নারকেল জিঞ্জিরা
সালমা মঞ্জুলিকা
করোনা বাঁধিয়ে স্বামী স্ত্রী মিলে চিৎপটাং হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়েছিলাম বেশ কয়েকদিন। যমকে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি বেশ বেঁচেবর্তেও রইলাম। ডিসেম্বর মাসটা বৃথাই গেল। টেনশন আর রোগে ভুগেভুগে মন পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। একটু স্বস্তি খুঁজছিলাম দু’জনই। হাজবেন্ড একদিন অফিস থেকে ফিরে সুসংবাদটা দিল। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের একটি গ্রুপ আইটি পল্লীর উর্ধতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানির (বিএসসিসিএল) বর্তমান এমডি আমার হাজবেন্ড মশিউর রহমান ও জিএম কামাল ভাই সহ আরও কয়েকজনকে ইনভাইট করেছেন তাদের ইয়ারলি গেটটুগেদারে। তারা আমাদের নিজ খরচে নিয়ে যাচ্ছেন সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে! আমার হাজবেন্ড তাদের প্রধান অতিথি। ভদ্রলোক আবার তার মেঝো শ্যালিকার বাচ্চাদের রেখে কোথাও যান না। তাই আমাদের পরিবারের সাথে আমার বোনও যাচ্ছে তার দুই ছানা নিয়ে। এই খবর শুনে প্রবল খুশির তোড়ে আমার রাতের ঘুম উধাও। রোজ দিন গুনি। সামিয়ানার মত খোলা আকাশের নীচে বিস্তীর্ন ফেনিল সাগর আর সবুজের সমারোহ থেকে থেকে হাত ছানি দিচ্ছিলো।
জানুয়ারির দুই তারিখ সন্ধ্যায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমরা দলবল নিয়ে উড়ে গেলাম চিটাগাংয়ের পতেঙ্গায় শাহ আমানত ইন্টারনাল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সোজা গেলাম এক মাইল দূরে বাংলাদেশ নেভি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বোট ক্লাবের নিজস্ব রেস্টুরেন্টে। অন্ধকারেই রিভার ভিউ উপভোগ করতে করতে ডিনারটা সেরে নিলাম। ডিনারের ফাঁকেই দেখা হলো হোস্টদের সাথে। তারা আপ্যায়নের ত্রুটি রাখলেন না।
খেয়েদেয়ে রাতেই রওনা হলাম ওয়াটার বাস ঘাটে। সেখানে অপেক্ষা করছে ঝলমলে আলোকসজ্জায় সজ্জিত রয়াল ক্রুজ শিপ বে ওয়ান! আমরা সদলবলে শিপে উঠলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলাম আমাদের জন্য বুকিং দিয়ে রাখা রয়াল স্যুটটি শিপ কর্তৃপক্ষ অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে! এই নিয়ে তুমুল ঝগড়াঝাটি শুরু হলো। যাকে দেয়া হয়েছে তারা মালিকপক্ষের লোক। সুতরাং কিছুই করা গেল না। আমাদের দেয়া হলো ফ্যামিলি কেবিন। ব্যাগ ব্যাগেজ রেখে একটু জিরিয়ে দুই বোন মিলে শিপ ঘুরে দেখতে বের হলাম। বেশ বড় শিপ। চারতালা এই শিপটির ধারণ ক্ষমতা দুইহাজার জন। এটি মূলত জাপানি শিপ। জমজমাট কনসার্ট দেখে আর শিপ ক্রুদের হাস্যকর নাচ দেখে অর্ধেক রাত পার হলো। বাকি রাত পার হলো ঘড়ি দেখে দেখে।
ভোর ছয়টায় শিপ সেন্টমার্টিন্স আইল্যান্ড থেকে কিছু দূরে থামলো। সমুদ্র সৈকতের কম ঢালু হওয়াতে এত বড় শিপ একেবারে কিনারায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। আমারা ছোট একটি শিপে করে বে ওয়ান থেকে সেন্টমার্টিন দ্বিপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুটা কাছাকাছি আসতেই দ্বীপের একটা লম্বাটে প্রান্ত চোখে পড়লো যেটা চিকন হতে হতে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে এখানে আছড়ে পড়ছে! অভিভূত হয়ে দৃশ্যটা দেখলাম। প্রথম দৃশ্যেই বাজিমাৎ! আমরা জাহাজ ঘাটে এসে নামলাম। ঘাট থেকেই দেখা যাচ্ছিল সমুদ্রতীর ঘেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেলের অরণ্য! সেন্টমার্টিন্স মূলত নারকেল জিঞ্জিরা। এখানে প্রায় দেড়লাখ নারকেল গাছ আছে।
আসার আগে নেট ঘেটে দেখেছিলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিতো। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল ‘জাজিরা’। পরবর্তীতে যেটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সাধু মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপের নাম হয় সেন্টমার্টিন।
ঘাট থেকে অদ্ভুত ধরনের এক রিক্সাভ্যানে পাঁচজন করে বসে দুপাশে সবুজ গাছের বনের মধ্য দিয়ে করা অলি গলি পার হয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত দি আটলান্টিক রিসোর্টে। সেখানে গিয়ে আরেক বিপত্তি। আমাদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা রুম খালি হয়নি তখনও। দুপুর বারোটার পরে চেক ইন। অতএব রিসোর্টের বাইরে সাগর কিনারে ফেলে রাখা ইজি চেয়ারে গিয়ে বসলাম সব। রিসোর্টটা একেবারে সাগরের তীর ঘেঁষে বানানো। সাগরের নীল পানি দেখেই মনটা আনচান করে উঠলো। বোন আর ওর বাচ্চারা পারলে তখনই নেমে পড়ে সাগরে!
