ালাম। আয়নার দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো দাড়িটা কাটতে হবে এবার। তবে এই শাল-পলাশ-মহুয়ার বনে মাঝে মাঝে ওটাও ভীষণ মানানসই মনে হয়। আজকাল রোজ সকালে অমল আসে। ভানু বলেছে, আমি যেন ওর বাংলাটা একটু শুধরে দিই। তবে শুধরানোর মতো এখনও তেমন কিছু চোখে পড়েনি, বরং ওর ভাবনাগুলো আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। কাল থেকে একটা লেখাও শুরু করেছি- রোজনামচার গল্প। কর্পোরেটের যান্ত্রিকতা থেকে এভাবেই হয়তো আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে পারব।
অমল জানালার দিকে তাকিয়ে পড়ে যাচ্ছে –
“তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার
মনে মনে ভাবে বুঝি ডানা এই ,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার।”
আমিও ওর কথার সুর ধরে ওদিকেই তাকিয়ে আছি। হারিয়ে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি বাইরে শালের বনে। দূরে কয়েকটা ময়ূর উড়ে বেড়াচ্ছে। না, এবার আর আমাকে দেখে ওরা আড়াল হলো না। আরও দূরে একটা হলুদ পলাশের গাছ। হলুদ পলাশ আমি জীবনে এই প্রথম দেখলাম। আমি ওর নিচটাতে গিয়ে থামলাম। আচ্ছা, ঝিলাম হলুদ পলাশ দেখেছে কখনও? নিয়ে যাব ওর জন্য, ও নেবে তো?
এখন আমার খুব ইচ্ছে করছে – জানালার এই গরাদগুলো ভেঙে ফেলি।
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১