চৈতন্য চিহ্ন

সারাজীবন বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে চাকরি জীবনের শেষে এসে রাজধানী দিল্লীতে পোস্টিং পেলাম। ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আমার চাকরি। অবশেষে সাহিত্য আকাদেমিতে বদলি হয়ে আসতে পেরে বেশ ভালোই লাগছে। রবীন্দ্র ভবনে অর্থাৎ সাহিত্য আকাদেমির হেড কোয়ার্টারেই পোস্টিং পেলাম। একমাত্র মেয়েও এখন চাকরিসূত্রে থাকে নয়ডায়। তাই এই পোস্টিং-টা আমার খুবই দরকার ছিল। এই বছরে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার যাঁরা পাবেন তাঁদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। বাংলা থেকে কেউ পেল কি না এই নিয়ে আমার কৌতূহল থাকেই। দেখলাম এই বছরে বাংলা ভাষায় সাহিত্য অবদানের জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন অধ্যাপিকা মিরা হায়দর। যে বইটার জন্য ওনাকে বেছে নেওয়া হয়েছে তার নাম ‘চৈতন্য চিহ্নের পাঁচশো বছর’। উপন্যাস অথচ নাম দেখে মনে হবে প্রবন্ধ। তবে ‘চৈতন্য চিহ্ন’ শব্দটায় এসে হোঁচট খেলাম। সব মিলিয়ে বেশ কৌতূহল জাগছে। অফিসের লাইব্রেরি থেকে বইটা নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরলাম। বাড়িও এখন ফাঁকা। স্ত্রী গেছেন কন্যার ওখানে। একটা দু’টো করে পাতা উল্টাচ্ছিলাম বইটার। গল্পটা শুরু হয়েছে ব্যস্ত আইনজীবী পরমা সেনগুপ্তের ‘মেল এসকর্ট’ সার্ভিসে ফোন করা দিয়ে। বছর চল্লিশের মহিলা বিয়ে করেননি মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে ‘মেল এসকর্ট’ আনিয়ে নেন। শুরুর দিকটা এরকম বেশ মামুলিই। কিন্তু কয়েকটা পাতা পড়ার পরেই একটা সংলাপ পড়ে চমকে উঠলাম। পরমা সেনগুপ্তের একটা কথার জবাবে ওই এসকর্ট ছেলেটি অভিনন্দন বলছে “কোন মানুষটা ভদ্র ফ্যামিলি থেকে আসেনি ম্যাডাম? উই আর অল ফ্রম এলিট ফ্যামিলি। উই আর অল!” আমার চমকে ওঠার কারণটা অবশ্য একটা স্মৃতি। ব্যক্তিগত। তখনো চাকরি-বাকরি কিছুই পাইনি। কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে শহীদ নগরের দিকে একটা এক কামরার ঘরে ভাড়া থাকি। রোজগার বলতে কয়েকটা ট্যুইশন আর বীমার এজেন্সি। একবার সন্ধেবেলা বেরিয়ে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বেশ রাত হয়ে গেল। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ঢাকুরিয়া স্টেশনে যখন নামলাম তখন রাত প্রায় বারোটা। আমার তখন খাওয়া বলতে ‘বৌদির হোটেল’। কিন্তু অত রাতে সে তো বন্ধ হয়ে যাবে। আশেপাশে কোনো দোকান খোলা থাকলে কেক বা বিস্কুট কিনে রাতটা পার করবো এই ভেবে স্টেশনের বাইরে বেরোতে দেখলাম একটা ঠ্যালায় দোকান সাজিয়ে খাবার বিক্রি করছে একটি মেয়ে। কাছে গিয়ে দেখলাম রুটি আর কলাই-এর ঘুগনি পাওয়া যাচ্ছে। ওই সময়ে ওটাই অমৃত মনে হয়েছিল। দাম দেওয়ার সময় আমি দোকানদার মেয়েটিকে দেখলাম। বেশ সুশ্রী দেখতে। বয়সে হয়তো আমার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে। বছর বাইশ থেকে চব্বিশ। কিন্তু অতলান্ত গভীর দু’টি চোখ। আমি বলেই বসলাম “তোমাকে দেখে তো ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে বলে মনে হয়। শেষে এই কাজ করতে হচ্ছে?” হয়তো আমি বলতে চেয়েছিলাম যে বাড়িতে পড়াশোনা না করে কেন এই কাজ করছে! মেয়েটি আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বললো “কোন মানুষটা ভদ্র ফ্যামিলির থেকে আসেনি বলুন তো? আমরা সবাই ভদ্র ফ্যামিলির থেকেই এসেছি! আমরা সবাই!”

বইয়ের কাহিনীটাও এইখান থেকেই অন্য বাঁক নিলো। এই একটা কথা ওদেরকে পিছিয়ে নিয়ে চলে গেল পাঁচশো বছরেরও বেশি সময়। ওরা কি তাহলে জাতিস্মর? নবদ্বীপে তখন নিমাই পণ্ডিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হয়ে উঠেছেন। কাতারে কাতারে মানুষ আসছে তাঁর কাছে। কৃষ্ণ নামে মুখরিত হয়ে উঠছে গোটা বাংলা। সেই সময়ের এক দম্পতি। সনাতন আর লক্ষ্মীরানী বেজ। ওরা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ। মহাপ্রভুর কৃষ্ণ নামের জোয়ার এসে পড়েছে সেই অন্ত্যজ পাড়াতেও। ঈশ্বরের নাম করতে তো আর বাধা নেই। বাধা হলো ভদ্রলোক সমাজের সাথে একসঙ্গে নাম-গান গাওয়াতে। একদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এলেন ওদেরই গ্রামে। মহাপ্রভুকে ঘিরে শুরু হলো নাম-গান। কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে গাইছেন মহাপ্রভু। দিগ্বিদিক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আনন্দের জোয়ার। মহাপ্রভুকে ঘিরে যাঁরা গাইছেন তাঁরা সবাই ব্রাহ্মন – কায়স্থ। ভদ্র সমাজের। সনাতন আর লক্ষ্মীরানীর সঙ্গে দূর থেকে দেখছে সমস্ত নমঃশূদ্র পাড়া। কাছে গেলে যে ভদ্র সমাজের জাত যাবে। মহাপ্রভুও তো ব্রাহ্মণ। তিনিই কি আর অন্ত্যজদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসবেন! অত বড় একটা মানী মানুষের কি আর তাতে মান থাকবে? কৃষ্ণ নাম শুনে দরদর করে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে সনাতন আর লক্ষ্মীরানীর। একটি অসাবধানেই হয়তো ওরা এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ঝাপসা চোখে দেখলো স্বয়ং রাধামাধব যেন এগিয়ে আসছেন তাঁদের দিকে। অবয়ব আরেকটু কাছে আসতেই ভ্রম ভাঙলো। দেখলো মহাপ্রভু এগিয়ে আসছেন তাদের দিকে। ওরা বুঝতে পারলো যে মহা অন্যায় করে ফেলেছে ওরা। আজ নিশ্চিত মৃত্যু। এরপরেই জমিদারের পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তারপরে কোনো একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেবে গলায় দড়ি বেঁধে। কিন্তু মৃত্যুর ভয় নিয়েও ওরা দেখতে লাগলো অনিন্দ্য সুন্দর এক মানুষ। এগিয়ে আসছে ওদেরই দিকে। এখন অনেকটাই কাছে। এ কি সত্যিই মানুষ! মানুষের এত রূপ থাকে! মহাপ্রভু ওদের একদম কাছে এসে বললেন “তোমরা এমন দূরে দাঁড়িয়ে কেন? এসো আমাদের সঙ্গে। নামের আনন্দে ডুব দেবে এসো।” সনাতন আর লক্ষ্মীরানী অবাক হয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলো। বিশ্বাস হচ্ছে না ওদের। মহাপ্রভু স্বয়ং ওদেরকে মণ্ডপে ডাকছেন! সনাতন হাত জোড় করে মাটির দিকে তাকিয়ে বললো “বাবা আমরা নমঃশূদ্র। আমরা নিচু জাত। আপনি নাম গান করুন। আমরা দূর থেকেই শুনবো। আর প্রাণভরে দেখি আপনার দিব্য নৃত্য।” মহাপ্রভু সনাতনের হাত ধরে ফেললেন “তা তো হয় না বাবা! তিনি যে সবার মধ্যে। কেউ নিচু আর কেউ উঁচু কি করে সম্ভব?” সনাতনের দ্বিধা তবুও কাটছিল না “বাবা আপনারা যে ভদ্র শ্রেণী। আমাদের স্পর্শে যে আপনারা অশুচি হয়ে যাবেন!” মহাপ্রভু হাসলেন। সেই ভুবন ভোলানো হাসি। যাতে পাথরও গলে যায়। বললেন “কই বাবা! আমি তো তোমাকে ছুঁলাম। আমি কি অশুচি হলাম? চারিদিকে তাকিয়ে দেখো তো কোন লোকটা ভদ্র শ্রেণী থেকে আসেনি? আমরা সবাই এক জাত। যতদূর তুমি যত মানুষ দেখতে পাবে সবাই ভদ্র শ্রেণী। সবাই উচ্চ জাত।” সেদিন মহাপ্রভুর স্পর্শে এক হয়ে মিশে গিয়েছিল নমঃশূদ্র পাড়া আর উচ্চ পাড়া। পরের দিন মহাপ্রভু বিদায় নেবার আগে সনাতন লক্ষ্মীরানীকে সাথে নিয়ে গিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিল তাঁর কাছে “বাবা এতই দয়া যখন করলেন তখন একটা কিছু চিহ্ন দিয়ে যান শরীরে যা আমাদের জন্ম-জন্মান্তরেও অটুট থাকবে।” মহাপ্রভু স্মিত মুখে বলেছিলেন “মৃত্যুর পরে শরীর থাকে না। তাই শরীরে চিহ্ন রেখে লাভ কি? মৃত্যুর পরেও শুধু থেকে যায় পরম্পরা। গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানব সমাজ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভদ্র সমাজ। আমি তোমাদের শিখিয়ে দিলাম এই মন্ত্র। তোমরা দু’জন বহন করবে এই মন্ত্র। এটাই চিহ্ন। তোমাদের দিয়েই শুরু হবে এই পরম্পরা।”

এই বছর আকাদেমি পুরস্কারের অনুষ্ঠান দিল্লীতেই হচ্ছে। সাহিত্য আকাদেমির সদর দপ্তর রবীন্দ্র ভবনে। উপস্থিত আছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি স্বয়ং। এই ধরনের অনুষ্ঠান যেমন হয়। ভাব গম্ভীর। সাহিত্য এবং অন্যান্য কলার দিকপালরা উপস্থিত। রাষ্ট্রপতি তাঁর পাশে বসা সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি বিশিষ্ট সাহিত্যিক জে ভি আর রামমূর্তির সঙ্গে কথা বলতে বলতে পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় চোখ বোলাচ্ছিলেন। হঠাৎই কিছু একটা শুনে যেন চমকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সঞ্চালককে ডেকে সভাপতি কিছু বললেন। তারপরের সঞ্চালক ঘোষণা করলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছায় তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং এই বছরের অন্যতম পুরস্কার প্রাপক মিরা হায়দরকে মঞ্চে ডাকছেন। এরপরেই দেখলাম ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন উনি। স্টেপ করে কাটা কালো চুলের মধ্যে কিছু রুপোলী রেখা মাথায়। অসম্ভব একটা ব্যক্তিত্ব ঘিরে আছে যেন তাঁকে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলেই অনুরোধ করলেন উপস্থিত জনমণ্ডলির উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য। “মিরা হায়দর আমার বাবা-মা’র দেওয়া নাম নয়। এই নাম আমার নিজেরই নেওয়া।” মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্য বিশিষ্টজনদের সম্ভাষণ করে এভাবেই শুরু করলেন উনি। সুললিত ইংরেজিতে প্রত্যেকটি কথা কেটে কেটে বলছিলেন উনি “খুব সত্যি কথা বলতে কি আমি জানি না কারা আমার বাবা বা মা। সম্ভবতঃ আমার জন্ম হয়েছিল ফুটপাথে। কলকাতা শহরের ফুটপাথেই বড় হয়ে উঠেছি আমি। ছোটবেলায় আমার কোনো নাম ছিল না। ‘এই মেয়েটা’ সম্ভাষণেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।” অনেক বছর আগের কথা। আমার এক পরিচিত অলকেশদা। থাকতো চেতলায়। অফিসে একটা প্রমোশন পাওয়ার পরে আমাকে ডাকলো একটা বীমা করাবার জন্য। সেই সন্ধ্যেতে বৌদি আর বাচ্চারা ছিল না। বীমা বিষয়ক কথা তো আধ ঘণ্টাতেই সারা। তারপরেই চলতে থাকলো অল্প অল্প পান আর সাহিত্য আলোচনা। ক্যামু, সার্ত্রে, মিশেল ফুকো থেকে রবীন্দ্রনাথ , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অবধি। ওদিকে সময় তো আর বসে নেই রাত বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা যখন প্রায় রাত একটা। আমি তখন রাসবিহারীর মোড়ে। কোনোক্রমে গড়িয়াহাট যাবার কিছু একটা পেয়ে গেলে গড়িয়াহাট থেকে যোধপুর পার্কের শেয়ারের অটো নির্ঘাত পেয়ে যাবো। রাস্তার ধারে একটু দূরে দূরে আলো আঁধারিতে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে রাত পরীরা। অলকেশদা আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছিল। ওদের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখে মনে হলো যেন খুব চেনা। হয়তো চেনা নয় কিন্তু মেয়েটার চেহারার মধ্যে অন্যরকম একটা আলো ছিল। হ্যাঁ সত্যিই আলো মানে যাকে বলে বিভা। দেখলাম অলকেশদাও খেয়াল করেছে। মেয়েটার পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে অম্লান বদনে বললো “দেখেছিস আজকাল ভদ্র ঘরের মেয়েরাও লাইনে নেমে পড়েছে!” মেয়েটার না শোনার কথা নয়। ওদেরকে কে আর অত খাতির করে চুপিচুপি বলে! মেয়েটা শুনতেও পেলো। তারপরেই ঠোক্করটা খেলাম। মেয়েটা মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরেই বললো “এই দুনিয়ায় কার জন্ম আর ভদ্র ঘরে হয়নি? সবাই ভদ্র ঘরের। সবাই।” মিরা হায়দর বলে চলেছেন “যখন একটু বড় হলাম তখন আর মেয়েটা নয় ‘এই মাগি’ সম্ভাষণেই অভ্যস্ত হয়েছি। সস্তার হোটেলে ক্যাবারে নাচ করেছি। আমি বেশ্যাবৃত্তি করেছি। বেশ্যার দালাল হয়েছি। আবার কালীঘাটের বেশ্যাখানার মাসির স্নেহ ভরে দেওয়া টাকায় রেল স্টেশনে ঠ্যালা লাগিয়ে খাবারের দোকানও দিয়েছি।”

পরমা সেনগুপ্ত অভিনন্দনের মুখে ওই কথাটা শুনে চমকে যাওয়ার কারণ ছিল একটা বই। আসলে একটা বইয়ের একটা লাইন। ঠিক ওই কথাটা। যেটা ছেলেটা এইমাত্র ওকে বললো। সৈয়দ আনিসুজ্জামান নামে এক লেখকের একটি বই ‘চৈতন্য চিহ্নের পাঁচশো বছর’। সৈয়দ আনিসুজ্জামান একসময় আকৃষ্ট হয়েছিলেন মূলবাসি অর্থাৎ আদিবাসী সম্প্রদায়ের ইতিহাস ও জীবন চর্চা নিয়ে। বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে এবং তাদের জীবন চর্চার সঙ্গে মিশতে গিয়ে ওনার পরিচয় হয় যমুনা হেমব্রম নামে এক যুবতীর। তাকে উনি কোনো কথা প্রসঙ্গে বলেন যে তুমি কখনো নিজেকে মনে করবে না যে তুমি ছোট জাত বা কারোর চেয়ে হীন। তখন সেই পড়াশোনা না জানা যুবতী তাঁকে উত্তরে বলেছিলেন “আমি তো ভাবি না। এই গোটা পৃথিবীতে কেউ কারোর চেয়ে ছোট নয়। কেউ কারোর চেয়ে বড় নয়। আমরা সবাই একই জাত।” নিরক্ষর এক আদিবাসী তরুণীর মুখে এমন কথা শুনে উনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কি করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কেউ এত বড় একটা কথা বলতে পারে? এরপরে উনি আরও অনেকগুলি চরিত্রের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করলেন। ঈশ্বর আর শ্যামলী। রফিক আর আমিনা। মাসুদর আর বনানী। শরৎ আর জামিলা। সুনন্দ আর এঞ্জেলিনা। কেউ ক্যাবারে নাচে। কেউ পাতাখোর। কেউ বিপ্লবী। আবার কেউ ফুটপাথের ভিখারি তো কেউ আবার বারোয়ারী বেশ্যা। নিজে একজন সমাজতাত্ত্বিক হওয়াতে শ্রীচৈতন্যর ওপরে পড়াশোনা এবং আগ্রহ দুইই প্রবল ছিল। ওনার সম্পর্কে বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে হঠাৎই একদিন পেয়ে গেলেন সনাতন আর লক্ষ্মীরানীর ওই ঘটনাটি। ঘটনাটি পড়ে ওনার মনে হয়েছিল ওরা যে আকস্মিক ভাবেই সেদিন কীর্তনের আসরে এসে উপস্থিত হয়েছিল তা নয়। ওরা ইচ্ছে করেই এসেছিল। ওরা জানতো যে এর শাস্তি মৃত্যুও হতে পারে তাও এসেছিল। এখান থেকেই উনি শব্দটা তুলে আনলেন ‘রেসপেক্ট’। সম্মান করা এবং সম্মান আদায় করে নেওয়া। শ্রীচৈতন্য সেদিন ওদের এই বোধটাকেই চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন। ওনার চিন্তার এই পরম্পরা এখন ছড়িয়ে পড়ছে। সম্মান করা এবং সম্মান আদায় করা কোনো বই পড়ে শেখা যায় না। এটা আসলে একটা বোধ।

মিরা হায়দর বলছিলেন “এর মাঝেই চলছিল পড়াশোনা। আমি ডিসট্যান্ট লার্নিং নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। যে কারণে আজ আপনাদের সঙ্গে এই মঞ্চ শেয়ার করতে পারছি। আমি কৃতজ্ঞ মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতি। তিনি প্রথা ভেঙে আমাকে বলার জন্য ডাকলেন। নিজের সম্পর্কে এত কথা আমি কোনোদিনই বলিনি। আজ বললাম।” আমি ভাবছিলাম কি অসম্ভব ব্যক্তিত্ব একজন মানুষের থাকলে এই মঞ্চে নিজের সম্পর্কে এভাবে বলা যায়। পরমা সেনগুপ্ত বইটি পেয়েছিলেন ওনার এক মক্কেলের থেকে। সৈয়দ আনিসুজ্জামান পরবর্তীকালে নকাশালবাড়ি আন্দোলনের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন এবং একটা এনকাউন্টারে পুলিশের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। ওনার গবেষণাধর্মী লেখা ‘চৈতন্য চিহ্নের পাঁচশো বছর’ উনি ছাপিয়েছিলেন। কিন্তু সম্ভবতঃ খুব বেশি ছাপানোর মত সামর্থ্য ওনার ছিল না। যে কটি ছাপানো হয়েছিল তাও হয়তো কবেই উনুনের আঁচ ধরানো কিম্বা ঠোঙা তৈরির কাজে লেগে গেছে। যে একটি দু’টি কোনোভাবে রয়ে গেছে তারই একটি কোনোভাবে পরমা সেনগুপ্তের হাতে এসে পড়েছে। “রেসপেক্ট একটা শব্দ। কিন্তু এই শব্দের তীব্রতা অনেক জোরালো। আপনি আপনার অফিসের পিয়নের সাথে কেমন ব্যবহার করেন? তাকে কি মানুষ হিসেবে তাঁর যোগ্য রেসপেক্ট দেন? আপনি একজন পথবেশ্যার প্রতি কিরকম আচরণ করেন? তাঁকে কি দেন তাঁর যোগ্য সম্মান? রেসপেক্ট শুধু একটা শব্দ নয়। রেসপেক্ট একটা শিক্ষা। রেসপেক্ট একটা সংস্কৃতি। রেসপেক্ট একটা বোধ। রেসপেক্ট আসলে একটা ক্রোমোজোম। সনাতন আর লক্ষ্মীরানীর মধ্যে এই ক্রোমোজোম প্রত্যক্ষ করেছিলেন শ্রীচৈতন্য। রেসপেক্ট হল সেই চৈতন্য চিহ্ন।”

‘চৈতন্য চিহ্ন’ বিষয়ে আমার মনে এখন আর কোনো জটিলতা নেই। সমস্ত হল নিস্তব্ধ। মঞ্চ থেকে নেমে আসছিলেন মিরা হায়দর। আমি প্রত্যক্ষ করতে পারছি সেই চিহ্ন।

তারিখঃ ডিসেম্বর ২০, ২০২০

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse