জয় বদ্রি বিশাল
মৌমী
যুবতী অলকানন্দাকে কখনো বাঁ দিকে কখনো ডান দিকে রেখে গাড়োয়াল হিমালয়ের সংকীর্ণ পথে যখন চলেছি তখন শুধু নদী সমৃদ্ধিদায়িনী এটাই বারংবার মনে হয়েছে। মা রূপে পালন করছে কত শত গ্রাম, কত শত পশুপাখি…
উত্তরাখণ্ড তথা তপস্যার দেবভূমিতে পা দেওয়া মাত্র তুমি শিহরিত হবে যদি তুমি সত্যের পূজারী হও, যদি তুমি ‘Mother Nature’-কে সর্বশক্তিমান মনে করো, যদি তুমি বিশ্বাস করো কর্মই ধর্ম আর নর-ই নারায়ণ…
আমরা চলেছি বদ্রিনাথ-এর পথে। হিন্দুদের ছোটো চারধাম যাত্রার একধাম হলো বদ্রিনাথ। গাড়োয়াল হিমালয়ের চামোলি জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরে বিষ্ণু ভগবান বিরাজ করছেন। কথিত আছে দেবী গঙ্গা মানুষের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার সময় পৃথিবী তার গতিবেগ সহ্য করতে পারবে না জেনে দু ভাগে ভাগ হয়ে যান, একটি ভাগ হলো পুণ্যতোয়া অলকানন্দা। আরো পাঁচটি নদীর সাথে এই নদীর সঙ্গম পাঁচটি প্রয়াগভূমির জন্ম দিয়ে মা গঙ্গার গতিপথ প্রশস্ত করেছে। অষ্ট শতকে আদি শংকরাচার্য অলকানন্দা নদী গর্ভে শালগ্রাম শিলা পান। তিনি সেই শিলা তৃপ্তি কুণ্ডের পাশের গুহায় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই ভগবান বিষ্ণু এখানে পূজিত হন। পরবর্তী কালে ষোড়শ শতাব্দীতে গাড়োয়াল রাজ বর্তমান মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দির হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী জগতের চালক সর্বশক্তিমান বিষ্ণুর হলেও মন্দিরের গঠনরীতিতে আশ্চর্যজনক ভাবে বৌদ্ধদের মনাস্ট্রির ছাপ রয়েছে। এখানে ভগবান বিষ্ণু নর-নারায়ণ রূপে পূজিত হন। অর্থাৎ গীতায় অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণের বলা সেই জ্ঞান যে সব মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করছে নারায়ণ রূপে, নরই নারায়ণ সেটাই এখানে মেনে চলা হয়। আরো একটি মতানুসারে কথিত আছে এখানে তুলসিগাছের একটি বিশেষ প্রজাতি বদ্রি তুলসীর ঝোপ প্রচুর পাওয়া যায়। একদা ভগবান বিষ্ণু এখানে ধ্যানে মগ্ন হন এবং তীব্র সূর্যালোকের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে দেবী লক্ষ্মী বিশাল বদ্রি তুলসী গাছে রূপান্তরিত হন। সেই থেকে এই জায়গার নাম ‘বদ্রি বিশাল’ এবং দেবী লক্ষ্মী বা বদ্রির নাথ বা ঈশ্বর ভগবান বিষ্ণু এখানে অধিষ্ঠান করছেন বলে এই স্থান ‘বদ্রিনাথ’।
নীলকণ্ঠ পর্বত শৃঙ্গ থেকে নয় কিমি পূর্বে নর পর্বত ও নারায়ণ পর্বতের মাঝে বদ্রিনাথ মন্দির অবস্থিত। বহুবার এই মন্দির ভূমিকম্প ও তুষার ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও পূর্ণাথীদের ভীড় প্রতি বছর এখানে বেড়ে চলেছে। নীলকণ্ঠ পর্বতশৃঙ্গ কে কেন্দ্র করে অনেকগুলি মাউন্টেরিয়ারিং এক্সপিডিসন শুরুর রাস্তা এই বদ্রিনাথ ধাম। মহাভারতে উল্লিখিত পাণ্ডবদের স্বর্গারোহণ পর্বতের পথে মহাপ্রস্থানের শুরু বদ্রিনাথ থেকে চার কিমি দূরের শেষ ভারতীয় মানা গ্রাম থেকেই…
বহুবার হিমালয়ের কাছে গেছি, প্রতিবার এর গাম্ভীর্য, ধ্যান তন্ময়তা আমাকে আবিষ্ট করেছে। কিন্তু গাড়োয়াল হিমালয়ের এই অংশে হিমালয়ের ভাস্কর্য আমার মুখে একটি শব্দই বসিয়েছে, ‘আলাদাই..’। পর্বত চূড়ায় প্রথম রোদের কিরণ হোক বা অলকানন্দার তীব্র স্রোতের পাশে সন্ধ্যে নামা হোক পুরোটাই এখানে ভাষাতীত বাঙময়তা। উষ্ণ প্রস্রবণ ‘তৃপ্তি কুণ্ডে’ স্নান করে রাত নয় টার পর তীব্র ঠাণ্ডায় বদ্রিনাথের দর্শন মনে শুন্যতা আনে। যে শুন্যতা পরিপূর্ণ করে জীবনবোধকে, তেল যোগায় জীবনের চালিকাশক্তিতে…
বদ্রিনাথ থেকে হরিদ্বার নেমে আসতে গেলে পথে পড়বে হনুমান চটি। মহাভারত অনুযায়ী যেখানে বজরংবলি মহারথী ভীমের শক্তিশালী হওয়ার অহংকার বিনষ্ট করেছিলেন। তারপর আসবে পঞ্চপ্রয়াগের প্রথম প্রয়াগ ‘বিষ্ণুপ্রয়াগ’। ধৌলীগঙ্গা ও অলকানন্দা এখানে মিলিত হয়েছে, যেখানে নারদ মুনি বিষ্ণু ভগবানের তপস্যা করেছিলেন তাঁর দর্শনের অভিলাষী হয়ে। এরপর আসবে দ্বিতীয় প্রয়াগ, ‘নন্দপ্রয়াগ’, যেখানে নন্দাকিনী ও অলকানন্দা মিলিত হয়েছে। তৃতীয় প্রয়াগে মহাভারতের মহারথী কর্ণ সূর্যদেবের তপস্যা করেছিলেন বলে কথিত আছে এবং তাঁর নামানুসারে এই প্রয়াগের নাম ‘কর্ণপ্রয়াগ’। চতুর্থ প্রয়াগে কেদারনাথ থেকে আগত মন্দাকিনী মিলিত হয়েছে বদ্রিনাথ থেকে আগত অলকানন্দার সাথে। এই প্রয়াগ ‘রুদ্রপ্রয়াগ’ নামে পরিচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম প্রয়াগ হলো ‘দেবপ্রয়াগ’। গঙ্গোত্রী থেকে আগত ভাগীরথী এবং বদ্রিনাথ থেকে আগত অলকানন্দা এখানে মিলিত হয়েছে। কথিত আছে বদ্রিনাথ থেকে আগত অলকানন্দার সাথে সরস্বতী নদী ফল্গুপ্রবাহে এসে এখানে মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি নদী যথাক্রমে ভাগীরথী, অলকানন্দা ও সরস্বতী মিলিত প্রবাহ হলো পতিতপাবনি গঙ্গা। এরপর গঙ্গা নদীর প্রবাহ ধরে হৃষিকেশ হয়ে পাকদণ্ডী শেষ হয় হরিদ্বারে, যেখানে গঙ্গা দেবীর সন্ধ্যারতি শেষ হয় মঙ্গল প্রদীপ গঙ্গার বুকে ভাসিয়ে ‘গঙ্গা মাই কি জয়’ বোল বলতে বলতে…
“মহাদেবের জটা হইতে” তাহলে গঙ্গার উৎপত্তি হয়নি, হয়নি ভূগোল বইতে লেখা ‘গোমুখ গুহা’ থেকেও, গঙ্গার জন্ম হয়েছে অগণিত মানুষের বিশ্বাসের ফল্গুধারায়, জন্ম হয়েছে গতিপথের প্রতিটি বসতির হেঁসেলে, জন্ম হয়েছে নদী গর্ভে বিলীন চিতার ভস্মে, জন্ম হয়েছে মৃত্যু সত্য জীবনবোধে…
শুধুমাত্র ঈশ্বর দর্শন ইচ্ছা হলে পুণ্যার্থী হওয়া যায় হয়তো, দশ হাজার আটশো ফুট উচ্চতায় তীব্র ঠাণ্ডা সহ্য করে মন্দিরে পুজোও দেওয়া যায় কিন্তু ঈশ্বর লাভ কি হয় আদৌ? যদি তুমি মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারো, ভালোবাসতে না পারো, সহিষ্ণু না হও, হিংসা ত্যাগ করতে না পারো, সামর্থ্য অনুযায়ী বিপদের সময় বন্ধু হতে না পারো তাহলে কি তোমার মানব ধর্মের শিক্ষা লাভ হয়েছে বলে মনে হয়? প্রশ্নগুলো বদ্রিনাথের পর্বতগাত্রে প্রতিধ্বনিত হতে শুনেছি আমি। অন্যদের সঙ্গে ‘জয় বদ্রি বিশাল’ বলতে থাকা বাইরের আমি বুঝতে পেরেছে প্রতিধ্বনির আওয়াজ অনেক বেশি জোরালো, ভিতরের আমি তাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে ঈশ্বরলাভ আসলে কী? এই খোঁজেই হয়তো বারবার ফিরে যাব হিমালয়ের সংকীর্ণ পথের বাঁকে, বিস্তৃত উপত্যকায়, তুষারাবৃত পর্বত চূড়ায় কিংবা মেঘে ঢাকা খাদের কিনারে, সম্পূর্ণ একা…
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২