তিন তালার রুমে ঢুকতে ঢুকতে বেলা দুইটা বেজে গেল। ছোট রুমে বাহারি খাটটাই শুধু চোখে পড়লো। খুব আহামরি কিছু না। রুমের সাথে লাগোয়া ত্রিকোনাকৃতির বারান্দা। এখান থেকে সামনের সমুদ্র দেখা যায় এটাই বাড়তি পাওনা। দেরি হয়ে গেছে বলে হোটেলের বাথরুমেই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে গেলাম নীচের ডাইনিং হলে। ভাত ডাল মুরগি খুব সুস্বাদু লাগলো। যারা আগে এসেছে তারা জানালো এই দ্বীপে এর ভেয়ে ভাল রিসোর্ট,ভাল রান্নার হোটেল জোটানো কষ্টকর। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের রান্না মোটামুটি। কিছু নোয়াখালির হোটেল আছে যেখানে একটু ভাল রান্না পাওয়া যায়।
বিকেলে সাগর ঘুরতে বের হলাম দুই বোন আর ছানাপোনারা মিলে। এখানকার পানি কক্সবাজারের পানির তুলনায় অনেক বেশি নীল। বিশাল সব শিলার টুকরো ক্ষয় হওয়া বালির বড় দানা দিয়ে দ্বীপ গঠিত হয়েছে বলে পানি অনেক পরিষ্কার। সাগরের কিনারে চোখে পড়লো অদ্ভুত ধরনের ছিদ্রছিদ্র ছোটবড় অজস্র পাথর। কক্সবাজারের ইনানি দ্বিপে দেখা পাথরের চেয়েও অনেক বেশি ঝাঁঝরা এগুলো। গোটা এলাকা জুড়েই নারকেল, কেয়া আর সামান্য কিছু শ্যাওড়া, ঝাউয়ের অরণ্য। কেয়া ফলও চোখে পড়লো। একটা মার্কেট চোখে পড়লো। ভাবলাম পরদিন সময় করে এসে দেখবো নুতন কিছু পাওয়া যায় কিনা এখানে।
সন্ধ্যা বাড়তেই আবার রিসোর্টে ফিরে এলাম। একটু পরেই শুরু হবে গানবাজনা আর বারবিকিউ নাইট। পতিদেবের কুবুদ্ধিতে শীতের কাপড় তেমন কিছু আনিনি। রাতে বাইরে বসে দেখলাম সাগর থেকে হাড়কাঁপানো হি্মেল বাতাস ধেয়ে আসছে! পাতলা লংকোটের ওপর ওড়না। জড়িয়ে নিয়েও ঠান্ডা যাচ্ছিল না।
শুরু হলো গানের আসর। যেখানে বারবিকিউ পার্টি হচ্ছিল তার পাশেই একটা স্টেজে দলবল নিয়ে গান শুরু করলো স্থানীয় এক শিল্পী। স্থানীয় উচ্চারণে সে একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে গাইলো একেরপর এক বাউল গান। আমাদের হোস্টরা দেখলাম গানের তালে তালে নাচ জুড়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে বেশ কিছুক্ষণ বসে উপভোগ করলাম এরপর আর না পেরে উঠে গেলাম।
পরদিন ভোরে পতিদেবের সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বের হলাম। দ্বীপটা ছোট। আয়তনে মাত্র আট কিলোমিটার। দুই ঘন্টা হাঁটলে গোটা দ্বীপটাই ঘুরে আসা যায়। ভোর বেলা সাগরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগতেই মন ফুরফুরে হয়ে গেল। আমাদের মত আরও অনেকেই বের হয়েছে হাঁটতে। এক কিশোর দেখলাম অল্প পানির মধ্য দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরছে।
বেশ কিছু বড় সাইজের কাঠের নৌকা চোখে পড়লো। সম্ভবত এগুলো মাছ ধরার নৌকা। ভাটার কারণে কিছু নৌকো তীরের পাথরের মাঝেই আটকে আছে। জোয়ার এলে এগুলো নিয়ে ভেসে যাওয়া যায়। আমি সাথে করে মোবাইল নিয়েই বের হয়েছিলাম। পটাপট ছবি তুলতে লাগলাম। দুই কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে আমরা একেবারে জাহাজঘাট পর্যন্ত গেলাম। এরপর ফেরার জন্য পা বাড়ালাম। রিসোর্টের কাছাকাছি আসতেই দেখি আমার বোন আর কামাল ভাইয়ের ওয়াইফ বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। এবার ভদ্রলোককে বিদায় করে দিয়ে ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। খানিকক্ষণ হেঁটে রিসোর্টের কাছের এক দোকানে চা খেয়ে হিহি হাহা করে আড্ডা মেরে আবার রুমে ফিরে এলাম। রিসোর্টে সকালের নাশতা পাওয়া যায় না। তাই রিসোর্ট থেকে বের হয়ে কিছুদূর হেঁটে স্থানীয় এক হোটেলে গিয়ে পরোটা ভাজি দিয়ে নাশতা সেরে এলাম।
একটা দল দেখলাম ছেঁড়াদ্বীপ যাচ্ছে। আমরা দুই বোন নেচে উঠলাম। আমার কাঠখোট্টা মেশিনম্যান আর কামাল ভাই দুই ভীতু মিলে আমাদের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিল। বললো, ওখানে যাওয়া খুব রিস্কি। কিছুতেই যাওয়া যাবে না। হোস্টদের একজন একটু খোঁচা দিয়ে বললো ছেঁড়াদ্বীপ না দেখলে জীবন বৃথা। সরকার আগামীকাল থেকে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করেছে। আজ না গেলে আর জীবনেও যাওয়া হবে না। এবার মেশিনম্যান নড়েচড়ে বসলো। বিনি পয়সায় বেড়াতে এসে এমন রত্ন না দেখেই চলে যাবে? সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা বড়রাই শুধু যাবো। বাচ্চাদের আমার ছেলে আর কামাল ভাইয়ের ছেলের জিম্মায় রেখে আমরা বের হলাম। জাহাজ ঘাট থেকে ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া নেয়া হলো। নৌকা খুব ভালভাবেই চলতে লাগলো কোনও রকম সমস্যা না করেই। আফসোস হলো বাচ্চাদের রেখে এসেছি বলে। কোনো ভয়ই ছিল না।
ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি এসে বোট থেমে গেল। সামনে পানি। চার পাঁচ হাত গভীর হবে। টলটলে পরিষ্কার পানির নিচে বড়বড় পাথর খণ্ড দেখা যাচ্ছিল। সামনে এগোলে পাথরে ঘষা লেগে বোট ছিদ্র হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। একটা কাঠের নৌকো এগিয়ে এল। সবাই মিলে নৌকায় করে দীপে পৌঁছলাম।
বিশাল বিশাল পাথরের উপর দিয়ে সিকি মাইল হেঁটে দ্বীপের মাটিতে নামলাম। এখানে বিশাল সব কেয়া গাছের ভয়ানক জঙ্গল! চারদিকের নীল সাগর, বড়বড় পাথর আর কেয়ার ঘন ঝোপ মিলে মিশে অপার সৌন্দর্য! রোদে পুড়ে পুড়ে সবাই মিলে দ্বীপটা ঘুরলাম। একটা জায়গায় এসে দেখলাম সামান্য দূরেই সেন্টমার্টিন দ্বীপের একটা প্রান্ত দেখা যাচ্ছে! বড়জোর সিকি মাইল হবে। মাঝে সাগরের জল। জলের নিচে বিশাল সাইজের সব পাথর! এই দ্বীপটিকে বাস্তবিক অর্থেই সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেঁড়া অংশ মনে হয়। ভাটার সময় হেঁটেই আসা যাই এই দ্বীপে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই দুটো প্রান্ত পুরোপুরি মিলেমিশে যাবে। পর্যটকের ভিড় থাকলে পাথরগুলো পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, সরে যায় এই কারণেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে
ফেরার সময় তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। এক লোক দেখলাম রোদের মাঝে বসে বসে গোলা আইসক্রিম বিক্রি করছে। সব ভিড় করলাম সেখানে। টক ঝাল মিষ্টি আইসক্রিম খেয়ে কলজেটা ঠাণ্ডা করে তারপর ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় আরেক ঝামেলা। যেই নৌকায় এসেছি সেই নৌকায় করেই ফিরতে হবে! কি অদ্ভুত ব্যবসা চলে এখানে!
রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে দুইটা বেজে গেল। আজও সাগরে নামা হলো না। লাঞ্চ সেরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেলের দিকে বোনকে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। সূর্যাস্তের ঠিক আগে আকাশে একেবারে দিগন্ত রেখার সমান্তরালে কমলা রঙের আভা ছড়ানো অদ্ভুত একটা রেখা ছড়িয়ে পড়েছে! মুগ্ধ রূপ দেখে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে গেলাম। একজায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। হালকা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল সেন্টমার্টিন কবরস্থান লেখা সাইনবোর্ডটা। একটু গা ছমছম করে উঠলো। বোনকে বললাম চল ফিরে যাই।
ফেরার পথে গতকালকের দেখা সেই মার্কেটটায় থামলাম। রিসোর্ট থেকে দেড়মাইল দূরে এই মার্কেট। কক্সবাজারে যা পাওয়া যায় এখানেও তাই আছে। তবে এখানে প্রবালের দেখা মিললো। গতবার সারা কক্সবাজার খুঁজেও এই জিনিসের দেখা পাইনি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে প্রবাল তোলার ব্যাপারে। এখানেও দেখলাম লুকিয়ে বিক্রি করছে।
জিনিসপত্রের মাঝেই কিছু লোক বিভিন্ন জাতের মসলা মাখা থরেথরে মাছ সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। সাগর থেকে ধরে আনা বিভিন্ন জাতের মাছ, স্কুইড, কাঁকড়া, চিংড়ি মশলা মাখিয়ে তাজা তাজা ভেজে দেয়া হচ্ছে চড়া মূলের বিনিময়ে। সাথে করে পর্যাপ্ত টাকা নিয়ে বের হইনি বলে আফসোস হলো।
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে রাত হয়ে গেছে টের পাইনি। চার্জ ছিল না বলে দুজন মোবাইলও আনিনি। তাড়াতাড়ি পা চালালাম রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। সাগরের কিনারা ধরে সোজা গেলেই রিসোর্ট। কিন্তু তীর ধরে হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম পানি বেড়ে যাচ্ছে। তার মানে জোয়ার ধেয়ে আসছে। খুব ভয় লাগলো। একটা জায়গায় এসে বুঝলাম ভুল পথে এসেছি। সামনে আর পথ নেই। যেতে হলে এখান থেকে নেমে পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। আশে পাশের লোকজনগুলোকে দেখে ভয় লাগলো। অন্ধকারে কিভাবে পানির উপর দিয়ে যাবো তাও ভেব পাচ্ছিলাম না। রাস্তায় তেমন লোকও নেই। হঠাৎ দেখলাম এক লোক মোবাইলের আলো জ্বেলে সামনের দিকে যাচ্ছে। দুই বোন তার পিছু নিলাম।
অন্ধকারে দিনের আলোয় দেখা রিসোর্টটাকে চিনতে পারলাম না। রিসোর্টের নামও মনে পড়ছিল না। ভয়ে ভেতরটা জমে যাচ্ছিল। বোনকে টের পেতে দিলাম না। হঠাৎ মনে পড়লো ব্যাগে রুমের চাবি আছে। চাবির রিংয়ে রিসোর্টের নাম লেখা আছে। ওটা বের করে নামটা মনে করে একটা দোকানে বসে থাকা লোকজনদের জিজ্ঞেস করলাম। তারা বললো আপনি রিসোর্ট পেছনে ফেলে এসেছেন। পিছনে ম্যাজিক লাইট দেয়া যে বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে ওটাই এই রিসোর্ট। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রিসোর্টে পৌঁছে দেখলাম আমাদের খোঁজার জন্য রীতিমতো তোলপাড় হচ্ছে। ছেলে আর তার বাবা রেগে আগুন। উত্তর না দিয়ে বকাঝকা সব হজম করলাম।
রাতে আবার বারবিকিউ পার্টি। বাচ্চাদের বেশ কিছু খেলা হলো। মহিলাদের জন্য ছিল চেয়ার সিটিং।আর পুরুষদের রশি টানাটানি প্রতিযোগিতা। খেলাপর্ব শেষে শুরু হলো পুরষ্কার বিতরণী পর্ব। সবার জন্য ভাল ভাল গিফট ছিল। গিফট নিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি রুমে এসে ঘুম দিলাম পরদিন আমারা সেন্টমার্টিন ছেড়ে যাবো।
পরদিন সকালে বাইরের হোটেলে গিয়ে নাশতা করে বাজার থেকে আত্মীয়দের জন্য এটাওটা কিনতে কিনতে বেলা এগারোটা দশটা বেজে গেল। রিসোর্ট থেকে জানিয়ে দিয়েছে সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে রুম ছেড়ে দিতে হবে। বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ পানিতে নামতে পারেনি তাই। লবিতে গিয়ে অনুরোধ করে আধঘন্টা সময় বাড়িয়ে নিলাম। এরপর সব মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সাগরে। একটা সমস্যা টের পেলাম। পানির নিচে ডুবে থাকা পাথর দেখা যাচ্ছে না আছড়ে পরা ফেনার কারণে। তাই পায়ে লেগে পা কেটে যাচ্ছে। আমরা পরিষ্কার জায়গা খুঁজে নিয়ে সেখানে জড়ো হয়ে হুড়াহুড়ি করছিলাম। আধঘন্টা পর উঠে রিসোর্টে গিয়ে গোসল করে ব্যাগ নিয়ে বের হতে হতে ঠিক বারোটা বেজে গেল।
এবার নতুন বিপদ। দ্বীপে পরিবহন ধর্মঘট সেদিন। বাচ্চাদের নিয়ে, এত বড়বড় লাগেজ নিয়ে কিভাবে ঘাট পর্যন্ত হেঁটে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে একটা ভ্যান পাওয়া গেল। ভ্যানে সব লাগেজগুলো তুলে দিলাম। এরপর বাচ্চাদের নিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যাবার পর দেখি আমাদের সেই ভ্যান থামিয়ে সব লাগেজ নামিয়ে দিয়েছে কিছু স্থানীয় যুবক। লাগেজ আনার কাজে পুরুষরা সব ব্যস্ত হয়ে গেল। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে হেঁটে ঘাটের কাছেই একটা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বসলাম। প্রায় দুই ঘন্টা বসে থাকার পর বিকাল পাঁচটায় আমরা শিপ কর্ণফুলীতে উঠলাম। শিপে উঠে মন ভাল হয়ে গেল। বিশাল বড় রুমটা চমৎকার।
কেন জানি মন খারাপ লাগছিল। আমি মোবাইল হাতে ডেকে চলে গেলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বীপের চিহ্ন দেখা গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সাগরের বুকে ছোট বড় ঢেউ তোলা গভীর কালো জলের ওপর অস্তগামী সূর্যের ছড়িয়ে পড়া কমলা আলোর দৃশ্যটা ক্যামেরা বন্দী করলাম। ভিডিও করলাম বেশ কয়েকটা। টের পেলাম জাহাজ একটু বেশিই দুলছে। সাগর বলে কথা! বে ওয়ান অনেক বড় শিপ ছিল বলে এতো বেশি দুলুনি টের পাইনি। দুলতে দুলতেই আধোঘুমে আধো জাগরণে রাত বারোটায় পোঁছে গেলাম কক্সবাজার।
কক্সবাজারে একদিন থেকে তারপর আবার উড়ে চলে এলাম সোজা ঢাকা। আমার সেই প্রিয় হেঁসেল আবার সেই ব্যস্ততা, অবসরে আবার ফেসবুক আর লেখালিখি।
কৃত্রিমভাবে সাজানো রিসোর্টের চেয়ে আমাকে অনেক বেশি টানে আদি অকৃত্রিম প্রকৃতি। সাগর আমাকে খুব বেশি ডাকে। যতবারই যাই ততবারই নতুন লাগে। সেন্টমার্টিন্স দেখার জন্য মেশিন ভদ্রলোকের কাছে অনেক ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করেছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম জীবনে কখনও দেখা হবে না। এভাবে যে সুযোগটা এসে যাবে বুঝিনি। আয়োজকদের মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়েছি। আবার কবে এমন হুটহাট বেরিয়ে পড়া হবে জানিনা। হয়তো সামনের শীতে সুযোগ আসবে। ততদিন পৃথিবী সুস্থ থাকুক, সুন্দর থাকুক। করোনা নামের ঘাতক ব্যাধি দূর হোক।
স্বপ্ন দেখেই বাঁচি। আশায় আশায় জীবন সামনের দিকে এগিয়ে নেই। ছোট ছোট স্বপ্নেরা বেঁচে থাক এভাবেই।
তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১