জলদানব

(১)

টানা দুই সপ্তাহ ধরে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি। বন্যার পানিতে খাল-বিল, মাঠ-ঘাট একাকার। বড় রাস্তার কিছু অংশ ছাড়া প্রায় সবকিছুই পানির নিচে। শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় দূরে দূরে বাড়ীঘরগুলো এক একটা দ্বীপের মতো ভাসছে। বাজারে জোর গুজব, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে তাই এই বিপত্তি। অবশ্য এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই আধার মানিক গ্রামের মানুষগুলোর। প্রতিবছর বর্ষাকালের এ বন্যায় অভ্যস্ত মানুষগুলো এই সময়ে নানা রকম আনন্দের উপকরণ খুঁজে নেয়। বড় বড় নৌকায় বসে পুঁথি পাঠের আসর আর মাছ ধরার উৎসব শুরু হয় এই সময়টাতে।

আধার মানিক গ্রামটি মাছের আধার। এই গ্রামে অনেক বিত্তবান পরিবার আছেন যারা মাছের লোভে অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে জমি কিনেছেন, বাড়ি করেছেন। এখানকার বিলে মাছ, খালে মাছ, পুকুরে মাছ। আর বন্যার সময় সব মাছ ছড়িয়ে পড়ে এখানে ওখানে। মাছ ধরার কত রকম ফন্দি ফিকির আছে এই গ্রামে, তা কেবল এই গ্রামের লোকেরাই জানে।

গতকাল থেকে বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমে এসেছে, এখনও থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। কয়েকদিন পর পূর্ণিমা। কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আধখানা চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। একটা ছোট ডিঙিতে করে  বাঁশি মোহন দাস ওরফে বাইশ্যা ভাসা জালের ফাঁদ পেতেছে।

বাইশ্যা পাশের কদলপুর গ্রামের লোক। কদলপুর পাহাড়ের পাদদেশে একটি সুন্দর গ্রাম। বর্ষার পানি সে’দিকটায় কম। নিম্নাঞ্চল বলে বন্যার দাপট এই গ্রামেই প্রবল, মাছের আনাগোনাও তাই বেশি। পিতৃপুরুষের পেশায় সিদ্ধহস্ত বাইশ্যা প্রায় সারা বছর এই গ্রামের খালে বিলে মাছ ধরে এখানকার হাটে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে। আর বন্যায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভাসা জাল বসিয়ে মাছ ধরা তার পেশা।

ভাসা জাল অনেকটা ব্যাডমিন্টন খেলার নেটের মত। বাইশ্যার জাল প্রস্থে পাঁচ ফুট আর লম্বায় প্রায় কয়েক হাজার ফুট। কিছুদূর পর পর বাঁশের খুঁটি গেড়ে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয় এই জাল। বন্যার পানিতে জলকেলি করতে আসা কই, মাগুর, শিং সহ আরো নানা মাছ এই জালে আটকা পড়ে। বাঁশি মোহন তার ছোট্ট ডিঙি নিয়ে দিনে চার-পাঁচবার সে জাল তুলে মাছ খুঁজে নেয়। ছয়-সাত ঘণ্টা পরপর তাকে কাজ করতে হয়, নয়তো মাছ মরে ফুলে উঠে। আবার অনেক সময় এই জালে বিষধর সাপও জড়িয়ে পড়ে, তখন আরেক বিপত্তি!

রাত প্রায় একটা। বাঁশি মোহন আজ রাতের মতো জাল থেকে মাছ তুলে নিয়েছে ডিঙিতে। এমন সময় ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নামে। সামনেই আধার মানিক স্কুলের পাকা দালান। বাইশ্যা স্কুলের একটা থামের সাথে নৌকা বেঁধে স্কুলের বারান্দায় উঠে আসে।

বেশ ভালো মাছ উঠেছে আজ। নৌকা থেকে ত্রিপল জড়ানো বিছানাপত্র নিয়ে এই স্কুল বারান্দাতেই শুয়ে থাকবে বাকি রাত। কোমরের প্যাঁচে জড়ানো বিড়ির বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি নিয়ে স্কুলের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মনের সুখে একটা লম্বা টান দেয়। এমন সময় পূব আকাশ আলোকিত করে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, সেই আলোতে স্কুলের মাঠের পানির নিচে কী যেন কালো মত একটা কিছু প্রবল আলোড়ন তুলে।

বাঁশি মোহন চমকে উঠে, “কী! কী ওটা!”

হাতের জ্বলন্ত বিড়িতে পরপর দুটো টান দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। দু’পা এগিয়ে বারান্দার কিনারায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকায়, “বড় কোন মাছ কি?”

চারিদিকে নিবিড় অন্ধকার, মাঠের পানিতে খলবল শব্দ হয়, আকাশে চমকে উঠে বিদ্যুৎ। কালো প্রাণীটা দ্রুত সামনের দিকে আসতে থাকে। কড় কড় করাত শব্দে বজ্রপাত হয়। আবার বিদ্যুৎ চমকের আলোয় বাঁশি মোহন দেখতে পায় পানি থেকে লাফিয়ে উঠছে কালো, বীভৎস, ভয়ঙ্কর এক প্রাণী।

চিৎকার দিয়ে স্কুল বারান্দায় লুটিয়ে পড়ে বাঁশি মোহন। তখনই ঝুপ ঝুপ করে আবারো নেমে আসে হুড়মুড় বৃষ্টি। বন্যার পানিতে টাপুর টুপুর শব্দটা কেমন যেন ঝিম ধরিয়ে দেয়। কখন যে জ্ঞান হারিয়েছে বাইশ্যা, সে নিজেই বলতে পারে না।

দিন তিনেকের মধ্যে আতঙ্কটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে জল দানবের গল্প।

(২)

পশ্চিম পাড়া কালীমন্দিরের ব্রাহ্মণ শম্ভুনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি অন্য এক গ্রামে। ধর্ম বিষয়ে উনার পাণ্ডিত্য নিয়ে উনি নিজেই খুব গর্ব বোধ করেন, যদিও ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারেননি বলে একমাত্র ছেলেটা বখে গেছে। ছেলে নিজের বউকে নিয়ে বাড়িতে থাকে। মা মারা যাবার পর নিজের বাড়িতে মদ জুয়ার আসর বসিয়েছে। এসব অনাচার সহ্য করতে না পেরে শম্ভু ঠাকুর সব ছেড়ে এই মন্দিরে উঠেছেন। মন্দিরের পাশে থাকার ঘর আছে। সংস্কৃত মন্ত্রগুলো শুদ্ধ উচ্চারণে  বলতে না পারলেও  এলাকায় বেশ প্রসার রয়েছে ঠাকুরের। তাছাড়া এই গ্রামে কোন ব্রাহ্মণ নেই, তাই সম্ভবত শম্ভু ঠাকুরের পোয়াবারো।

জাত পাতের ব্যাপারে শম্ভু ঠাকুরের  স্পর্শ কাতরতা একটু বেশি। নিজের রান্না নিজে করে খান। যাকে-তাকে মন্দিরের চৌকাঠ মারাতে দেন না। ভক্তকুলের হাতে কখনো ফুল বেলপাতা প্রসাদ দিতে হলে একবার মুখের দিকে তাকিয়ে জাত বিবেচনায় আলগোছে এমনভাবে দেন, যাতে কোন ছোট জাতের হাতের ছোঁয়া না লাগে। তবে ভালো দক্ষিণা পেলে ছোট জাতের বাড়িতে পুজো করতে যেতে কখনো আপত্তি করেন না। শুধু নিজের ঘরে ফিরে মন্দিরের পুকুরে স্নান সেরে তবেই আহার করতে বসেন।

একবার বেণিমাধব নিতান্তই বাধ্য হয়ে শম্ভু ঠাকুরের পিতলের ঘটি থেকে পানি খেয়ে ফেলেছিল। তাই দেখে শম্ভু ঠাকুরের সেকি নাচানাচি! মনে হচ্ছিল স্বয়ং শম্ভুনাথ বোধহয় প্রলয় নৃত্য শুরু করেছেন! সংস্কৃত অভিধানে যত রকম অশ্রাব্য গালিগালাজ ছিল সম্ভবত তার সবটুকুই সেদিন উগড়ে দিয়েছিলেন শম্ভুনাথ চক্রবর্তী।

কালীমন্দির থেকে ফেরার পথে ভিক্টরের খুব খারাপ লেগেছিল। বেণিমাধব, ভিক্টরের পরম বন্ধু। সেদিন মন্দিরের প্রসাদ ছিল কচুরি আর জিলাপি । তাড়াতাড়ি করে খেতে গিয়ে বেণিমাধবের গলায় আটকে যায়। শ্বাস নালীতে আটকে যাওয়ায় বেণি কোনো উপায়ান্তর না দেখে ব্রাহ্মণ ঠাকুরের পিতলের ঘটিতে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়েছিল। তাতে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল যে, ওভাবে গালাগালি করতে হবে!

উত্তেজিত শম্ভুনাথ চক্রবর্তী যখন এরপর বাংলায় ছোটলোক, ইতর, অজাত-কুজাত বলে গালাগালি করছিলেন তখন বেণিমাধবের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল ভিক্টরের। বেণিমাধব কেমন যেন হতভম্ব হয়ে থর থর করে কাঁপছিল। ভিক্টর, বেণির হাত শক্ত করে চেপে ধরে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিল।

(৩)

আধার মানিক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র ভিক্টর। ক্লাসের ফার্স্টবয় সে। শম্ভু ঠাকুরের সংস্কৃত গালিগালাজের সবটুকু না বুঝলেও সারমেয়, অকাট মুর্খ, শাখামৃগ এসব বেশ বুঝতে পেরেছিল। বেণিমাধব আর ভিক্টর একই ক্লাসে পড়ে। লেখাপড়ায় একটু দুর্বল হলেও সকল ধরনের খেলাধূলা আর দস্যিপনায় বেণিমাধবের জুড়ি মেলা ভার ।

ভিক্টর শান্তশিষ্ট, বুদ্ধিমান। পেশী শক্তির চেয়ে মগজের শক্তিতে বিশ্বাসী। এই ভিন্ন প্রকৃতির দুই কিশোরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের কারণ দুজনেই ভালো ফুটবল খেলে। আর দুজনেরই ভীষণ পছন্দ মাছ শিকার।

গ্রামের একমাত্র ব্রাহ্মণ শম্ভুনাথ চক্রবর্তী আবার মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। মাঝরাত্তিরে কমপক্ষে একবার তাকে জল বিয়োগের জন্য উঠতে হয়। মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে টয়লেট খানা একটু দূরে। এই ঘোর বর্ষায় অতদূরে কি যাওয়া সম্ভব! তাই মন্দিরের পিছনের বারান্দা থেকে বিলের পানিতে কাজ সারবেন বলে বসেছেন। আজ বৃষ্টি নেই, আকাশে কালো মেঘের ছোটাছুটি আছে। তারই ফাঁকে চাঁদের আলো ভাসছে। আর নানা পোকামাকড়ের চিৎকারে কানে তালা লাগার জোগাড়।

ঠাকুরের জলবিয়োগ এর মাঝামাঝি অবস্থা, এই সময়ে সামনে বিলের পানিতে আলোড়নটা চোখে পড়ে। ঠাকুর মশাইয়ের জল বিয়োগ মাঝপথে আটকে যায়। তার চোখের সামনেই লাফিয়ে উঠে সেই কালো, ভয়ঙ্কর জলদানব।

ঠাকুর মশাই কোন রকমে দৌড়ে এসে “মা মাগো রক্ষা করো” বলে মা কালীর মূর্তির সামনে আছাড় খেয়ে পড়েন।

এই বয়সে এরকম একটা ভয়ংকর দানবের মুখোমুখি হয়ে বেঁচে ফিরে আসায় সবাই যখন ঠাকুর মশায়ের সাহসের প্রশংসা করছিল তখন ভিক্টর ভাবছিল, “ঠাকুর মশায়ের এবার উচিত শিক্ষা হয়েছে!”

পরের দিন সন্ধ্যায় আধার মানিক স্কুলের বাংলার শিক্ষক মদন কুমার মল্লিক যখন জল দানবের মুখোমুখি হয়ে বন্যার পানিতে হাবুডুবু খেলেন তখন ভিক্টরের খুব খারাপ লাগলো। মদন স্যার একটু বদরাগী। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা প্রথম পত্র পড়ান। আঞ্চলিক উচ্চারণে উনার বাংলা পাঠ ভিক্টরকে বেশ আনন্দ দিতো। তবে ভাল ছাত্র হিসেবে মদন স্যার ভিক্টরকে খুব স্নেহ করতেন আর দুর্বল ছাত্রদের কাছে মদন স্যার ছিলেন যম। পান থেকে চুন খসলেই ছাত্রদের পিঠের ছাল তুলে নিতে মদন স্যার সিদ্ধহস্ত।

(৪)

গত দু’দিন ধরে বৃষ্টি নেই, কিন্তু পানি কমারও কোনো লক্ষণ নেই। কাপ্তাই বাঁধ এখনো বন্ধ হয়নি। আরও এক সপ্তাহ- দশ দিনের মধ্যে পানি নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। এই সময়টাতেই সাধারণত গ্রামের লোকজন নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে।

বেণিমাধব ভাসা জাল বসায়। একটা কলা গাছের ভেলা বানিয়ে সেই জালের তদারকি করে। যদিও তার জালটা ছোট, তেমন বেশি মাছ পায় না।

ভিক্টরদের একটা নৌকা আছে, বৃষ্টি কমে গেলে ভিক্টর সেই নৌকা নিয়ে বের হয়। বেণিমাধব তার ভেলাটা একটা গাছে বেঁধে ভিক্টরের নৌকায় উঠে আসে। তারপর দুই বন্ধু মিলে বড় রাস্তার ধার ধরে এগিয়ে যায়। বেণিমাধব দক্ষ হাতে নৌকা সামলায়, ভিক্টর নৌকার মাথায় বসে টর্চের আলোয় রাস্তার পাশে পানিতে মাথা ডুবিয়ে ঝিমুতে থাকা মাছগুলো খুঁজে নেয় আর ট্যাঁটা মেরে গেঁথে ফেলে। এভাবে ট্যাঁটা মেরে মাছ গাঁথায় ভিক্টর খুব মজা পায়। মনে হয় গভীর জঙ্গলে যেন বাঘ শিকার করছে।

এ বছর সেসব কিছুই আর হবে না। জলদানবের ভয়ে কেউ রাতে বের হয় না। বেণিমাধব ভয় পায় না, সে তার ভেলা নিয়ে ভাসা জাল ছড়ায়।

“তোর কি ভয় ডর কিছু নেই?” ভিক্টর প্রশ্ন করে।

“ভয় করলে খাবো কী?”

এই কথার উত্তর দিতে পারে না ভিক্টর। সত্যিই তো কাজ না করলে খাবে কী?

বেণিমাধবের বাবা ছিলেন ফায়ার ব্রিগেড কর্মী। একবার আগুন থেকে এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি মারা যান। এই শোক সামলে উঠতে পারে না বেণির মা। হার্ট অ্যাটাক করে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। বাবার সব টাকা-পয়সা চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়, তবুও মাকে বাঁচাতে পারে না বেণিমাধব। জীবন-জীবিকার তাগিদে পড়া শুনার ফাঁকে ফাঁকে এখন তাকে অনেক শ্রম দিতে হয়; বিশেষ করে এই বর্ষাকালে,যখন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হলো মাছ ধরা।

(৫)

জলদানবের ভয়ে সবাই উৎকণ্ঠিত। কী হতে পারে এই দানব, সে বিষয়ে কারও কোনো ধারণা নেই।

বাঁশি মোহন দাস বিড়িতে দুটো টান মেরে কায়দা করে ছাই ঝাড়ে, “আমি নিশ্চিত,এটা মেছো ভুত।”

শম্ভুনাথ চক্রবর্তী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেন, “এটি মৎস্য অবতার এর অন্য একটি রূপ।”

আর বাংলা শিক্ষক মদন স্যার অনেক ভেবে বললেন, “জলদানব!”

ভিক্টর ভাবে, এবারের বর্ষাটা মাঠে মারা যাবে। এত বড় বন্যা হল অথচ নৈশ অভিযান হবে না, তা কি হয়! কিন্তু জলদানবের ভয়ে ঘর থেকে বের হতেও দিচ্ছে না।

“কী করা যায় বল তো?’”ভিক্টর বেণিকে প্রশ্ন করে।

“মানে?” বেণি মুখ তুলে জানতে চায়।

“এই দানবটাকে কীভাবে তাড়ানো যায় তার একটা বুদ্ধি বের করতে হবে।”

“বুদ্ধি দিয়ে তুই দানবটাকে ধরবি!”

“অবশ্যই বুদ্ধি দিয়ে সব হয়। দাঁড়া আমাকে একটু ভাবতে দে।”

বেণির অবশ্য এসব ভাবনা নেই, “আরে ওস্তাদ, ওসব বুদ্ধি খাটানোর কাজ তোর, আমি বুঝি ধর তক্তা, মার পেরেক।” ভিক্টরকে মজা করে মাঝে মাঝে ওস্তাদ ডাকে বেণি, “কী করতে হবে তাই বল?”

কী করতে হবে তা ভিক্টরও জানে না। এদিকে সবাই যখন জলদানবের ভয়ে তটস্থ,তখন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে ডাকাতি। পরপর দুদিন দুটো বাড়িতে ডাকাতি হয়ে যায়। ডাকাতরা বাড়ির দামি জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির লোকজনকে বেঁধে রেখে নিঃশব্দে পালিয়ে যায়।

“এদিকে আবার শুরু হয়েছে ডাকাতি। কী যে করি!” ভিক্টর বিমর্ষ।

“আমি ডাকাতদের দেখেছি।” বেণি বেশ গর্বের সাথে ঘোষণা দেয়।

“বলিস কী! কখন? কোথায়?” ভিক্টর জানতে চায়।

“কাল রাতে। আমি তখন ভেলা  নিয়ে মাছ ধরছিলাম। একটা বড় নৌকা,অনেকগুলো লোক নিঃশব্দে দাঁড় টেনে  দ্রুত চলে যাচ্ছিল। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আজ ডাকাতির খবর শুনে  বুঝতে পারলাম ওরাই সে ডাকাতের দল।”

এরপর দুদিন কোন ডাকাতি নেই, বৃষ্টি নেই, জলদানবেরও কোন দেখা নেই। বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। ভিক্টর আর ঘরে থাকতে পারে না। এভাবে পানি নামতে থাকলে দু একদিনের মধ্যে রাস্তাঘাট বেরিয়ে আসবে। তখন আর নৌকা নিয়ে নিশি অভিযান করা যাবে না।

(৬)

ভরা পূর্ণিমা। আকাশে ঝলমলে চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। বেণিমাধব যেখান থেকে নৌকায় উঠার কথা সেখানে গিয়ে ভিক্টর দেখে বেণিমাধব নেই। ভেলাটা একটা গাছের সাথে বাঁধা। ভিক্টর বেণির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এমন সময় ভিক্টর দেখতে পায় ডাকাতদের নৌকাটাকে। বেশ বড় সড় নৌকা। ডাকাতরা একসাথে দাঁড় টানছে। খুব দ্রুত ছুটছে নৌকা। ভিক্টর কী করবে ভেবে পায় না। এমন সময় সে দেখতে পায় অদ্ভুত এক দৃশ্য। ডাকাতদের নৌকা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তারপর ভীষণ ভাবে দুলতে থাকে। দুলতে  দুলতে নৌকা উল্টে পানিতে পড়ে যায় ডাকাতরা।

পানির ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠে কালো এক প্রাণী, জলদানব।

ডাকাতদের মধ্যে হুটোপুটি পড়ে যায়। জলদানব পানির ভেতর থেকে আবারও লাফিয়ে উঠে। একবার এদিক, একবার ওদিক। ডাকাত সর্দার ভয় পেয়ে জীবনের বড় ভুলটি করে ফেলে। এক বুক পানিতে দাঁড়িয়ে তার দোনলা বন্দুক থেকে দু-দুটো গুলি ছুড়ে। গুলির শব্দে মুহূর্তে জেগে যায় গ্রামের লোকজন।

গুলির আওয়াজ শুনে ভিক্টর একটু ভড়কে যায়। ওর ডিঙিটা অবশ্য গাছের আড়ালে রয়েছে। সামনে বেণিমাধবের ভেলাটা ভাসছে। দূর থেকে গ্রামের লোকজনের হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ ভিক্টর চমকে উঠে। বেণিমাধবের ভেলার পাশে পানিতে ভুস ভুস করে বুদ বুদ উঠছে।  তারপর একটা কালো হাত আছড়ে পরে ভেলায়। ধীরে ধীরে একটা কালো প্রাণী বুকে হেঁটে এসে উঠে আসে ভেলাটাতে। অদ্ভুত একটা প্রাণী। দু’দুটো লেজ রয়েছে প্রাণীটার। ভিক্টর নৌকার দাঁড়টা  শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে নৌকার গলুই এ উঠে দাঁড়ায় আর তখনই প্রাণীটা আর্তনাদ করে ওঠে, “ওস্তাদ… ”

“বেণিমাধব!”

“হ্যাঁ,আমি।”

ভিক্টর নৌকা থেকে লাফিয়ে ভেলায় পৌঁছে যায়। মুখে টর্চের আলো ফেলে, “বেণি, তুই!”

“হ্যাঁ আমি। আমি তোদের জলদানব।” অনেক কষ্টে বেণি উচ্চারণ করে, “ বুদ্ধির খেলায় কেমন তোকে হারিয়ে দিলাম বল তো?”

বেণির গায়ে একটা ডুবুরির পোশাক। ভিক্টরের মনে পড়ে বেণি বলেছিল, ওর বাবার এই পোশাকটার কথা। এই পোশাকে পানির নিচে বেণিকে দেখে সবাই ভয় পেয়েছিল। গ্রামের মানুষ ডুবুরির পোশাক চেনার কথা নয়। তাছাড়া  রাতের আধো আলো, আধো অন্ধকারে কী করেই বা চিনবে?

বেণি অকস্মাৎ কেমন ফুঁপিয়ে উঠে, “ওই বাইশ্যার জন্য আমি মাছ ধরতে পারতাম না। ওর বড় জাল দিয়ে পুরো এলাকাটা ঘিরে রাখত। তাই ওকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছি। আর তোর মনে আছে সেবার মদন স্যার আমাকে খুব মেরেছিল অথচ আমার কোন দোষ ছিল না, দোষ করেছিল রাঘব।”

সেদিনের ঘটনাও ভিক্টরের মনে আছে। রাঘবের বাবা শহরে ব্যবসা করেন। রাঘব বছর বছর নতুন কাপড়ের স্কুল ড্রেস সেলাই করে। রাঘবের সেরকম একটা নতুন পোশাকে কী করে যেন বেণির হাত থেকে ময়লা লেগে যায়। রাঘব রেগে গিয়ে বেণিকে ঘুষি মারে। তারপর দুজনের হাতাহাতি। এমন সময় মদন স্যার ক্লাসে আসেন। সমস্ত ঘটনা শুনে বেণিকে বেধরক পেটান। ভিক্টর অবশ্য বলতে গিয়েছিল দোষটা রাঘবের, কিন্তু মদন স্যার ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন।

বেণিমাধব অদ্ভুতভাবে হেসে উঠে, “তাই তো স্যারকেও ভয় দেখিয়েছি আর শম্ভু ঠাকুর..,।”

“থাক, ওটা বলতে হবে না; শম্ভু ঠাকুরের কথা আমি জানি।” সেদিনের কথা ভেবে আজও ভিক্টরের কন্ঠে রাগ ঝরে পড়ে।‘

“কিন্তু আজ যেভাবে তুই ডাকাতদের থামালি সেটা অবিশ্বাস্য! আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।”

“আজ ওদের আসতে দেখেছিলাম, আবার এই পথেই যে ফিরবে তা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আগেই ওঁৎ পেতে ছিলাম।”

দূরে তখন গ্রামের মানুষের উল্লাস শোনা যাচ্ছে। কয়েকটা ডাকাত ধরা পড়েছে। ডাকাতদের নিয়ে সবাই স্কুলের দিকে যাচ্ছে। ভিক্টর বলল, “চল উঠ, ডাকাত দেখতে যাবো।”

দুর্বল কন্ঠে এবার বেণি বললো, “আমার গুলি লেগেছে।”

“কী! গুলি লেগেছে! কই, কোথায়?”

এতক্ষণে টর্চের আলোয় ভিক্টর দেখতে পেল বেণির কালো পোশাক লাল হয়ে উঠেছে, “সর্বনাশ! এখন কী হবে?”

“কিচ্ছু হবে না, তুই আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।”

“না, তোকে ডাক্তার জেঠুর কাছে নিয়ে যাবো।” ভিক্টর বেণিমাধবের ডুবুরির পোশাক খুলে নেয়। তারপর ওকে নৌকায় তুলে দ্রুত নৌকা চালিয়ে ডাক্তার জ্যাঠুর বাড়িতে নিয়ে যায়।

বেণিমাধবের এই দুঃসাহসিক অভিযানের  কথা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়না। একদিকে ডাকাত ধরার উত্তেজনা আর অন্যদিকে বেণির জন্য উৎকন্ঠায় কাটে বাকী রাত। এই ঘোর বন্যায় এমন অজ পাড়া গাঁয়ে এর চেয়ে বেশী কিছু করার নেই গ্রামবাসীর।

সারা রাত যমে মানুষে টানাটানি। ভোর রাতে বেণিমাধব একবার চোখ খুলে তাকায়।

ভিক্টর তখনও বেণির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বসে আছে বেণির পাশে। শক্তমুঠোয় ভিক্টরের হাতটা চেপে ধরে আবার চোখ বুজে বেণি। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে বাঁ চোখ থেকে। একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা দেয় ঠোঁটের কোণে। তারপর হাতের বাঁধনটা শিথিল হয়ে যায়।

বেণিমাধবের শেষ যাত্রায় গ্রামের মানুষের ঢল নামে। সেই ভীড়ে বাঁশী মোহন ওরফে বাইশ্যাও ছিল। মদন স্যার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,যে “ছেলেটা বড় ভাল ছিল। কত মেরেছি কখনও টু শব্দটি করেনি।”

শম্ভু ঠাকুর কপালে দু হাত ঠেকিয়ে বললেন, “একেই বলে বাপকা বেটা!”

থানার বড় দারোগা নিজে আসেন ডাকাতদের নিয়ে যেতে। যাবার সময় বেণির মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকে বলেন, “বেণিমাধবের মত ছেলেরা দেশের গর্ব।”

গ্রামের লোকজন বেণিমাধবের বীরত্বে গৌরব বোধ করে। সবাই জানতে পারে ডাকাতদের বাঁধা দিতে গিয়ে ডাকাতের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে বেণিমাধব। শুধু জলদানবের গল্পটা ভিক্টর নিজের কাছে রেখে দেয়, কাউকে জানতে দেয় না।

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Bhupendra
Bhupendra
3 years ago

মন ছুঁয়ে গেল। আধার মানিক আমাদের পূর্বপুরুষদের ভিটে। আমিও ওখানে গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ দাদা।

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse