নীল বোতলের শ্বাসসমূহ
প্রজ্ঞা মৌসুমি
প্রতিবারই নীল শিশিটার সামনে এসেই দাঁড়ায় মেয়েটা। যেদিন ও প্রথম দোকানে এসেছিল, বকুনি দিয়ে তাড়িয়েছিলাম। চোর-ছ্যাঁচোড় কিনা বলা তো যায় না। তাছাড়া ওরকম নোংরা কাপড় পরা কাউকে দোকানে ঘুরতে দেখলে খদ্দেররাই বা কী ভাবতো। ক্লাস সচেতন, ভদ্র, সৌখিন খদ্দেরই তো এই দোকানের লক্ষ্মী। দ্বিতীয় দিন আবার তাকে দেখতে পেয়ে কৌতূহল হলো। খাবারের কিংবা খেলনার দোকান হলে ওর ফিরে আসার একটা মানে বুঝতে পারতাম। ‘কেন’-র কোন নিরাপদ যুতসই উত্তর খুঁজে পাইনি বলেই হয়তো অস্বস্তি হয়েছিল। কিংবা আমার নিজের ভেতরেই তিরতির করে কেঁপে ছিল সর্ষে ফুলের মতোন ঝকঝকে অথচ গোপন কোন কামনা। কত’ইবা হবে ওর বয়স। বারো, এগারো কিংবা তারও কম। ‘ঘর কোথায়?’ জিজ্ঞেস করতেই দক্ষিণ দিকটায় আঙুল তুলেছিল। যেখানে নতুন মানচিত্রের মতোন টলমল করছে রিফিউজি ক্যাম্প।
অ্যান্টিক জিনিসের কদর কিংবা মূল্য তেমন বুঝতে শিখিনি। বুঝতে চাইওনি। পরীক্ষায় ফেল করার পর, আর পড়াশোনা করবো না- এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বাবা প্রথমে খুব চাবকালেন বেত দিয়ে। পরে এই দোকানে নিয়ে আসলেন, শাস্তিস্বরূপ। খুব মা- ন্যাওটা ছেলে কিনা আমি। মাকে ছাড়া, বাড়ি ছেড়ে এত দূরে থাকাই আমার শাস্তি, যন্ত্রণা। এখানে নির্বাসন পাওয়ার মতো বিষণ্ণ নির্জনতা আছে। দোকানটা বড়ো মামার। বছর খানেক আগে মামা হঠাৎ করে নিখোঁজ (লোকে বলে গুম খুন) আর মামাতো ভাই মালয়েশিয়া চলে যাওয়ার পর, দোকানের দায়িত্ব নেন বাবা। আপাতত সব কাজ বাবা ফোনেই সামলান। তিনি ব্যবসার ব্যস্ততায় আসার ফুরসত পান না। দোকানটা বেচে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
শুনেছি, আগে দোকানে ভিড়ভাট্টা হতো। প্রাচীন সব জিনিসপত্র দেখার- জানার আগ্রহ লোকের ছিল। আমি সেইসব ব্যস্ততা দেখিনি। প্রয়োজনীয়তার কাছে সৌখিনতার দম্ভও ম্লান হয়ে যায়। চারপাশে এতসব বিপর্যয়ের ভিড়ে সৌখিনতা দাঁড়াবে কোথায়! মাঝেসাঝে জিনিসপত্র কেনাবেচার কিছু থাকলে বাবা ফোন করে জানিয়ে দেন। পুরনো খদ্দেররাই আসেন। জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে, ব্যাংকে জমা না রাখা অবধি, টাকা তুলে রাখি সত্তর বছরের পুরনো সিন্দুকে। দোকানের আয় এবং লাভ সবই দাঁড়িপাল্লায় উঠবে, নিখুঁত ভাগ বাটোয়ারা হবে। এই দায়িত্বের ভার, গুপ্তধনের মতো টাকা আর এতসব জিনিসপত্র আগলাতে গিয়ে বুঝি, বাবা আমাকে পরীক্ষায় বসিয়ে গেলেন। ওঁদের বিশ্বাস ধরে রাখার যন্ত্রণা দিয়ে গেলেন। অথচ আমি পরীক্ষাকেই এড়িয়ে যেতে চেয়েছি বরাবর।
পুরনো রোদের ঘ্রাণ জড়ানো মেয়েটার মুখোমুখি হওয়াও ছিল আমার জন্য পরীক্ষা। যে পরীক্ষাকে আমি অতিক্রম করতে চাইনি। আমার ধাঁচ যেমন, শুরুতে এড়াতে চেয়েছি। তাই দ্বিতীয় দিন নোংরা কাপড় পরে ঢুকা যাবে না বলে বিদায় করি। একদিন পর ও ঠিক আবার আসে। পরনে একই জামা। সাবানের একটা গন্ধ নাকে লাগে। আমাদের বাড়ির নুর চাচীকে মনে পড়ে তখন। হঠাৎ একটা-দুটো ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে সাবান ধার চাইতো- ‘একটু ডলা দিমু খালি।’ সাবানে ঐ বস্তি পাড়ার ঘ্রাণ লেগে থাকবে দাদু মানতে পারতেন না। এমনিতেই শুচিবায়ু ছিল। একবার অনুমতি না নিয়ে চাচী কলতলা থেকে একটু সাবান লাগিয়েছিল বলে দাদুর কী রাগ, ছুঁড়ে ফেলেছিলেন বাড়ির পেছনে। আর তখনই আগর গাছ থেকে ঝুপ করে নেমে এসেছিল সন্ধ্যা রঙের কাক, ঠোঁটে করে নিয়েছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষা- অবহেলার এক ছলক সাবান। অনুমতির যথার্থ মূল্য দেওয়ার জন্য মেয়েটাকেও কি নুর হতে হয়েছিল নাকি আগর গাছের কাক! কাকের গায়ের গন্ধ বুঝি ওরই মতোন হয়।
মেয়েটার স্থির চোখ মুগ্ধ করে আমাকে। প্রথমটায় দিকভ্রান্ত নাবিকের মতো নাকি স্থির কম্পাসের মতো সারি সারি জিনিসপত্রের ভিড়ে নীল বোতল বরাবর চলে গেল মেয়েটা, ঠিক ঠাহর করতে পারিনি। মিরাজ, মামাবাড়ির দারোয়ানের ছেলে, এসেছিল তখন টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুপুরের খাবার দিতে। মেয়েটাকে হঠাৎ দেখে চমকে গিয়ে দেয়ালের কান এড়ানো স্বরে বলেছিল মেয়েটা পাগল আছে। বাবা ভাই মরেছে ওর দেশেই, সেনাদের গুলিতে। মা মারা গেছে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতে। পত্রিকায় মেয়েটার একটা আলোচিত ছবিও এসেছিল। সেখান থেকেই মিরাজ ওকে চেনে। ‘বুঝলেন ভাই, পৃথিবী এক প্রকার পিৎজা, ফালি করেই সুখ’- মিরাজ দেয়ালের কানে সাপ হয়ে হিসহিস করে, থালায় ভাত উপুড় করে, কাঁঠাল বিচির ভর্তা ঠেলে দেয় এক কোণে।
আমার তখন মায়ের মুখ মনে পড়ে। মনে পড়ে বালা পরা একটা কোমল হাত। মায়েরও একটা নীল বোতল আছে, নানার হাতের। নানাকে মা কখনো দেখেনি আর তাই হয়তো নানার হাতের যে কোন কিছু মায়ের বড়ো আদরের। বাবাও রাগ করে সেসব জিনিসই ভেঙেছে বেশি ‘ বাপের বাড়ির পুরান ছুরান জিনিস নিয়ে যত আদিখ্যেতা।’ এই নীল বোতলই মায়ের আলাদীনের প্রদীপ যেখানে বাবা মিশে থাকে কখনো কনডেন্স মিল্কের সাথে, কখনো ছানাপোনা তিলের সাথে, কখনো বা জলপাই তেলের নরম ঠাণ্ডায়। দূরের বোনদের সাথে যখন কথা হয়, বোনেরা নীল বোতলের গল্প করে, দীর্ঘশ্বাস বাজায়- বুবু কেমন আছে বোতলটা? বছর বদলালে আরো যেন গাঢ় নীল হয়… খেয়াল করিস মনে হবে নতুন নতুন নীলপদ্ম ফুটে, সেই পূর্ণিমায় তিনশো পঞ্চাশ ছিল, গতকাল গুনে দেখি তিনশো তেপান্ন.. ঘুম আসে না আজকাল। নীল পদ্ম গুনতে গুনতে কখন যে বাবা ঘুম পাড়িয়ে যায়।’
ঠিক সেই দুপুর বেলাটায় মায়ের আদর হারানো নীল বোতলের মুখোমুখি আমি আর কাকের আপন বোন মনে হওয়া মেয়েটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। যে নিঃসঙ্গতা আমাদের এক করে। যেমন দুটো সম্পূর্ণ অপরিচিত বৃক্ষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এক হয়। আসলে, মাটির কমলালেবু পার হলে আমাদের তো ঐ একটাই আকাশ। পত্রিকায় মেয়েটার ছবি আমি দেখিনি। তবে ওর মুখ, পত্রিকার অন্য আরেক ছবি মনে করিয়ে দেয়- আফগান মোনালিসা। আমার একাকীত্ব কিংবা আচারের তেল থেকে উঠানো এক টুকরো জলপাইয়ের মতোন কামনা থেকেই হয়তো এই উদ্বাস্তু মোনালিসাকে আমি প্রতিদিন ভেতরে আসতে দিয়েছি। লোভ আমাকে তাড়া করেনি, খাপছাড়া তলোয়ার হয়ে ওর স্বাদ নিতে চায়নি- তা নয়। তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে দাঁড়ানো ঐসব রিফিউজিদের আমার বড়ো ভয়। বেসামাল কিছু হলে যদি ওরা ছুটে আসে আহত বাঘ হয়ে। কিংবা ও কখনোই আমার শিকার ছিল না, ছিল মেইট- সঙ্গী। যাবতীয় রহস্য আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে যার ঘ্রাণ বরাবর।
আমাদের আলাপ পরিচিতির ভাষা ছিল একটা বন্ধ দরজা। এতকিছু থাকতে নীল বোতলটাই কেন- প্রশ্নের উত্তরে কখনো সখনো যা কথা বলতো বুঝিনি কিছুই কিংবা স্পষ্ট করে বলেনি সে কিছুই। ওর মতোন একাগ্র অর্থহীনভাবে নীল বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ক্লান্তি আসে । তাই নীল বোতলকে ঘিরে আমি তাকে আবিষ্কার করতে চাই। আমি তার নীল পাঠ করি। শব্দের খোঁজে নিঃশব্দে হেঁটে চলি কোবাল্টের খনিতে, যেখানে ভয়ংকর আর রহস্যময় মৃত্যু হতো শ্রমিকদের। সেই থেকে জানি কোবাল্ট শব্দের জন্ম জার্মান থেকে, যার মানে ‘দানব’। হয়তো মেয়েও কোন দানবকে খুঁজে ফেলে। আমি শব্দে শব্দে শিখি কোবাল্ট ব্লু। সেই ব্রোঞ্জ যুগ থেকে কাঁচকে যে দিয়ে গেছে আদুরে নীল- আসমানী রঙের থেকে গাঢ় অথচ নেভী ব্লু থেকে হালকা মাঝারী নীল।
কখনো কখনো বোতলটা মেয়েকে দিয়ে বা দেওয়ার অভিনয় করে ও কতোটা মরিয়া হয়, খুশি হয় যাচাই করতে ইচ্ছে হতো। ইচ্ছে হতো জানতে ‘কাকের কলজে এনে দিতে হবে কিন্তু’ বললে সে কী এনে দেবে নিজেরই কাক-কলজে? কেন তার বোতলের তৃষ্ণা ফুরোয় না! আমি সবকিছুতে বোতল খুঁজে পাই। আকাশও যেন একটা বোতল, জাদুর বোতল। কোবাল্ট নীল শিশিটা আমার স্বপ্নেও তাড়া করে। আমি আর মেয়ে একই সাথে যেন ঠিক একই স্বপ্ন দেখছি। সারা দোকান জুড়ে হাজার হাজার শিশি। বাইরে থেকে জানালা ভর্তি বোতল আমাদের শ্বাস বাড়িয়ে ডাকে। অথচ কোবাল্ট নীল বোতলটা কিছুতেই খুঁজে পাই না আমরা। অনেকগুলো স্পষ্ট ছায়া আমাদের সাথে ঘুরে, শোঁ শোঁ বাতাস হয়ে বলে- ‘বোতলে কাগজ আছে, নানা ইচ্ছে লেখা। সে বোতলে ইচ্ছে রাখলে ইচ্ছে পূরণ হয়।’
এক সময় দেখি আমিই একটা বোতলে আটকে আছি। কেমন এক ভয় দিয়ে ভেঙে গেছে ঘুম। মনে হয়েছে কোন বোতল নিঃশ্বাস ফেলছে কোথাও। আমি জানি কোন সে বোতলের কথা বাতাসেরা বলে। মাঝরাতে দরজা পেরোতে পারিনি শুরুতে, ইচ্ছে শিশির মুখোমুখি হওয়ার আতংকে। ভয় হতো কারণ ঠিক জানতাম দোকানের দরজা খুললেই দেখব ভূতুড়ে অন্ধকারে ওড়নায় মুখ চেপে দাঁড়িয়ে কাকের ঘ্রাণ উপচানো মেয়ে। অবশ্য ক্রমাগত একাকীত্বে বোতলের স্বপ্নে, ভাবনায়, ভয়ে ধাতস্থ হয়েছি একটা সময়। মুগ্ধ হয়ে ভেবেছি কী ইচ্ছে পূরণ করতে চাই, পরীক্ষায় পাশ? মশিউর যেমন নয়নমনির ফুঁ দেওয়া কলম এনেছিল। এ কলমে লিখলে নিশ্চিত পাশ- ওর এত বিশ্বাস ছিল। তাই আমরা যখন পড়তে বসতাম ও ঠিক ঘুরে বেড়াত, সিনেমা দেখত। আমরা অবশ্য সেটা জেনেছিলাম রেজাল্টের দিন। নয়নমনিকে যখন ধরা হলো ওর কলম দিয়ে লেখার পরও কেন পাশ করেনি মশিউর। টাকা ফেরত দিতে হবে। এদিকে নয়নমনি ততদিনে টাকা খরচ করে ফেলেছে। জ্যাঠিমা বিশ্বাসটা ভাঙতে চায়নি কিংবা নয়নমনিকে বাঁচাতেই হয়তো বলেছিল, ‘লিখতে ভুলে গেলে দোয়ার কলম সহজে মনে করিয়ে দেয়। তাড়াতাড়ি লিখতে সাহায্য করে। এইটুকুতেই তার জাদু। সে বড়জোর তালা খুলে, দরজা নয়।’
আমি ইচ্ছে বোতলের জাদুতে বিশ্বাস করতে থাকি। এক ঠাঁয়ে বোতলের দিকে তাকিয়ে থেকে গাঢ় কোন ইচ্ছে খুঁজে চলি। একদিন বুঝি আমি আসলে বাড়ি ফিরতে চাই। বাড়ি ফেরার ইচ্ছের মতো তীব্র আর কোন ইচ্ছে কখনোই ছিল না আমার। জানি প্রিয় কিছুর জন্য হাহাকার থাকতে হয়। একটা বাড়ি আমার ভেতর হাহাকার হয়। যে বাড়িতে আমার শৈশব কেটে কেটে বসানো, যেখানে কত সব হুহু জ্বলে- নিভে জোনাক পোকার মতোন, নীলপদ্ম ফুটে গোপন বোতলে। মেয়েও কি সেই একই ইচ্ছে বয়ে বেড়ায়- বাড়ি ফেরার? নীল বোতলের দিকে তাকিয়ে গভীরে ওর ছিমছাম উঠোন আবিষ্কার করি। এক পাশে ছুটে যাওয়া বাস্তুসাপ,অন্য পাশে শান্ত গাছ, যেখানে সারে সারে ঝুলে আছে বোতল, অপেক্ষায়। নরম বাতাসে দুলে যাচ্ছে রঙিন শিশিরা যেন ওরা ঠিক ধরে ফেলবে শূন্যে উড়ে বেড়ানো একেকটা দানব, দানবের চোখ। আমি দেখি এমনই শান্ত বোতলরঙা উঠোন যেখানে যুদ্ধ ছিল না, ছিল না ধর্মের কোন খাপছাড়া তলোয়ার।
বোতলে বুঁদ হয়ে মামাতো ভাইকে একদিন শিশির ছবি পাঠাই, যদি কিছু জানায়। ফিরতি উত্তর আসে- ইট’স এ কোবাল্ট ব্লু পয়জন বোটল। বিষের বোতল! বিস্ময়ে নীল বোতলের দিকে তাকাই। আহা নীলকন্ঠ, ঠিক এই মানচিত্রের মতোন। নীল শিশিতে আটকে থাকা একশ পঁচানব্বইটি দেশ বোন পৃথিবীতে যেন দীর্ঘশ্বাস বাজায় ঠুন-বোন-ঠুন-বোন… শ্বাসের মানচিত্র ধরে আমি আর মোনালিসা টালমাটাল ছুটি। আমরা নেমে পড়ি কবিতার মতো একটা সবুজ ধানক্ষেতে, দূরে কী নরম ঘর। চারপাশে সারে সারে কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে থাকে, অবিকল রূঢ় সৈনিকের মুখ।
তারিখঃ জুলাই ৬, ২০২১