ডেথ রোড
চিরন্তন ভট্টাচার্য
জ্যাকেটের জিপারটা বুক অবধি তুলে হোম স্টে’র ঘর থেকে বাইরে এলো ধ্রুব। গোটা চৌহদ্দিতে ও ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। অদ্ভুত একটা নির্জনতা। হোম স্টে’র নামটা অবশ্য বেশ মিষ্টি – হ্যামিল্টন নেস্ট। এই জায়গাগুলোতে এককালে সাহেব সুবোদের ঘরই ছিলো। ধ্রুব যখন ওখানে থাকতো তখন এখানে আদৌ কোনো ঘর ছিলো কি না সে আর মনে পড়ছে না। হয়তো ছিলো। পরিত্যক্ত কোনো ঘর। তবে এখানে হোম স্টে বানালেও এই ডেথ রোডের ওপরে অসম সাহসী কোনো টুরিস্ট ছাড়া থাকতে আসবে না। পৃথিবীর অন্যতম ভুতুড়ে জায়গা হিসেবে কার্শিয়ং সংলগ্ন এই ডাউহিল পরিচিত। তার মধ্যে আবার সবচেয়ে কুখ্যাত হলো এই ‘ডেথ রোড’। ধ্রুব অসম সাহসী বা এরকম কিছু না। তবে বহুকাল এই রাস্তার ওপরেই ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলে পড়েছে। এটাও শোনা যায় যে ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলের হোস্টেলে অনেকগুলো ভূত আছে। শীতের সময়ে যখন দীর্ঘ তিন মাস হস্টেল বন্ধ থাকে তখন নাকি অদ্ভুত সব আওয়াজ পাওয়া যায়। ডেথ রোড ধরে একা হাঁটতে হাঁটতে এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই কৌতুক উপভোগ করছিলো ধ্রুব। ভূত থাকলেও ওরা মনে হয় পরিচিতদের কিছু বলবে না। সন্ধ্যে হওয়ার সময় এখনো হয়নি। কিন্তু আকাশে ঘন মেঘ থাকায় বিকেলেই আঁধার নেমে এসেছে। এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলো বাকিদের কি মনে থাকবে আজকের দিনের কথাটা। তেত্রিশ বছর আগে এই ডেথ রোডের পরিত্যক্ত রোমান গির্জার একটা পাথরের ওপর একের ওপরে এক করে জমে উঠেছিলো ছয় ছ’টা হাত – ধ্রুব, আসিফ, সামান্থা, সিলভান, নিলয় আর রুবি। ওরা একসাথেই পড়াশোনা শুরু করেছিলো ডাউহিল স্কুলে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত স্কুল কো-এড। তারপরে সামান্থা আর রুবি থেকে গেলো ডাউহিল গার্লসে। আর ওরা চলে গেলো ভিক্টোরিয়া বয়েজে। যদিও একই জায়গায় তাই বন্ধুত্বের ঘাটতি হয়নি কোনোদিনই। সবাই একই সাথে বিদায় জানিয়েছিলো স্কুল আর ডাউহিলকে। সেদিন ওরা ওই পাথরের ওপরে হাত রেখে শপথ নিয়েছিলো যে সেইদিন থেকে ঠিক তেত্রিশ বছর পরে ঠিক সন্ধ্যে ছ’টার সময়ে এই পাথরের ওপরে এই ছ’টা হাত আবার মিলিত হবে। আজ উনিশে জানুয়ারি। সেইদিন। ঠিক তেত্রিশ বছর পরে। কথা ছিলো কেউ কারোকে মনে করাবে না এই দিনটা। এই ছয় জন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক ঠিক এইদিনে এইখানে এসে উপস্থিত হবে। ধ্রুব’র পক্ষে এভাবে কোথাও বেরিয়ে পড়া এখন প্রায় অসম্ভব। একবার কেউ চিনে ফেললে আর দেখতে হবে না! সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই নির্জন হোম স্টে টা ধ্রুবর জন্য আদর্শ।
গন্তব্যে পৌঁছে দেখলো আসিফ জমিয়ে বসেছে। বৃষ্টি এখন নেই। কিন্তু যেকোনো সময় ঝুপ ঝুপ করে নেমে পড়তে পারে। তাই পায়ের কাছে বিরাট একটা ক্যাম্প ছাতা গুটিয়ে রাখা আছে। একটু দূরে একটা বিরাট এস ইউ ভি রাস্তার ওপরে পার্ক করা। এই যে চেয়ারগুলোর ওপরে ওরা বসে আড্ডা দিচ্ছে সেগুলোও নিশ্চিত আসিফের নিয়ে আসা। ও তো থাকে মুম্বাইতে। কিন্তু এগুলো সম্ভবত শিলিগুড়ি থেকে ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছে। আসিফ ছিলো বলেই আজ ধ্রুব এত বড় ফিগার। এরকম বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। আপাতত তিনজন এসেছে। আসিফ ছাড়া বাকিদেরকে কিন্তু ও সেই তেত্রিশ বছর পরে আজকে দেখছে। কিন্তু তাও চিনতে পারছে। ওই তো মোটা একটা চশমা পরে বসে আছে সিলভান। আর ওই তো রুবি। বয়স যেন রুবি কে আরও সুন্দরী করে তুলেছে। মজার কথা হলো ও যে এসেছে সেটা আসিফও জানে না। কেন না সেটাই তো ছিলো শর্ত। কেউ কারোকে মনে করিয়ে দেবে না। ধ্রুব একটু ইচ্ছে করেই একটু দূরে একটা পাথরের ওপরে বসেছে। একটু নাটকীয়তা করতে ইচ্ছে করছে। ঠিক সন্ধ্যে ছ’টার সময়ে উপস্থিত হয়ে ও সবাইকে চমকে দেবে। আরে ওই তো নিলয় আসছে। ব্যাটা এখনো সেরকম দুলকি চালে চলে! আসিফ ওকে আসতে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো। আসিফ চিরকালের জমজমাটি মানুষ। ধ্রুবর মনে আছে ওর সেই মুম্বাই শহরের সংগ্রামের দিনগুলো। তখন সবাই বলতো বোম্বে। আসিফ নিজের বাড়িতে ওকে আশ্রয় দিয়েছিলো সেটাই বড় কথা নয় ওর সাফল্যের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিয়েছিলো। আসিফদের পরিবার খুব ধনী পরিবার। কিন্তু ওদের সবচেয়ে দামী গাড়িটা ব্যবহার করতে দিয়েছিলো ধ্রুবকে। আসিফের এক কথা – বলিউডে নায়ক হতে গেলে কাপ্তেনি তোমাকে দেখাতেই হবে! যদিও এটা সত্যি না। প্রতিভা না থাকলে এই ফিল্ডে কেউ কিছুই করে উঠতে পারবে না। তবুও এটাই ছিলো আসিফের ভালোবাসা। অল্প দূরেই বসে আছে ধ্রুব। যদিও মুখে মাস্ক আর মাথায় টুপি তাও কেউ চিনতে পারছে না! অবাক লাগছে ওর! বাকিরা না হয় অনেকদিন ওকে দেখেনি। যদিও ধ্রুবর রিসেন্ট চেহারা কার আর না দেখা! তবুও। কিন্তু আসিফও চিনতে পারছে না! তারমানে মেকআপ টা বেশ জবরদস্ত হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটা বেজে পেরিয়ে গেছে। আকাশের গায়ে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসা কালো আর সাদা মেঘগুলো পুঞ্জ পুঞ্জ করে জমা হচ্ছে। সামান্থা তো এখনও এলো না। ওর কি মনে নেই আজকের কথা? আর একটা আশঙ্কাও মাথার মধ্যে আঘাত করছে সামান্থা ঠিক আছে তো? সামান্থা এসেও কি ধ্রুবকে চিনতে পারবে না? তেত্রিশটা বছর বড় কম সময় নয়। যদিও ধ্রুব নিশ্চিত সামান্থা এসে পৌঁছে গেলেই ওর এই হাইড এন্ড সিক গেম খতম হয়ে যাবে। সামান্থা ওকে চিনতে পারবেই।
ওরা একে অন্যের খবর নিচ্ছে। কতদিন পরে দেখা আবার। ‘তুই কি করছিস রে নিলয়?’ রুবি জিজ্ঞাসা করলো। নিলয় বলার আগেই আসিফ বলে উঠলো ‘ব্যাটা এখন মস্ত বড় লেখক। নিলয় পন্থের নাম তুই জানিস না?’ রুবি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘ওহ! হ্যাঁ। ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের মধ্যে এখন সবচেয়ে বিখ্যাতদের মধ্যে একজন। আমি তো ভাবতেই পারিনি সে আমাদের নিলয়! তুই লেখক হলি কী করে?’ নিলয় এতক্ষণে মুখ খোলার সুযোগ পেয়ে বললো ‘ওই যে বলে না প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর ভূমিকা থাকে আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। আমার লেখক হওয়ার পেছনে আমার বউ সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলো!’ মুখচোরা সিলভান এবারে বললো ‘আহা! শুনি শুনি সে কেমন প্রেমের কাহিনী।’ নিলয় দুটো হাতকে একটু ঘষে নিলো। মনে হয় ঠাণ্ডা কাটাতে। তারপরে শুরু করলো কাহিনী ‘এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে বাবা দিল্লী পাঠিয়ে দিলো পড়তে। তখনই তার সঙ্গে আলাপ। তারপরে প্রেম। আমাদের আদত বাড়ি তো তোরা জানিসই হরিয়ানার গ্রামে। তা শহুরে মেয়ের অমন প্রেমের ভাব দেখে প্রেমে সেই যে মজে গেলাম একেবারে বিয়ে অবধি গড়িয়ে গেলো। শ্বশুরের বিরাট ব্যবসা। অমন ব্যবসা ছেড়ে কে আর অন্য কাজ খোঁজে। বড়লোকের একমাত্র মেয়ের জামাই। ব্যবসা একেবারে নিজের মত করে নিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে করে যত পুরনো হতে লাগলাম তত ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া বাড়তে লাগলো। বাপের দেহান্তের পরে মেয়ে হলো ব্যবসার মালিক আর আমি সেই কর্মচারী। একদিন বউ বললো ভিখারির বাচ্চা এত প্রাচুর্য কোনোদিন চোখে দেখেছো। বোধহয় অল্প কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তারই উত্তর এটা। তারপরে ক্রমশঃ তেজ বাড়তে লাগলো কথার। তারপরে একদিন বললো ওদের একটা কোনো নতুন ইউনিট খোলার জন্য টাকা দিতে হবে। ওদের অভাব নেই কিন্তু আমি যে যোগ্য সেটা প্রমাণ করতে দিতে হবে। সে বেশ ভালো টাকা। আমি আর কোথায় পাবো! তাই যোগ্যতার অভাবে গেট আউট হয়ে গেলাম! তারপরে শুরু হলো অভাব। চলে এলাম দেরাদুনে। অর্থের প্রবল কষ্টের মধ্যেও চলতে থাকলো লেখালিখি। এভাবেই একদিন প্রাক্তন বউয়ের অনুপ্রেরণায় আমি লেখক হয়ে উঠলাম।’
এবারে রুবি বললো ওর কাহিনী ‘আমি ভাই বর সোহাগী গৃহ বধূ। বরের রোজগারে খাইদাই আর সংসারের কাজ করি!’ ওর থামার আগেই আসিফ হাত নেড়ে বলে উঠলো ‘ওরে আমার বর সোহাগীরে! শালা তোর বর তো তোকে কবেই লাথ মেরেছে!’ রুবিও ঝাঁঝিয়ে উঠলো ‘এই এই ডোন্ট হিট বিলো দ্য বেল্ট! সবসময় সত্যি বলতে হবে তার কোনো মানে আছে? এটা হলো হোয়াইট লাই!’ আসিফও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে দিলো ‘তোর বেল্টের তলায় তো শুধু চর্বির পাহাড়। শালা গোটা কলকাতাকে বাসি পাউরুটি আর কেক খাইয়ে এখন কলকাতার নামকরা বেকারি চেনের মালিক!’ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেছে। নিলয় বললো ‘সামান্থা বোধহয় আর এসে পৌঁছতে পারলো না! আসিফ তুই তো সবার খবর রাখিস। সামান্থার কোনো খবর জানিস না?’ আসিফ মাথা নাড়লো ‘না রে। তোদের সবার খবর আমি জানি কিন্তু একমাত্র সামান্থার খবর আমি জানি না। কোথায় যে ভ্যানিশ হয়ে গেলো! তবে এটুকু নিশ্চিত সামান্থা আসবে। আসবেই। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল – যেখানেই থাকুক ও ঠিক ছ’টার সময় এসে উপস্থিত হবে।’ ধ্রুব খুব আশ্চর্য হচ্ছিলো কেউ একবারও ওর কথা জিজ্ঞাসা করছে না। কেউ উদ্বিগ্ন হচ্ছে না যে ও কেন এখনো আসছে না। হতে পারে সবাই বুঝতে পেরে গেছে যে ও এসে একটু দূরেই চুপচাপ বসে আছে। ওরাও ওকে চমক দিতে চাইছে! কিন্তু সামান্থা এখনো এলো না এটা সত্যিই খুব চিন্তার। সামান্থা আজকের দিনটা ভুলে গেছে এটা অসম্ভব।
আসিফ সিলভান কে জিজ্ঞাসা করলো ‘তুই তো ইসরো তে আছিস?’ সিলভান অল্প একটু হেসে বললো ‘হ্যাঁ। আমার পথ খুব সোজা। কেমিক্যাল নিয়ে নাড়াচাড়া করি আর ঘরে ফিরে বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করি।’ আসিফ বললো ‘সে আমারও বাপের রেখে যাওয়া ব্যবসার টাকা ওড়াই আর গোটা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই।’ সিলভান বললো ‘গোটা পৃথিবী ঘুরেও তুই আমাদের ইংরেজ বাঙালি সামান্থা কারের খবর কোথাও পেলি না?’ আসিফ যেনো একটু বিষণ্ণ ‘না রে। তবে ধ্রুব একবার বলেছিলো সামান্থা নাকি সিডনিতে থাকে। তবে আমি সিডনিতে গিয়ে কোথাও সামান্থার খোঁজ পাইনি।’ ইংরেজ বাঙালি। এটাই হলো সামান্থার সঠিক পরিচয়। সামান্থা যেন এক রূপকথার মানুষ। যেন এক পরী। শান্ত ভ্রু পল্লবের তলায় অতলান্ত গভীর দুটো চোখ দেখলে মনে হতো যেন নারকেল গাছে ঘেরা বেলাভূমি। সামান্থা ছিলো জন্মসূত্রে খাঁটি ব্রিটিশ। ওর বাবা কোনো এক চা বাগানের ম্যানেজার ছিলো। কিন্তু সামান্থার গভীর অনুরাগ ছিলো বাংলা। যখনই সুযোগ পেতো বাংলায় কথা বলে যেতো অনর্গল। সাহেবি স্কুলে পড়ে যেখানে ওরাই ইংরেজি শিখে সাহেব হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো সেখানে সামান্থা পুরো উলটো পথে হেঁটে খাঁটি বাঙালি হবার চেষ্টায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো। অনেক পরে ধ্রুব বুঝতে পেরেছিলো সামান্থার প্রতি ওর শুধু বন্ধুত্বের অনুরাগ নেই। তার গভীরে আরেকটা যেন অনুভূতি আছে। তবে সামান্থা কখনো ওর এই ভাবকে পাত্তা দেয়নি। অনেকবার ধ্রুব’কে এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে এত বিরাট সাফল্যের পরেও কেন ওর কোনো ভালোবাসার সঙ্গিনী নেই। এইসব প্রশ্নগুলো অনেকটা ক্রিকেট মাঠের বিষাক্ত বাউন্সার বলের মতো। ব্যাট চালাতে গেলেই সমূহ বিপদ। তার চেয়ে চুপচাপ মাথা নামিয়ে বল ছেড়ে দেওয়ায় নিরাপদ। ধ্রুব তাই করতো। সাংবাদিকদের করা ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্নেরই ও উত্তর দেয় না। ট্যাবলয়েডগুলো নিজেদের মত আন্দাজে বিভিন্ন গসিপ ছড়াতো। একবার তো একটা ট্যাবলয়েড কোথাও কিছু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আসিফকে জড়িয়ে ওকে নিয়ে গুজব রটিয়ে দিলো। কিন্তু যে কথা গভীর অন্তরালের। যে কথা ও কোনোদিনই কারোকে বলতে পারেনি। এমনকি আসিফকেও না। ওর যে বলার ইচ্ছে ছিলো না এমন নয়। কিন্তু যে গোপন এক আলমারির মধ্যে ও এই কথাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলো একদিন নিজেই আবিষ্কার করলো সেই গোপন আলমারির চাবিটাই ও হারিয়ে ফেলেছে।
ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আসছে কাঙ্ক্ষিত সময়ের দিকে। এমন সময় নিলয় বললো ‘আজ ধ্রুব আসলে জমে যেতো পুরো।’ আসিফ বললো ‘ধ্রুব আসলে তোকে আমাকে এইভাবে বসে থাকতে হতো না। এত লোক জমতো যে আমাদের কথা বাদ দে, এই ডেথ রোডের ভূতগুলোকে পর্যন্ত পালাতে হতো। একবার কী হয়েছিলো জানিস। ধ্রুব আর আমি তাইওয়ান গেছি। ভেবেই রেখেছিলাম কোনো একটা গ্রামে গিয়ে কয়েকটা দিন একদম ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড হয়ে কাটিয়ে আসবো। তাইপেই অবধি ধ্রুব মুখ ঢাকা দিয়ে ছিলো। ওখানের প্রশাসনকেও জানানো ছিলো। পুলিশের গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। পরের দিন একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছে ধ্রুব মুখের ঢাকা সরিয়ে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিন্তু তার পরের দিন ভোরেই দেখা গেলো বেশ ভালো রকমের একটা ক্রাউড এসে জমা হয়েছে ওই গ্রামে আমরা যে হোম স্টে তে ছিলাম তার সামনে অপেক্ষা করছে কখন ধ্রুব বেরোবে!’ ধ্রুবকে নিয়ে কথা বলছে শুনে ওর বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্ত আকাশের গতি বেশ খারাপ। মেঘগুলো একদম কাছাকাছি নেমে এসেছে। আকাশ অন্ধকার বলে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু পরিস্থিতি দেখেই বোঝা যায় মেঘগুলো এখন অনেক ঘন হয়েছে। গির্জার কাছে একটা রাস্তার বাতির আলো জ্বলছে। মামুলি একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব। তবুও একটু আলো আসছে। ছ’টা বাজতে আর মিনিট পাঁচ বাকি। সামান্থা কি সত্যিই এলো না!
স্মার্ট ওয়াচের সময় জানাচ্ছে ঠিক সন্ধ্যে ছ’টা। আকাশের মেঘগুলো এখন গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এসে ওদের গায়ের সাথে লেগে লেগে আদর খাচ্ছে। তখনই গির্জা ঘরের পেছনদিকে নীল একটা বিদ্যুতের রেখা সমস্ত আকাশটাকে ফালা ফালা করে চিরে দিলো। আর ঝুপ করে ইলেকট্রিক চলে গিয়ে সবেধন নীলমণি ওই বাল্বের আলোটাও নিভে গেলো। এই জানুয়ারি মাসে এমন বিদ্যুতের ঝলক খুব অদ্ভুত। এই অন্ধকারের সুযোগেই ধ্রুব চুপিচুপি ওদের কাছে চলে এসে পাথরের ওপরে হাত রাখলো। আর খেয়াল করলো অন্ধকারের মধ্যেই ওর হাতের পাশে পাশে পাথরের ওপরে জমে উঠছে হাতগুলো। মৃদু একটা আলো জ্বলে উঠলো। স্বাভাবিক প্রতিবর্ত মেনেই চোখ চলে গিয়েছিলো আলোর উৎস সন্ধানে। আর খেয়াল করে দেখলো আসিফের অন্য হাতে ছোট্ট একটা ব্যাটারিতে চলা বৈদ্যুতিক বাতি। আসিফের দিকে মুখ তুলে ‘শালা’ বলে খিস্তি দিতে উদ্যোগ নেওয়ার সময়ই পাথরের দিকে চোখ পড়তেই সেই মৃদু আলোয় দেখলো পাথরের ওপরে জমে উঠেছে ছ’টা হাত। ঠিক ছ’টা। ধ্রুব’র হৃৎপিণ্ড যেনো থেমে আসছিলো তারমানে অবশেষে সামান্থা এসে গেছে।
‘ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরো – ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল, ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল –
ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।।’
আরে ওই তো সামান্থা। সেই গভীর চোখ। সেই লুটিয়ে পড়া হাসি। মন্ত্রোচ্চারণের মত করে রবীন্দ্র কবিতা বলে যাওয়া। সামান্থাকে দেখেই বাকিরা হইহই করে উঠলো। ধ্রুব’র দিকে কেউ খেয়ালই করছে না। বহু বহু বছর পরে গলার কাছে মেঘের মতো অভিমানগুলো আটকে গেলো যেন। সামান্থাও ওর দিকে তাকাচ্ছে না। যদিও বাইরে থেকে কিছুই বুঝতে দিচ্ছে না। আর যাই হোক ধ্রুব যে বিরাট এক অভিনেতা সে তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। তবুও কখনো কখনো অভিনয়ের থেকে বেরিয়ে আসতে মন চায়। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে একটু দূরেই সরে গেলো ধ্রুব।
আসিফ ক্যাম্প ফায়ারের মত করে আগুন জ্বালিয়েছে। সামান্থার গলায় গান ‘পুরনো সেই দিনের কথা’। আড্ডা জমজমাট হয়ে উঠেছে। নিলয় জিজ্ঞাসা করলো ‘কিন্তু সামান্থা তুই এলি কখন? আমরা তো ভাবলাম তুই আর এলি না!’ সামান্থা হাসতে হাসতে বললো ‘আমি অনেকক্ষণ এসেছি। ওই পাথরটার ওপরে বসে তোদেরকে দেখছিলাম আর আড্ডা শুনছিলাম। ভাবলাম একদম ঠিক সময়ে সবার সামনে এসে চমকে দেবো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো আর আলো নিভে গেলো। তাতে একদম সুবিধা হয়ে গেলো। ধ্রুব প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো। কেন না এতক্ষণ ওই পাথরের ওপরে তো ও বসেছিলো। ওখানে সামান্থা কোথায় ছিলো! কিন্তু ওর কথা তো কেউ শুনছেই না। আসিফ তাও সামান্থাকে একটু ঠোকার সুযোগ ছাড়লো না ‘আমি তো খেয়াল করেছিলাম। হ্যাট – কোট পরা কেউ একজন বসেছিলো। ভাবলাম টুরিস্ট। কি করে জানবো বঙ্গ ললনা শাড়ি না পরে হ্যাট – কোট পরে আসবে!’ সামান্থা আসিফের গালটা একটু টিপে দিয়ে বললো ‘হ্যাট তো তোর মতো একটা লুচ্চা কে টুপি পরানোর জন্য। আর কেউ না চিনুক তুই ঠিকই চিনতে পেরে যাবি জানতাম! আর কোট! সে তো ঠাণ্ডার জন্য।’ বলেই জ্যাকেটের জিপারটা টেনে নামিয়ে দিয়ে বললো ‘এই দেখ ভেতরে কিন্তু শাড়িই পরা আছে!’ রুবি জিজ্ঞাসা করলো ‘তুই তাহলে আছিস কোথায়?’ সামান্থা উত্তর দিলো ‘অস্ট্রেলিয়া। তবে সিডনিতে না। তাসমানিয়াতে। ধ্রুব ঠিকই বলেছিলো। আমি ওর ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।’ আসিফ অবাক হয়ে বললো ‘তোর সঙ্গে ধ্রুব’র দেখা হয়েছিলো?’ সামান্থা উত্তর দিলো ‘না না। কোনো প্রশ্নই নেই। ও ছিলো মঞ্চের মূল আকর্ষণ আর আমি তো হাজার দর্শকের ভিড়ে একজন।’ আসিফ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘ওর মধ্যেই ধ্রুব তোকে দেখতে পেলো কীভাবে? মঞ্চের থেকেই চিনে ফেললো?’ সামান্থা এর মধ্যেই আসিফ কে পেড়ে ফেললো ‘তাহলে হিউম্যান কম্পিউটারও ফেল মেরে গেলো! তুইও ধরতে পারলি না আসিফ?’ তারপরেই অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা সামান্থার মুখের ওপরে মেঘের চাদরের মত ছেয়ে ফেললো ‘ভালবাসলে উপস্থিতি অনুভব করা যায় রে আসিফ! বোঝা যায়। অদ্ভুত আঘ্রাণ তোকে বুঝিয়ে দেবে সে এখানেই আছে। যেমন আমি বুঝতে পারছি ধ্রুব এখানেই আছে। এতক্ষণ আমারই সঙ্গে ওই পাথরটার ওপরে বসেছিলো। ও আমারই সঙ্গে এসে এই পাথরের ওপরে হাত রেখেছিলো। তোরা কি কেউ খেয়াল করেছিলি ঠিক ওই সময়ে এই পাথরের ওপরে হাত ছিলো ঠিক ছ’টা। পাশাপাশি। গোল। একটা সার্কেলের মত। কিন্তু ঠিক ছ’টা।’ রুবি, সিলভান, নিলয়, আসিফ সবাই দেখেছে ছ’টা হাত। রুবি বললো ‘আমি ভেবেছিলাম আসিফ হয়তো একটা হাত ধ্রুব’র জন্য রেখেছে। কিন্তু পরে ভাবলাম ওর তো অন্য একটা হাতে আলো ধরা ছিলো! তাহলে কি সত্যিই ধ্রুব এসেছিলো?’ আসিফ বললো ‘এসেছিলো না। এসেছে। সামান্থা ঠিকই বলেছে। ও এখানেই আছে। আমাদের মধ্যেই আছে এখনো।’ নীল একটা দলা পাকানো কুয়াশা একটা মায়াবী সরীসৃপের মত ওদের গা বেয়ে পাক খেতে খেতে জড়িয়ে ধরছিলো। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা ডেথ রোড। দূরের অন্ধকারে জমাট বেঁধে থাকা অন্ধকারের ডেলার মত পাহাড়গুলো। ওরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো যে এই বিষণ্ণ নির্জনতার ডেথ রোডে আজ ওরা পাঁচ নয় ওরা ছয় জন ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা করছে আজ থেকে ঠিক তেত্রিশ বছর আগের অন্য একটা বিষণ্ণ নির্জনতাকে।
তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২৩