গোলকধাঁধা আঁকার কথা
মিঠু
আঁকার আবার কথা কি হে? এ শুধু দেখার, চোখ- প্রাণ জুড়াবার। এইরকম একটা বিশ্বাস অনেকের মতো আমারও ছিল।
ছোট্ট থেকে পড়া ( প্রধানত গল্প ও উপন্যাস) এবং আঁকার জগৎ আমার কাছে ভালোবাসার দুটি ভিন্ন দিক ছিল। পড়ার নেশায় অল্পবিস্তর যে কয়টি গল্প উপন্যাস, বন্ধু ও স্কুল লাইব্রেরি থেকে ধার করেছি, তাই পড়েছি। আঁকা নিয়ে ভালো বাংলা লেখাগুলো আজও হাতের কাছে পাইনি আর আমি এমনই কুঁড়ে- বেগম যে জোগাড় করাও হয়ে ওঠেনি। তাই আগেভাগেই বলে রাখছি যে আমার এই লেখাটি একটি অবান্তর প্রচেষ্টা মনে হলে, সমালোচনা করতে দ্বিরুক্তি করবেন না। এ আমার নিতান্তই ব্যাক্তিগত আঁকা – পড়া – লেখার কথা।
আমি আর্ট কলেজে পড়ার, থুড়ি শেখার, সুযোগ পাইনি, শিল্প-সাগরের ধারে একটু বসেছি মাত্র, তাই ধৃষ্টতা মার্জনা প্রার্থী।
প্রথম যখন আঁকতে শুরু করি, তখন আমি কেবল মানুষ ও জীবজন্তুই আঁকতে ভালবাসতাম। তাও আবার হুবহু যেমনটি আছে তেমনটি আঁকার একটা চ্যালেঞ্জ থাকতো মনে। সাধারণ মতে, একদম “ফটোর মত” আঁকা যেমন দক্ষতার পরিচয়। পরে বুঝলাম, যদি আঁকার গভীরে পৌঁছতে চাই তাহলে এই হুবহু বাস্তব আঁকা আসলে শুধুমাত্র স্কুল লেভেলের ভালো রচনা লেখা শেখা মাত্র।

Medium- Ink and paper
যেমন, কেউ যদি একজন মানুষ বা গাছ সম্পর্কে একটি সুন্দর রচনা পুঙ্খানুপু্খভাবে বর্ণনা করে পাঠকের মনে একটি নিপুণ ছবি ফুটিয়ে তোলেন, তার মূল্য কিছু কম নয়। কিন্তু এক কবি বা সাহিত্যিক কয়েকটি শব্দে বা গল্পের এক নিবিড় অধ্যায়ে সেই গাছ বা মানুষের চিত্রটি দিয়ে আপনার মনের ভিতরটা একেবারে যখন উথাল পাথাল করে দেয় সেইটা খানিক সৃষ্টি কাজে নিজস্বতার পরিচয়।
প্রথমদিকে আঁকা শিখে, কাউকে সামনে বসিয়ে বা তার ছবি দেখে পোর্ট্রেট এঁকে বেশ একটা গর্ব বোধ হয়। ঠিক রেখায় রেখায় মিলে গেলো। এরপর আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগতে শুরু করে, যে কাজ ক্যামেরা এক সেকেন্ডে করে ফেলে, সেইটাই আমি বসে বসে এক ঘণ্টায় করবো কেন? তবে কি আমার মন আর হাত একটি ক্যামেরার বিকল্প মাত্র?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সাধারণত শিল্পকলার ইতিহাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন। আর্ট কলেজের অনেক ছাত্রকে শিল্পকলার ইতিহাস ক্লাস ফাঁকি দিতে দেখেছি । এই থিওরি বিষয়টা বেশ খটোমটো ভাষায় জর্জরিত এবং অনেক ছাত্ররাই এটিকে খুব বেশি সুনজরে দেখেনা। হাতে কলমে আঁকা শেখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তখন।
সৃষ্টিকে কালোত্তীর্ণ করতে হলে কালের খবরও যে রাখা দরকার সেইটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমার।
যেই সময়ে ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়নি সেই সময়ের শিল্পীদের কাছে হুবহু প্রকৃতি বা মানুষের চেহারা বা তার ভাবখানা মূর্ত করা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। তাই সেই যুগের বিখ্যাত শিল্পীদের অমূল্য আঁকা সম্পূর্ন বাস্তবধর্মী। আজকের আমি যখন অগণ্য যুগের, বহুস্তরের সংস্কৃতির উপরে বসে, প্রযুক্তির উচ্চ মাধ্যম নখের গোড়ায় ধরে আছি, তখন আমার বিষয় বস্তু কি কেবলমাত্র যা চোখের সামনে দেখছি তাকেই নকল করা মাত্র? মনের আলোড়ন ব্যক্ত করবো কি শুধু একটা ঝোড়ো হওয়ার গাছ দিয়ে না একটা সুন্দর ঘোমটা পরা প্রদীপ হাতে নারীমূর্তি এঁকে? দুটোই নিঃসন্দেহে মনোরম ছবি, কিন্তু আমার মন যে সমকালীন ঘটনা প্রবাহে ডুব দিয়ে অনেক বেশি জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। কি করি তখন?
