চিলেকোঠা

সকালে সবেমাত্র লিখতে বসেছি, এমন সময়ে মোবাইলটা ডিডিং শব্দে বেজে উঠলো। হোয়াটসঅ্যাপ-এ পৃথা মেসেজ পাঠিয়েছে অফিস থেকে। সকালে আমি একটু রিসার্চ করে তথ্য সংকলন করি, আর দুপুর ও সন্ধ্যায় সেই তথ্যের ওপর নির্ভর করে আমার উপন্যাসের কাহিনী বিস্তার করি। সবেমাত্র একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি – তিব্বতি, ইহুদি, ব্ল্যাক আমেরিকান আর সিরিয়ার গণহত্যার ঘটনাগুলিকে সংযুক্ত করে। প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন হচ্ছে, আর তাই এই সময়ে পৃথার মেসেজ-এ আমি একটু বিরক্তই হলাম। গত বছরে আমার লেখা একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘দ্য সোর্ড অফ সুলতান রাজিয়া’ বেস্ট সেলার হবার পর আমার একটু নাম হয়েছে – ইন্সটা, ফেসবুক, ট্যুইটারে নামের পাশে পেয়েছি নীল ‘ভেরিফায়েড’ টিকের আভিজাত্য। মেসেজটা খুলে দেখলাম লেখা আছে, ‘চিলেকোঠায় উঠে দেখতে ভুলো না, আজ সকালেও বাথরুমের এগজস্ট থেকে জল পড়েছে’। কাল রাতে প্রচুর বরফ পড়েছে  ক্যুবেক-এ। বাগান, রাস্তা, পেভমেন্ট সব সাদা বরফের চাদরে ঢাকা। এই ঠান্ডায় অ্যাটিকে উঠতে মন চাইছে না। পৃথা এ দেশে তিরিশ বছর কাটালেও চিলেকোঠাকে এখনো অ্যাটিক বলতে শেখেনি। দেশের চিলেকোঠা ও কানাডার অ্যাটিকের মধ্যে চরিত্রগত হয়তো কোনো তফাৎ নেই, কিন্তু আকৃতিগত তফাৎ তো আছেই। তাই আমার মনে হয় অ্যাটিককে চিলেকোঠা নামে না ডেকে অ্যাটিক বলাই উচিত। যাকগে, কাজে মন দিলাম; একটু বেলায় অ্যাটিকে ওঠা যাবে’খন।

শীতে ইউনিভার্সিটি ছুটি,  তাই প্রগতি এখন বাড়িতে; সকালে চায়ের কাপ নিয়ে টিভিতে খবর দেখতে ব্যস্ত। ভল্যুম একটু বেশি, নিচের ড্রয়িং রুম থেকে ওপরের স্টাডিতে আওয়াজ আসছে স্পষ্ট। মন বসছে না কাজে। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। নাঃ, অ্যাটিকের কাজটা সেরেই আসি। সিঁড়ির পাশে স্টোর রুম থেকে ফোল্ডিং মইটা বের করে প্যাসেজে সিলিঙের যেখানটায় অ্যাটিকে যাবার দরজা আছে তার নিচে রাখলাম। মইয়ের প্রথম ধাপে পা রাখতে গেছি, স্টাডির দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো আমার কৈশোরের স্বপ্নের রানী – তার পরনে কমলা রঙের পোশাক – লম্বা হাতের ব্লাউজ , সামনে উন্নত বক্ষ আর পেছনে উন্মুক্ত পৃষ্ঠ। নাভির নিচে ধুতির মতো পরা কমলা ফিনফিনে কাপড়। সেই গানটার মতো আমার বুকটাও ধক ধক করে উঠলো, নিজেই শুনতে পেলাম। সে এসে মইয়ে তার বাঁ হাত রাখলো। মাথাটা একটু তুলে আমার চোখে রাখলো চোখ। নিখুঁত সাজানো ভ্রুযুগলের নিচে দুটো গভীর কালো চোখ আর লম্বা নাকের শেষে লাল চেরির মতো ঠোঁট। নাকে এলো বর্ষার সন্ধ্যের হাস্নুহানার সতেজ মদির গন্ধ। মাথায় আমার হালকা ঝিম ধরেছে। তার ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক হলো, তার নিশ্বাস স্পর্শ করলো মইয়ের ওপর রাখা আমার ডান হাতের রোমকূপ। শরীর শিহরিত হলো আমার। দুই ঠোঁটের সামান্য ফাঁক দিয়ে মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁত দেখতে পেলাম। কানে এলো তার পাখির মতো কবোষ্ণ কণ্ঠস্বর।

– চিলেকোঠায় কেন যাচ্ছো জিষ্ণু?

আমার মুখে কোনো কথা এলো না। আমি তখনও আবিষ্ট। কিন্তু এর পরের শব্দগুলো আমার সমস্ত আচ্ছন্নতা আর ভালো লাগাকে ভেঙে চুরচুর করে দিলো।

– ওখানে তো সব্যসাচী থাকে। ওকে ওর মতোই থাকতে দাও।

আমি কোনো কথা না বলে তেতো মুখে মইয়ের দুটো ধাপ ওপরে উঠলাম।

– আমার কথা শোনো জিষ্ণু। তুমি আমার কাছে থাকো প্লিজ।

তার চোখে মুখে সব্যসাচীর জন্য এই আকুতি আমার উষ্মাকে যেন আরও উস্কে দিলো।

– আমি আর কোনোদিন কিন্তু তোমার কাছে আসবো না।

– কোনোদিন কি তুমি আমার কাছে এসেছো? তুমি তো সব্যসাচীর কাছেই থাকো সবসময়। আমার কথা তো তোমার মনে পড়েছে সব্যসাচীর জন্যই। চাইনা আমি তোমাকে।

আমি তার দিকে আর না তাকিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে মই বেয়ে উঠতে থাকলাম। সিলিঙের দরজা খুলে আমার মাথা ও শরীর ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো নিকষ-কালো অ্যাটিকের বরফ শীতলতায়। দু’পা এগিয়ে গেলাম বাথরুমের এগজস্ট যেখানে আছে সেদিকটায়। কিন্তু অন্ধকারের রংটা যেন ধীরে ধীরে কালো থেকে গাঢ় সবুজ হয়ে গেলো। পায়ে পেলাম সবুজ ঘাসের গালচের স্পর্শ। আমার ডানদিকে একটা ঝাঁকড়া বকুল গাছ, বাঁদিকেও। সামনে অঘোরচাঁদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় – আমার ইস্কুল। টিফিনের ঘন্টা বাজালো নিবারণদা, ছেলে-মেয়েরা হইহই করে স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে আর আমার দুই পাশ দিয়ে দৌড়ে আমার পেছনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আরে ওই তো, আমি আর সুতনু, ক্লাস টু’তে পড়ি। টিফিন বাক্স হাতে নিয়ে আমরা ওই ডানদিকের বকুল গাছটার তলায় বসলাম। টুপ্ টুপ্ করে গুড়ি গুড়ি বকুল ফুল ঝরে পড়ছে আমাদের ওপরে। আমার বাক্সে মায়ের তৈরী চিঁড়ের পোলাও আর সুতনুর বাক্সে লুচি-আলুভাজা। ও একটা লুচি ছিঁড়ে সেটা দিয়ে পদ্মডাঁটার মতো সরু দুই আঙুলে কয়েকটা আলুভাজা খামচে ধরে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি সেটা মুখে নিয়ে এক চামচ চিঁড়ের পোলাও দিলাম ওর বাক্সে। দুটো পনিটেল করা মাথা ঝাঁকিয়ে শ্যামলা মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জানিস তো, আমি যখন বড়ো হবো, তখন একদিন আমার চারদিকে লাল আগুন ঘিরে ধরে নাচবে। আমি তা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই। তখন তোকে ডাকলে আমাকে বাঁচাতে আসবি তো সব্য?

– আমার নাম তো সব্য নয়! আমি তো জিষ্ণু!

