পথের পাঠশালায়

 

Twenty years from now you will be more disappointed by the things that you didn’t do than by the ones you did do. So throw off the bowlines. Sail away from the safe harbor. Catch the trade winds in your sails. Explore. Dream. Discover.”

 

-Mark Twain

 

বছর কুড়ি পরে যখন জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত হয়ে, আমার সারাজীবনের প্রাপ্তির ঝুলি হাতড়াব, কী পাব তখন সেখানে? সেখানে কি থাকবে শুধুই অর্থ উপার্জনের নেশায় দিনগত পাপক্ষয়? একেবারেই তা নয়। আমার জীবনের মূলমন্ত্র মার্ক টোয়েন মহাশয়ের উক্তিটি,”Explore. Dream. Discover.”

 

বনে-জঙ্গলে,পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ানোয় বড় প্রাপ্তি হল বিভিন্ন জায়গার মানুষের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হওয়া। তারা এতকাল ছিল অচেনা, কিন্তু পরিচয় হওয়া মাত্রই মনে হয় যে তাদের সঙ্গে যেন কতদিনের চেনাজানা, মাঝের দিনগুলি কেবল যোগাযোগ ছিল না। পথ, পথের পাশের ঘর, পাহাড়, ঝর্ণা, নদী সেও যে আমার পথ চলার সাথী। পথ চলতে চলতে কত রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে এই ছোট্ট জীবনে। মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছি। প্রকৃতিকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছি। শুরুর দিনগুলি খুব সহজ ছিল না। অভিজ্ঞতা দিনে দিনে সমৃদ্ধ করেছে।

 

নিজের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায়, ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রথম পা বাড়িয়েছিলাম ঘাটশিলায়। এর আগে এই স্থানের উল্লেখ কিংবা বর্ণনা অনেক গল্পে পেয়েছিলাম, আর মনের মধ্যে কল্পনার রং মিশিয়ে অনেক ছবিও এঁকেছিলাম। সেবার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই, গরমের ছুটিতে হঠাৎ ইচ্ছেডানায় ভর করে রওনা দিয়েছিলাম। বেড়াতে যাওয়ার সেরকম কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এর আগে দুটি কলেজ ট্যুর করেছি মাত্র। তখন ছিল চাকরিজীবনের শুরুর দিক; বেতন কম, সাংসারিক দায়ভারও বেশি। বেড়ানোর জন্য আর্থিক বরাদ্দও ছিল খুবই সামান্য। শুধুমাত্র উৎসাহ ও উত্তেজনাটুকু সম্বল করে বেরিয়ে পড়া আর কি!

 

সকাল দশটা নাগাদ স্টেশনে নেমেই দেখি, মুহূর্তে স্টেশন চত্ত্বর ফাঁকা হয়ে গেল। স্টেশনের বাইরেও লোকজন খুবই কম। পরে জেনেছিলাম, ওই গরমের সময় ওখানে কেউ সকাল দশটার পরে খুব কাজ না থাকলে বেরোয় না। স্টেশনের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে হোটেল নিয়ে সেই যে বাথরুমে ঢুকলাম, বেরিয়েছিলাম ঘণ্টাখানেক পরে। শাওয়ার চালিয়ে ঠাণ্ডা জলের ধারায় চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। জলের ধারা থেকে বেরোলেই গরমে ঘামে অস্থির অবস্থা। মনে আছে, ভেজা জামাকাপড় বিছানায় পেতে রেখে তার ওপর শুতে হয়েছিল। তাতেও বেশিক্ষণ লাগছিল না শুকনো হতে। এখনও গরমের কথা কখনও মনে হলেই আজও ঘাটশিলার কথাই প্রথমে মনে আসে। বিকেলে রোদ পড়লে ‘হ্যাপি সিং’জির অটোতে গিয়েছিলাম রাতমোহনায়, সুবর্ণরেখা নদীর পারে।

 

নদীতে তখন হাঁটু জল, মাঝে মাঝে ছোট-বড় পাথর নদী, ধীরেসুস্থে মৃদুমন্দ গতিতে বয়ে চলেছে। অথচ পরে আরেকবার বর্ষায় এই সুবর্ণরেখাকেই দেখেছি দুকূল ছাপিয়ে বয়ে যেতে, কি তার গর্জন! নদীতে কয়েকজন মহিলা দিন শেষে হাঁটুজলে গা ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা হাতে নাইলনের সুতোর সঙ্গে কি একটা জিনিস বেঁধে মাছ ধরছিল। ওই গরমে বাইরের লোক বলতে আমিই ছিলাম।

 

