ডাইনী
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস
এবড়োখেবড়ো রাস্তার পাশে কালচে শ্যাওলা ধরা পাঁচিলের একাংশের ইট বেরিয়ে পড়েছে।ভোটের সময় প্রার্থীর নাম লেখা ছিল পাঁচিলে।নামটা আবছা পড়া যায় এখনো।উপাধিটা মুছে গেছে পলেস্তারা খসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।মরচে পড়েছে পাঁচিল সংলগ্ন লোহার গেটটায়।নীচের অংশটা পাতলা হতে হতে প্রায় গর্ত হয়ে গেছে।ভাম,কুকুর,বেড়াল,শেয়াল সব ঢুকে পড়ে গেট খোলা না থাকলেও।তবুও গেটটা বড়ো সুন্দর।কারণ গেটের দুই পাশ বেয়ে উঠেছে একটা গোলাপী আর একটা সাদা বোগেনভেলিয়ার ঝাড়।সারা বছর ফুল ধরে সেগুলোয়।গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সুরকি বিছানো পথের দুধারে নানারকম পাতাবাহারের সারি।গেট থেকে বাড়ির সদরদরজা অবধি পৌঁছে দেয় ওরা।অনেকখানি জমির ওপর ছোট্ট একতলা সেই বাড়ি।সামনে একফালি বারান্দা।সেটা পেরোলেই পাশাপাশি দুটো শোবারঘর।দুটো স্নানঘর আর একটা রান্নাঘর একদিকে।আরেকদিকে সিঁড়ির ঘর।পেছনে একটা টানা বারান্দা।বারান্দার একপাশে দুটো বেতের মোড়া।ছোট্ট একটা টি টেবিল।টেবিলের ওপর ছোট্ট চীনেমাটির টবে একটা ক্যাকটাস।বারান্দা পেরিয়ে দুইধাপ সিঁড়ি নামলেই কিচেন গার্ডেন।লালশাক আর পালংচারা সদ্য মাথা তুলেছে সেখানে।সারি করে বসানো আছে কয়েকটা বেগুন,লঙ্কা,কপি,টমেটোর চারা।সকালের রোদ ঝিলমিল করছে তাদের গায়ে।
বাগানের একপাশে রোদে পিঠ দিয়ে হাততোলা উনুনে রান্না চাপিয়েছে সুহাসিনী।শীতের এই আরাম আরাম রোদে বসে রান্না করতে তার ভারি ভালো লাগে।আর একা মানুষের রান্নাই বা কতটুকু!একটা ডাল,একটু ভাত।সঙ্গে একটু চুনোমাছের ঝাল কিংবা ঝোল হয়তো।কিংবা সবজির তরকারী।আজ অবশ্য রান্নার কিছুটা ঘটা আছে।মুসুর ডাল সেদ্ধ হচ্ছে উনুনে।তাতে কয়েকফালি টমেটো দিয়েছে সুহাসিনী।বাগান থেকে একমুঠো ধনেপাতা ছিঁড়ে এনে ধুয়ে কুচি করে রেখেছে একটা প্লেটের এককোণায়।সর্ষে-শুকনো লঙ্কা সম্বরা দেবার পর ডাল নামিয়ে নেবার আগে ওটা দিতে হবে।সুহাসিনী পারশে মাছের গামলাখানা কোলের কাছে টেনে নিলো।তাতে লবণ-হলুদ-পোস্ত-লঙ্কাবাটা আর বেশ খানিকটা সরষের তেল মাখিয়ে রাখলো।এতোখানি তেল সে নিজের রান্নায় দেয় না কখনো।
-“কই গো মাসি,এই নাও তোমার শাক।”বিন্দু এক ঝুড়ি পালং শাক নামিয়ে রাখে সুহাসিনীর পাশে।
-“ভালো করে ধুয়ে কেটেছিস তো?”
-“হ্যাঁ গো হ্যাঁ।তোমার ভারি পিটপিটানি।দাঁড়াও সবজিও কাটা হয়ে গেছে।দিয়ে যাচ্ছি।”রান্নাঘরের দিকে এগোয় বিন্দু।
-“বড়ির কৌটোটা আনিস তো সঙ্গে।”
ঘাড় হেলিয়ে চলে যায় বিন্দু।সুহাসিনী সেদ্ধ ডালের পাত্রটা নামিয়ে কড়াই বসায়।উনুনে সরু ফালি কাঠ গুঁজে দিয়ে তেল ঢালে কড়াইতে।একটা শুকনো লঙ্কা ফালি করে তেলে ছাড়ে সে।একটা তেজপাতা।একচামচ কালো সরষে।চটপটিয়ে ওঠে সরষেদানাগুলো।হুশ করে সেদ্ধ ডাল ঢেলে দেয় সুহাসিনী।বিন্দু সবজিগুলো দিয়ে যায়।বড়ির কৌটোটাও।
-“আমি বাড়ি চললাম মাসি।আর কোনো কাজ নেই তো এখন?”
-“না।তুই বাড়ি যা।শোন্,তুই দুপুরে ছেলেটাকে নিয়ে আসিস।আজ এখানেই খাবি।”
অবাক হয় বিন্দু,”কেন গো মাসি?আজ কি?”
সুহাসিনী হেসে ফেলে,”আজ রোববার।…আসিস তোরা।”
-“আচ্ছা।”একটু বিস্ময় নিয়েই বিন্দু চলে যায়।সাত আট মাস সে কাজ করছে এ বাড়িতে।কখনো কোনো আড়ম্বর দেখেনি সে।বিশেষ ভালমন্দ রান্নাও হয় না এখানে।সকালে সে চা আর মুড়ি খায় কাজের ফাঁকে।সুহাসিনীও তাই খায়।এই সাত আটমাসে মাছ মাংস ডিম ক’দিন এবাড়িতে ঢুকতে দেখেছে,সেটা মনে হয় বিন্দু হাতে গুনে বলতে পারবে।প্রায়ই বাগান থেকে এটা ওটা সবজি তুলে ভাতে বা ডালে সেদ্ধ দেয় সুহাসিনী।ব্যাস,অতটুকুই রান্না হতে দেখেছে বিন্দু।রাতে বোধহয় মুড়ি-খই দিয়েই চালায়।বিকেলে বিন্দু আসে না কাজে।তাই সে জানে না।
বিন্দু গেট খুলে বেরিয়ে আসে।ঠিক তখুনি সাইকেলটা এসে থামে গেটের মুখে।
-“কি গো বিন্দু,কাজ হয়ে গেল?”শুভাশীষ সাইকেল থেকে নেমে হাসিমুখে বলে।বিন্দুও হাসে।এই লোকটার মধ্যে এমন কিছু সহজ ভাব আছে যেটা তার ভালো লাগে।আপনা থেকেই মন ভাল হয়ে যায়।
-“হ্যাঁ কাকু।হয়ে গেল কাজকম্মো।তুমি পেছনের বাগানে যাও।মাসি বাগানে বসে রান্না করছে।আমি যাই এখন।”
-“এসো।” সাইকেলটা নিয়ে শুভাশীষ ভেতরে ঢুকে যায়।বিন্দু গেটটা আটকে একটু দাঁড়ায়।এ বাড়িতে কাজে ঢোকার আগে সে কত কথাই না শুনেছে সুহাসিনী আর শুভাশীষকে জড়িয়ে।ও পাড়ার মল্লিকা বৌদি,যার বাড়িতে সে বিকেলে ঘরমোছার কাজ করে,তার কাছে তো এই অঞ্চলের সবার রান্নাঘরের কথাও জমা থাকে।বিন্দু এখানে কাজে ঢুকবে জেনে,সে-ই তো চোখ বড়ো বড়ো করে বলেছিল,”ও বাড়িতে যাচ্ছিস!ও বাড়ির মহিলা কি জিনিস জানিস?ডাইনি একটা!সব্বাইকে খেয়েছে নিজের পরিবারের।আবার একটা লোকের সঙ্গে তার ফস্টিনস্টি আছে।সে আবার ওর বরের বন্ধু ছিল।কেউ মেশে না ওই ডাইনীর সঙ্গে।” বিন্দু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল এসব শুনে।ঘরে ফিরে বরকে সবটা খুলে বলেছিল।সে লোক বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
-“বাদ দাও তো।কে কি করলো তাতে তোমার কি?পয়সা পাবে।কাজ করবে।পছন্দ না হলে ছেড়ে দিও।” বিন্দু অনেকখানি সন্দেহ আর ভয় নিয়ে কাজে ঢুকেছিল এরপর।কিন্তু যত দিন যাচ্ছে,ততই তার ভালো লাগছে সুহাসিনীকে।চুপচাপ একটা মানুষ।ডাকসাইটে সুন্দরী নয়।কিন্তু কি একটা শ্রী যেন ওর সারা মুখ জুড়ে বিরাজ করে।তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।কতই বা বয়স হবে?পঞ্চাশ পেরিয়েছে কি না সন্দেহ।কেমন নরম করে কথা বলে।বিন্দুর সুবিধা অসুবিধার খোঁজখবর করে।সাহায্য করে নির্দ্বিধায়।ইস্,এমন মানুষকে সবাই ডাইনী ভাবে!বিন্দুর ভারি অবাক লাগে।
****
শুভাশীষ সাইকেল রেখে হাঁক পাড়ে,”কই রে সুহাস,আছিস নাকি রে?”এটা তার ধরন।হাঁক না পেড়ে সে কারো অন্দরমহলে ঢোকা পছন্দ করে না।সুহাসিনী ডাক শুনে গলা তোলে,”শুভদা,তুমি পেছনের বাগানে এসো।সাইকেল ওখানেই রাখো।” শুভাশীষ পেছনের বাগানে যায়।হলুদ গাঁদাঝোপের পাশে তোলা উনুনে রান্না করছে সুহাসিনী।গায়ে সবজে-সাদা ছাপা একটা শাড়ি।হলদে চাদর।রোদ পড়ে লাল হয়ে গেছে মুখটা।উত্তুরে হাওয়ায় খোপা থেকে বেরিয়ে কুচি কুচি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার।সেগুলো বামহাতে সামলাতে সামলাতে ডানহাতে খুন্তি নাড়ছে সুহাসিনী।শুভাশীষ কিছুসময় ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে শীতসকালের এমন একটা দৃশ্য।জীবনটা অন্যরকম হলে এ দৃশ্য নিঃসঙ্কোচে প্রতিদিন উপভোগ করবার সুযোগ ঘটতো তার!দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।সুহাসিনী মুখ তুলে স্নিগ্ধ হাসে শুভাশীষকে দেখে।
-“এসো শুভদা।বারান্দা থেকে ওই মোড়াটা এনে বসো।” শুভাশীষ মোড়া নিয়ে এসে বসে।
-“চা খাবে?”
-“না না।এই তো চা খেয়ে আসলাম গৌরের দোকান থেকে।”
-“গৌরের দোকান?”চোখ পাকায় সুহাসিনী।”তার মানে কচুরীও খেয়েছো পাশের দোকান থেকে।”
অপ্রস্তুতের হাসি হাসে শুভাশীষ,”ওই একটু আর কী!”
-“তুমি কি গো শুভদা!তোমার হাইপ্রেশার।সুগার কমে না সহজে।তাও এই সব খেয়ে বেড়াও!”
-“দ্যাখ সুহাস,বেশী পাকামি করিস না।সারা সপ্তাহ তো কোয়ার্টারেই কাটাই উড়ে বামুনের অখাদ্য রান্না খেয়ে।শুধু ওই কচুরীর টানেই রোববার বাড়ি ফিরি।তাতে তোর এতো খবরদারি!বেশ।এরপর আর বাড়িও ফিরবো না এরম শাসন করবি তো!”শুভাশীষ উঠবার চেষ্টা করে।সুহাসিনী হেসে ফেলে,”কি ছেলেমানুষের মতো রাগ করছো শুভদা।বসো বসো।”শুভাশীষ গজগজ করতে করতে বসে,”দ্যাখ,আমার মা নেই,বাবা নেই,ভাই-বোন-বৌ-ছেলে-মেয়ে কিচ্ছু নেই।কারো প্রতি আমার কোনো দায় নেই,দায়িত্ব নেই।জীবনের কাছে আমার কোনো চাহিদাও নেই।তাহলে এতো নিয়ম মেনে ভালো থেকে আমার কি হবে,বল্ তো?তারচেয়ে যে কয়দিন বাঁচি,খেয়েপরে বেঁচে চলে যাই।কি বলিস?”সুহাসিনী কিছু বলে না।চুপচাপ পালংশাকের ঘন্টতে বড়ি মেশাতে থাকে খুন্তি দিয়ে।শিরশিরে বাতাসে চুপচাপ বসে থাকে দুটো মানুষ।সুহাসিনী ঘন্ট নামিয়ে কড়াই ধুয়ে উনুনে বসায়।তেতে উঠলে তাতে তেল ঢালে।কালোজিরে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেয়।চিটপিট করে ওঠে ফোড়ন।পার্শে মাছ মাখা ঢেলে দেয় তেলে।মশলা ধোয়া জল দিয়ে ঢাকা দেয় কড়াই।শুভাশীষ নিশ্চুপে দেখতে থাকে সুহাসিনীর গৃহিনীপনা।তার খুব বলতে ইচ্ছে করে যে অন্য কিছু নয়,শুধু এই সাংসারিক সুহাসিনীকে দেখবার লোভে সে ফি রোববার ছুটে ছুটে আসে ষাট কিলোমিটার পেরিয়ে।এ বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সুহাসিনী।ওই যে কলাগাছে যে বৌ-মোচাটা ঝুলছে,ওতে সুহাসিনীর যত্নের ছাপ স্পষ্ট।ঐ যে বারান্দায় মোড়ার পেছনে দেওয়ালে রবি ঠাকুরের ছবিটা,ওটায়ও সুহাসিনী মিশে আছে।এই লাল মেঝে,হলুদ গ্রীলদেওয়া জানলা,সাদা লাল একতলা বাড়ি সবটাতেই সুহাসিনী।সুজয় যখন বেঁচেছিল,তখনও সে রোববার রোববার শুধু বড়ো লাল সিঁদুরের টিপপরা হাস্যমুখী সুহাসিনীর টানে এ বাড়িতে আসতো।সুজয় সব বুঝতো হয়তো।বাল্যবন্ধু তো!নয়তো বারবার কেন বলতো,”আমার কিছু ভালমন্দ হয়ে গেলে সুহাসকে দেখিস কিন্তু।ওর কিন্তু আর কেউ নেই।”
সত্যিই তো সুহাসিনীর কেউ ছিল না কখনো।বাপ-মা মারা গিয়েছিল কোন্ ছোটবেলায়।অকৃতদার মামার আশ্রয়ে কেটেছিল কিছুকাল।মামা মারা গেলে সে আশ্রয়ও ঘুচে গিয়েছিল।সুজয়ের মা ছিলেন সুহাসিনীর মায়ের বাল্যসঙ্গিনী।উনি না থাকলে সুহাসিনী কোথায় যেত,কে জানে!তাঁর আশ্রয়েই সুহাসিনী স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে গেল।পড়াশুনোর পাঠ চুকলে সুজয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন সুজয়ের মা।সুজয় তখন সদ্য রেলের কেরানী পদে যোগ দিয়েছে।
-“শুভদা,আজ খেয়ে যেও।” সুহাসিনীর কন্ঠস্বরে ভাবনার তার ছিঁড়ে যায় শুভাশীষের।
-“না রে।আজ থাক।”
-“না,না।আজ খেতেই হবে।”
-“কেন রে?”
-“এমনিই।”
-“আচ্ছা।”
-“চান করেছো তুমি?”
-“হ্যাঁ।স্নান করে বেরিয়েছি।”
-“বেশ।তাহলে আরেকটু অপেক্ষা করো।বিন্দুটা ছেলে নিয়ে খাবে এখানে।একসঙ্গে সবাই বসলে হবে।”
-“আজ কি আছে রে সুহাস?সবাই মিলে খাওয়ার মতো কিছু অনুষ্ঠান?”
সুহাসিনী কিছু বলে না।উদাস চোখে বাড়ির দিকে তাকায়।শুভাশীষ সুহাসিনীর দৃষ্টি অনুসরণ করে।একতলার ছাদে একটা টুকটুকে লাল বেনারসী মেলে দেওয়া আছে রোদে।আর একটা সিল্কের পাঞ্জাবী।
-“ওহ্,আজ আট তারিখ,না?তোদের বিয়ের দিন।…মনে ছিল না।”
****
কি ঝলমলে শীতের দিন ছিল সেটা।সকাল থেকে সানাই বাজছিল এ বাড়িতে।সুজয়ের মা বিজয়া ছুটোছুটি করছিলেন ‘কনের মা’ হয়ে।সুহাসিনীকে উনি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন।মেয়ের মতো।সেই মেয়েকে অন্যের ঘরে দিতে মোটেই রাজী ছিলেন না উনি।বরং ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সম্পর্কের সেতুতে বাঁধতে চেয়েছিলেন।শুভাশীষের বেশ মনে আছে,সুহাসিনীর বিয়ের শাড়ি-গয়না কিনতে বিজয়া কাকিমাকে সে-ই কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল।সুজয় তখন কিসের যেন ট্রেনিঙে বিলাসপুর গিয়েছিল তিনমাসের জন্য।টুকটুকে লাল জমিনে খুদে খুদে সোনালী বুটি।লাল মিনেকারী পাড়-আঁচল।শাড়িটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল শুভাশীষের।ইস্,ঐ শ্যামলা মিষ্টি মেয়েটা যদি এই শাড়ি পরে আলতারাঙা পায়ে তার ঘরে আসতো সারাজীবনের জন্য!শুভাশীষ আগলে রাখতো ওকে।কিন্তু তা হলো কই!কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিল সুহাসিনী।লাজুক শুভাশীষ কখনো মনের কথা বলেই উঠতে পারলো না ওকে।
-“চলো শুভদা,বারান্দায় উঠে বসবে চলো।রোদ বড়ো তেতে গেছে।”
-“অ্যাঁ? আচ্ছা,চল্।”
মোড়া নিয়ে শুভাশীষ বারান্দায় উঠে আসে।বসে বসে দেখতে থাকে কর্মরতা সুহাসিনীকে।সুহাসিনী একে একে তরিতরকারীর পাত্রগুলো তুলে আনে উনুনের পাশ থেকে।সাজিয়ে রাখে ডাইনিং টেবিলে।
-“কি এতো রাঁধলি রে,সুহাস?”
-“সে কী,তোমার সামনে বসেই তো রাঁধলাম।দ্যাখোনি বুঝি?অবশ্য তোমার মনে হয় চোখটা একটু লেগে এসেছিল।”
অপ্রস্তুত হয় শুভাশীষ,”ওই আর কী!…বল্ না কি রাঁধলি?”
-“তেমন কিছু নয়।একটু মুসুর ডাল,পালংশাকের ঘন্ট,পারশে পোস্ত,চুঁই দিয়ে মুরগীর ঝোল আর জলপাইয়ের চাটনী।”
-“ও বাবা,কখন রাঁধলি এসব?টেরই তো পেলাম না।এসব রান্নার কথা শুনলেই তো খিদে পায়।”হো হো হাসে শুভাশীষ।
-“চলো,তোমায় খেতে দিয়ে দিই।বিন্দু মনে হয় দেরী করবে আসতে।”
-“দিবি?দে।”
বাসনের আলমারী থেকে কড়ির প্লেট নামায় সুহাসিনী।শঙ্খশুভ্র প্লেটে সাদা ভাতের স্তূপ।পাশে শাকের ঘন্ট।কড়ির বাটিতে বাটিতে ডাল,তরকারী,চাটনী ঘিরে আছে থালাটাকে।ভাতের ওপর একচামচ ঘরে তৈরী ঘি ছড়িয়ে দেয় সুহাসিনী।কাঁচের গ্লাসে জল।
-“খেতে এসো,শুভদা।”
টেবিলে এসে বসে শুভাশীষ।এই আটপৌরে যত্নটুকু তার জীবনে বড়ো কম জুটেছে।তার নিজের মা কৈশোরেই গত হয়েছিলেন।বাউন্ডুলে বাবা নিঁখোজ তার পর থেকেই।জ্যাঠার সংসারে ঠেলা খেতে খেতে বড়ো হওয়া।সত্যিকারের যত্ন সে একমাত্র এই বাড়িতেই পেয়েছে।সুজয়ের মা আজীবন তাকে যত্ন করে খাইয়েছেন।তিনি মানুষটাই বড়ো মায়াভরা ছিলেন।সুজয় আর সুহাসিনীর বিয়ের মাস তিনেক পর যখন স্ট্রোকে দুম করে মারা গেলেন বিজয়া,শুভাশীষ মাতৃবিয়োগের যন্ত্রণা পেয়েছিল দ্বিতীয়বার।তারপরও অবশ্য এ বাড়িতে যত্ন করে খাওয়ানোর লোকের অভাব হয়নি তার।সুহাসিনী আজও ঠিক বিজয়ার মতো করেই গুছিয়ে খেতে দেয় তাকে।সুজয় থাকাকালীন এরকম খাওয়ার টেবিলে কি আড্ডাটাই না হতো!
-“ও কি? বসে আছো কেন শুভদা?খাওয়া শুরু করো।”সুহাসিনীর কথায় চমক ভাঙে শুভাশীষের।ডালের বাটিটা টেনে নিয়ে পাতে ঢালে সে।
-“হ্যাঁ রে সুহাস, কত বছর হলো রে সুজয় চলে গেছে?তেইশ না চব্বিশ?”
-“চব্বিশ।”
ভাত ছুঁয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে শুভাশীষ।সুহাসিনী আলতো করে বলে,”খেয়ে নাও,শুভদা।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
-“এতোগুলো বছর হয়ে গেল?”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে সুহাসিনীর,”কি হবে বলো এসব আর ভেবে?”
চকিতে মুখ তোলে শুভাশীষ।তীব্র চোখে তাকায়,”কিছুই যখন হবে না ভেবে,তখন আজও কেন এই তারিখে সুজয়ের পছন্দের খাবারগুলো বানালি?”
ম্লান হাসে সুহাসিনী,”অভ্যেস।”
-“কিসের অভ্যেস?মাত্র ছয়বছরের সংসার তোদের।তাতে এমন কি অভ্যেস তৈরী হয়ে যায় যে আজীবন তা পালন করে গেলি?”
-“ভুল বললাম,শুভদা।শুধু অভ্যেস নয় গো।কৃতজ্ঞতাবোধ।”
অবাক হয় শুভাশীষ,”কিসের কৃতজ্ঞতাবোধ?”
-“পরিচয় পাওয়ার কৃতজ্ঞতাবোধ।বিজয়া মাসি না থাকলে আমার তো কোনো আশ্রয় ছিল না,বলো?কোথায় ভেসে যেতাম!মাসি আমায় মেয়ের মতো বড়ো করলেন বলেই না কোনো অন্ধকার পথে আমায় হাঁটতে হলো না।সেই কৃতজ্ঞতাবোধ এমনই কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো যে মাসি যখন আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলো তোমার বন্ধুর সঙ্গে,আমি না করতে পারলাম না।অথচ আমি ভেবে রেখেছিলাম,কখনো কোনো সম্পর্কে জড়াবো না।”
-“কেন?”
মুখ তোলে সুহাসিনী।ম্লান হাসে,”জানো না,আমি ডাইনী!আমার মা-বাবা-মামা যারা আমার সঙ্গে সম্পর্কিত,তারাই যে মারা গেছে।তাদের যে আমি খেয়েছি!আমার নিঃশ্বাসেও নাকি বিষ আছে!”
-“সুহাস!”
-“অবাক হচ্ছো কেন,শুভদা?তুমি তো নিজেও দেখেছো।মাসি যতদিন না আমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে,আমার মায়ের বন্ধু থেকে আমার শাশুড়ি হয়েছে,ততদিন তো ভালোই ছিল।আমার বিয়ের পরে হুট করে অ্যাটাকটা হলো।”
-“কি সব বলছিস সুহাস?শরীরের সমস্যা কি সহজে বোঝা যায়!”
সুহাসিনী আমল দেয় না শুভাশীষের কথা।আপনমনে বলে যায়,”তারপর তোমার বন্ধুর বিষয়টাই দ্যাখো।বিয়ের ছ’বছর পরও বাচ্চা নেই বলে দু’জনে ডাক্তারের কাছে গেলাম।টেস্ট হলো কতরকম।ডাক্তার বললো,ওর শারীরিক সমস্যা আছে।কতজনেরই তো থাকে এরকম সমস্যা।তারা তো তারপরও সংসার করে আজীবন।কিন্তু তোমার বন্ধু মানতে পারলো না নিজের সমস্যাটা।রাতের পর রাত জেগে থাকতো।পায়চারি করতো সারা বাড়ি।আমার কাছে হাতজোড় করে বারবার বলতো,”ক্ষমা করো,সুহাস,ক্ষমা করো।তোমায় কিচ্ছু দিতে পারলাম না।” কত বোঝাতাম।মানতো না।তারপর এক রাতে কখন পাশ থেকে উঠে নদীর কাছে চলে গেছে জানি না।আর ফিরলো না।…”
-“সুহাস,তুই চুপ কর্।”
-“কেন,শুভদা?শুনতে খারাপ লাগছে?একবার আমার কথাটা ভাবো তো।কোন্ দুর্গ্রহে জন্ম হয়েছিল আমার,এ কথা আমি সবসময় ভাবি।জন্ম হয়েছিল যে পরিবারে,তাকে সমূলে ধ্বংস করেছি।আশ্রয় দিয়েছিল যারা,সামাজিক পরিচয় দিয়েছিল যারা,তাদেরও জীবন শেষ করে দিয়েছি।যাকে ভালবেসেছি কৈশোরের দিনগুলো থেকে,তাকে হারাবার ভয়ে স্বীকৃতি দিইনি তার ভালবাসায়।আমি কি মানুষ?” ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সুহাসিনী।মাথা নীচু করে বসে থাকে শুভাশীষ।উত্তুরে হাওয়ায় শিরশিরে শব্দ ওঠে বাগানে।শুকনো মেহগনি পাতা ঝরে পরে…টুপ্ টুপ্ টুপ্।
****
-“ও মাসিইই,মাসি।” বিন্দু এসেছে একা।
-“আয় বিন্দু।তোর ছেলে কই?” সুহাসিনী ডাকে।
-“ছেলেটার একটু শরীর খারাপ।এখুনি বাড়ি যাবো।বসে খাওয়ার সময় হবে না।তুমি খাবারটা বেঁধে দাও।” বিন্দুর কণ্ঠস্বরে দ্বিধা।সুহাসিনী কিছু বলে না।চুপচাপ সমস্ত তরিতরকারী ভাত দিয়ে দেয় বিন্দুকে।বিন্দু চলে যায় মাথা নীচু করে।সুহাসিনী তাকিয়ে থাকে সেদিকে।শুভাশীষ কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসেছে ততক্ষণে।সুহাসিনী তখনও তাকিয়ে আছে বিন্দুর যাওয়ার পথের দিকে।
-“সুহাস?”সুহাসিনী মুখ ফেরায় শুভাশীষের দিকে।বিষণ্ণ দুটো চোখ তুলে তাকায়,”শুভদা,বিন্দু কেন একা এসেছিল জানো?”
-“কেন?”
-“ওর ছেলের ওপর যাতে আমার কুদৃষ্টি না পড়ে!”
-“তোর কি মাথাটা গেছে রে,সুহাস?”
“না গো।এ বাড়িতে যারাই কাজ করে,তারা ভয়ে ভয়ে থাকে…যদি তাদের কোনো ক্ষতি আমি করি।বিন্দুও তার ব্যতিক্রম নয়।”
-“খেয়ে নে সুহাস।অনেক বেলা হয়েছে।”
-“খিদে নেই গো,শুভদা।আজ আর এ বেলা খাবো না।সব খাবার বিন্দুকে দিয়ে দিলাম।গরীব মানুষ।একদিন তো পেট পুরে খাক।…তুমি বাড়ি যাও।বিশ্রাম করো।আবার তো সন্ধের ট্রেনে চলে যাবে।”
-“সাবধানে থাকিস,সুহাস।…আসি।”
পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় সুহাসিনী,” এসো।…ওষুধগুলো নিয়ম করে খেও।নিজের যত্ন নিও।”
শুভাশীষ বেরিয়ে আসে ধীরপায়ে।
রোদ পড়ে আসছে।সুহাসিনী ছাদে যায়।শাড়ি আর পাঞ্জাবীটা ঘরে নিয়ে আসে।ভাঁজ করবার জন্য শাড়িটার দিকে হাত বাড়ায়।এই শাড়িটায় হাত ছোঁয়ালেই বহু পুরোনো একটা স্মৃতি ফিরে আসে বারবার।…বিজয়া মাসি আর শুভাশীষ বিয়ের বাজার করে ফিরেছেন কলকাতা থেকে।কী আনন্দ তখন মাসির কথাবার্তায়!সব জামাকাপড়গুলো টেনে টেনে বার করে দেখাচ্ছেন।পাশে হাসিমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শুভদা।বেনারসীটা বার করে মেলে দেখাতে দেখাতে সুহাসিনীকে বলছেন,”দ্যাখ তো,মা,শাড়িটা কেমন?সুন্দর না?শুভ পছন্দ করেছে।বারবার করে বলেছে,এটা শুধু তোকেই মানাবে!”হো হো হাসে মাসি।শুভদা লজ্জা পেয়ে কেমন লাল হয়ে গিয়েছিল সেদিন।আপনমনেই হেসে ফেলে সুহাসিনী।শাড়িটা আলমারীতে ঢুকিয়ে পাঞ্জাবীটা তুলে নেয়।ভাঁজ করবার আগে বহুসময় নাকের কাছে ধরে থাকে।স্মৃতির কোন্ গহ্বর থেকে বিজয়া মাসির গলা ভেসে আসে,”এই পাঞ্জাবীটা কেমন?সুন্দর না?সুজয়ের হবে তো?কি বলিস,সুহাস মা?…দাঁড়া,একটা কাজ করি।অ্যাই শুভ,এদিকে আয় তো বাবা।পাঞ্জাবীটা পরে দ্যাখা।…মাথা নাড়ছিস কি?তোর আর সুজয়ের জামার মাপ একই।তোর গায়ে ঠিকঠাক ফিটিং হলে ওরও হবে।পরে আয় বলছি পাঞ্জাবীটা!”…
চোখ বোজে সুহাসিনী।বন্ধ চোখের পাতা জুড়ে বরের পাঞ্জাবি পরা তরুণ শুভাশীষ।সবসময়ই তাই হয়।এই পাঞ্জাবিতে কখনই সুজয়কে সে দেখতে পায় না।…শুধুই শুভাশীষকে দেখে।…আজীবন।…চোখ ভরে আসে সুহাসিনীর।পাঞ্জাবিটায় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে।সুহাসিনী ফিসফিস করে বলে,”শুভদা…শুভদা…শুভদা…”।কোথায় যেন একটা কুবোপাখি ডেকে চলে একটানা…।
তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১