– তাহলে তুই আসবি না। জিষ্ণু তো ভীতু! সব্য ঠিক আসবে! আমি জানি!

– থাক তুই সব্যকে নিয়ে। আমি আর কোনোদিন আসবো না তোর কাছে।

আমি ছিটকে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। ভীষণ রাগ হলো সব্যটার ওপরে। অন্ধকারের রংটা গাঢ় সবুজ থেকে একটু হালকা হলো যেন। ঠান্ডাটা একটু যেন কম, বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া। নাকে এলো ধুনো-গাঁদাফুল-কাটাফল মেশানো একটা গন্ধ। ‘এ তে গন্ধপুষ্পে ….’ নিভারানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজো। ওই তো সৈরিন্ধ্রী! বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। ফর্সা তীক্ষ্ণ মুখের পেছনে ঘাড় ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া চুলের ঢল।

– কি রে, তুই এখানে?

– কেন? সরস্বতীপুজোয় তোদের স্কুলে আসতে নেই বুঝি?

– না তা কেন? তবে তোকে তো কোনোদিন দেখিনি, তাই ভাবলাম মেয়েদের স্কুলে আসবার সাহস তুই পেলি কোথা থেকে? ….ও আচ্ছা, এবারে বুঝেছি, তুই সব্য। তাই ভাবছি, জিষ্ণুর এতো সাহস হলো কী করে!

– আমি জিষ্ণু, জিষ্ণু, জিষ্ণু। আমি সব্য নই।

– এই কোথায় চললি? প্রসাদ খেয়ে যা! কাল আমাদের বাড়িতে গোটাসেদ্ধ খেতে আসবি তো সব্য?

সব্য, সব্য, সব্য! অসহ্য। বাথরুমের ছাদটা যেখানটায় সেদিকে আরও এগিয়ে গেলাম। অন্ধকারের রংটা যেন ফ্যাকাশে সবুজ হয়ে গেলো। আমার কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে, সামনেই সুমন্ত্রদার বাড়ি, অংক করতে আসি ওর কাছে। সদর দরজাটা খোলা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ফ্যানের সুইচ ফুল স্পিডে অন করে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা মাদুরের ওপরে বসলাম। ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’. বন্ধ দরজার ওপার থেকে সুমন্ত্রদার বোন সুভদ্রার মিষ্টি গলায় গান কানে এলো। আমি যখনই এখানে পড়তে আসি তখনই ভদ্রা এই গানটা গাইবেই। হঠাৎ দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেলো। সদ্য বৈকালিক ঘুম থেকে ওঠা ফোলাফোলা চোখের আর উস্কোখুস্কো চুলের ভদ্রা মুখ বাড়িয়ে বললো, ‘ও তুমি? বসে থাকো এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো। দাদার বাড়ি ফিরতে এখন ঢের দেরি’। দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেলো। একটু পরে দরজাটা পুরো খুলে গেলো। নেভি ব্লু স্কার্ট আর গোলাপি টিশার্ট পরিহিতা ঈষৎ পৃথুলা ভদ্ৰার ভরাট আদুরে গলা কানে এলো।

– ও জিষ্ণুদা, এখানে আমার কাছে এস। একা একা থাকতে আমার একদম ভালো লাগে না।

– আমি এখানেই বেশ আছি। খুব গরম আজ।

–  বাড়িতে আমি একা আছি কিন্তু। আমি তোমাকে কাছে ডাকছি আর তুমি না বলছো! একদিন ঠিক বুঝবে, সেদিন আর পাবে না আমায়।

– এই বেশ আছি আমি।

– সব্যদার মতো তুমি সাহসী হতে পারো না? এতো ভীতু কেন তুমি? সব্যদা হলে তার দুই হাত বাড়িয়ে দিতো আমাকে ভালোবাসতে। তুমি চলে যাও। আর এস না কোনোদিন।

ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি সুমন্ত্রদার বাড়ি থেকে। মে মাসের আসানসোল যেন জানুয়ারির কাশ্মীর। চারিদিকে বরফশীতল শুভ্রতা, অপমানে শরীরে তখন রাইগর মর্টিসের কাঠিন্য। ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার, ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে। কোথায় সব্য? একবার শুধু সামনে আয়। ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় ঘেমে উঠেছি আমি। অন্ধকারটা আরও পাতলা হয়ে এলো। অন্ধকারের রংটা হলদেটে সবুজ; বা বলা ভালো সবজে হলুদ। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অডিটোরিয়াম। ডায়াসের ওপরে এক জোড়া বলির পাঁঠা, নবীন-বরণ অনুষ্ঠানের দুই নবীন। হাতে-হাত, চোখে-চোখ; আমি আর চিত্রাঙ্গদা। বেচারি চিত্রা তারপর আমার সাথে আর কোনোদিন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। কলেজে যেদিন শেষ দেখা হয়, সেদিন সে বলেছিলো, ‘জিষ্ণু, ভদ্রা ঠিকই বলেছিলো। নারীর ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তোর নেই। চার বছর আগের ডায়াসের ওপর সেই প্রেমের অভিনয়টা তোর কাছে হয়তো মিথ্যে ছিল, কিন্তু আমার কাছে ছিল চরম সত্যি। আমি এই চার বছর তোর জন্যেই অপেক্ষা করেছি। ইলেক্ট্রিক্যালের উত্তরাও তাই বলে। তুই শুধু চোরাচাহনিতে ওকে দেখেই গেলি। অভির কাছ থেকে ওকে ছিনিয়ে নেবার সাহস দেখালি না। তুই না হয়ে সব্য হলে তার জীবনের প্রতিটা নারী তাদের ভালোবাসার যোগ্য সম্মান পেত।’

অন্ধকারটা হঠাৎ কেটে গিয়ে দশদিক হলদে সাদা আলোয় ভেসে গেলো। কিন্তু একি! ক্যুবেকের অ্যাটিক থেকে আমি কি করে ঝাড়গ্রামে মামাবাড়ির ছাদে এসে পড়লাম? অলকা, মনীষা, কাকলি, মেরিনা, ডরথি, আয়েষা ….. আমার চারিদিকে হাজার হাজার নারী শরীর। তাদের প্রত্যেকের মুখে যেন দুশো ওয়াট বাল্বের প্রজ্জ্বলতা। আমার ডানদিকে ছাদের ওপাশে রায়দিঘির কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল; সূর্য সেখানে ঝিকিয়ে উঠে চোখে আলো ছুঁড়ে দিচ্ছে। রায়দিঘি আর ছাদের মাঝে একেবারে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে ছাদের থেকেও পাঁচ ফুট লম্বা একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে, একলা।  একটা বীভৎস দর্শন শকুন সেই গাছের ডালে বসে আমার দিকে পেছন ফিরে বিষ্ঠা ত্যাগ করছে। সেই কুৎসিত দৃশ্যে আমার গা গুলিয়ে উঠলো। সামনাসামনি তাকালাম। কিন্তু ….. এ কী দেখছি আমি?

চিলেকোঠার দেয়ালে যেখানে সার দিয়ে মামার পোষা গোলা, লাক্ষা, গিরিবাজ, কাগজি এইসব বিভিন্ন জাতের পায়রার থাকার খোপ আছে,  যেখানে শুধুই সারাদিন বকম বকম শোনা যায়, তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা আর প্রগতি। পৃথার চোখের  স্নিগ্ধ দৃষ্টি আমার দিকেই প্রসারিত, মুখের হাসিটা স্মিত। দেখতে পেলাম, প্রগতি কথা বলছে সব্যসাচীর সাথে। আজ এখানেই সারা জীবনের হিসেব-নিকেশের নিষ্পত্তি করে ফেলতে হবে। সব্যকে দেখতে পেয়ে সারা শরীরের রক্ত যেন আমার মাথার দিকে প্রবল বেগে ধাবিত হলো। আমার দুইপাশের নারীর দল যেন উল্লসিত হয়ে উঠলো সব্যকে দেখতে পেয়ে। তারা রূপান্তরিত হল হাজার, লক্ষ, কোটি রঙিন প্রজাপতিতে। তাদের রঙের ছটায় চোখের আলো নিভে যাবার দশা। সব্য আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো। তার ফিনফিনে সাদা শার্টের ভেতরে চওড়া, শান বাঁধানো ঘাটের মতো বলিষ্ঠ,  রোমহীন বুক নজরে এলো। মাথার চুল হাওয়ায় উড়ছে, গালে মিষ্টি টোল, ঠোঁটে রহস্যময় হাসির ইঙ্গিত। শরীরের দুপাশে তার হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো শাহরুখ খানের মতো; যেন সে তার সহস্র লক্ষ কোটি অনুরাগিনীদের নিজের কাছে ডাকছে। প্রগতির সারা চোখে বিস্ময়। সে আরও বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়লো যখন সে আমাকে দেখতে পেলো। একবার সে সব্যর দিকে তাকায়, একবার আমার দিকে। পৃথার হাতটা ঝাঁকিয়ে সে কিছু বললো। প্রত্যুত্তরে পৃথা বোধহয় সাহস জোগানো কোনো কথা বললো ওকে, আর আমার দিকে একটা বরাভয়ের দৃষ্টি দিলো। মুহূর্তে সেই রঙিন প্রজাপতির ঝাঁক হঠাৎ প্রবল বেগে ধাবিত হলো সব্যর দিকে। তারা সব্যর সারা শরীরে বসলো। সব্যর সারা শরীর ঢেকে গেলো নানা রঙে, সবকটা রং যেন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সব্য যেন একটা স্থির কঠিন রঙিন মূর্তিতে রূপান্তরিত হলো। হাত দুটো শরীরের দুপাশে প্রসারিতই থাকলো, শাহরুখ খানের মতোই। আকাশে এখন সূর্যের সাদা আলো। পৃথা আর প্রগতি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে,  তাদের দুচোখেই বিস্ময়, দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার ওপর। আর তখুনি আবিষ্কার করলাম, আমি দুধ সাদা রথের ওপর আসীন। বিমর্ষ হয়ে বসে আছি। হাতে গান্ডীব। আমার রথের দুধ সাদা ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ আমার সারথি সুমন্ত্রদার হাতে। এই সেই সুমন্ত্রদা যে আমার কৈশোর আর তারুণ্যের একটা প্রেমও দানা বাঁধতে দেয়নি , শুধুই অংক শিখিয়ে গেছে। তবে এখন যেন একটু সেই মহাভারত সিরিয়ালের কৃষ্ণরূপী নীতিশ ভরদ্বাজের মতো লাগলো ওকে দেখতে। এবারে কি ‘হে পার্থ’, মার্কা গীতার ডায়লগ ঝাড়বে নাকি? তাহলেই তো গেড়ো।

– হে জিষ্ণু! যা ঘটেছে তা মঙ্গলের জন্যই হয়েছে, যা হচ্ছে তাও মঙ্গলের জন্যই, আর যা হতে চলেছে তাও মঙ্গলের জন্যই হবে।

– সে আমি ভালো করেই জানি সুমন্ত্রদা, শুক্রের শুভকামনা তো তুমি কখনোই করনি। করলে আজ আমার এমন হেনস্তার দশা হতো না।

– ফাজলামোর সময় নয় এটা জিষ্ণু।  সব্যসাচীর তো তোর মধ্যেই থাকার কথা; তবে তাকে আমিই বের করে নিয়ে এসেছি শুধু এই দিনটার জন্য। জীবনের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্মের জন্যে তৈরী হ’রে বোকা।

– কী করতে হবে আমাকে?

– তূণীর থেকে তুলে নে অঞ্জলীক; স্থাপন কর গাণ্ডীবে; জ্যা মুক্ত করে সব্যর হৃদয় বিদারণ কর। এই সুযোগ হেলায় হারাস না।

– সব্যর ওপর আমার ভীষণ রাগ কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি তাকে নিজের হাতে হত্যা করবো।

– তোকে করতেই হবে। তুই জিষ্ণু, তোকে হারানো যায় না। সত্যনিষ্ঠ পথের পথিক তুই। পৃথা তোকে লালন করে, সে জিষ্ণু আর সব্য দুজনকেই চেনে। কিন্তু তুই একবার প্রগতির কথা ভাব। সে সব্যকে তুই ভেবে বসেছিল। সব্যর জন্য তুই চিরতরে তোর মেয়েকে হারাবি।

– আমি যদি সব্যকে ভীষণ শক্ত একটা খাঁচায় বন্দি করে রাখি?

– না, ভবিষ্যতে উলূপীর অভাব হবে না, সে এসে ঠিক সব্যকে মুক্ত করবে। আমার পাঞ্চজন্য এবারে বেজে উঠবে। তারপর ওয়ান টু থ্রি গোনার সাথে সাথে তোকে লক্ষ্যভেদ করতে হবে।

পাঞ্চজন্যের নিনাদে মন শক্ত করে আমি অঞ্জলীক স্থাপন করলাম গাণ্ডীবে। সুমন্ত্রদার থ্রি শোনার সাথে সাথে জ্যা-মুক্ত করলাম। বাণ ছুটলো স্থির লক্ষ্যে। বাণ যখন সব্যর হৃদয় ছুঁলো, মুহূর্তে যেন এপর্যন্ত আমার দেখা সমস্ত দৃশ্য রিওয়াইন্ড হতে থাকলো, কানে এলো ভিসিআর এর রোল গোটানোর কর্কশ শব্দ। চোখে ধরা পড়লো রঙের পরিবর্তন; সাদা, হলদেটে সাদা, হলুদ, সবজে হলুদ, হলদেটে সবুজ , হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ হয়ে নিকষ অন্ধকারে ফেরত এলাম। মই বেয়ে নিচে নেমে এলাম। কমলা রঙের পোশাক পরিহিতা আমার কৈশোরের স্বপ্নের রানীর চিহ্নমাত্র চোখে পড়লো না।

হালকা মনে ঢুকলাম বেডরুমে। নিচের ড্রয়িং রুমে প্রগতি এখনো টিভি দেখে চলেছে। বেডরুমের জানলা দিয়ে নিচের বাগানে নজর গেলো। আপেল গাছটার নিচে সাদা বরফের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে সব্যসাচীর নিথর দেহটা। ঠোঁটে হাসিটা এখনো লেগে রয়েছে, আর হাত দুটো সেই শাহরুখ খানের মতো দুদিকে প্রসারিত। বুকের বাঁদিকে তীরটা অনেক গভীরে প্রোথিত। ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত; লাল ছাড়াও অন্য নানা রঙের। সেই বে-নি-আ-স-হ-ক-লা রক্ত সাদা বরফের ওপর তৈরী করছে পৃথিবীর মানচিত্র।

আমার ভীষণ ভয় করছে। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে গোঙানির ফ্যাকাশে চিৎকার। হঠাৎ মাথার ওপরের সিলিঙের কাঠের পাটাতন গুলো ঘরঘর শব্দে সরে গেলো। অ্যাটিকের জমা কালো ধুলো মেশা ঠান্ডা জল প্রবলবেগে নেমে এসে আমাকে স্নান করিয়ে দিলো। আমি ভিজে গেছি। প্রচন্ড শীতে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠছে। ‘জিষ্ণু, জিষ্ণু’ , ‘বাবা, বাবা’ শব্দ কানে এলো। চোখ খুলে দেখলাম একজোড়া উদ্বিগ্ন মুখ আর চারটে হাত আমার শরীরের তিনদিকে। আমার ঘুম পাচ্ছে, যেন অনেকদিন ঘুমোই নি। মাথাটা পৃথা-প্রগতির নিশ্চিত আশ্রয়ে রেখে চোখদুটো বুজলাম – পরম শান্তির ঘুম; ঘুমের শেষে চোখ খুলে, এক নতুন আলো দেখার আশায়।

তারিখঃ জানুয়ারি ১০, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse