চন্দন ঘরে ফিরবে না
সুধাংশু চক্রবর্তী
এবছরও ফুলমালা এবং আলোকসজ্জায় শোভিত ছয় চাকার ট্রাকে চেপে পাড়ার যুবক-যুবতীদের সঙ্গে ঢাকের ‘ড্যাং-ড্যাড্যাং-ড্যাং’ তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীর দোলাতে দোলাতে সপরিবারে বিসর্জনে চলেছেন মাদুর্গা । প্রতিমাগুলো নিয়ে ট্রাকটা আর একটু পরই এই বাড়ির পাশ কাটিয়ে যাবে । বিগত পনেরো বছরের মতো প্রৌঢ়া অহল্যা অনেক আগে থেকেই এসে দাঁড়িয়েছেন সদর দরজা হাট করে খুলে দিয়ে ।
সপরিবারে মাদুর্গা যখন ট্রাকের ঝাঁকুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীর দোলাতে দোলাতে এই বাড়ির পাশ দিয়ে বিসর্জনে চলেছেন, অহল্যা তখনই জলভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলেন, ‘হে মাদুর্গা, বিসর্জনের ঘাটে যদি চন্দরের দেখা পাও তাহলে ওকে বলো বন্ধুদের নিয়ে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে বাড়িতে ।’
মাদুর্গাও শরীর দোলাতে দোলাতে অহল্যাকে যেন ইশারায় অভয় দিয়ে গেলেন । যতক্ষণ মাদুর্গার মুখটা দেখা গেল অহল্যা ততক্ষণই জলভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে । ওদিকে খোলা বারান্দায় বসে প্রৌঢ়া স্ত্রীকে শঙ্কিত মুখে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধ অমলকান্তি চট্ করে ভেবে নিলেন, এর পর আর কি কি করবেন অহল্যা । সেসব কথা ভাবতে ভবতেই গাঢ় বিষণ্ণতায় চাপা পড়ে গেলেন অমলকান্তি ।
মাদুর্গা দৃষ্টির বাইরে চলে যাবার পর ছেলে এখুনি ফিরে আসবে ভেবে সদর দরজা ভেজিয়ে রেখে এসে রান্নাঘরে ঢোকার মুখে স্বামীকে বিষণ্ণ মুখে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে অহল্যা আজও শুষ্ক হাসি হেসে বললেন – মা’কে বলে দিয়েছি গো । এখন আর বসে থাকার উপায় নেই আমার । চন্দর এখুনি বন্ধুদের নিয়ে ফিরে এলো বলে ।
খানিকক্ষণ পরই নারকেল কোরানোর আওয়াজ ভেসে এলো রান্নাঘর থেকে । ওই আওয়াজ শুনে অমলকান্তি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন । ফিবছর বিজয়াদশমীর দিনই ছেলের জন্য নিমকি এবং নারকেলের নাড়ু বানাতে বসেন অহল্যা । এবং হাতের কাজের ফাঁকেই বার দশেক দরজায় মুখ বাড়িয়ে দিয়ে অমলকান্তিকে শুধোন, ‘চন্দর কি বন্ধুদের নিয়ে চলে এসেছে গো’ ?
অমলকান্তিকে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে টেনে নামালো রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা অহল্যার উদগ্রীব কণ্ঠস্বর – চন্দর কি বন্ধুদের নিয়ে ফিরে এসেছে গো ?
বিগত বছর বারো যাবত স্ত্রীর এই প্রশ্নের জবাব দেবার হাত থেকে অমলকান্তি যে একপ্রকার নিষ্কৃতি পেয়েছেন আজও তারই প্রমাণ দিলেন নীরব থেকে । নীরব না থেকে উপায় কি ? এইমুহূর্তে তিনি যে জবাব দেবার মতো অবস্থাতেই নেই ।
তারিখঃ অক্টোবর ১১, ২০২৩