পিছুটান
সৌরীণ মুখার্জী
“আর ক’টা দিন না হয় অপেক্ষা কর, আমি চেষ্টা করছি তো মধুজা, দেখিস আমি ঠিক পারবো। শুধু একটু সময় দে আমায়, একটু সময়… মধুজা যাস না, দাঁড়া। শোন মধুজা যাস না, যাস না দাঁড়া, শুধু একটু সময়….. ”
গলাটা শুকিয়ে এসেছে, অন্ধকারেই কোনোমতে জলের বোতলটার নাগাল পেল পলাশ। যেটুকু জল ছিল তাতে গলাটা ভিজলো কিন্তু তেষ্টাটা মিটলো না। এই ডিসেম্বরেও দরদর করে ঘামছে ও। প্রতিদিন এই একইভাবে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে, একই স্বপ্নগুলো ঘুরে ফিরে বারবার তাড়া করে বেড়াচ্ছে। মধুজা, ওদের একসাথে দেখা স্বপ্নগুলো, ছোটমা’র চোখের জল, বাবার কষ্ট, ভাইয়ের বায়নাগুলো আর একমাত্র বন্ধু, প্রাণের বন্ধু অলোক।
তখন সবে চারটে বেজেছে, আলোর দেখা পেতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। পশ্চিমে সকাল হয় দেরীতে, তার ওপর শীত। দূরে কোথাও ময়ূর ডাকছে। গান্ধীনগরের এই জায়গাটা লোকালয় থেকে খানিকটা দূরে। ওদের কোম্পানির কোয়ার্টারগুলো ছাড়া আরও কয়েকটা রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং আছে, তবে অধিকাংশই খালি। এখনও সেভাবে লোক সমাগম হয়নি। ফোনটা হাতে নিয়ে কললিস্টে ‘মধুজা’ টাইপ করলো পলাশ। নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে পাগলিটা। ঘুমোনোর সময় ওকে অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগে, কতদিন কলেজের ক্লাসের ফাঁকে পলাশের হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ও, চুলগুলো কপালে পড়লেই একটা অস্বস্তির ইঙ্গিত। দুষ্টুমি করে পলাশ ওর চুলগুলো নিয়ে কপালের ওপর ফেলে দিত। তারপর সারাদিন রাগ ভাঙানোর অধ্যায়। এখনও নিশ্চয়ই একইরকম আছে। ওর সিঁথি জুড়ে লাল রেখাটা ভাবতেই কেঁপে উঠলো পলাশ। এখন নিশ্চয় পাশেও অন্য মানুষ! আদেও ওরা ঘুমোচ্ছে তো। কান্নায় গোঁ গোঁ করে উঠলো ও, জলের বোতলটা মেঝের ওপর ছুঁড়ে মারলো।
খুব রাগ হচ্ছে ওর নিজের ওপর, খুব রাগ। কী দরকার ছিল বাড়ি ছেড়ে, মধুজাকে ছেড়ে এতদূরে আসার! চলে আসার দিন স্কুলের ভেতরের বাগানটায় ওদের শেষ দেখা। মধুজা বলেছিল ওখানেই কিছু একটা কাজ খুঁজতে, দরকার হলে ও ওর বাবাকেও বলে দেখতো। বিনপুরের ছোট্ট গ্রামটা ছেড়ে, দেশের এক অন্যপ্রান্তে, অন্যরাজ্যে একটা চাকরি! মধুজার বাড়ি থেকে কখনোই রাজি হবে না। কলেজের পরেই ওর বিয়ের কথা উঠবে আর সেসময় পলাশ ওখানে না থাকলে ওর পক্ষে হয়তো বাড়িতে ওদের সম্পর্কের কথাটাও জানানো সম্ভব হয়ে উঠবে না। মধুজা বারবার বলেছিল থেকে যেতে, ফিরে আসতে। পলাশ পারেনি। এই চাকরিটা ওর ভীষণ দরকার ছিল, এতদিন বাবা টেনেছে এবার ওর দায়িত্ব। নিজের মা’কে ওর সেভাবে মনে পড়ে না কিন্তু ছোটমা কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। ভাই আর ওকে কোনোদিন আলাদা চোখে দেখেনি। ভাই ছোট বলে হয়তো আবদারগুলো বেশি ছিল, কিন্তু তাতে কী! ও যেদিন চলে আসছিলো সব থেকে বেশি বোধহয় ছোটমাই কেঁদেছিলো, অনেক কষ্টে বেরোতে পেরেছিল ও। বাবারও হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তবে বাবা তো বরাবরই চাপা। কিছু বলতে পারেনি। স্টেশনে যাওয়ার সময় অলোকের সাথে দেখা হয়েছিল, ও বোধহয় ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে গিয়েছিলো পাছে আবার কষ্ট হয়। তবে চোখের কোনটা কি চিকচিক করছিলো!
* * * * * *
টেনশনে বারবার জল খাচ্ছে পলাশ। ওর হাত-পা’ও যেন কাঁপছে। তবে রোজকার টেনশন আর ঘুমহীন দুঃস্বপ্নের রাতগুলো থেকে এ যেন ঢের ভালো। সরোজকে দেখে একটু ভরসা পেল। এই একটা ছেলের সাথেই যা একটু ভাব হয়েছে ওর। বাকিরা সব কেমন যেন, নিজেদের গ্ৰুপের মধ্যেই থাকতে ভালোবাসে। সরোজ ওর পাশের রুমেই থাকে, ভরসা করে ও সরোজকে সবটা বলেছিল। মধুজা, ওদের ভালোবাসা, মধুজার বিয়ে, বাড়ির কথা সব। এ’ও বলেছিল ও সারারাত ঘুমোতে পারে না, কান্না পায়, খুব কষ্ট হয় ওর। ও যেন আর এখানে থাকতে পারছে না, ওর ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে যেতে? কিন্তু যাবেই বা কোথায়? বাড়ি ফিরলেই তো আর মধুজাকে ফিরে পাবে না। তারপরই বেশ কিছুদিন পরে সরোজ এই জায়গাটার সন্ধান দিয়েছিলো। গান্ধীনগর থেকে অনেকটা দূরে পোলো ফরেস্টের ভেতর জায়গাটা। লোকজন, মিডিয়া, প্রেস এইসব ঝামেলা এড়াতেই বোধহয় এতটা ইন্টিরিয়র। প্রথম প্রথম রাজি হয়নি পলাশ, অনেকটা টাকারও ব্যাপার। পরে অবশ্য ও নিজেই সরোজের কাছে ছুটেছিলো। আর কোনো উপায় ছিল না, রীতিমতো সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি চলে আসছিলো।
“কী রে এখনও ভয় পাচ্ছিস, পলাশ ?” সরোজের হিন্দিতে গুজ্জার প্রভাবটা বেশ লক্ষ্য করা যায়।
“পাচ্ছি না বললে ভুল হবে, তবে যে আর কোনো উপায়ও দেখছি না সরোজ।” পলাশ হিন্দিটা এখনও সেভাবে রপ্ত করতে পারেনি, ভাঙা ভাঙা বলে।
অরবিন্দ বারোত, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝামাঝি বয়স হবে। কাঁচা পাকা চুল, একটা স্ট্রাইপড শার্ট আর ব্লু ডেনিম। দেখে বুঝবার জো নেই, বিজ্ঞানের এতসব বিস্ময়কর আবিষ্কার তাঁর। অবশ্য সবই অগোচরে, লোক জানাজানি হলে হয়তো সমস্যা বাড়বে।
“আসুন পলাশ বাবু, এই মিশনটায় যাওয়ার আগে কতগুলো কথা আপনাকে জানিয়ে দিই। জানি না সরোজ আপনাকে কী কী বলেছে, তবুও এটা তো আমার দায়িত্ব। আমার কথাগুলো মনে দিয়ে শুনুন, তারপর সিদ্ধান্ত নিন। তবে ব্যাক আউট করলে টাকা কিন্তু আমরা পঞ্চাশ শতাংশই ফেরত দিই ।”
একটু ইতস্তত বোধ করলো পলাশ, এতগুলো টাকার ব্যাপার। যা কিছু সেভিংস ছিল তার বাইরেও সরোজের থেকে টাকা নিতে হয়েছে। এতটা সাহস করে ও এতদূর এসেছে, পিছু হটবে না।
“ঠিক আছে স্যার, আমি মনস্থির করেই ফেলেছি, তবুও আপনি বলুন।”
“গ্রেট। আমার হাতে যে ব্যান্ডটা দেখছেন এর নাম ব্যাক এফেকশন, অর্থাৎ পিছুটান। আলোর গতিবেগের হিসেবের সাথে মিলিয়ে কিছুটা কাছাকাছি একটা পরিমান বেগ এতে দেওয়া আছে। এ অনেকটা ছায়াপথের মতো। এই ব্যান্ডটা হাতে পরার সাথে সাথেই আপনি ফিরে যাবেন আপনার ফেলে আসা পিছুটানগুলোয়। আপনি তখন নিছক একটা ছায়া। বুঝতে পারবেন , শুনতে পারবেন কিন্তু কিছু বলতে পারবেন না। তবে এখানেই এর লিমিটেশন নয়। এখানে যে দুটো বোতাম দেখতে পাচ্ছেন, একটা লাল আর একটা নীল, এই দুটোর ব্যাপক ভূমিকা আছে। লাল বোতামটা টিপলে আপনি সেই সময় ওখানে উপস্থিত আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারবেন । তখন আপনি আর পাঁচটা মানুষের মতোই। আপনার না বলা কথাগুলো, আফসোসগুলো যা আপনি বদলাতে চান তখন নিমেষেই মিটিয়ে ফেলতে পারবেন । আর এই নীল বোতামটা টিপলে আপনি ছায়াপথ বেয়ে মুহূর্তের মধ্যে আবার এখানে ফিরে আসবেন ।
কী সিম্পল তো! একদমই না। এবার আসি লিমিটেশনে। এই গোটা মিশনটায় আপনি একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা পাবেন, অবশ্য সেটাও নির্ভর করছে আপনার শরীরের ওপর। যত দুর্বল হয়ে পড়বেন , মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন সময় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসবে। আর ওই সময়সীমার মধ্যে একটাও বোতাম টিপতে না পারলে ছায়াপথেই আপনার সমাধি।
লাল বোতামটা একবার টিপলে আপনি আর নীল বোতামটা টিপতে পারবেন না, এবং ফিরতেও পারবে না। বিজ্ঞান ব্যালেন্সে বিশ্বাস করে, এবং একারণেই ওখানে আপনার একটা অস্তিত্ব তৈরি হলে আপনার এখানের অস্তিত্ব মুছে যাবে। আপনার চাকরি, গান্ধীনগরের দিনগুলো, সরোজের বন্ধুত্ব এইসব কিছুই আপনি ভুলে যাবেন, আসলে এগুলো তো কোনোদিনই হয়নি তখন আপনার কাছে।
আর যদি নীল বোতামটা টেপেন, আপনি এখানে ফিরে আসবেন তো বটেই তবে আপনার ওখানের ওই সময়ের যা যা স্মৃতি সব মুছে যাবে, আপনার প্রেমিকা, আপনার বন্ধুরা, সব। এমনকি আপনি ওই সময় অবচেতনে যা ভুলতে চান, সব ভুলে যাবেন । আপনার বাড়ির স্মৃতিও হারিয়ে যেতে পারে ওই ছায়াপথের মধ্যেই।
এবার ভেবে নিয়ে আমায় বলুন, তবে খুব বেশিও সময় নেবেন না। ” অরবিন্দ থামলেন।
পলাশ কিছুটা জানলেও সবটা জানতো না। হয়তো সরোজ নিজেও জানতো না। সময়ের মধ্যে একটাও বোতাম না টিপতে পারলে ছায়াপথেই ও শেষ, আর সময় যে কখন শেষ হবে ও’ও জানে না । একটু ঘাবড়েছে। তবে রোজকার এই ঝামেলা, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার প্রবণতা এসবেও তো ভয় আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে ও বললো “আমি তৈরি স্যার, আপনি ব্যান্ডটা আমায় পরিয়ে ফেলুন।”
মুচকি হাসলেন অরবিন্দ।
* * * * * * *
বিকেলের পড়ন্ত রোদটা অশ্বত্থ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে স্কুল বাড়ির উঠোনটাতে এসে পড়েছে। জীবন যেন শান্ত শীতল আঁচল বিছিয়ে এখানে থেমে আছে। গান্ধীনগরের দিনগুলো বড্ড কঠিন মনে হয় এই দৃশ্যের সামনে। ঝরা পাতার স্তর পেরিয়ে ভালোবাসারা আজও কত সবুজ এখানে। ছায়ার আফসোসগুলো আরও দীর্ঘ হলো। দূর থেকে ছায়া দেখলো পলাশ বসে আছে স্কুল বেদিতে, মধুজার অপেক্ষায়। আজ রাতের ট্রেনেই হাওড়া , তারপর গান্ধীনগর। ভালো মন্দের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে অপেক্ষা করছে পলাশ। নিস্তব্ধ দুপুরে এই বিশাল স্কুলবাগানটা বড্ড ভালো লাগছে ছায়ার, মাঝে মাঝে পায়রার বাকুমও শোনা যাচ্ছে। একটা ফিসফিস আওয়াজ, কাছেই কোথাও। টনক নড়লো ছায়ার। গলাটা খুব চেনা, মধুজার। ও কি তাহলে এখানেই কোথাও আছে! স্কুলের পেছনদিকটাতে এগোলো ছায়া। হ্যাঁ ঠিক ওই তো মধুজা, সাথে আরেকজন কেউ। ছেলেটার মুখটা খুব চেনা চেনা, কিন্তু ছায়া ঠিক মনে করতে পারছে না।
“আরে আজ তো তুমি ওকে সব বলে দাও মধু, আজ ও চলে যাচ্ছে তো। একটা বছর হতে চললো আমরা প্রেম করছি, অথচ তুমি ওকে এখনও আশা দিয়ে রাখবে!”
“আরে আর একটা তো দিন, আমি জানি ও কিছুতেই এখানে থাকবে না। আর ওর বাড়ির যা অবস্থা চাকরিটা ওকে করতেই হবে। আর তুমি তো জানো প্রেমটা তোমার সাথেই, তবে ও না থাকলে এই কলেজের এতগুলো পরীক্ষা, প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, উদ্ধার হত বল? তুমি এক কাজ করো এখন বাড়ি যাও, রাতে কথা হবে। আমি বরং যাই, ওকে একটু সামলে আসি। একটু কান্না কান্না মুখ করতে হবে তো, এই দেখো তো ঠিক আছে, বোঝা যাচ্ছে না তো?”
মধুজা এগিয়ে যাচ্ছে বেদির দিকে, পলাশ এখনও বসে আছে অপেক্ষায়। ছেলেটা ততক্ষণে পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এর পরের অংশটা ছায়ার জানা। লাল বোতামটার দিকে তাকিয়েও হাতটা সরিয়ে নিল ও। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে ওর, বল কমে আসছে যেন। স্কুল থেকে বেরিয়ে এল ও।
বাড়ির উঠোনে আচারের শিশিগুলো রোদ খাচ্ছে। মাদুরের ওপর বসে ভাই অঙ্ক করছে। বুদ্ধি আছে ছেলেটার তবে বেশ ফাঁকিবাজ। বাড়ির ভেতর থেকে একটা আওয়াজ আসছে, আওয়াজটা বাড়ছে। ছোটমা আর বাবার গলা। ছায়া সামনে এগিয়ে গেল।
“চাকরি করবে না তো কী করবে বল তো? আর কিছু মুরোদ আছে তোমার ছেলের? আর তুমিই বা কতদিন টানবে ওকে? ছোটনের একটা ভবিষ্যৎ আছে, সব তো আর ওর পেছনে বিলিয়ে দিতে পারি না। দেখো নিজের ছেলে না হলেও এতদিন তো করলাম, এবার বাপু ওকে বিদেয় দাও। আর মাস গেলে তো টাকাটাও লাগবে নাকি? ওই পান গুমটির দোকান থেকে আর ক’টা টাকা আসে তোমার! ”
শুকনো মুখে দাওয়াতে বসে আছে বাবা। কিছু বলতে গিয়েও যেন ঢোঁক গিলে নিল।
“আরে এরকম করে বসে থাকো না তো, এরকমভাবে তোমাকে দেখলে ও আবার যেতে চাইবে না। আর আদিখ্যেতা না করে মুখ হাত ধুয়ে এসো। আর ছোট দেখে একটা আচারের শিশি ওর জন্য তুলে রেখো। বেশি দিও না যেন, ছোটন আমার আচার খেতে খুব ভালোবাসে।”
ছোটমা’র কথাগুলো যেন এই বিনা শরীরেও হুল ফুটিয়ে যাচ্ছে। ছায়ার পায়ের তলার মাটি সরছে, ও বুঝতে পারছে। আর হয়তো বেশিক্ষণ নয়। ওদিক থেকে সরে এল ছায়া। পলাশ বাড়ির দিকেই আসছে, মধুজার কান্নাটা ওকে বেশ ভালোই তছনছ করেছে বোঝা যাচ্ছে। অথচ পেছনের গল্পটা ও জানতেও পারলো না। পলাশের জন্য কষ্ট হলো ছায়ার, তবে লাল বোতামটা ও টিপবে না।
স্কুলের পেছনের মাঠটার কাছে পৌঁছালো ছায়া। এই মাঠেই কত ম্যাচ একা হাতে ও টেনেছে। গতবারের ফুটবল ম্যাচের শেষ গোলটাও ওর। মধুজার কি সেই আনন্দটাও মেকি ছিল? ভাবলো ছায়া। গোলপোস্টের ঠিক পেছনটাতে অলোক বসে আছে। ওর হাতের সিগারেটটা জ্বলছে। কলেজে ঢুকে থেকেই সিগারেটের নেশাটা ধরেছিলো ও। ওর সাথে আরেকজন কেউ বসে আছে, পেছন থেকে ঠিক বুঝতে পারলো না ছায়া। তবে গলাটা খুব চেনা চেনা।
“কী রে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড চলে যাচ্ছে একবারও দেখা করবি না ভাই?”
“না রে আর ইচ্ছে নেই। ওর আর এখানে না থাকাই ভালো। বরং যেখানে যাচ্ছে সেখানেই নতুন কিছু শুরু করুক। আর বেস্টফ্রেন্ড! কথাটা কেমন খিল্লির মতো শোনালো রে। বেস্টফ্রেন্ড হলে কি তোর আর মধুজার আলাপটা আমি করাতাম! ভুলে যাস না আমার জন্যই কিন্তু তুই ওকে পেয়েছিস দীপ।”
মনে পড়েছে, এবার বোধহয় সবটা মনে পড়েছে ছায়ার। দীপ, আরে দীপ তো অলোকের মামার ছেলে। বাঁকুড়ার ওদিকেই কোথায় যেন থাকে, মাঝেমাঝেই ওদের বাড়ি ঘুরতে আসতো। সেই জন্যেই স্কুলের পেছনে মধুজার সাথে ওকে দেখে মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছিলো ছায়ার। শেষে কি না অলোক এই নোংরা কাজটাতে মদত দিল! অলোকের চোখের কোণটা বোধহয় সত্যিই চিকচিক করছে এবার।
হাতটা জ্বলতে শুরু করেছে ছায়ার, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না ও। এবার বোধহয় সত্যিই সব ফুরিয়ে আসছে, এই মহাশূন্যেই কোনো একটা অজানা ছায়াপথে ও চিরকালের জন্য মিলিয়ে যাবে…..
* * * * * *
একটা বড় ঢেউ এসে প্রায় ভিজিয়ে দিয়ে গেল। আরেকটা একটু দূরেই ভেঙে গেল। দিউ’র সমুদ্র এই প্রথম দেখলো পলাশ। গান্ধীনগর থেকে একরাতেই পৌঁছানো যায় এখানে। একটা অদ্ভুত আরাম লাগছে এই জোলো হাওয়াটায়। এখানে সমুদ্র মুম্বাইয়ের মতো নোংরা নয়, নীল রঙটা বেশ গভীর, ভিড়টাও অনেক কম ।
এই তিনমাসে অনেকগুলো জায়গা’ই ঘুরে নিয়েছে পলাশ। গতমাসেই মাউন্ট আবু, উদয়পুর গিয়েছিলো। সামনের পূর্ণিমাতে কচ্ছের রণ যাওয়ার প্ল্যান, চাঁদের আলোয় একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয় ওখানে। গান্ধীনগর শহরটা আর আগের মতো খারাপ লাগে না ওর। রাতের ঘুমগুলোও ফিরে এসেছে। ময়ূরের ডাকটা এখন বেশ সয়ে গেছে। ও জানে ওরাও হয়তো ওকে ভালো থাকার কথা’ই বলছে। পুরনো কিছুই আর সেভাবে মনে পড়ে না, শুধু বাবার মুখটা মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে, খুব অস্পষ্ট। মাসের শুরুতে সরোজ শুধু একবার বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথাটা মনে করিয়ে দেয়। ও বলে যে এটা নাকি দায়িত্ব। বাদবাকি আর কিছুই তেমন পলাশের মনে নেই। চাইলেও মনে করতে পারে না।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঢেউয়ের আওয়াজটা এবার বাড়ছে। গুটিকয় লোক ইতিউতি ছড়িয়ে। পেছনের স্যাকগুলো থেকে লোকাল কোনো গান হাওয়ায় ভেসে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে আর কী’ই বা লাগে?একটা প্রিয় গান মনে মনেই গুনগুন করছে পলাশ। দূরে দেখলো, সরোজ এদিকেই আসছে। বালির ওপর ওর চলাটা দেখে মনে হলো সত্যিই ছেলেটার এবার জিমে ঢোকাটা মাস্ট, যেভাবে ফুলছে দিনদিন।
“বিয়ার? ”
মুচকি হেসে বোতলটায় চুমুক লাগালো পলাশ।
তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১