জীবন তরী
শারমিন আক্তার জাহান
ছোট ছোট বাচ্চাদের কলতানে মুখরিত হয়ে আছে পুরো রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। স্কুলে ঢোকার মুখেই বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। একটা গাছই সম্পূর্ণ স্কুলকে ছায়ায় আবৃত্ত করে রেখেছে। বিশাল বিশাল ডালের শাখা প্রশাখা বেঁকে আছে লাল লাল ফুলের ভারে, যেন আগুন লেগে আছে পুরো গাছে। বাচ্চারা ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে ফুল কুড়িয়ে কোঁচড় ভর্তি করে নিচ্ছে।
করিমন বেগম খুব সাবধানে গাছের আড়ালে নিজের দেহটা লুকিয়ে রেখে শুধু মাথা বের করে স্কুল প্রাঙ্গণের দিকে নজর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার নজর লম্বা সারির টিনের ক্লাশ রুমগুলোর দ্বিতীয় কক্ষের দিকে। পেছনের হাতে একটা চিকন বাঁশের কঞ্চি। অপেক্ষায় আছে প্রথম ক্লাশের মাস্টার কখন বের হবে।
একটু পরেই রোলকল আর বাংলা ক্লাশ নিয়ে মাস্টার বের হতেই হুড়মুড়িয়ে ছেলেমেয়েরা বের হয়ে আসে স্কুল মাঠে। নিজেকে আর একটু বের করে হাত ইশারায় কাউকে ডাকলো করিমন বেগম। দুটো লিকলিকে কালো বড় বড় চোখওয়ালা মেয়ে বই খাতা জামার নিচে লুকিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালো। অভাব শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিতে নিজের ছাপ ফেলেছে। কালো লিকলিকে শরীর ঢেকে রাখা জামা কাপড়ের এখানে ওখানে জোড়াতালি।
” এতো দেরি লাগে কেন আইতে? জানস না বিলে যাইতে হইব? জলদি বাইত গিয়া বই খাতা রাইখা ঢাকি নিয়া বিলে যা আর ঢাকি ভইড়া শামুক না আইনলে আজ খাওন বন্ধ। ঠিক মতোন হাজিরা দিছস তো স্কুলে?”
দুই বোন এক সঙ্গে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো মায়ের প্রশ্নে। দুইজনেরই মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের কারোর ইচ্ছে নেই স্কুল ছেড়ে যেতে। পড়তে তাদের খুব ভালো লাগে স্কুলে যখন মাস্টাররা পড়ায় তখন তারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আর রাতে ভাইরা যখন কুপি জ্বালিয়ে পড়ে তখনও তারা পাশে বসে পড়া শোনে কিন্তু মা তাদের টেনে তুলে দেয়। বলে,
“মাইয়া মানুষের এতো পইড়া কাম নাই, বিয়ার পরেতো সংসার কইরাই খাইতে হইব। তারচেয়ে রান্ধন বাড়ন আর ঘরের কাম শিখ। ভবিষ্যতে কামে লাগব।”
ওরা জানে ওদের স্কুলে ভর্তি আর প্রতিদিন স্কুলে যেতে দেয়ার কারন উপবৃত্তির টাকা, যা দিয়ে সংসারে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধের রেশন কেনা হয়।এছাড়া দুই ভাই আছে যাদের লেখাপড়া শেখানোও বাবা মায়ের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কারণ তারা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবে। যদিও বাস্তবতা বড্ড রূঢ় তবুও বাবা মায়েরা এ স্বপ্ন বুনবেই আর তা বাস্তবায়নের জন্য মেয়েদের স্বপ্নের বলি চড়িয়ে যাবে। এই যে তাদের মা কঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কারণ কি জানেন? তার কারণ তার দুই ছেলে যাতে স্কুল পালিয়ে খেলতে যেতে না পারে। ঠিক মতো পড়া লেখা করে সেদিকে খেয়াল রাখা।
বড় বোনের নাম তসলিয়া আর ছোটটার নাম তাহমিনা। ওদের দায়িত্ব ভাগ করা। এখন মেঠোপথ ধরে আম বাগান পাড় হয়ে এক ঘন্টা হাঁটলে চলন বিলের পাড়ে ওদের বাড়ি পৌঁছাবে। রাজশাহী গোদাবাড়ি জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে ওদের বাস। উন্নয়নের কোন ছোঁয়া নেই এই গ্রামে। এখনো ভোর হলে সবাই বিলের পাড়ে লাইন ধরে বসে প্রকৃতির ডাকে সারা দেয়। এখানে এটাকে লজ্জা বা অস্বাস্থ্যকর বলে এরা চিন্তাই করেনা। এটাই এদের কাছে স্বাভাবিক নিয়ম। বিলের পাড়ে বিন্নিঝোপের মাঝে মাথা দেখে সবাই যার যার বসার স্থান নির্ধারণ করে।
সকালে মেয়েদের জন্য কোন খাবার থাকেনা রাতের খাবার যেটা বেঁচে থাকে সেটা বাপ আর দুই ভাইয়ের জন্য বরাদ্দ থাকে। তসলিমা ঘরের যাবতীয় কাজ সামলাবে আর তাহমিনা ওর চেয়ে বড় ঢাকি নিয়ে ছুটবে বিলে শামুক কুড়াতে।
অবশ্য বিলে শামুক কুড়াতে বেশ মজা লাগে তাহমিনার। ধান গাছের গায়ে গায়ে লেগে থাকে এই শামুক। কোঁচড় ভর্তি করে এনে ঢাকিতে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে বেশ মাছ পাওয়া যায়। তখন মা খুশি হয়ে মাছের বেশ বড় একটা চাকা পাতে তুলে দেয়।
এই যে এত্তো এত্তো শামুক রোজ কুড়িয়ে নিয়ে ভেঙে হাঁসের পালকে খাওয়ায় আর হাঁস এত্তো এত্তো ডিম দেয় এর একটা ডিমও তাদের ভাগে আসেনা। সব ডিম হাটে বিক্রির জন্য চলে যায় আর দুই একটা যা থাকে সেটাও ভাইদের জন্য।
মাঝেমাঝে কেন যে মেয়ে হয়ে জন্ম নিলো সেই দুঃখে দুই চোখ ফেটে কান্না আসে। সাঁঝের বেলা বাড়িতে ক্লান্ত দেহে ভরা ঢাকি নিয়ে হাঁসের খাবার দেয়ার পরেই নিজে খেতে পায় তাহমিনা আর ততক্ষণে রান্না-বান্না সহ ঘরের সব কাজ সামলিয়ে নেয় তসলিমা।
সবকিছু যেনো ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে আজ। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে তাহমিনার। বাড়িতে বেশ খুশির আমেজ। সবাই হাঁফ ছেড়ে যেনো বাঁচছে। বড় বোনের বয়স বারো হতেই বিয়ে হয়ে যায়। একেতে গায়ের রঙ পরিষ্কার তার ওপর ঘরের কাজে পারদর্শী তাই কোন রকম যৌতুক ছাড়াই পাত্রপক্ষ রাজি হয়ে যায়। বাবা -মাও খুশি মনে বিদায় দেয় বড় মেয়েকে।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধে ছোট মেয়েকে নিয়ে রান্না বান্না তেমন পরে না। সারাদিন বিলে মাঠে টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়ায় আর গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। যদিও কালো রঙের মাঝেও মিষ্টি একটা মুখ। কিন্তু সেই মিষ্টতা কাউকে স্পর্শ করেনা বরং চিন্তার খোরাক যোগায়।
তাই যখন এই বিয়ের প্রস্তাব আসে বিনা বাক্যে তাহমিনার বাবা মা রাজি হয়ে যায়। পাত্রের বয়স যদিও কিছুটা বেশি। বেশি মানে মেয়ের বাবার কাছাকাছি আর পাত্রের প্রথম বউ মারা গেছে তাতেও এদের কোন আপত্তি নেই। কোন যৌতুক ছাড়া পাত্র তার কালো মেয়েকে বিয়ের আগ্রহ দেখিয়েছে এতেই তারা খুশি।
একটা জিনিস অবশ্য মেয়ের বাপের মনে সংশয় ছিলো। পাত্রের কোন গার্জিয়ান নেই এখানে। একটা ঘর ভাড়া করে পাত্র একাই থাকে। আর এটা জানাতেই জয়নাল মানে পাত্র জানিয়ে দিলো বিয়ের সময় তার দুলাভাই উপস্থিত থাকবে। তখন আর আপত্তির কিছুই ছিলো না।
সাতদিনের মাঝেই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকতা কিছুনা। গ্রামের গণ্যমান্য তিন চারজন লোক আর ছেলে পক্ষের দুইজন। একটা লাল সুতার শাড়ি আর এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল, বড় বোনের দেয়া এক ডজন লাল রেশমি চুড়ি এই দিয়েই বিয়ের সাজে সেজে বরের ঘরে যায় তাহমিনা।
বিয়ের তিনদিনের মাথায় স্বামীর অত্যচার কি জিনিস সেটার স্বাদ পায়। এরপর সেটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়ায়। বাপ মায়ের কাছে জানিয়েও কোন লাভ হয়না।
তাদের মতে এটা সব সংসারেই হয় আর মেয়েদেরকেই মানিয়ে নিতে হয়। স্বামীর মন মর্জি বুঝেই চলতে হয়। আর একটা দুইটা বাচ্চা হলেই তখন স্বামীর আচরণ আপনা আপনিই শুধরে আসবে। ধৈর্য মেয়েদেরকেই ধরতে হয়। এটাই নিয়ম।
তিন মাস পর ননদের স্বামী এসে তাদের শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আসে। নাটোর জেলার নন্দীগ্রামে তার শ্বশুর বাড়ি। নন্দীগ্রামে এসে জানতে পারে বাপের সম্পত্তির যেটুকু পেয়েছিলো জয়নাল তা অনেক আগেই বিক্রি করে উড়িয়ে দিয়েছে নেশার রাজ্যে। বউ নিয়ে বোনের বাড়িতে উঠে। বোনও থাকতে দেয় তার একটা ভাঙা পরিত্যক্ত ঘরে। অবশ্য জানিয়ে দেয় তিন বেলা খাবারের বিনিময়ে ঘরের সব কাজ তাহমিনাকেই করতে হবে কারণ তার ভাই কোন কাজ করেনা।
দুইদিন পরে ননদাই বিয়ের খরচ আর আসা যাওয়ার ভাড়া বাবদ চারহাজার টাকা দাবি করে বসে। জানায় সব টাকা জয়নাল তার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলো।মাথায় আকাশ ভেঙে পরে তাহমিনার। প্রতিদিন এই নিয়ে অশান্তি আর ঝগড়া। স্বামীর কাছে কিছু বললেই গায়ে হাত। বাধ্য হয়ে একমাত্র সম্বল মায়ের দেয়া কানের সোনার দুল বিক্রি করে ধার শোধ করে।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ননদের সংসারের যাবতীয় কাজ করে দুইজনের খাবার জোটানো আর রাতে বিভিন্ন অজুহাতে মাইর খাওয়াই জীবন হয়ে দাঁড়ায় তাহমিনার। আর অপেক্ষায় থাকে তৃতীয় কারো জন্য, যার আগমনে জয়নালের মানসিকতার পরিবর্তন হবে।
মাস ছয়েক পরে অনেক অনুরোধে বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পায়। মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আর সহ্য করার ক্ষমতা নাই। জয়নাল কোন কাজতো করেই না তার উপর নিয়মিত নেশা করে। আর ফিরে যেতে চায়না স্বামীর কাছে শুনেই আকাশ ভেঙে পড়ে মা বাপের মাথায়। একেতে কালো মেয়ে তার উপর স্বামীর ঘর ছাড়া। সমাজে ঢিঃ ঢিঃ পড়ে যাবে। কাউকে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। অনেক বুঝিয়ে অনেকটা জোর করেই ফেরত পাঠিয়ে দেয় তাহমিনাকে।
বছর পার হতেই নিজের ভেতরে আরেকজনের অস্তিত্ব টের পায়। অনেক কষ্টের পরে একটা আশার আলো খুঁজে পায় যেনো। খুশিতে দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। এইবারে জয়নাল সংসারী হবে। কামাই রুজি শুরু করবে। নিজের একটা সংসার হবে। হোক তা ছোট্ট, তবুও নিজের একটা সংসার। দুইহাতে কোমড় সমান চুল টেনে খোঁপা বেঁধে, কোমরে আঁচল গুঁজে দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কজে লেগে পড়ে তাহমিনা আর অপেক্ষায় থাকে রাতে কখন জয়নাল ফিরবে তার। এবারে হয়ত স্বপ্নের সাগরে তার জীবন তরী গা ভাসাবে।।
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১