তবে কি আমি বলতে চাইছি যে আলোকচিত্র কেবলই সামনের বস্তুটিকে বাস্তবের আলোতে দেখিয়ে শেষ হয়ে যায়? সে কি প্রযুক্তির দক্ষতা ছাড়িয়ে গভীর ভাষা ব্যক্ত করতে অক্ষম? এইযে ক্যামেরা, এইটিও আসলে আরেকটি মাধ্যম মাত্র। সমসাময়িক শিল্প জগতে তাই এই মাধ্যমগুলো নিয়ে অনেক ব্যবধানের সীমারেখা গেছে ঘুচে।
Contemporary visual art এখন ড্রইং -পেইন্টিং, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি, ভিডিও, পারফরম্যান্স … যা কিছু চোখে দেখে আনন্দ পাওয়া যায় সবই এক শিল্প সূত্রে বেঁধে দিয়েছে। শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে নিজের সৃষ্টির অভিব্যক্তি দিয়ে থাকেন।
যখন বম্বেতে ২০০০ সাল থেকে, প্রথম প্রথম performance art বা ভিডিও আর্ট দেখতাম, বেশ বিভ্রান্ত হতাম। এমনকি অনেক ফটোগ্রাফিক আর্টও হৃদয়ঙ্গম হতো না। আসলে মনের ভিতর একটা আড়াল ছিল, এইসব মাধ্যমগুলোর প্রতি।
ধীরে ধীরে পড়াশোনা শুরু হলো aesthetics নিয়ে। ইতিহাসের আড়াল থেকে শিল্পকে সামনে পেলাম। জানলাম যে বিভিন্ন ভৌগলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা কিভাবে শিল্পচেতনার বিবর্তন এনেছে। ইউরোপে গ্রীকদের অতি প্রাচীন অপূর্ব ভাস্কর্যের ঐতিহ্য কিভাবে হারিয়ে গেলো শত শত বৎসর আবার তারা ভিন্নস্বাদে জেগে উঠলো রেনেসাঁয়। আবার ভারতে কিভাবে অজন্তার গুহাচিত্র অনুপ্রাণিত করলো বাংলার শিল্পীদের স্বদেশী শৈলীতে ছবি আঁকতে।
আমার নিজস্ব সৃষ্টি অভিজ্ঞতা থেকে বলি এবার। আমার নিজের মনের মধ্যে একটা ধোঁয়ার মত ভাবের আনাগোনা সৃষ্টি হয়। কোনো অনুভূতি একটা অবচেতন মনে নাড়া দিচ্ছে, সেটিকে ঠিক গদ্যে পরপর লিখে ফেলা যায় না কিন্তু ছায়ার মত একটা ছবি দেখতে পাই। তখন আমি ভাবতে বসি এটি কি জলরঙ করবো, না ক্যানভাসে করবো, নাকি ফটোগ্রাফিতে যথার্থ ভাবটি আনা যাবে। এই সময় এও ভাবি যে আমি তো ফটোগ্রাফির বিশেষ কিছু জানিনা। তখন ফটোগ্রাফার বন্ধুদের অনুরোধ করি যেমনটি আমি ভাবছি তেমনটি স্কেচ করে বুঝিয়ে দিই। সবাই বোঝেনা, এক আধজনকে ভাগ্যবলে মেলে। তখন তৈরি হয় সেই কাজ, দুজনের প্রচেষ্টায়।
এমন যৌথ প্রচেষ্টায় বহু শিল্পীরা আজকাল ভিডিও আর্ট, ইনস্টলেশন আর্টও সৃষ্টি করে থাকেন।

Style and fashion
এইরকমভাবে সৃষ্টির ব্যাপারটি এখনও খুব বেশি লোক জানেনা। কারণ অবশ্য নিয়মিত গ্যালারি যাওয়া খুব কম লোকেরই অভ্যেস। আর তাঁদের মধ্যেও অনেকেই বেশ মুগ্ধতা বা বিরক্তির অনুভূতিটুকু নিয়ে প্রদর্শনী দেখে বেরিয়ে যান। তার বেশি ভিতরে জানার সময় ও ধৈর্য্য কজনেরই বা থাকে!
আমার দুটো কাজের ছবি সঙ্গে দিচ্ছি, দুটো ভিন্ন মাধ্যমে করা কিন্তু বিষয়টি কাছাকাছি। প্রথমটির নাম দিয়েছি “স্টাইল বনাম ফ্যাশন”, কাগজে আঁকা তুলি দিয়ে। দ্বিতীয়টির নাম “ক্লোনিং”, ফটোগ্রাফ (কনসেপ্ট ও মডেল আমি নিজে, ফটোগ্রাফার নরেন বাঙ্গেরা) ।
যে সময়ে ছবিগুলি বানিয়েছিলাম, সেই সময় খুব হুজুগ উঠেছিল চুল রঙ করার। “স্টাইল বনাম ফ্যাশন” ছবিটিতে আমি মাঝখানের প্যানেলটি স্বাভাবিক কালো চুলের মানুষটির শুধু তার আসল চুলের রঙে তার নিজস্ব স্টাইলে রেখেছি, সেটাই তার পরিচয়। বাকি চারটি প্যানেল নানান রঙের চুলের বাহারে তাদের মুখোশ পরা চেহারার ফ্যাশনে। সেই রবিঠাকুরের কথায়, ” ফ্যাশনটা হল মুখোশ আর স্টাইলটা হল মুখশ্রী”।
দ্বিতীয়টি আমার প্রতিক্রিয়া মন্তব্য চুল সোনালী (blonde) রঙ করার ওপর। আমি নিজে পরচুলা পরে ছবি তুলিয়েছিলাম। ফটোগ্রাফার নরেন বাঙ্গেরাকে আমার ভাবনাগুলো বুঝিয়েছি বহুদিন ধরে, স্কেচ ও করে দিতাম ঠিক যেমনটি আমার মনে আসছে। এখন প্রশ্ন তো করতেই পারেন এটিও কেন আমি আঁকলাম না, ফটো তুলালাম কেন? কারণ, সেটি শিল্পী হিসেবে আমার শেষ নির্ণয় – আমার মনের ছবিটি চাক্ষুষ দেখবার জন্য আমি কোন মাধ্যমটি বেছে নেবো, (সব সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে), সে কেবল আমিই জানি! তারপর দর্শক বিচার করুন কোনটা ভালো কোনটা মন্দ লাগছে তাঁদের।
অস্কার ওয়াইল্ড এর একটা আমার প্রিয় কোটেশনের মর্মার্থ দিয়ে শেষ করি… আমি লিখি অত্যন্ত স্বার্থপর কারণে; আমি লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। যদি পাঠক সেটা উপভোগ করেন সেটি জেনে আমার ভালো লাগে। কিন্তু যদি তারা আমার লেখা অপছন্দ করেন তাহলে তাদের সাহায্য করার কোনো উপায় দেখিনা।
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১