তাল ফুলুরির গন্ধ

ভাদ্রমাসের সকালে সোনালী নরম রৌদ্র, চিকন ও ঈষৎ বাঁকা ভাবে এসে পড়েছে বাতাবি লেবু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে।ওই গাছে,পাতার আশ্রয়ে বাসা বেঁধে থাকা একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখি কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে আবার খানিক বাদেই মুখে খাবার নিয়ে ফিরে আসছে বাসায়।তা দেখে ছোট্ট ছানা দুটির আনন্দ আর ধরে না।

তাল তাল সোনালী বাতাবি লেবুর ভারে গাছটি যেন নুইয়ে পড়ে ক্রমে দুলে দুলে উঠছে প্রভাতী বাতাসের মায়াবী স্পর্শে।মাটির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে,ওই দিকেই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বিষহরি।

জাতিতে সদগোপ হলেও,এই বসতবাটি ছাড়া চাষযোগ্য জমি বা বিষয় সম্পত্তি বিশেষে কিছু ছিল না তার। ডানপা টা হারানোর পর আরো সর্বশান্ত হয়েছে সে।দুবছর আগে শহরে ঠিকাদারী কাজ করতে গিয়ে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হাঁটুর নিচ থেকে থেতলে যায় বিষহরির শক্ত সমর্থ একটি পা, সেটিকে বাদ দিতে হয় চিরতরে। সেই থেকে সে চলৎশক্তিহীন।কাজ কর্ম হারিয়ে প্রবল আর্থিক অনটনের মধ্যে মেজাজটাও যেন বিগড়ে থাকে সব সময়,কারণে অকারণে।তাই খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া তার বড় মেয়ে শালুক ও সাত বছরের ছেলে কুন্দন তার আসে পাসে খুব একটা ঘেসে না আজকাল। পরনের লুঙ্গি টাকে একটু উপরের দিকে তুলে শক্ত করে বড় একটা গিঁট মারতেই আভরণ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পরে কাটা পা টা।সেখানে হাজার হাজার চোখ যেন অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে,দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়ে আসে।

বর্ধিষ্ণু গ্রামের এক প্রান্তে অভিজাত লাহা বাবুদের বাড়িতে কাজ করে স্ত্রী মালতি।তার গতর খাটানো টাকাতেই দুবেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থান হয় বিষহরির গোটা পরিবারের। মালতির পয়সায় বসে বসে অন্ন ধংস করতে যেন উদ্ধত পৌরুষে জ্বলা ধরে বেরোজগেরে বিষহরির অথচ সে নিরুপায়। বড্ডো অসহায় লাগে নিজেকে, ভগবান যেন অবাঞ্ছিত ভাবে তাকে গুঁজে দিয়েছে এই সংসারে, যেখানে তাকে কারোর প্রয়োজন নেই এতটুকুও। অনন্ত অযাচিত অবসরের মাঝে সে বাসি খবরের কাগজ সংগ্রহ করে টুকরো টুকরো করে। আঠা দিয়ে জুড়ে ঠোঙা বানায়।সেই ঠোঙা শালুক দোকানে দোকানে দিয়ে যে সামান্য কটা টাকা পায়,তা তুলে দেয় বাবার হাতে।সেই টাকা থেকে নিজের জন্য সামান্য কিছু হাতখরচ রেখে সংসারের তেল ,চাল ,ডালের সংস্থান না হলেও,নুন ও সামান্য কিছু সস্তার আনাজপাতি কেনা হয়ে যায় দিব্যি।

এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজের ঠোঙা গুলোকে গুছিয়ে তার উপর আঠার শিশিটাকে বসিয়ে রেখে একটা বিড়ি জ্বালাবার উপক্রম করতেই, অনেক ক্ষণ থেকেই ভেসে আসা চলমান অস্পষ্ট একটা গোলমালের আওয়াজ, তার উঠানে এসে আরো গভীরতর হয়ে আছড়ে পড়লো এই সাত সকালে।

বিষহরি অসহায় দৃষ্টিতে দেখল,শালুকের চুলের মুঠি ধরে মাঝ উঠনে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসছে বাগদি পাড়ার ভোলার মা। ছোট্ট কুন্দন দিদির সাথ ছাড়েনি,সে ও আছে পাশে,হাতে তার এক পাঁজা শাপলা, অবিন্যস্ত ফুলগুলো ধুলোয় লুটাচ্ছে।পরনের জামা কাপড় ভেজা।অনতিদূরে ভোলা তার মোটা গোলগাল পেট-টি বার করে দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে।পিছু পিছু উৎসুক একটা দঙ্গল। কলহপ্রিয়া হিসাবে ভোলার মায়ের বেশ নামডাক আছে পাড়ায়।পায়ের উপর পা দিয়ে ঝগড়া করতে তার জুড়ি মেলা ভার।এমনই দোর্দণ্ডপ্রতাপ যে চিল শকুন ও ওড়েনা তার বাড়ির উপর দিয়ে।ভিখারিরাও তার ত্রিসীমানা মাড়ায় না, সকলে সমঝে চলে তাকে। সক্কাল বেলা বিবাদমান ভোলার মাকে শালুকের চুলের মুঠি ধরে হুঙ্কার দিতে দেখে বিষহরির মুখাবয়ব পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো।

-ওলো শালুকের বাপ!বলি তোমাদের কি মরণ হয় না গো!এই সোমত্থ মেয়েটাকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে চুরি বেদ্যা শেখাচ্চো!কি আর করবে বলো?মা মাগী তো নাগর ধরে ফস্টি নষ্টি করে বেড়াচ্চে।ন্যাংড়া সোয়ামি,আর ছেলে মেয়েদের খবর রাখতে তার বয়েই গেছে!বলি তোমরা যা ইচ্চে তাই করো, এই আমি চোখ বুজলুম কিন্তু আমার বাগানের নারকেলটা,কলাটা,মূলটা যে রোজ রোজ চুরি হয়ে যাচ্চে এর বিহিত একটা করো দিকি?

সুর টেনে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল কথা গুলো।

– তক্কে তক্কে ছিলাম।আজ হাতে নাতে ধরেচি একদম।বলি তোমার কানে যাচ্চে আমার কথাগুলো? আমার ভোলার আবার দয়ার শরীল।বলে মা ছেড়ে দাও।ওরা তো খেতে পায় না গরিব মানুষ।তা দুটো খাক না।খাক না বললেই হলো?আমার গতর খাটানো পরিশ্রমের ফল বারো ভুতে খাবে?বেচে থাকতে সে আমি সহ্য করবো নি।তুমি এর বিচার করো না হলে আমি আজ পঞ্চায়েতে নালিশ দেব।

ভোলা হলদে দাঁত বার করে শালুকের উঠতি বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে লোলুপ দৃষ্টিতে।

বিষহরি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবম্ভ হয়ে যায়।ভোলার মায়ের তির্যক বাক্যবাণ তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। লজ্জা,ঘৃণা,অপমানের সেই মুহূর্তে, তার মাথাটা যেন টুকরো টুকরো হয়ে চতুর্দিকে ফেটে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। সে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে, মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দ্রুত ছুটে আসে উঠোনের মাঝখানে। ভোলার মায়ের হাত থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে সপাটে একটা চড় মারে গালে।এতক্ষনে মুঠিতে ধরে থাকা ছোট দুটি কষটে পেয়ারা শিথিল হয়ে গড়িয়ে পড়ে শালুকের পায়ের কাছে।

সারাটা দিন বালিশে মুখ গুঁজে মরার মতো এক ধারে পড়ে রইলো শালুক।গাল বেয়ে বয়ে যাওয়া অশ্রু জলের সরলরেখা তখনো স্পষ্ট।ভোলাটা এই ভাবে প্রতিশোধ নিলো!কথাটা ভাবতেই তার সর্বাঙ্গ তেলে বেগুনে জ্বলছে।ভোলা খুব খারাপ ছেলে,ইস্কুলে যায় না। অন্যের নামে দোষ দিয়ে নিজেদের বাগান থেকে নিজেই কলাটা মূলোটা চুরি করে, সেগুলো বিক্রি করে যে পয়সা পায়, তা দিয়ে এদিকে ওদিকে লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খায়।সেদিন ভাইয়ের পেটকাটি ঘুড়িটা ওদের বাগানে পুকুরের উপর হেলে পড়া খেজুর গাছে আটকে গেছিলো।সেটা পারতেই দুই ভাই বোন ঢুকেছিলো ওদের বাগানে।না হলে কি আর সাধ করে কেউ মরতে যায় ওই বড় বড় ঘাসের আগাছার জঙ্গলের ভিতর!পাশেই গন্ধরাজ, রাংচিতা, বনচালতার ঘন বন আর লতাপাতায় মোড়া ঘন জঙ্গল। ওদিকটাতে আবার ভীষণ সাপের ভয়। ঘুড়িটাকে পিঠে আটকে ওই শুয়ে পড়া গাছ বেয়ে নেমে আসতেই শালুক দেখল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ভোলা,হাত নেড়ে ইশারায় ডাকছে তাকে।ভাইকে ওইখানেই দাড় করিয়ে রেখে,কাছে গেলে তাকে একটা কাঠবিড়ালির বাচ্চা দেখাবে বলে সেখান থেকে আরো কিছুটা দূরে একটা ভাঙা ঘরের ভিতর নিয়ে যায়।ভিতরে ঢুকতেই ভুল ভাঙলো শালুকের।একটা দেওয়ালের দিকে মুখ করে পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরলো ভোলা।গায়ে কি জোর রে বাবা ওর!তার ফ্রকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট বুক দুটো দুমড়ে মুচড়ে যেন পেশাই করতে চাইছিলো সে।ক্রমে বেড়ে চলা নিজের বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ,কান পর্যন্ত পৌঁছে একটা অবশ্যাম্ভাবী বিপদের সংকেত দিচ্ছিলো তাকে।ভোলার হাতে জোরে একটা কামড় দিয়ে এক ঝটকায় তাকে ছিটকে ফেলে, ছুট্টে বার হয়ে এসেছিলো সে ওই ঘর থেকে, তার ভাইয়ের কাছে। ভোলা চিৎকার করতে করতে বলে ছিল-“কাজ টা তুই ভালো করলি নে,এর প্রতিশোধ আমি নেবো।”

ভোলা খারাপ ছেলে এটা সে জানতো কিন্তু এতটা খারাপ, সেটা তার কল্পনার অতীত ছিল।আর আজ সকালে ভাই কুন্দকে সাথে নিয়ে ডিঙি চড়ে যখন পদ্ম বিল থেকে শাপলা তুলে ঘাটে ফিরছিলো শালুক,ভোলা তখন ঘাটের একধারে ওল্টানো একটা তাল গাছের ডোঙার উপর বসে ভাঙা একটা নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁতন করছিলো।তারা দুই ভাই বোন বাড়ির পথ ধরলে ভোলাও তাদের পিছু নেয়।বেশ খানিকটা পথ হেঁটে ভোলাদের বাগানের পাশ দিয়ে যে পথটা বাঁকা ভাবে চলে গেছে পান বরজকে বামহাতে রেখে তাদের বাড়ির দিকে। সে পথে এগোতেই শালুক লক্ষ্য করে ভোলা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে এসে তাদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকের পথটা বেশ নিরিবিলি। শালুক প্রথমে একটু ভয় পেলেও খানিকটা কাছে এগিয়ে যেতেই দেখলো,তার জন্য দুহাতে দুটি পেয়ারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভোলা।তার হাতে পেয়ারা দুটি  তুলে  দিয়ে সে বললো, “নে!খা।একটা তোর ,আর একটা কুন্দর।আজ থেকে আমরা আবার বন্ধু হলাম।” শালুক প্রথমে নিতে না চাইলেও ভোলার জোরাজুরির কাছে হার মানতে হয় তাকে। তাই নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে ভোলাকে এড়াতে সে হাতে তুলে নেয় কচি পেয়ারা দুটি।এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।সবে মাত্র তখন বাড়ির দিয়ে দুপা বাড়িয়েছে তারা অমনি হঠাৎ কোত্থেকে ভোলা ওর মাকে ডেকে এনে পিছন থেকে দৌড়ে এসে শালুকের চুলের মুঠি টেনে ধরে।সহসা হ্যাচকা টানে শালুকের হাতে ধরে থাকা শাপলাগুলি এদিকে ওদিকে ছিটকে যায়।এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।ঘটনার আকস্মিকতায় শব্দহীন হয়ে যায় দুই ভাইবোন।

তাদের হাতের মুঠিতে থাকা পেয়ারার দিকে তাকিয়ে, চোখা চোখা শব্দ প্রয়োগ করে চুরির অপবাদে বেদম প্রহার করতে করতে ভোলার মা এগিয়ে চলে তাদের বাড়ির দিকে।মজা দেখার জন্য পথে সঙ্গ নেয় অকেজো লোকজন।যুদ্ধ বিজয়ে উল্লাসে ভোলার হলদে দাঁতে যেন হাসি আর ধরে না। সে শুধু বারে বারে সেদিনের কামড়ে দেওয়া জায়গাটিতে বাম হাতের আঙ্গুল বোলাচ্ছিলো তখনো।