সবাই তো আর আমার মত পাগল নয় যে, গ্রীষ্মের দাবদাহে ঘাটশিলা ভ্রমণে যাবে! ধীরে ধীরে দিনের আলো কমে এলো। তালগাছের আড়াল নিয়ে সূর্য সেদিনের মত অস্ত গেলেন। দিনটি ছিল পূর্ণিমার আগের দিন। সন্ধ্যের মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে আকাশে ঈষৎ ক্ষয়ে যাওয়া, গোল থালার মত সোনা রংয়ের চাঁদ,সে যে কি অপূর্ব এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। গ্রীষ্মের বিকেলের একটা আলাদা গন্ধ আছে। অনেকটা ধুলোর মত। সেই গন্ধ মেখে, চাঁদের আলোয় ভিজে ওখান থেকে আর ফিরতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, না জানি রাত্রিতে নদীর এই পাড়টা কি স্বর্গীয় চেহারা নেবে। কিন্তু জায়গাটা সন্ধ্যের পরে একেবারে শুনশান হয়ে যায়। ওভাবে চুপচাপ বসে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মত উপযুক্ত পরিবেশ ঐটি আদৌ নয়। “হ্যাপি”জির ডাকে ওই মায়াময় পরিবেশে স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল। রাত্রে হোটেলে ফিরে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। রুমে কারেন্ট নেই। কয়েকটা পাটকাঠির মত রোগা রোগা মোমবাতি আর দেশলাই ধরিয়ে দেওয়া হল ঘরের অন্ধকার দূর করার জন্য। সেই মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে ঢোকার একটু পরেই, হঠাৎ জানালার বাইরে থেকে কাদের যেন গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। খেয়াল হল, পাশের বাড়ির ছাদ, হোটেলের এই ঘর লাগোয়া। সেখানে কয়েকজন লোক, কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আসর জমিয়ে বসেছে,এবং হোটেলের রুমে মহিলা দেখে তাদের আচরণ ও কথাবার্তায় আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে। মোমবাতি নিভিয়ে ফেললাম। হোটেলের রিসেপশনিষ্টকে ফোন করে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে অবিলম্বে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত করার অনুরোধ জানালাম। কিন্তু তিনি জানালেন, কোনো রুম ফাঁকা না থাকায় আমাকে ওই রুমেই সেদিনের মত থেকে যেতে হবে। যদিও আমি যতদূর জানতাম,ওইদিন এই একটি রুম ছাড়া আর কোনো রুমে কোনো বোর্ডার ছিল না। ফোন রেখে জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

 

রাত্রের খাওয়ার খেয়েই ঢুকেছিলাম,সুতরাং বাইরে বেরোনোর আর কোনো প্রয়োজন ছিল না। একে ওই পৈশাচিক গরম, অন্যদিকে একমাত্র হাওয়া চলাচলের রাস্তা, জানালাটিও বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তখনও স্মার্টফোনের যুগ আসেনি তাই চোখ বন্ধ করে শুধুই সময় গুণে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। রাত তখন প্রায় বারোটা হবে, হঠাৎ একজন রুমের দরজা নক করে বলল, অন্য রুম ফাঁকা হয়েছে, আমি যেন ওই রুমে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাই তখনই। আমি সে কথার কোনো উত্তর দিলাম না। বিছানার সঙ্গে সেঁটে মড়ার মত পড়ে রইলাম। আরও বারকয়েক দরজায় আওয়াজ করে সেই লোকটি ফিরে গিয়েছিল। অস্বীকার করব না, এই ঘটনাটিতে তখন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। টেনশনে হোক কিংবা ক্লান্তিতে, চুপিচুপি চোখে কখন যেন ঘুম নেমে এসেছিল।

 

পরেরদিন ‘হ্যাপি’জির অটোয় বাকি দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে, বিকেলের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। এই ঘাটশিলা ভ্রমণ আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। অনেক ধরনের প্রতিকূলতাকে জয় করে ইচ্ছের পতাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে ফিরেছিলাম। ওই ছিল শুরু, তারপর কত জায়গায় ঘুরেছি,কত ধরনের অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরেছি, দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ হয়েছি। রোজের চালডালের হিসেবের বাইরে বেরিয়ে এসে ভাবতে পেরেছি পৃথিবীটা এখনও কত সুন্দর। চারপাশের স্বার্থপর,ক্ষমতালোভী মানুষগুলোর বাইরে কত সহজ সরল সুন্দর মনের মানুষের দেখা পেয়েছি, যার ফলে মনে হয়েছে পৃথিবীতে সবাই খারাপ নয়। এমনই ভালোমানুষের সংখ্যা বেশি বলেই আজও পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য আছে। এক পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে গেলে বাড়ির বাইরে পা দেওয়া ভীষণভাবে দরকার। বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা এক মহৎ গুণ। ভ্রমণ যাকে ত্বরান্বিত করে। হিমালয়ের বিশালত্বের মাঝে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার যে আনন্দ, তা কি আর চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে অনুভব করা সম্ভব? জুতো পরা দুই হাতের উপর ভর দিয়ে, বেঁকে যাওয়া কোমরকে কোনওভাবে টেনে নিয়ে অমরনাথের মত এত দুর্গম রাস্তা পাড়ি দেওয়ার মনের জোর বছর পঁচিশের যুবক কিভাবে পায়,তার উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু আমার শিক্ষালাভ ওর কাছেই। তাই তো বেরিয়ে পড়তে প্রাণ চায়,পথেই যে মুক্তি। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,

“পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে,

বাজে আমার বুকের মাঝে

বাজে বেদনায়।

আমার ঘরে থাকাই দায়।”

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Satakshi Ghoshal
Satakshi Ghoshal
2 years ago

দারুন। নামটা ভীষণ ভাল দিয়েছো। বেশ সুন্দর অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ এত বছর পরে। খুব ভাল লাগল

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse