নীল আকাশের বেলা
ফাহিম ফয়সাল
আকাশ নাকি নীল? কে বলেছে এ কথা। মিথ্যা বলেছে। আকাশ তো সাদা। প্রতিদিন যখন বাবার সাথে জমিতে যায়, বাবার হাত ধরে আকাশের দিকে মুখ তুলে কথাগুলো ভাবে আজরা। নীল আকাশ দেখার খুব ইচ্ছা আজরার। কোনোদিন সে নীল আকাশ দেখেনি। গোলগাল চেহারা আজরার। বাদামি রঙ। বাবা হোমেদ আলী পাঁচ বছরের আজরাকে নিয়ে জমিতে যাচ্ছে। এক হাতে জগ ও খাবারের পোটলা আরেক হাতে আজরার আঙুল। আকাশ আজও প্রতিদিনের মতো সাদা। সাদা আকাশে মেঘ কেমন যেন। বোঝা যায় না। হোমেদ আলী মেয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকায়। চোখ ঝলসে যায়।
নীল আকাশের মেঘ দেখতে তুলোর মতো। সেখানে চোখ ঝলসে না। মেয়েকে দেখাতে চেয়েছিলো কিন্তু দেখানো হয়নি। আজরার এ শখটা পূরণ করবে সে। আজরার চেহারা কিছুটা ওর মায়ের মতো। কাজের সময় মেয়েকে বাড়িতে রেখে আসে না সে। আগে আসতো। আজরার হাতের নিচে কাঁচা কঞ্চের জোড়া বাড়ির দাগ এখনো যায় নি। মেয়ের গায়ে কোনোদিন হাত তোলেনি হোমেদ আলী। সুমা তুলেছে। সুমা রানীকে বিয়ে করে যেদিন বাড়িতে আনে আজরাকে সেদিনই ঘরে ঢুকতে দেয়নি সে। অথচ যে কাঁথা সেদিন বাসরঘরের বিছানার শোভা বাড়িয়েছিলো তার প্রতিটি ফুল আজরার মায়ের নিজ হাতে নকশা করা। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো কমলা বিবিকে। ঘর পালানো মেয়ে। সংসারের শুরুটা কঠিন হলেও দিনশেষে তাদের ঘরে বেহেশতের হাওয়া আসতো। রাতের বিছানায় কমলা বিবির কাজলমাখা চোখে তাকিয়ে হোমেদ আলী ভাবতো কেমনে আমার কাপালে এমন পরী জুটলো। আমি তো অতি সাধারণ এক কৃষকের ছেলে। কমলার বাবা এলাকার মাতব্বর। কমলা বিবি মেয়ে চেয়েছিলো আর হোমেদ আলী ছেলে। যেদিন আজরার জন্ম সেদিনটা ছিলো খুব স্বচ্ছ। হোমেদ আলীর মনে আছে। আসমানে সেদিন নীল রঙের উৎসব ছিলো। জমির পাশের পাকুড় গাছ সেদিন সবুজ রঙ ছড়াচ্ছিলো তার প্রতিটি পাতা দিয়ে। একটা বড়ো ডাল মাটির দিকে নামানো এ গাছটার। এর প্রশস্ত ছায়ায় ঘাসে ভরা কমলা বিবির কবর। আজরা বাবার জমিতে কাজ করার পুরোটা সময় এ গাছের নিচে বসে থাকে। গাছটা ওর সাথে কথা বলে। একটু দূর থেকে দেখলে তাই মনে হয়। ঢালু ডালে বসে থাকে। কখনো মায়ের কবরের ওপর শুয়ে থাকে। ঘুমিয়েও পড়ে। হোমেদ আলী অনেক বার কবরের ওপর থেকে টেনে তুলেছে ওকে। কবরে নাকি শোয়া লাগে না। আজরার মনে থাকে না এই নিষেধ। আজরা সুযোগ পেলেই এমনটা করে। ঘাসেভরা কবরের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকে। এরপর ঘুম। হোমেদ আলীর চোখের জল নোনা ঘামে একাকার হয়। হোমেদ আলী দেখেও না দেখার ভান করে। থাক। একটু থাক।
এমনি এক দিনে আজরা মায়ের কবরের পাশে বসে আছে। পেছন থেকে ধপাস করে একটা শব্দ হয়। হোমেদ আলী ফাটানো রোদে তখন জমিতে। আজরার একটু ভয় হয়। এক পা এক পা করে গাছটার পেছনে যায়। দেখে মাটিতে উপুর হয়ে এক ছেলে কাতরাচ্ছে। ওর বয়সি বা একটু বড়ো । আজরা টেনে তোলে। এ গাছে ওঠার কথা কখনো ভাবেনি আজরা। কে এই ছেলে? সাহস এতো কেনো? আজরা ওর কপালে লেগে থাকা মাটি মুছে দেয়।
– তুমি কে?
আজরার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়না ছেলেটি। মুখ বেঁকে তখনো ব্যাথায় ডুবে আছে।
– কে তুমি কতা কও?
ছেলেটা এবার একটু বিরক্ত হয় ওর বারবার প্রশ্নে। আজরা ছুটে গিয়ে বাবার খাবার জগ নিয়ে আসে।
– দেখি মাথা নিচু করো। পানি ঢালে আজরা ওর মাথায়।
– কী করো মা?
পেছন থেকে হোমেদ আলীর আওয়াজ। সামনে এসে ব্যাপারটা বুঝতে পারে হোমেদ আলী। ঘাড়ের গামছা থেকে নিচের অংশ ছিড়ে ছেলেটার কপালে বেঁধে দেয়। আজরা অপরাধী গলায় বলে
– আব্বা পানি তো সব শেষ। ভাত খাওয়ার সময় তুমি খাইবা কি?
আজরার মা-সুলভ আচরণে হোমেদ আলীর মন আনন্দে ভরে ওঠে।
– লাগবো না মা। আজ তো পান্তা ভাত। আইসো এক সাথে খাই।
ছেলেটার হাত ধরে হোমেদ আলী মেয়েকে নিয়ে খেতে বসে গাছের নিচে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় গাছটার মাথার ওপর দিয়ে। সাদা আকাশে তখনো রোদের রাজত্ব।
***
ভোর বেলার আকাশটা স্বচ্ছই থাকে। হোমেদ আলী আকাশের দিকে চায়। প্রতিবারের মতো। নীল নীল দেখা যাচ্ছে। অবস্থা ভালোই ঠেকছে। আজকে তাহলে আকাশটা নীলই হবে মনে হয়। হাত মুখ ধুয়ে দু মুঠো খেয়ে নেয় হোমেদ আলী। এখন জমিতে যাবে। ঘর থেকে বের হয়। আজরাকে এখন ডাকবে বলে আকাশের দিকে তাকায়। চোখ আবার ঝলসে যায়। কোথায় সে নীল। কিচ্ছু দেখা যায় না এ ঝলসানো রোদে। সবকিছু ঘোলা। সব শূন্য।
ছোটো গ্রামে জনবসতি খুব একটা নেই। ঘরগুলো অনেক ফাঁকা ফাঁকা। সুমা রানীর এখনো সন্তান হয়নি। উঠোনে বসে মাছ কাটছে। ছোটো পুটি। দ্রুত হাত চালাচ্ছে। চুড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আজরা একটু কাছে আসতেই শব্দটা শুনতে পায়। শুনতে খুব ভালো লাগে। সুমা রানীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে আজরা। কী সুন্দর মুখখানা। আমার মাও কি এমন সুন্দর ছিলো? মনে প্রশ্ন আসে। যখন হাতে লাঠি থাকে তখন সৌন্দর্যটা কোথায় যেনো হারিয়ে যায়।
– এ আজরা! ছাই নিয়ে আয়তো! ছাই ফুরে গেসে!
ছুটে যায় আজরা। হাতের তালুতে করে ছাই তোলার আগে বুড়ো আঙুলে কয়লার কালি ভরিয়ে নেয়। ছাই এনে সামনে রাখে। বুড়ো আঙুল দিয়ে সুমা রানীর গালে ছোট্ট করে ফোঁটা দিয়ে দেয়।
– কী করলি এটা! এক থাপ্পড় দিমু। যা ভাগ এহন এহান থেকে। তাড়াতাড়ি আসবি। দেরী করলে লাঠি তো চেনোস্।
মুখ নামিয়ে আজরা চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গাছটার নিচে এসে বসে। হোমেদ আলী জমিতে।
থপাত করে শব্দ হয় গাছের পেছন থেকে। আজরা গিয়ে দেখে উপুর হয়ে পড়ে আছে ছেলেটি। মাথায় মাটি। আজরা দেখে কিন্তু আগেরবারের মতো আর এগিয়ে যায় না। ছেলেটা কিছুক্ষণ ব্যথায় ঝিম ধরে থেকে আজরার কাছে আসে।
-পানি আছে? ছেলেটি কপাল মুছতে মুছতে প্রশ্ন করে।
– না। আজরার কড়া উত্তর।
– মন খারাপ? চলো খেলি। বলে হাত ধরে ছেলেটি গাছের পেছনে নিয়ে আসে।
– কী খেলা? আজরার মলিন মুখে প্রশ্ন করে।
– এ ডাল দিয়ে কে আগে ওপরে উঠতে পারে।
– কতো ওপরে? অত ওপরে তো পারবো না।
– আরে ঐ কাছের ডালটার কাছে। আজরা ওঠার চেষ্টা করে। পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে তবু পারে না।
আজ যেন সূর্য তার কলস থেকে ঢেলে দিয়েছে সবটুকু রোদ। দূরের কাক মাথা নাড়িয়ে দেখছে এদের কাণ্ড। এক পর্যায়ে ওরা হাঁপিয়ে ওঠে। বসে পড়ে ওখানে। আজরা মায়ের কবরের ওপরে বসে পড়ে।
– কবরের ওপর বসা লাগে না। নামো! ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলে। আজরা সরে আসে। ছেলেটা প্রশ্ন করে
– কার কবর এটা?
– মায়ের কবর। কবরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে আজরা।
– আমার মায়েরটা যে কোনহানে থাকলো কে জানে? আজরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
– তোমার মায়ের কী?
– কবর।
– তোমার মা নাই?
– মা বাপ কেউই নাই। করবডা কোনহানে তাও জানি না। দাদির কাছে থাকি। কবরডা কোনহানে জানলেও অন্তত কবরের কাছে গিয়া দোয়া করতে পারতাম। আজরা ভাবে সে তো কখনো কবরে এসে দোয়া করে নাই। বাবাকে দেখেছে মাঝে মাঝে। আজরা হাত তুলে দোয়া করে। ছেলেটা অবাক হয়ে দেখে।
– তোমার হাতে কালি ক্যান? ছেলেটা প্রশ্ন করে।
– কয়লার কালি। কয়লা গলায়া আম্মারে ফোঁটা দিয়ে দিসি।
– সৎমা? সৎমারা নাকি ভালো হয় না।
– আমার মা খারাপ না। ভালো।
– তাই নাকি? তাইলে তোমার আব্বা খারাপ।
– কেন?
– তোমার হাতের নিচে মাইরের দাগ। আজরা থতোমতো খেয়ে যায়। চুপ করে থাকে।
– বাদ দাও কালি দিয়ে ফোটা দিলে কী হয় তাই কও? প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে ছেলেটি।
– খারাপ মাইনষের নজর লাগে না।
– নজর না লাগলে কী হয়?
– বেশিদিন বাঁচে। আমার আপন মা আগেই মরে গেসে। আমার ছোটো মা যেন মেলাদিন বাঁচে। আমি তারে মরতে দিমু না।
– তাইলে আমি দাদিরে ফোটা দিয়া দিমু। আমার দাদির অসুখ। সেও তাইলে মেলাদিন বাঁচবো। আমার একটা প্রিয় ছাগলের বাচ্চা আছে ওরেও দিমু।
পেছন থেকে সুমা রানী মুচকি হাসে কিন্তু চোখ জল ছেড়ে দেয়। হাত থেকে লাঠিটা পড়ে যায়। ছুটে গিয়ে আজরাকে কোলে নিতে ইচ্ছা করে সুমার। ছোট্ট আজরাকে সে চেনেনি। হোমেদ আলী পাশ থেকে সুমার হাত শক্ত করে ধরে। দম আটকে রাখে। কান্নাটাকে গিলে ফেলতে চায়। পারে না। সুমার হাতেও সময় নাই। জীবন তাকেও থাকতে দিলো না। ডাক্তারের কথা কানে বাজতে থাকে হোমেদ আলীর। আর মাত্র মাস কয়েক। কবরটার দিকে তাকায় হোমেদ। পরক্ষণেই মেয়ের দিকে চায়।
সামান্য কালির ফোঁটা দিয়ে কিচ্ছু হয় না রে মা!
হোমেদ আলী মনে মনে বিলাপ করে।
আকাশটা আজ নীল হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। পাকুড় গাছের একটি সবুজ পাতা উড়ে এসে কমলা বিবির কবরের পাশে এসে আলগোছে পড়ে। কিছুক্ষন আগের রোদ ঝলমলে সূর্য যেন ম্লাণ, শ্বেত শুভ্র আকাশ ধীরে ধীরে আঁধারে ঢেকে যায়। খুব ধীরে ধীরে নিভে আসে দিনের আলো।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২