 

একটা চিনচিনে ব্যাথার মণ্ড পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে দুচোখে কান্নার বাস্প হয়ে ভিজিয়ে দিলো শালুকের। সবাই যখন তার দিকে চোরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে গিলছিল,তখন বড্ডো অসহায় লাগছিলো নিজেকে।এতগুলো চকচকে চোখের সামনে নিজেকে উলঙ্গ মনে হচ্ছিলো তার।সে চাইলে সবার সামনেই বলতে পারতো আসল ঘটনাটা,কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতো না তাকে।মাকে বললে মা ও বিশ্বাস করবে না ,উল্টে তাকেই দোষ দেবে।বোবা কান্নাটা থামতেই জানেনা যেন! মাথার বালিশ টাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আরো একবার মুখ লুকায় সে।

দিনান্তে মালতি ঘরে ফিরে দেখলো দাওয়ায় বসে স্বামী বিষহরি কি যেন আকাশ কুসুম ভেবে চলেছে। সে ফিরেছে দেখেও বিষহরি তার দিকে চাইল না একটিবার ও। কাছে বসে কুন্দ ঘুড়িতে আঠা লাগাতে ব্যাস্ত।মা কে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই মালতি আঁচলের তলা থেকে কি যেন একটা বের করে ছেলের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে তার রুক্ষ চুলে নরম হাত বুলিয়ে কপালে এঁকে দিলো স্নেহের চুম্বন।সেই সুযোগে কুন্দ ও সকাল থেকে ঘটে চলা সমস্ত ঘটনা ইনিয়ে বিনিয়ে সুর করে করে মাকে শোনাল।নিরুত্তর মালতি কিছু বললো না। শুধু তার একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে গেল শেষ বিকালের তপ্ত বাতাসে।তার কেবলি মনে হলো,সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোতে ছেলে মেয়ে দুটো দুলে দুলে পড়ে।খিদের পেটে সে তাদের দুবেলা ভালো মন্দ খেতে দিতে পারে না একথা ঠিক ,তাই বলে অন্যের খাবার তারা চুরি করে খাবে একথা মালতি বিশ্বাস করে না।সে বুঝতে পারে দুপুরে কাররই খাওয়া হয়নি।তাই সে ভাত বাড়তে অতি দ্রুত ঘরে প্রবেশ করলো।

দিনের আলো মিইয়ে পড়লে চারধারে অন্ধকারের রঙ লাগে।নিঝুম পল্লীগ্রামটি ক্রমে ডুবে যেতে থাকে অতল ঘন অন্ধকারে।থোকা থোকা জোনাক জ্বলে ওঠে শিরিষ গাছের পাতায় পাতায়। পূবালী হওয়ায় ভেসে আসা সন্ধ্যা শাঁখের আওয়াজ জানান দেয় যে গ্রামটি এখনো বেঁচে আছে!বিরামহীন ঝিঝির ডাক ঘুমের মায়ার চাদরে মুড়ে দেয় পল্লী জনজীবনকে।

হ্যারিকেনের মাথা থেকে নুনের পুটুলিটা তুলে নিয়ে মেয়ের শরীরে আলতো করে চেপে ধরে মালতি।সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা নিয়ে শালুক কাতরায়।এতে কতটা উপশম হবে কে জানে!কেমন যেন একটা অব্যক্ত শূন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। বিষহরি ও দাওয়া থেকে উঠে এসে মেয়ের গা ঘেসে বসে।অনতিদূরে বসে ছোট্ট কুন্দ ভেজা স্লেটটাকে পাখা দিয়ে বাতাস করার ভঙ্গিতে হওয়ায় দুলিয়ে দুলিয়ে শুকাচ্ছিলো।বিষহরি একটু গলা খাঁকারি দিলো,মালতির দিকে মুখ তুলে বললো,

-চল বউ আমরা দূরে কোথাও চলে যাই।

মালতি কোনো উত্তর দিলো না। কুন্দ হাতের থেকে স্লেট নামিয়ে রেখে বাবার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললো

-আমরা কোথায় যাবো বাবা?

-তুমি চিনবে না,সে অনেক দূর বাবা।

নরম সুরে উত্তর দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো বিষহরি।ছেলের শরীরের গন্ধ জুড়ে নিজের শৈশব উঠে আসে যেন। চোখ বন্ধ করে তার মাথাটা বুকের মাঝে চেপে ধরলো সে।

দুপুরে মালতি লাহাদের বাড়ি থেকে একটা বড় কুচকুচে কালো তাল নিয়ে এসেছিলো।সাথে এক বাটি

সর্ষের তেল।আর কয়েকদিন বাদেই জন্মাষ্টমী, গ্রামশুদ্ধু লোকের নেমন্তন্ন সেদিন ওই বাড়িতে।রাস মঞ্চে বেণীমাধবের দোলনা দুলবে।পালা গানের দল আসর বসাবে।দুই বেলা পাত পারবে ছেলে থেকে বুড়ো সবাই। তাই আগে ভাগেই লাহা গিন্নি বড় একটা তাল আজ একপ্রকার জোর করেই তাকে দিয়ে দিয়েছে

যদি আর পরে না থাকে।তার একটা সদ্গতি করতে মালতি উঠে গেল মেয়ের পাস থেকে।

মালতি একটা কাঁসার বড়ো পাত্রে তালের গোলার মধ্যে চালের গুঁড়ো ময়দা আর গুড় দিয়ে আনমনে চটকাচ্ছিল।শরীরের ব্যথার কথা ভুলে গিয়ে শালুক উঠে এলো মাকে সাহায্য করতে। প্রথমে মালতি তার সাহায্য নিতে না চাইলেও শালুক কুরুনীর নিচে একটা কলার পাতা পেতে এক মালা নারকেল কোড়ার জন্য তুলে নিলো।কাজ করতে গিয়ে তার মনোকষ্ট যদি সামান্যও লাঘব হয় এই ভেবে মালতি আর বাধা

দিলো না।খানিক বাদে কুন্দ দিদির গা ঘেসে দাঁড়িয়ে নিজের পরিধেয় প্যান্টে হাত মুছে ডানহাত খানি পেতে বললো,

-দিদি আমায় এট্টু।

শালুক আর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে,এক খাবলা সাদা নারকেল কোরা ভাইয়ের হাতে তুলে দিতেই,পুরোটা একবারে মুখে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে সে চিবাতে থাকে।মায়ের চোখ থেকে লুকাতে তার এই পন্থা।

মালতি নারকেল কোরা আর সামান্য মৌরি মিশিয়ে পাঁচ আঙুলের অদ্ভুত এক মুদ্রায় ওই তালের গোলা থেকে ছোট ছোট ফুলুরি গরম তেলে ছারে। প্রথমে সেগুলি ছেএয়াকক করে ডুবে গিয়ে পরে গরম তেলের ফ্যানার সাগরে কেমন লালচে হয়ে ভেসে ওঠে।মন মাতানো সে ফুলুরির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বিষহরির ভাঙা কুঁড়ে।সে গন্ধ যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে গ্রাস করে জীবনের যা কিছু  দীনতা।অদ্ভুত এক ভালোলাগার তরঙ্গে ভেসে যায় দুঃখ বেদনার হাহাকার,যা কিছু অপ্রাপ্তি,ঘন অন্ধকারে ছড়িয়ে পরে সব।

কুন্দ কড়াইয়ের উপর প্রায় ঝুকে পড়ে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছিলো কেমন করে ফুলুরি গুলো ফুলে ফুলে লাল হয়ে উঠছে।মালতি একটু ঠান্ডা হয়ে আসা একমুঠো তাল ফুলুরি একটা বাটিতে করে তার হাতে

তুলে দিয়ে বললো,

-নে,কিন্তু এখানে বসে খাসনে যেন।মুখথেকে পড়বে সব এঁঠো হয়ে যাবে,যা ওদিকে যা।ওদিকে গিয়ে খা।

এক পা দু পা করে বাটি ভর্তি ফুলুরি নিয়ে কুন্দ ঘরে ঢুকে দেখলো তাদের ছোট্ট চৌকিটার উপর দিদি শুয়ে আছে।দিদির মুখে একটা ফুলুরি ঢুকিয়ে দিতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে।ভাই কে কাছে টেনে নিয়ে বললো,

-দেখিস এবার থেকে আমাদের খুব ভালো হবে। খুব ভালো থাকবো আমরা।

দিদির চোখে অপার বিস্ময় দেখে ছোট্ট কুন্দ খাওয়া থামিয়ে রেখে আমতা আমতা করে জিগ্গেস করলো,

-ভালো থাকা মানে কি রে দিদি?

কিছুক্ষন চুপ করে রইলো শালুক। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো

– ভালো থাকা মানে মোটা চালের ভাতের সাথে এক টুকরো মাছ আর একবাটি দুধ।পরনে ভালো কাপড়।

কুন্দ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দিদির মুখের দিকে।স্কুলে যেদিন একথালা খিচুড়ির সাথে গোটা একটা ডিম্ দিয়ে ছিল তাকে,সেদিনের থেকেও অনেক বেশি অবাক হলো আজ।আনমনে একটানা বকে চলে কুন্দ।সে কথা শালুকের কানে গিয়ে পৌঁছায় না ভাবের গভীরে হারিয়ে যায় সে।

রাত্রি গভীর হয়। কাঠের চৌকির উপর শুয়ে এ পাশ ও পাশ করতে থাকে বিষহরি।ঘুম কিছুতেই আসছে না। পাশে ছেলেটা ঘুমিয়ে কাদা। নিচে মেয়েটাও হয়তো মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে।বিষহরি ফিসফিসিয়ে ডাকলো -মালতি এই মালতি।

বিষহরি অবরে সবরে এই রকম ডাক দেয়।ক্লান্ত শরীর ভেঙে এলেও এই ডাকে সারা দিয়ে সে চৌকির উপর উঠে আসে,মানুষটা যেন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে না বসে।আজ ও মালতি ডাক শুনে উঠে যায় উপরে। কিন্তু বুঝতে পারে এ ডাক সে ডাক নয়। সে পরনের কাপড় শিথিল করতে গেলে বিষহরি বাধা দেয়।

-শোন মালতি অনেক দিন তো বসে বসে খেলাম,কাল থেকে ভাবছি কাজে লাগবো।অভাব যে বড় বালাই রে বড় বালাই।

-কোন শত্তুরে বলে তুমি বসে খাও? তার মরণ হয় না গো!

-না মালতি তুই আর আমায় বাধা দিস নে।আগে তুই আমার কথা টা শোন।

বিষহরির বুকের মধ্যে ঘন হয়ে শুয়ে আলতো করে চোখ বোজে মালতি।বলে চলে বিষয় হরি। আকাশে তখন শুক্ল দ্বাদশীর পূর্ণ চাঁদ। নিচের ঘন কালো ভেজা মেঘর পর্দা সরে যেতেই পূর্ণ চন্দ্রকলার উজ্বল প্রভা জোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ছে পল্লী গ্রামের বড় বড় গাছেদের মাথায়,প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে।বিষহরির বাড়ির উঠানে ও টলমলে জোৎস্নার প্লাবন।সেই জোৎস্নাধারার মায়াবী আলো যেন ভাঙা জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমেছে শালুকের সোমত্থ শরীরে।নদীর ধারের সরস সতেজ চিক্কণ শ্যাম-কমলী-লতারই মতো মেদহীন শরীর জুড়ে রুপালি জোৎস্নার আলোক ছটার উজ্বল লাবণ্য তার সারা মুখখানাতে চন্দনের ঘ্রাণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।ফিনিক দিয়ে চাঁদের আলো তার গায়ে এসে পড়তেই সে বুঝতে পারলো উবে যাওয়া কর্পূরের মতো একটু একটু করে ব্যাথ্যা গুলো সব যেন কমে যাচ্ছে।অস্পষ্ট ঘোলাটে চোখে দেখলো, উঠোনে চাঁদের আলোয় কারা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে! অনেকটা পরীর মতন। তাদের ডানা থেকে চুইয়ে নামা সাদা জোৎস্নার ঝলকে চোখে ধাঁধা লাগছে তার।মাথাটা কেমন যেন হালকা হয়ে আসছে,মনে হচ্ছে থেকে থেকে চেতনা শূন্য হয়ে যাচ্ছে শরীর। মনে হল তুলোর মতো হাওয়ায় ভাসছে সে।বাবা মায়ের গোপন কথা গুলো আর কানে এসে পৌছাচ্ছেনা।পরীদের ডানায় হাজারো তালফুলুরি উড়ছে ,আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে সেই ফুলুরির মায়াবী গন্ধ, অজস্র জুঁই ফুলের মতো ঝাঁজ তার।যেন কোথা থেকে ভোলার মা ও এসে ভাসছে তাদের উঠানে।যেন পূর্ণিমার গোল চাঁদের মতো বড়ো বড়ো চোখ!সে চোখে জ্বলছে!কি ভয়ানক ক্রুর দৃষ্টি!খুব শীত করছে।চোখ বন্ধ করে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকে সে।

তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse