ধূসর গোধূলি আকাশের মেঘরঙে সুরের তোতাপাখি
অমিতাভ সরকার
মানুষগুলো চলে যায়। শেষ হয় এক-একটা যুগের। শিল্পীকেও চলে যেতে হয় একদিন। আমাদের চারপাশে যাদের আমরা রোজ দেখে আসছি, যারা আমাদের রোজকার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেইসব মানুষগুলোও সময়ের টানে একদিন সবাই জীবনতরীর মেঘ পালে সুদূরের পথে পাখা মেলে উড়ে চলে যায়। যারা যায়, তারা আর ফিরে আসে না।
আমরাও চলে যাব। আবার, যাঁদের আমরা টিভির পর্দায় চিনি, রেডিও, এফ এম, এবং এখানকার ডিজিটাল মাধ্যমের কম্পাক্ট ডিস্ক, পেন-ড্রাইভ প্রভৃতিতে সেইসব কালজয়ী ঘুম-ভাঙানিয়া সুরের অমোঘ মায়াজালে যাঁরা যুগের পর যুগ আচ্ছন্ন করে রাখেন, বস্তুত তাঁরাও মানুষ। তাঁদেরও দুঃখ-যন্ত্রণা আছে। আছে জীবনের না-পাওয়ার অনেকখানি ব্যথা-বেদনা। সেই সব কষ্টের নদীসাগর পার করেই জীবনের এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অদ্ভুত রঙ্গমঞ্চে তাঁরা আমাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, নিজেদের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছেন, আমরা কিছুটা বুঝেছি আবার বুঝিনি অনেকটাই। শিল্পীদের বোঝা অতটা সহজ না। জীবনের ঝড়জলে মানুষের পাশে খুব একটা বেশি কেউ থাকে না, আবার দৈবাৎ কখনও কখনও এর ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায়। বিচিত্র আমাদের জীবন, বিচিত্র মানুষের ভাবনা, বিচিত্র তার গতিপ্রকৃতিও। মানুষের মনকে কতটুকুই বা আমরা জানতে বা বুঝতে চেষ্টা করি!
সুরের তোতাপাখি নির্মলা মিশ্র আজ নির্মল সুরের আকাশে জীবনের শিকল খুলে উড়ে গেছেন সেই দূর অপারে। ওঁনার গান শোনা সেই ছোটোবেলায় ক্যাসেটের যুগে। সামনে ওনার চশমা পরা হাসিমুখের ছবি, পিছনে গানগুলোর নাম। ক্যাসেট গেয়ে চলে গিয়েছে ‘সবুজ পাহাড় ঢাকে আয় রে ছুটে আয়’, ‘এই বাংলার মাটিতে মাগো জন্ম আমায়’, ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, ‘বলো তো আরশি তুমি মুখটি দেখে।’ আবারও শুনেছি। এছাড়া দূরদর্শন বা আকাশবাণীর প্রোগ্রাম বা সাক্ষাৎকারে ওঁনার মনকাড়া কিছু বেসিক গান, ‘আশিতে আসিও না’ সিনেমায় মান্না দের সাথে দ্বৈত কণ্ঠে ‘তুমি আকাশ এখন যদি হোতে’, ‘আঁধার সূর্য’ সিনেমায় ‘রিনিঝিমি রিনিঝিমি শ্রাবণের সুর বাজে’ প্রভৃতি কিছু গান দিয়েই শিল্পীর সেই কবেকার কণ্ঠ চেনা হয়ে গিয়েছিল সেই কতদিন আগে। আর ভুল হয়নি।
প্রাণোচ্ছল সুরেলা গলার মতোই মাতৃময়ী মানুষটাও ছিলেন গভীর সহৃদয়া। কিন্তু শেষের পাঁচ-সাতটা বছর নানাবিধ অসুস্থতায় ওনার মতো হাসিখুশি মানুষকেও শয্যাশায়ী হতে হল। শিল্পীদের যেন কষ্ট সহ্য করতেই আশা। পাওয়া না-পাওয়া সবটাই সেই দৈবের হাতে। ওড়িয়া ভাষায় এবং বেশ কিছু ওড়িয়া ফিল্মে ওঁর নেপথ্য কণ্ঠদান সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে। আজ মনে হয়, বাংলা সিনেমা যেন ঠিক সেভাবে তাঁর কদর বুঝল না।
আমরা সাধারণ আটপৌরে মানুষ বাইরেটা দেখেই মাতামাতি করি, আর অতি অল্পকিছু ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিই। শিল্পের স্বরূপ অনুধাবন তাই আর হয়ে ওঠে না। আড়ালেই রয়ে যায় শিল্পীর অন্তরের অপরিসীম দুঃখগাথা। তাঁদের সুবিপুল কর্মকাণ্ডের প্রকৃত পরিমাপও হয় অনেক পরে, বা কখনো হয়ই না। শিল্পী থাকেন না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠের গানগুলো রয়ে যায়, মনের নিবিড় অনুরণনে বাজতে থাকে, চির আগামীর জন্যে।
আমরা শুনেই চলি যাপনার একান্ত অনুভবে। পৃথিবী তাকিয়ে থাকে।
তারিখঃ জানুয়ারি ১৬, ২০২৩