দু’জন
উপমা অধিকারী
বাতেন সাহেবের মাঝে রোগটা প্রথম দেখা যায় বাড়ির বারান্দায় নেড়ি কুকুরটার মৃত্যুর পর।
নেড়ি কুকুরটা পোষা ছিলো কারো, হারিয়ে গিয়েছিলো, কিংবা হয়তো আসলে কারোরই পোষা ছিলোনা সে কখনোই। বাতেন সাহেব এতো কিছু জানতেন না। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাইক রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে আড়ালে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারছিলেন তিনি। তখনই দেখেছিলেন রোগা শুকনো হাড় জিরজিরে কুকুরটাকে, পেটে বাচ্চা আছে। জীবন-যুদ্ধে খুব একটা পারদর্শী মনে হলো না, গায়ে প্রচুর মার খাওয়ার দাগ, ডান কানে বড় একটা ক্ষত। বাতেন সাহেব নিজেকে কখনোই পশুপ্রেমী দাবী করেন না, তিনি কখনোই কোনো কুকুর বিড়াল কিছুই পালেননি আগে, তাদের গ্রামের বাড়িতে গরুও ছিলো না কখনো, ছাগল ছিলো যদিও। কিন্তু সেই মুহূর্তে কুকুরটাকে দেখে পিতৃসুলভ স্নেহ জাগ্রত হয় তার মধ্যে, তিনি ব্যাগ থেকে তার আধ খাওয়া বন-রুটিটা ছুঁড়ে দেন। এরপর একবারও পিছনে না তাকিয়ে বাইকে উঠে যান। তার বাড়ি সেখান থেকে বেশি দূর নয় আসলে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ না সারলেও হতো। কিন্তু বাড়ির সামনের গলির ছাপড়া দোকানগুলোর একটায় বাতেন সাহেব বসেন নিয়মিত। চা-বিড়ি খান। সেদিনও সেখানে বসার পর কুকুরটার চিন্তা কখন মাথা থেকে চলে গিয়েছিলো কে জানে, আসলে বাতেন সাহেব কখনোই পশুপ্রেমী নন । একারণেই , দুদিন পর নেড়ি কুকুরটাকে যখন তিনি নিজের বাড়ির বাইরে দেখেন, প্রথমে চিনতে পারলেন না।
বাতেন সাহেবদের বাড়িটা মফস্বল শহরের আর আট-দশটা পুরনো বাসার মতোই। চারতলা, সামনে ছোটমতো জায়গা , সেখানেই এসে বসেছে কুকুরটা, হয়তো বাচ্চা দিতে চায়। দেখা গেলো এই দুদিনে সে আরো রুগ্ন হয়েছে , ঘা বেড়েছে। সেখান থেকেই বাতেন সাহেবের পরিবার ধারণা করলো হয়তো বেচারা কারো পোষা ছিলো, এখন বাইরে টিকতে পারছে না। সন্তানদের এই পৃথিবীতে আনার জন্য একটু নিরাপত্তা সে চায়, এজন্যেই যে জায়গায় ভালোবাসা পেয়েছে ,তাকেই খুঁজে খুঁজে বের করেছে । দেখা গেলো বাতেন সাহেবের দু ছেলে-মেয়েই মহা উৎসাহী , খেতে দিচ্ছে নিজেদের মাছ থেকে, নিজেদের পুরানো জামা দিচ্ছে ড্রেনের পাশে শোবার ব্যবস্থা করার জন্য, নাম রাখলো কাল্লু। দু’সপ্তাহ পরেই কাল্লু বাচ্চা দিলো। প্রথম ক’দিন ঠিকই ছিলো, কিন্তু এরপর হঠাৎ-ই একদিন নিচতলার জানালা থেকে কেউ একজন ওদের উপর ঢেলে দিলো গরম জল। মারা গেলো তিনটে বাচ্চা, বেঁচে থাকলো দুটো। বাতেন সাহেবের মেয়ে সাইয়ারা গলা ফাটিয়ে কান্না করলো সেদিন, বাতেন সাহেব যেন তাদের গিয়ে কিছু একটা বলে। কিন্তু তিনি কী বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না, কুকুরটা যে তাদের পোষাও নয়। কাল্লু জীবনসংগ্রামে কতোটা অপরিপক্ক তা আরো বুঝা গেলো ,যখন বাকি দুটো বাচ্চাও ড্রেনে পড়ে গেলো। সে কোনোভাবেই তুলতে পারে না,সম্ভবত অন্য মা কুকুররা যেভাবে ঘাড়ে কামড়ে ধরে বাচ্চা নিয়ে যায়, কাল্লুর তা জানা ছিলো না। এবার বাতেন সাহেব যদিও বসে রইলেন না, নিচে গেলেন বাচ্চাগুলোকে তুলতে। কিন্তু কাল্লুর তখন তিনটে বাচ্চা হারিয়ে মাথা পাগলের জোগাড়, বাতেন সাহেবকে দেখেই ধাওয়া দিলো সে। বাতেন সাহেব ভয় পেয়ে দিলেন দৌড় , ঘরে এসে ভাবলেন পরের দিন কাউকে ডেকে তুলে দেওয়া যাবে। সে রাতে ড্রেনে পড়া বাচ্চাটা সারারাত কাঁদল, আর কাঁদল গরম জলে পুড়ে যাওয়া আধা বেঁচে থাকা আরেকটা বাচ্চা। তার শরীরের ঘায়ে পোকা ধরেছিলো। পরের দিন সকাল হতে হতে মরে গেলো সবগুলোই।পরের পাঁচ থেকে ছয়দিন কাল্লু সারাদিন কান্না করলো বাগানে বসে, কিছু খেলোনা। এবং সপ্তমদিন সেও মারা গেলো, তার কানের ঘা এর জন্য, নাকি সন্তানশোকে, তা কেউ আর জানতে পারলোনা।
বাতেন সাহেবের রোগটা শুরু হলো তার কিছুদিন পরেই। অনেককিছুই সে ভুলে যায়, মনে রাখতে পারেনা। দেখা গেলো সাইয়ারার স্কুলের প্যারেন্টস ডে তে একদিন যেতে ভুলে গেলেন, বাজার করতে গিয়ে না করেই একদিন ফিরে এলেন।এটুকুই নয়, রোগ বাড়তে লাগলো, দেখা গেলো কাল্লু নামে যে একটা নেড়ি কুকুর ছিলো, এ স্মৃতিও সম্পূর্ণভাবে তার মাথা থেকে চলে গেছে, যেনো কেউ ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে। সামনের গলির দোকানের একজন জানালো তার রোগটা নাকি এলজাইমার হতে পারে। কিছু মনে না থাকা রোগ। বাতেন সাহেব নিজেও এলজাইমার সম্পর্কে ভালোই জানেন, তিনি দেখলেন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তিনিই সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন যে তার এলজাইমার রয়েছে। তার স্ত্রী সাঈদা খানম এলাকারই প্রাইমেরি স্কুলের টিচার, সে স্কুলেই দু’সন্তান সাইয়ারা আর শিতাব পড়ে। তারাও মেনেই নিলো শুরুতে কিন্তু সমস্যা প্রকট হলো যখন আব্দুল বাতেনুজ্জামান তার অফিসে কিছু টাকার হিসাব ভুলে গেলেন। ওষুধ কম্পানিতে চাকরি, প্রচুর এদিক সেদিক হয়, কিন্তু তা সামাল দিতে জানতেন বাতেন সাহেব। কিন্তু সমস্যা বাঁধালো তার স্মৃতি । ফলে এক বছরের মাথায় বাতেনুজ্জামান তার চাকরিটা ছেড়ে দিলো কিংবা হারালো, কারণ এ ব্যাপারে সে কাউকেই কিছু বলেনি। তার আসলে পরে মনেও ছিলোনা আর , চাকরিটা কি গেছে নাকি সে-ই ছেড়েছে ?
করোনাপরবর্তী সময়কালে গরীব একটা দেশের এক মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাসিন্দা বাতেন সাহেবের চাকরি যখন চলে গেলো, তার পরিবার পড়ে গেল মহা বিপদে, আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় যে সাঈদা খানম পড়লেন বিপদে।তার একার আয়ে কোনোভাবেই সংসার চলে না, দু সন্তানের খরচ চলে না। এ ব্যাপারে তার অর্ধাঙ্গের কোনো মাথা ব্যথাই নাই, চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও কোনো লাভ হয়না। সাঈদা চিৎকার করতে করতে ,কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যান প্রতিদিন। এরপর একদিন সারাদিন ক্লাস করিয়ে , টিউশন পড়িয়ে শেষে বাড়ি এসে দেখেন বাতেন সাহেব শিলপাটা নিয়ে বসেছেন। শিলপাটায় ধার দিতে লোক এসেছিলো গত পরশু, সাথে সুন্দর নকশা করে দিয়ে গেছেন। বাতেন সাহেব বেকার বসে তা দেখেছেন এবং এখন তিনিও নকশা আঁকতে চান, সরঞ্জাম কিনে এনেছেন। সাঈদা এবার আর চিৎকার করেন না, তার মায়া হয়, কষ্ট হয়, দিন শেষে তিনি অধিক শ্রমে কাতর হলেও, এই সংসারের প্রতি তার মন মরে যায়নি। রাতে অনেকক্ষণ বাতেন সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তিনি। এরপর জিজ্ঞেস করেন তাকে যে, তিনি নিজের বাড়ি গিয়ে দুটো দিন কাটিয়ে আসবে কিনা, হয়তো ভালো লাগবে। হয়তো পরে এসে নতুনভাবে সব শুরু করা যাবে ,তিনি অন্য কোনো কম্পানিতে জয়েনের চেষ্টা করতে পারবেন। বাতেন সাহেব একবাক্যে রাজি হয়ে যান, এবং কোনো কিছু না নিয়েই পরের দিনই নিজ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
বাড়ি গিয়ে বাতেন সাহেবের ভালোই লেগেছিলো প্রথম কিছুদিন, । কিন্তু বাবা-মা নেই, ছোট ভাইয়ের সংসার এখন সে বাড়িতে , কতোদিনই বা অকর্মা ভাইকে পালবেন তারা। ফেলেও দিতে পারে না কারণ নিজেদের ভিটেমাটি, চার ভাইয়ের সমান ভাগ তাতে, আবার রাখতেও পারেন না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি সেখানেও হয় , আড়ালে অনেকে পাগল ডাকতে থাকে বাতেন সাহেবকে। কিন্তু এগুলো খুব একটা ছুঁতে পারে না তাকে কারণ তখন তিনি মজে গেছেন অন্য কাজে। একদিন বাজারে গিয়ে তার পরিচয় হইলো সুশীল কর্মকারের সাথে , শিলপাটায় ধার দেওয়া যার পেশা। বাতেন সাহেব বসে বসে তার কাজ দেখেন সারা দুপুর আর নিজে শিখেন। বহুদিন পর তার মনে হলো, তিনি সুখী, বহুদিন পর।
বাতেন সাহেবের জীবন হয়তো এভাবেই গ্রামে কেটে যেতো অনির্দিষ্টকালের জন্য, এলজাইমারে ভুগে। কিন্তু ঈশ্বর হয়তো নাটকীয় কোনোকিছুই কখনো কারণ ছাড়া ঘটাননা, বাতেন সাহেবের হঠাৎ ঘটা নাটকীয় জীবনেও তাই মোড় এলো।
সুশীল কর্মকারের ছোট মেয়ের বিয়ে লেগেছে, তিনি ব্যস্ত। তার মেয়ের বিয়ের খবর এখন বাজারের গরম খবর কারণ, গ্রামে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে সুশীল কর্মকারের বড় মেয়ে জামাই, সমুদ্রজিৎ সাহা। বাতেন সাহেব সারাদিন বাজারে বসেই শুনতে পেলেন , সুশীল কর্মকারের বড় মেয়ে ঝুমুর মারা গিয়েছে ৪ বছর হলো। আর তাদের একমাত্র সন্তান আত্মহত্যা করেছে ৫ মাসও হয়নি, তাতেই নাকি সমুদ্রজিৎ ঘুরে বেড়াচ্ছে বহাল তবিয়তে, বিয়েও খেতে এসেছে। কর্মকার আর সাহা , বিয়ে হলো কীভাবে সে কাহিনীও ভালোই মুখে মুখে। ঝুমুর আর সমুদ্রজিতের প্রেম হয়েছিলো কীভাবে তা নাকি কেউই জানেনা। শুধু জানা যায়, পাশের গ্রামে সমুদ্রজিতের মামার বাড়ি, ছোটবেলায় পূজায় আসতো এরপর ফুটবল খেলতো। সেই সূত্র ধরেই নাকি এগ্রামে সমুদ্রজিৎ ফুটবল খেলতে এসেছিলো একবার। সেখান থেকে ঝুমুরের সাথে পরিচয়ই বা কীভাবে হলো, প্রেম ও বা কখন করলো কেউ জানে না। সমুদ্রজিৎ বড় হয়েছে জেলা শহরে, স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, এখন ঢাকার এক কলেজে শিক্ষকতা করে। ঝুমুরের সাথে বিয়ের সময় সমুদ্রজিতকে তার বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছিলো, জমিজমা থেকে বঞ্চিত করেছিলো , এতোকিছুর পরেও সমুদ্রজিৎ বিয়ে করেছিলেন ঝুমুরকে। সুখেই নাকি ছিলো তারা। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটা ছেলে হয় তাদের, নাম অরণ্য। হয়তো রূপকথার গল্পের মতো শেষ হতে পারতো কিন্তু তা হয়নি, ঝুমুরের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পরে। যে জমি-জমার প্রতি সমুদ্রজিতের কোনো আগ্রহই ছিলোনা, সে জমিও মরিয়া হয়ে চায় সে বাবার কাছে , ঝুমুরের চিকিৎসার জন্য। সমুদ্রজিতের বাবা পাষাণ না , তার ভাগের জমি দেওয়া হয় তাকে, কিন্তু ঝুমুরকে বাঁচানো সম্ভব হয়না, কেমো নিতে নিতেই মারা যান তিনি । অরণ্যের বয়স তখন ১০ বছর। বাবা-ছেলের সংসার হয়তো ভালোই চলছিলো, কিন্তু সমুদ্রজিতের কপালের দোষ কাটেনা। তার সেই একমাত্র ছেলেও আত্মহত্যা করে মাত্র সাড়ে তেরো বছর বয়সে।
ঘটনা শুনে বাতেন সাহেব মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন সব ভুলে যেতে কিন্তু পারছিলেন না। বাজারে গুঞ্জনের শেষ নাই, সমুদ্রজিৎ নাকি পাগল। তার মাঝে ছেলের কোনো শোক নেই, ছেলে মারা যাওয়ার পর নাকি কান্না-কাটি করেন নাই। কারো সাথে বিশেষ কথাও বলেন না, একাই ঘুরেন। অনেকে বলছে হয়তো তার ঢাকায় আরো প্রণয়ী আছে, এই শোক সামলাতে না পেরেই ছেলেটা চলে গেলো। আবার এখন সে শ্যালিকার বিয়ে খেতে চলে আসলো কেনো তাও কারো স্পষ্ট না। সুশীল কর্মকারের তো জমি-জমাও কিছু নেই যে ভাগ নিতে আসবে।উলটা বিয়েতে নাকি টাকা-পয়সা দিয়ে ভালোই সাহায্য করেছে। এদিকে আবার আসার পর থেকে সমুদ্রজিৎ নদীর পারে শুধু বসে থাকে আর কিছুই করে না। গ্রামের মাঝে দিয়ে চলে গেছে বেলান নদী, সে নদীরই পারে বসে থাকেন তিনি। রাতেও নাকি থাকেন। বাতেন সাহেব শুরুতে আগ্রহ না দেখালেও, একদিন সমুদ্রজিৎ ই আসলেন বাজারে, এসে বাতেন সাহেবকে নিয়ে আগ্রহ দেখালেন।
সমুদ্রজিৎ এসেছিলেন শ্বশুরের কাজ দেখতে, শিলপাটার কারুকর্ম নাকি তার ভালো লাগে দেখতে। সেখান থেকেই বাতেন সাহেবের সাথে পরিচয় হলো তার। সমুদ্রজিৎ সুন্দর করে হেসে বললেন,
“বাহ আপনি তো তাহলে জাতশিল্পী। কম্পানির চাকরি ছেড়ে আঁকাআঁকি করছেন।”
বাতেন সাহেব খুবই অবাক হলেন। এই প্রথম কেউ তার কাজ ঠাট্টার ছলে তো দেখছেই না, উল্টা শিল্পী ডাকছে। বাকি মানুষরাও অবাক, সমুদ্রজিৎ তো হেসে কথা বলার মানুষ না, বরং তাকে দেখে লাগে কোনো মৃতদেহ ভাবলেশহীনভাবে চলে বেড়াচ্ছে মাটিতে। কথা হলো সেদিন টুকটাক।এরপর সমুদ্রজিৎ আসতে থাকলেন নিয়মিত, এসে শিলপাটার কাজ দেখেন। দেখা গেলো সমুদ্রজিৎ, শিলপাটায় আঁকাআঁকির বাইরে কোনোকিছু নিয়েই কথা বলতে তেমন আগ্রহী না। বাতেন সাহেব খুশিই হলো, সেও আসলে আর কোনোকিছুতেই আগ্রহী না। তাই এলজাইমার আসলে তার ভালোই করেছে, বাকি আর সব কিছুই তিনি ভুলে যান।
সুশীল কর্মকারের ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ধুমধাম করে। সমুদ্রজিৎ আসেন না বাজারে দুদিন হলো। বাতেন সাহেব শুরুতে গায়ে লাগান না, হয়তো লোকটা তাকে পাগলই ভাবে, তাই পাগলের কাজকারবার দেখতে আসে। কিন্তু যেদিন শুনলেন পরের দিন সমুদ্রজিৎ ঢাকা চলে যাবে, বাতেন সাহেব ভাবলেন, আচ্ছা তাহলে দেখা করে আসা যাক !
খোঁজ নিয়ে দেখলেন, সমুদ্রজিৎ তখনও নদীর পাড়ে। ভেলা বানাচ্ছেন। বাতেন সাহেবকে দেখে কিছু বলছিলেন না, চুপ করে কাজ করেই গেলেন। বাতেন সাহেবেরও আসলে কাজ নেই, সেও পাশে বসেই রইলো। ভেলা বানানো শেষ হলো সন্ধ্যায়, এরপর সমুদ্রজিৎ মুখ খুললেন।
-যাবেন আমার সাথে ভেলায় করে? নদীটা ঘুরে দেখি একটু।
চারিদিকে মশা প্রচুর আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। এর মাঝে ছোট্ট একটা ভেলা ভাসছে বেলান নদীর বুকে, ভেলায় বসে আছে আব্দুল বাতেনুজ্জামান আর সমুদ্রজিৎ সাহা। পূর্ণিমা নেই ,তবে আকাশে কৃষ্ণপক্ষের বেশ বড় একটা চাঁদ , সেই চাঁদ যদিও অর্ধেক ঢেকে আছে মেঘে। বাতেন সাহেবের আবারো মনে হলো, নাহ, শিলপাটা খোদাই এর বাইরে এই আরেকটা সময়ে তিনি সুখী। তিনি মুখ খুললেন,
-পৃথিবীটা বড় সুন্দর। আফসোস আমি হয়তো কালই ভুলে যাবো সব !
সমুদ্রজিৎ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর বাতেন সাহেবকে অবাক করে দিয়ে বললো,
-আসলেই সুন্দর। কিন্তু আমার চোখে কেন জানো সুন্দর কিছু ধরে না। মনে হয় সবসময় কালো একটা পর্দা। সব কিছু ঘিরে রেখেছে। সেটা ভেদ করে আনন্দ ঢুকতেই পারেনা।
-আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর কী এমন হয়েছে?
-নাহ।
-আচ্ছা তাহলে ছেলের…
-নাহ, অরণ্যের মৃত্যুর পরও হয়নি।আমার এটা ছোট থেকেই। ১০/১১ বছর বয়স থেকেই। আমার ছেলেটার ও এমন ছিলো কিনা। এজন্যই হয়তো চলে গেলো।আমি ওকে হিংসে করি। আমি তো চলে যেতে পারি না।
সমুদ্রজিৎ কথাগুলো বলে আরো বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অরণ্য অসুখী ছিলো কিনা সেটার উপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই আসলে। অরণ্য হয়তো আসলে সমুদ্রজিতের জন্যই মারা গেছে, সমুদ্রজিতের অসুখের জন্য । সমুদ্রজিতের অসুখ হলো সে সদাবিষন্ন। এই যে বিয়ে বাড়িতে ঘুরলো, চারিদিকে এত জাঁকজমক, সমুদ্রজিৎ হেঁটে বেড়াচ্ছে তার মাঝ দিয়ে। মনে হয় যে তার চারিদিকে পর্দা, সেই সুখ আনন্দ তাকে ছোঁয় না , সে যেন ঈশ্বর অথবা একটা মৃতদেহ, যে শুধু দেখবে। কিন্তু নশ্বরদের একজন কখনোই হয়ে উঠতে পারবেনা। সমুদ্রজিৎ অনেকবার চেষ্টা করেছে নিজেকে শেষ করে দিতে, পারেনি। ঝুমুরকে বিয়ের সময় ভেবেছিলেন হয়তো পারবেন বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে। ঝুমুরকে সে ভালোবাসে, এতো ভালোবাসা কাউকে কখনো বাসেনি সে। কিন্তু নাহ, নিজের বিয়ের দিন ও ঠিক একই অনুভূতি ই ছিলো সমুদ্রজিতের। যখন পানপাতা সরিয়ে ঝুমুরের মুখটা ও দেখতে পেলো, মন থেকেই হেসেছিলো ক্ষণিকের জন্য।কিন্তু কই, সেই আনন্দ পরমুহুর্তেই ফিকে হয়ে যায় কেন তাও কোনো কারণ ছাড়াই।
-বুঝলেন বাতেন সাহেব, আমি একটা আগাগোড়া অসুখী মানুষ। এবং কোনো কারণ ছাড়াই। আমার সব ছিলো যখন তখন যেমন ছিলাম, সব আছে যখন, তখনই আমি তেমন।
-আমি বুঝতে পারছি। আমারো সব আছে। তাও আমি অসুখী ছিলাম।
বাতেন সাহেবের উত্তরে সমুদ্রজিৎ ঘুরে তাকায়। বাতেন সাহেব এরপর যা বলেন তা তিনি নিজেও কখনো ভাবেননি ভুলেও।
-আমার চাকরি আমার ভালো লাগতো না। সারাক্ষণ মিথ্যা, চুরি-চামারি এইসবের উপরেই কাজ। আমি সহজ-সরল মানুষ ভাই। আমার এইসব খোদাই টোদাইতেই আনন্দ। এতো প্যাঁচ আর আমি চাই না।তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি আমি।
বলে বাতেন সাহেব নিজেই অবাক হলেন। চাকরি যে ছেড়ে দিয়েছেন তা দেখি তার ভালোই মনে আছে! এতোদিন ছিলো না কেন! এমনকি সমুদ্রজিৎকেও তিনি নিজেই বলেছেন যে চাকরি কি ছেড়েছেন কি ছাটাই হয়েছেন, তার মনে নাই।
সমুদ্রজিৎ শব্দ করে হাসলেন।
-তাহলে আপনার আসলে এলজাইমার নেই। আপনি তো ডক্টর দেখাননি কখনো তাইনা?
-না। কিন্তু আমার মনে ছিলো না কেন কিছু ! আমি কি অভিনয় করছিলাম এতদিন!
সমুদ্রজিৎ কিছুক্ষণ ভাবলেন। হয়তো বাতেন সাহেব মনেপ্রাণে চাইতেন সুখী হতে। সে চাওয়া থেকেই নিজে থেকে যে স্মৃতি তিনি ভুলতে চান তা ভুলে যান, অনিচ্ছাকৃতভাবেই। কিন্তু সমুদ্রজিৎ নিজেও তো অনেকবার সুখী হতে চেয়েছেন। কই তার এমন হলো না কেনো? ঝুমুর আর অরণ্যের মৃত্যুর পর সমুদ্রজিৎ আসলেই কষ্ট পেয়েছিলো। কিন্তু কেন জানি অবাক হননি, অবাক হননি দেখেই কান্নাও আসেনি। তার মনেই হয়েছে জীবন হইলো একটা এন্ডলেস সাফারিং । তো এগুলোও সে সাফারিং-এরই একটা অংশ। তাই সে মেনে নিয়েছে। কিন্তু কই, ঝুমুরকে বিয়ে করতে এতো কষ্ট তাহলে কেন করেছিলো সে? তাহলে হয়তো সেও বাতেন সাহেবের মতো সুখ খুঁজেছে । পার্থক্য হলো বাতেন সাহেব পেয়েছে, তিনি পাননি।
-আমি খুব ভাবলেশহীন বুঝলেন, এখন যেমন তা-ই। ছেলেটাকে সময় দিতে হতো,আমি দিইনি। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। সারাদিন চুপচাপ কাজ করতাম পাগলের মতো। যাতে বিষণ্ণতা আমাকে চেপে না ধরে। কিন্তু নাহ, বিষণ্ণতা আমাকে ছাড়লো না আর সবই ছেড়ে গেলো।
-আমিও অনেকগুলো মৃত্যুর জন্য দায়ী। কয়েকটা কুকুরের মৃত্যুর জন্য। আমার মনে ছিলোনা! কতোটা স্বার্থপর কারণে রোগী সেজেছিলাম আমি !
বাতেন সাহেবের কাল্লুর স্মৃতি ফিরে এসেছে। তার চোখে জল চলে আসে। লুকানোর চেষ্টা করতে হয়না, এ মুহূর্তে সমুদ্রজিতকে তার অতি আপনজন মনে হয়। আর আসলে সমুদ্রজিৎ নিজেও মাথা নিচু করে বসে আছে।
-এতোগুলো মৃত্যুর দায় আমি নিতে পারিনি। খুব যন্ত্রণা হতো রাত হলে।আমি আমার জীবন ঘেন্না করতাম। সেদিন থেকে নিজেকেও ঘেন্না করছিলাম। এরপর একদিন সব যন্ত্রণার অবসান হলো, আমি ভুলে গেলাম সব।
-আমিও নিতে পারিনি। অরণ্যকে আমার দোষেই হারিয়েছি আমি। কিন্তু আমার যন্ত্রণার অবসান হয়নি। আমি কিছু করতেও পারছিনা।
-হয়তো করেছেন। এই বিয়েতে এসেছেন কেন আপনি? উদ্দেশ্য কী?
সমুদ্রজিৎ ভাবতে থাকে। আসলেই তো। এই বিয়েতে সে কেন এসেছে? নিজের বিয়ে যে কারণে হয়েছিলো সে কারণেই হয়তো? সে সুখ খুঁজছে। বিয়ে বাড়ি বা মেলায় সবাইকে বড় সুখী মনে হয়। সমুদ্রজিৎ’ও হয়তো এজন্যেই এসেছে। এমনকি গত মাসে সে বাণিজ্য মেলায়ও গিয়েছিলো । মেলায় সে এমনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে যেন বসন্তকালে অনেকগুলো সতেজ সবুজ গাছের মাঝে তিনি এক মরা গাঁদাগাছ।
-সুখ তো খুঁজেছি সবসময়। পাইনি। বরং এতোটা বিষণ্ণ দিন কাটিয়েছি যে ভেবেছি এর চেয়ে খারাপ আসলে কেউ থাকতে পারে না। কিন্তু নাহ। বিষণ্ণতার আসলে কোনো তল নেই। দেখেন ঝুমুর মারা গেলো। আমি বুঝলাম,যে দুঃখ আসলে আরো গাঢ় হতে পারে। এরপর অরণ্য মারা গেলো। আমার বিষণ্ণতা আরো গাঢ় হলো। অথচ আগে এর দশ ভাগের একভাগ অসুখী হয়েও ভাবতাম এতো অসুখী কেউ নেই, কেউ হতে পারেনা।
বলেই সমুদ্রজিৎ ভাবলো, হয়তো বিষণ্ণতা এভাবে মাপা যায়না। যতোই বাড়ুক , সব বিষণ্ণতাই একই রকম গভীর । এখন যদি সে আবার সব ফেরত পায়, সে কি খুব সুখী হয়ে যাবে? নাহ তো ! হয়তো কম বিষণ্ণ থাকবে আরেকটু, কিন্তু সেই কালো পর্দাতো আর সরবেনা, বিষণ্ণতার গভীরতা থাকবে অপরিবর্তনীয়।
-বাতেন সাহেব। আপনি আপনার পরিবারের কাছে ফেরত যান। আমি হারিয়েছি হেলায়, আপনি হারাবেন না।
-হ্যাঁ, আমার যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি যে আঁকাআঁকি ছাড়া কিছুতেই সুখ পাইনা ! হয়তো সাঈদাও পায়না কিন্তু আমি তো সব তার ঘাড়ে দিয়ে চলে এসেছি।
-হয়তো আমরা কেউই সুখ পাই না আমাদের কাজে। অন্যের জন্য কাজ করে কেই সুখে থাকে বলুন? শিল্পকর্ম যখন করছেন, তখন আপনিই এখানে স্রষ্টা। মানুষ সৃষ্টি করতে ভালবাসে।
-আপনার শ্বশুর সুশীল কর্মকারও তাহলে সুখী বলছেন?
-হতেও পারে, নাও হতে পারে। আপনি যখন পেশাগত কারণে শিল্পচর্চা করছেন, সেখানে নিজস্বতা কতোটুকু? সেটা কি নিজের সৃষ্টি? আমাদের তো নিজের সৃষ্টি কিছুই নেই এইজন্যেই আমরা অসুখী।
-তাহলে আপনিও চেষ্টা করে দেখবেন কি? শিলপাটায় নকশা করে? কেমন লাগে?
-চেষ্টা করে দেখা যায়।
বাতেন সাহেবের নিজেকে বড় স্বার্থপর লাগলো। সমুদ্রজিৎ নিজের পরিবার হারিয়েছে। বাতেন সাহেবের আছে তাও তিনি যাচ্ছেন না। তিনি একই সাথে ফেরত যেতে চান আর চান না। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি অস্পষ্টস্বরে বললেন,
-চলুন। আপনি আর আমি, দুই ভাই। ভেসে ভেসে কোথাও চলে যাই। যেখানে আমরা কিছুমিছু করে হয়তো বাঁচবো , নিজেদের মতো। দেখি আপনি সুখী হন কিনা আমার মতো। চেষ্টা করে দেখবেন? নিরাপদে থেকে কী হবে বলুন? আমার কাল্লু তো যেখানে নিরাপদ ভাবলো নিজেকে, সেখানে গিয়েই সবাইকে হারালো। বরং মার-ডাং খেলেও রাস্তাতেই সে ভালো ছিলো বেশি।
-আরো স্বার্থপর হতে চাইছেন তাহলে? আমি আর আপনি দুজনই পাপী , ভাই। অন্তত আমার পাপের মতো পাপ করবেন না। কাছের মানুষদের মৃত্যুর কারণ হবেন না। বাড়ি ফিরে যান।চাকরি করুন।
-তাহলে অসুখী হয়েই থাকবো?
-জানিনা।
-আমিও জানিনা।
আব্দুল বাতেনুজ্জামান আর সমুদ্রজিৎ সাহা চুপচাপ বসে থাকে, তাদের নৌকা দুলতে থাকে। তাদের সামনে দুটো পথ। কোনটায় এগোবেন তারা কেউ জানেন না। চাঁদের আলোয় বসে আরেকটু ভেবে দেখা যাক !
তারিখঃ জানুয়ারি ১৭, ২০২৩