পলাশের পথে পথে

ভেবেছিলাম এ বছর আর যাবো না। গতবছরই মার্চে গেছি পুরুলিয়া, পলাশ তেমন পাইনি। শুধু শুধু এবছর আর গিয়ে লাভ নেই।

 

ঠিক তখনই হোয়াট্সঅ্যাপে একটা ছবি এল।গাছ ভর্তি পলাশ। ছবি টা পাঠিয়েছে আমার এক বন্ধু, নীচে লেখা, “পুরুলিয়া এখন ঠিক এইরকম “।

ফেসবুকে নাকি পুরুলিয়ার স্থানীয় কেউ পোস্ট করেছেন।

 

এরপর আর লোভ সামলানো গেলনা।আমাদের চার বন্ধুর বেড়ানোর দল, ঠিক করলাম, আবার যাব। যে বন্ধু আমাদের দলপতি, সে একটু সবজান্তা টাইপের, কিন্তু আমরা ওর জ্ঞান সহ্য করি, কারণ বেড়ানোর সমস্ত ব্যবস্থা ওই করে।

 

যথারীতি দুম করে টিকিট কেটে ফেলল, হাওড়া পাটনা জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে। দুপুর ২:০৫ এ ছাড়বে হাওড়া থেকে, আসানসোল পৌঁছোবে বিকেল ৪:৩৩ এ।তারপর গাড়ি নিয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব গড় পঞ্চকোট। এসি তে ট্রেন ভাড়া ৩৫০ টাকা মতো। আর গাড়ি নেবে ১০০০ টাকা।

 

থাকার জন্য বুক করা হল পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তরের প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র। ইউটিউব ভিডিও দেখে মনে হল,বেশ ভালো ব্যবস্থা। এসি সুপার ডিলাক্স

ডবল বেড রুম নেওয়া হল দুটো।ভাড়া ট্যাক্স নিয়ে ৩৫০০ করে।

ফেরার টিকিট নেই ট্রেনে, সবজান্তা বলল,”ভলভো বাসে ফিরব।” আমি বাসে বমি করি,সেটা আর ভয়ে বললাম না। সবার সামনে যা তা বলে দেওয়া সবজান্তার স্বভাব। ঠিক করলাম, বমির ওষুধ খেয়ে বাসে উঠব।

 

নির্দিষ্ট দিনে, আমরা একসাথে হ’লাম হাওড়া স্টেশনে। ট্রেন ঠিক সময় ছেড়ে দিল। দুর্গাপুর ছেড়ে কিছু দূর এগিয়েছে, বেশ আড্ডা জমেছে, হঠাৎ পিঠে সবজান্তার চাপড়,” ওই দেখ,পলাশ! ”

পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে দেখি সত্যিই দুপাশে কিছু দূর অন্তর অন্তর দেখা যাচ্ছে পলাশ!!

দেখতে দেখতেই আসানসোল নেমে গেলাম ঘড়িতে যখন ঠিক সাড়ে চারটে, অর্থাৎ,নির্দিষ্ট সময়ের তিন মিনিট আগে।

 

তখন টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ চারদিকে। গাড়ি ছুটে চলেছে গড় পঞ্চকোটের দিকে। আমাদের রিসর্টে ঢোকার আগে একটা মোড় পড়ল, পুয়াপুর মোড়। সেখান থেকে পুয়াপুর গ্রাম পেরিয়ে আমাদের রিসর্ট।ওই রাস্তার দুপাশে,যতদূর চোখ যায়, শুধু পলাশ আর পলাশ!!

আমাদের মন নেচে উঠল।এবারে পুরুলিয়া আসা তাহলে সার্থক। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে ।

 

রিসর্টে পৌঁছোলাম ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের কোলে,চারদিকে সবুজে ঘেরা,অপূর্ব পরিবেশ। আমাদের বুকিং ছিল গড় পঞ্চকোট ৩ আর 8 নম্বর  ঘরে। দারুণ ব্যবস্থা, বিরাট ঘর,দুদিকে বারান্দা,খাটে অনায়াসে তিনজন বড় মানুষ শুতে পারে। বাড়তি পাওনা হল,একটা আলাদা ড্রেসিং স্পেস। আমাদের এক বন্ধু কোথাও যাবার আগে একঘন্টা ধরে সাজে, সে দারুণ খুশি হল আলাদা সাজার জায়গা পেয়ে ।

 

সবার ক্ষিদে পেয়েছে। ট্রেন থেকেই ফোন করে সন্ধ্যা আর রাতের খাবার অর্ডার করে দেওয়া হয়েছিল। এখানে এটাই নিয়ম। একবেলা আগে খাবার টা বলে দিতে হয়। চিকেন পকোড়া আর চা খেয়ে জমে উঠল আড্ডা, রিসর্টের  দোলনায় দুলতে দুলতে।

 

ঠিক নটায় রাতের খাবার। রুটি, পনিরের তরকারি আর স্যালাড। সবাই ক্লান্ত, শুয়ে পড়লাম চটপট। পরদিন ভোরবেলা যাব পলাশ দেখতে।

 

পরদিন ভোরে,হাঁটতে হাঁটতে গেলাম হোটেলের বাঁদিক দিয়ে, জঙ্গলে। একটু হাঁটতেই দেখি,এদিক ওদিক প্রচুর পলাশ। এক এক জায়গায়, যতদূর চোখ যায়, শুধু আগুনরঙা পলাশ। আমি গেয়ে উঠলাম, ” ওরে পলাশ, ওরে পলাশ, রাঙা রঙের শিখায় শিখায় , দিকে দিকে আগুন জ্বলাস “।

 

জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে,হঠাৎ মনে হল, গড় পঞ্চকোটের গড় আর রাস মন্দির টা দেখতেই হবে।পাহাড়ের যেদিকে আমাদের রিসর্ট,তার উল্টো দিকে হল গড় আর মন্দির। রাস্তা থেকে একটা অটো নেওয়া হল।অটো যাচ্ছে আদ্রার দিকে।বলল, “আপনাদের গড়ের রাস্তায় নামিয়ে দেব।”

আমরা তো খুব খুশি। কিছুক্ষণ পরে আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে অটোওয়ালা বলল, “সামনের রাস্তা ধরে চলে যান,কাছেই গড়।ফেরার সময় আমি আপনাদের তুলে নেব গড়ের সামনে থেকেই।”

 

সেইমতো আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পাশে গ্রাম। দুপাশে দেখতে দেখতে মিনিট কুড়ি হাঁটার পর যখন আমি কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি, তখন সবজান্তা বলল, ” জি পি এস বলছে, আর বাইশ মিনিটের রাস্তা। ” আমার তো মাথায় হাত।এখন ফিরে যেতে গেলে কুড়ি মিনিট, আর সামনে যেতে গেলে বাইশ মিনিটের রাস্তা। ভগবান!! কার সাথে এসেছি!! মনে হল অটোওয়ালা টার গলা টিপে দিই গিয়ে।

 

যেখানে অটো নামিয়েছিল,সেখান থেকে, ঘড়ি ধরে, ঠিক সাড়ে বাহান্ন মিনিট হেঁটে, পৌঁছোলাম, গড়ের সামনে। সবজান্তা দাঁত বের করে বলল, “তোর ওজন ৫০০ গ্রাম কমে গেল।” বীভৎস ক্ষিদে পেয়েছে। স্থানীয় দোকানে এক মাসির হাতে বানানো রুটি আলুর তরকারি তখন অমৃত মনে হল।

 

সামনেই গড় পঞ্চকোটের ভাঙা চোরা গড়। সবজান্তা বলল, ” দেখ, গড় টা এখনো বর্গী আক্রমণের সাক্ষী হয়ে আছে। ” শুনলাম কল্যাণেশ্বরী মন্দির আগে এখানেই ছিল।এখন মাইথনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গড়ের কাছেই রাস মন্দির। ভেতরে রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ। এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে দেখতেই অটো এসে গেল ফেরার জন্য।

 

হোটেলে ফিরে, লাঞ্চ সেরে, ভাবছি বিকেলে কি করব, এমন সময় সবজান্তা বলল, ” মাইথন যাবি? বোটিং করব।”

ব্যাস, নেচে উঠলাম আমরা। গাড়ি বলা হল। পান্চেত আর মাইথন ঘুরব, ১৩০০ টাকা নেবে গাড়ি।

 

বিকেল ৩:৩০ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার দুপাশে পলাশ দেখতে দেখতে একটু পরেই পৌঁছে গেলাম পান্চেত ড্যাম। দামোদরের ওপর করা এই ড্যামে এখন জল কম।

মাইথন পৌঁছাতে ৪:৩০ বাজল। বরাকর নদীর ওপর করা এই ড্যামে প্রচুর জল। জলের মাঝে মাঝে তৈরী হয়েছে আইল্যান্ড। ৪০ মিনিট বোটিং, ৭০০ টাকা নেবে বলল। বেশ বড় নৌকা, মোটর বোট নয়, আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম মনে মনে। কিন্তু দেখলাম, স্থির জল, নৌকা তাই দুলছেনা বেশি। গুছিয়ে  বসতে পারলে কোন ভয় নেই।

চারদিকে জল, মাঝে মাঝে সবুজ আইল্যান্ড, গাছে ভরা, আর বসন্তের ” মাতাল সমীরণ “। সব মিলিয়ে  প্রকৃতি তখন প্রেমিক। একের পর এক বসন্তের গান গাইতে লাগলাম আমরা। একটা আইল্যান্ডে এসে থামল নৌকা। আমরা নামলাম। তখন ঠিক সূর্যাস্তের সময়। সূর্য তার রঙ পরিবর্তন করছে আর জলে তার প্রতিফলন হচ্ছে। সোনালী সূর্য যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে।অবর্ণনীয় সেই সৌন্দর্য। মুঠো ফোনে আর কতটুকু বন্দী করা যায়। চিরকালীন ছবি রয়ে গেল আমাদের মনের ক্যামেরাতে।

 

সূর্যাস্ত পুরোটা দেখা গেল না, কারণ আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।আমরা রিসর্টে ফিরলাম সাতটা নাগাদ। আর তারপরেই শুরু হল আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। জঙ্গলের মধ্যে বৃষ্টির অভিজ্ঞতা এই প্রথম আমার। মাটির সোঁদা গন্ধ, গাছের ওপর বৃষ্টির আওয়াজ, গাছের গন্ধ, পাতা ঘষার শব্দ, সব মিলিয়ে আমরা তখন বাকরুদ্ধ।

 

পরদিন সকাল ৮:৩০ তে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলের চারজনের খাওয়ার বিল হয়েছিল ২০০০ টাকা মতো। আসানসোল ভলভো স্ট্যান্ড থেকে ভলভো ধরলাম। কলকাতা অবধি ভাড়া ৪৫০ টাকা করে,সময় নেবে চার ঘন্টা মতো। পরে কবে কোথায় বেড়াতে বেরোচ্ছি, এই প্ল্যান করতে করতে চার ঘন্টা কখন কেটে গেল!

দেখলাম সামনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এবার যে যার বাড়ির পথে। ছবি পোস্ট করতে হবে তো ফেসবুকে!!

তারিখঃ এপ্রিল ৯, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse