জানবে না কোন দিন
তামান্না স্মৃতি
সকালে ফোনটা পেয়ে অর্নব বেশ অবাক হয়ে গেল। তাকে মাধুরী নামের একটা মেয়ে ফোন করেছে। মেয়েটি অবশ্য ফোনে তাকে খুব বেশী কিছু বলেনি। শুধু বলেছে আজ বিকেলে মেয়েটি তার সাথে দেখা করতে চায়। বিষয়টা নাকি খুব জরুরী। অর্নব যেন কোনোভাবেই তার সাথে দেখা করাটা মিস না করে। অর্নব বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তার মতো একজন মধ্যবয়স্ক বিবাহিত পুরুষের সাথে একটা অপরিচিত মেয়ের কী এমন কথা থাকতে পারে হাজার চিন্তা করেও অর্নব সেটা বের করতে পারলো না। আজ বিকেলে অবশ্য অর্নবের অফিসে তেমন কোনো কাজ নেই, চাইলে সে আজ অনায়াসে মেয়েটাকে সময় দিতে পারে। কাল হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। কাল বিকেলে অর্নব তার স্ত্রী পৃথাকে নিয়ে গাইনোকোলজিষ্টের কাছে যাবে। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট একটা সময় তাদের গাইনোকোলজিষ্টের কাছে যেতে হয়। অর্নবের সাথে পৃথার বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর হলো। এখনো তারা কোনো সন্তানের মুখ দেখেনি। অর্নব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য বোধহয় তার আর এ জীবনে হবে না। অর্নবের নিজের কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। তবে পৃথার অনেক সমস্যা আছে। ডাক্তার প্রায় বলেই দিয়েছে পৃথার কনসিভ করার সম্ভাবনা শতকরা দশ ভাগেরও কম। অথচ অর্নব যখন পৃথাকে বাবা মার পছন্দে বিয়ে করেছিল তখন তার একটায় শর্ত ছিল। বিয়ের পর পরেই তারা একটা বাচ্চা নিয়ে নিবে। পৃথারও কোনো সমস্যা ছিল না। সে-ও খুব সহজে অর্নবের দেয়া শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তবে আমরা বোধহয় প্রায় ভুলে যাই যে আমাদের জীবনের সব কিছু আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না। সকল পরিকল্পনার মূল চাবিকাঠি আসলে সৃষ্টিকর্তার হাতে। তা না হলে দুজনের মধ্যে এত ভালোবাসা এবং বোঝাপড়া থাকার পরেও অর্নবের সাথে মীরার সম্পর্কটাই বা ভেঙ্গে যাবে কেন?
অর্নবের সাথে মীরার সম্পর্কের শুরু দুজনের অনার্সের প্রায় প্রথম দিক থেকেই। দুজনের একে অপরের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। পার্থক্য ছিল শুধু এক জায়গায়। অর্নব খুব সাধারন চিন্তা ধারার মানুষ ছিল। সহজ সাধারণ জীবন যাপন-ই তার পছন্দ। ভেবেছিলো সে আর মীরা বিয়ে করবে, পরপর দুটো বাচ্চা নিবে, তারপর বাচ্চা কাচ্চা সমেত চুটিয়ে সংসার করবে। কিন্তু মীরার চিন্তা ভাবনা ছিল অন্যরকম। সে বিয়ে করার পক্ষে ছিল ঠিকই কিন্তু বিয়ের পরপরেই বাচ্চা নেয়ার পক্ষে ছিল না। তার কথা হলো বিয়ের অন্তত পাঁচ বছর সে বাচ্চা নিয়ে ভাববে না। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করবে। এসব নিয়ে দুজনের মাঝে প্রায় বাকবিতন্ডা হতো। তবে তাদের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডা যে ব্রেকআপের পর্যায়ে চলে যাবে সেটা শুধু অর্নব কিংবা মীরা কেন তাদের কাছের বন্ধুরাও কল্পনা করতে পারেনি। অর্নব মীরাকে অনেক বুঝিয়েছিলো।
বার বার বলেছিলো, কাজটা ঠিক হচ্ছে না মীরা। তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। এত দিনের সম্পর্ক আমাদের। কেউ না জানলেও তুমি আর আমি তো জানি আমাদের সম্পর্কটা এখন আর প্রেমিক প্রেমিকা পর্যায়ে নেই, এর চেয়ে অনেক বেশী দূর এগিয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের ব্রেকআপ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। পরবর্তীতে তুমি কিংবা আমি যাকেই বিয়ে করি না কেন তাদেরও কিন্তু ঠকানো হবে।
অর্নবের কথাগুলো শুনে মীরা কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিয়েছিলো, অন্য কাউকে ঠকানো হবে বলে তুমি জোর করে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারো না। ভালোই হয়েছে আমাদের বিয়ে হয়নি। বিয়ে হলে আমাদের দুজনের সংসার এক বছরও টিকতো না।
অবাক হলেও সত্য অর্নবের সাথে ব্রেকআপের মাত্র পনের দিনের মাথায় মীরা তার বাবা মার পছন্দে একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে ফেলেছিলো।
………………….
অর্নব বেশ অবাক হয়ে তার সামনে বসা মাধুরী নামের ভদ্রমহিলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনে উনার গলা অল্পবয়স্ক কোনো তরুণীর মত শোনালেও ভদ্রমহিলা কিন্তু বয়সে অর্নবের চেয়ে কয়েক বছর বড়-ই হবে। অর্নবের অবাক হওয়ার কারন অবশ্য ভদ্রমহিলার বয়স নয়। ভদ্রমহিলাকে সামনাসামনি দেখে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছে। এক হাতে বেশ বড়সড় একটা প্লাস্টার বাধা, কপালে বড় কাটার দাগ, ঠোঁটের একপাশে কালশিটে দাগ। দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে গত কয়েকদিনের মধ্যে বেশ বড় রকমের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে।
অর্নবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পড়তে পারলেন বলেই হয়তো মাধুরী ম্লান হেসে বললেন, আপনি ঠিক-ই ধরেছেন। কিছুদিন আগে আমার সাথে বড় ধরনের একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই যাত্রায় বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বলতে পারেন। তারপর মুখটা একটু নামিয়ে বললেন, আমার সাথে আমার অফিসের আরেকজন মহিলা কলিগ ছিল। সে আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেনি।
অর্নব একদৃষ্টিতে মাধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে আসলে বোঝার চেষ্টা করছে মাধুরী তাকে কী বলার জন্য ডেকেছে। অর্নবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। সে ভেতর ভেতর কাঁপছে। আজ সকালে মাধুরী ফোনে নিজের পরিচয় দেয়ার সময় যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির নাম বলেছিল বিয়ের পর মীরা সেখানেই জয়েন করেছিল না? ব্রেকআপের পর মীরার সাথে তার আর কখনো যোগাযোগ না হলেও মীরা সম্পর্কে অনেক খবর তার কানে প্রায়-ই আসে।
মাধুরী একটু নরম গলায় বললো, আপনি কী জানতে চান সেদিন আমার সাথে আর কে ছিল?
অর্নব বেশ জোর গলায় বললো, না আমি জানতে চাই না। আমি কিচ্ছু জানতে চাই না। আপনি কেন আমাকে ডেকেছেন? একজন মানুষকে যেচে পড়ে কষ্ট দিতে আপনার এত ভালো লাগে? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আপনি যান। আপনি এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যান।
মাধুরী অর্নবের সামনে থেকে চলে গেল না। আগের মতোই মাথা নীচু করে বসে রইলো। একটু পর মুখ তুলে নরম স্বরে বললো, মীরার এই সংবাদটা আপনাকে দেয়ার জন্য আমি আসিনি। বরং মীরার জীবনের শেষ কিছু কথা আপনাকে বলার জন্য আমি এসেছি।
– এসব কী বলছেন আপনি?
মীরা আপন মনেই বলতে লাগলো, আমরা একটা অফিস ট্যুরে চিটাগাং এ গিয়েছিলাম। ঘটনার দিন আমাদের ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কথা ছিল লাঞ্চের পরপর আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। সকালে অফিসের কাজ শেষে আমি আর মীরা ভাবলাম হাতে যেহেতু সময় আছে দুজনে অল্প কিছু কেনাকাটা করে আসি। দুপুরের পর লম্বা একটা ড্রাইভ করে ড্রাইভারকে আমাদের নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হবে তাই তাকে আর সঙ্গে নিলাম না। তাকে রেস্ট করতে বলে আমি আর মীরা অফিসের গাড়ীটা নিয়ে বের হলাম। মীরাই গাড়ী ড্রাইভ করছিল। কিছুদূর যেতেই কী যে হলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম আমাদের গাড়ীটা আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। আসলে আমাদের গাড়ীটাকে বেশ বড়সড় একটা মাইক্রোবাস ধাক্কা দিয়েছিলো। তাকিয়ে দেখি আমার পাশে মীরা রক্তাক্ত অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে। আমি আর এক মুহুর্ত দেরী করিনি বিশ্বাস করুন। সঙ্গে সঙ্গেই ওকে পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। পুরো সময়টুকু আমি ওর পাশেই ছিলাম। ডাক্তাররাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু মীরাকে তারা বাঁচাতে পারেনি। তবে মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে ওর জ্ঞান ফিরেছিলো। আমার সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলেছিলো। আমি এই অবস্থায় নিজের চিকিৎসা না করিয়ে কেন ওর পাশে বসে আছি এই নিয়ে আমাকে মৃদু ধমকেও ছিলো। তারপরেই অদ্ভুত কথাটা আমাকে বললো।
অর্নবের আর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস বা শক্তি কোনটায় অবশিষ্ট নেই। এটা ঠিক যে আট বছর আগে মীরার সাথে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আদৌ কি তাদের মাঝে সব সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে? না কি যাওয়া সম্ভব? অর্নবের জীবনে মীরার জায়গা কি কখনো কেউ নিতে পেরেছে? সে নিজেই কি কখনো পৃথাকে মীরার জায়গা দিতে পেরেছে? না কি কখনো পারবে?
মাধুরী আবারো বললো, আমি সেদিন মীরার মুখে আপনার নাম প্রথম শুনলাম। এতদিন একসাথে চাকরি করেছি, দুজন বন্ধুর মতো মিশেছি কিন্তু কখনো সে আপনার কথা আমাকে বলেনি। সেদিন প্রথম বললো। বললো যে, আমি যেন অবশ্যই আপনার সঙ্গে দেখা করি। আপনাকে বলি, ওর বিয়ের মাত্র তিনদিন পর জানতে পারে সে প্রেগনেন্ট। একবার ভেবেছিলো বাবুটা সে নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু আপনার চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় সেটা সে করতে পারেনি। প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে আপনার আর মীরার একটা মেয়ে বাবু হয়েছে। মীরা তার স্বামীর পরিচয়েই তাকে বড় করেছে। এই বিষয়ে তার পরিবারের কেউ কিছু জানে না।
অর্নব শিশুর মত হাউমাউ করে কাঁদছে। মাধুরী অর্নবের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। একটু পর মাধুরী ভেজা গলায় বললো, অনেকবার ভেবেছি কথাগুলো আপনাকে না জানাই। যে চলে গেছে সে তো চলেই গেছে। তার জীবনের শেষ কথাগুলো আপনাকে নাহয় নাইবা বললাম। পরে ভেবে দেখলাম, যে বিষয়কে কেন্দ্র করে আপনার আর মীরার সম্পর্ক ভেঙে গেল, যে সন্তানের আশায় আজও আপনি তৃষ্ণার্তের মত ঘুরছেন, তার কথা না জানালে বোধহয় আপনার প্রতি আমার অন্যায় করা হবে। সামাজিক অথবা পারিবারিক যে কারনেই হোক না কেন মেয়েকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে না পারুন অন্তত মেয়েকে চোখের দেখা তো দেখতে পারবেন। মেয়ের যে কোনো খুশীর মুহুর্তে, তার সুখের সময় কিংবা কষ্টের দিনগুলোতে তার জন্য প্রাণভরে দোআ তো করতে পারবেন। আর কেউ না জানুক অন্তত আপনি তো জানবেন আছে, কেউ একজন আছে। আপনার রক্ত, আপনার আত্মজা কেউ একজন এই পৃথিবীতেই আছে।
……………………..
ছয় মাস পর।
অর্নব বাচ্চাদের একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে আসবে। তার মেয়েটাও রোজ আসে তবে তার হাত ধরে নয় অন্য কারো হাত ধরে। অর্নব দেখলো, ওই যে আসছে। ছোট ছোট পা ফেলে তার মেয়ে আসছে। অর্নব বুভুক্ষের মত মেয়ের দিকে চেয়ে রইলো। মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে তার চোখের সামনে দিয়েই স্কুলের ভেতর চলে গেল। মেয়ে চলে যেতেই অর্নবের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। অর্নব বিরক্ত হয়ে ভাবলো, এতবার চোখ মোছার পরেও চোখে এত অশ্রু আসে কোথা থেকে? এই অশ্রুবিন্দুগুলোর উৎপত্তি আসলে কোথায়? লাল নীল কষ্ট ভরা এই পৃথিবীতে নাকি অচেনা কোনো ভুবনে?
তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১