প্রবাল দ্বীপে ‘ডো’

 

রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল সেবু প‍্যাসিফিক ফ্লাইট নং #5j619। মানিলার এই “নিনয় অ‍্যাকুইনো” এয়ারপোর্ট বেশ ব‍্যস্ত। আসলে ফিলিপাইন্সের ছোটো বড় দ্বীপগুলোতে যেতে গেলে এয়ার ছাড়া গতি নেই। তাই সারাদিন জেগে থাকে এই এয়ারপোর্ট। আমার সিট ছিল জানলার ধারে। সময়টা রাত চারটে কুড়ি।

আকাশে ওড়ার সাথে সাথে পাল্টে গেছে দৃশ‍্যপট। মানিলা শহর এখন রাতের আকাশ যেন। আলোগুলো ছোট্টো ছোট্টো তারা । আরোও একটু ওপরে উঠে মেঘের রাজ‍্য। সমুদ্রের সফেন ঢেউয়ের মতো মেঘের কার্পেট। মাঝে মাঝে সোনালি আর কমলা আলোর ফুলকারি কাজ।

এ দৃশ‍্য ক‍্যামেরার যান্ত্রিক চোখে ধরা পড়ে না। দুচোখ ভ’রে শুধু সঞ্চয় করে রাখা অন্তরতম ফ্রেমে।

নামতে হবে বহোল দ্বীপের তাগবালারিণ এয়ারপোর্টে। আমার পাশে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, আমার পুত্র। ও মানিলায় চাকরি পাওয়ার পর প্রায় দুবছর পরে আমাদের দেখা। তাই সময়টুকু বুকভরে নেওয়ার চেষ্টা দুজনেরই সমান। আমরা এসেছি কোরাল দ্বীপ দেখতে। সাথে আছে আমার পুত্রবধূ লিজা। ওর দেশে এসেছি বলে ওর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি।

তাগবালারিণ এয়ারপোর্ট বেশ সুন্দর। যখন গিয়েছিলাম, করোনার করাল ছায়া তখনো অন্ধকার  করেনি পৃথিবী। তাই খুব বেশি  বাড়াবাড়ি  ছিল না সুরক্ষার। ফিলিপাইনসে এসে অবধি এদের ব‍্যবহার আমায় ভীষণভাবে আকৃষ্ট করছিল। এরা এতো ব‍্যবহার সচেতন যে, ঝগড়াও করে হেসে হেসে। আমরা যে কথায়, হাসি তো দূরে থাক! ভ্রুদুটোও সোজা রাখতে পারি না! গলার স্বরের কাঠিন‍্য লুকোতে পারিনা! এরা অবলীলায়  একগাল মধুর হেসে সে কথার উত্তর দিয়ে চলে যায়। তো এ হেন মানুষদের  সাথে আলাপ করতে কার না ভালো  লাগে! এরকমই একজন এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গেটে, হাতে একটা  বোর্ড । তাতে লেখা ছিল,”লিজা ম‍্যাম্”!

আমরা উঠে পড়লাম, ওঁর গাড়িতে। উনি নিতে এসেছেন আমাদের। যাব “পাংলাও”। আমাদের  রিসর্ট “দ‍ুমাল‍্যুয়ান বীচ্ রিসর্ট”। বেশ সুন্দর সাজানো সব। তৈরিই হয়েছে বিনোদনের কথা মাথায় রেখে। নানারকম কোরাল রাখা রয়েছে বাগানে। তার সাথে অসংখ্য পাতাবাহারি গাছ। ওদের হলুদ ঘেঁষা গায়ের রঙ নাতিদীর্ঘ সুঠাম চেহারা আর মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম।

সমুদ্রের পাড় জুড়ে পরপর ওদের রিসর্ট। কিন্তু কোনোও বাউন্ডারির বাড়াবাড়ি  নেই। বোঝাই যায় না কোনটা কার। শুধু একটা করে হাত দুয়েক উঁচু পিলার যেন দায়ে পড়ে সীমা রক্ষা করছে। প্রতিটি রিসর্টের সামনে বালির ওপর বিলাস বহুল বসার ব‍্যবস্থা। বিচের ওপর কাজু গাছের ছায়ায়  ঝরঝরে সাদা বালি। বসে পড়লাম। একটা দূর্গ বানাবার চেষ্টা করছি, কে যেন এসে বসল পাশে। দেখে মনে হল, স্থানীয় ছেলে। এই বছর পঁচিশেক হবে। হাতে গীটার। হাসলাম। বললাম

—- আর ইউ আ সিংগার ?

মাথা নেড়ে বলল,

—- ইয়েসস্! আয়াম্ ডো।  ইউ ইন্দিয়ান! রাইট ?

মাথা হেলাই আমিও। হাসি একটু। নিজের পরিচয় “ভারতীয়” দিতে পেরে বেশ ভালো  লাগল। বললাম

—- হোয়ার ডু ইউ লিভ ?

ডো লম্বা হয়ে বালির ওপর শুয়ে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল,
—– আন্দার দ‍্য স্কাই !

ওর নির্মল হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম না, ও ইচ্ছে করেই আকাশের তলায় শোয় ? না বাধ‍্য হয়ে !
আমাদের  লাঞ্চ বুক করা ছিল লোবোক নদীর লঞ্চে। বললাম, চলো আমার সাথে। হাসতে হাসতে হাত বাড়াল,
— ফ্রেন্ড ?
হাত রেখে বললাম।
— ইয়েস!

এখানে নদী খরস্রোতা নয়। এদের সবকিছুর মধ‍্যেই একটা সুমিষ্ট স্নিগ্ধ ভাব আছে। সবুজের সমারোহে নদীর জলও সবুজ। এতো গাঢ় সবুজ আমি  কখনোও দেখিনি। নদীর ধারে ধারে ছবির মতো  গ্রাম। ওরা অপেক্ষা  করছিল  নাচ দেখানোর জন্য । আমাদের  লঞ্চ দাঁড়াল।

ডো আমাকে জায়গামতো দাঁড় করিয়ে দিল, যাতে আমার দেখতে অসুবিধে না হয়…

লাফিয়ে নেমে গেল, ওদের সাথে গাইতে লাগল, ওরা সবাই হাসছে, মনখোলা হাসি…এই সবুজ কি ছায়া ফেলেছে ওদের মনে!

কয়েকটা বাঁশকে আড়াআড়ি ফেলে, অদ্ভুত কায়দায় টিনিক্লিং নাচল । ওদের সুর তাল ছড়িয়ে পড়ল, সবুজের সাথে মিশে গেল একাত্ম হয়ে। প্রমাণিত হলো, সঙ্গীতে ভাষা অনিবার্য নয়। নদীর স্রোতের মতোই স্নিগ্ধ ওদের হাসি। মনেই হলো না আমার দেশ এদের থেকে বহু-বহু কিলোমিটার ভৌগলিক দূরত্বে। এই নদী, এই বনজঙ্গল, ঐ আকাশ সব্বাই এক ভাষায় কথা বলে, হাসে, কাঁদে, ভালোবাসে।

ফিরলাম সন্ধ‍্যায়। ডো ছুটলো ওর বাড়ি। আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই এঞ্জেলো অপেক্ষা করে আছে। শুধু শুধু মেয়েটার কষ্ট হলো। চলে আসতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে রইলাম। ডো গীটার নিয়ে ফিরে এল। স্টেজের সামনে তখন বেশ ভিড়। ও গেয়ে উঠল,

–“শায়লা! ডোন্ট ব্রেক মাই হার্ট”—

বড় ভালো ওর গলাটি । আমি অপেক্ষা করছিলাম এঞ্জেলোর। ও কি উঠতে পারে না? কয়েকবার জিজ্ঞেস করব ভেবেও পারিনি। সংকোচ হয়েছে। দূর থেকেই ওদের শুভকামনা জানাই… কাল আবার মাঝ সমুদ্রে, কচ্ছপ আর ডলফিন  দেখতে যাব ।

পরদিন ছোট্টো একটা নৌকা নিতে এলো।কালো পোশাক পরে বীচের ওপর লাফিয়ে নামল ডো। হাসতে হাসতে হাত বাড়ালো। বলল, এটা নাকি ওরই নৌকা। আমাদের নিয়ে যাবে। কেন যে ডো বিশ্বাস করে ফেলেছিল এই অসম বয়সী, ভিনভাষী, ভিনদেশীকে…জানি না। কিম্বা ওরা এমনই সৌভাগ‍্যের অধিকারী, যারা সব্বাইকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে।

স্কুবা ডাইভিং হবে। কীসব ধরাচূড়ো পরিয়ে দিল। প্রথমটা ভয় হলো। মৃত‍্যুভয়? এই বয়সে? নাঃ! জয় করে ফেললাম। ডো এসে হাতটা ধরলো। মুখে নল নিয়ে জলের তলায় নামতেই…ম‍্যাজিক। অজস্র রঙিন মাছ। কেউ ঝাঁক বেঁধে। কেউ একা। ছোট্টো ছোট্টো কচ্ছপ দেখা গেল দূরে। যেন এক আলাদা জগৎ। ‘তারা’ মাছেরা দেখতে ঠিক নক্ষত্রের মতোই, ভীষণ অদ্ভুত তাদের স্বভাব। কতো যে রঙ তাদের! ডো বলল, ওরা রঙ পাল্টায়, কষ্টে, আনন্দে, প্রেমে, অপ্রেমে…ভারি মজা লাগল। একটা নীল তারামাছকে হাতে নিয়ে উঠে এলো ডো। বলল, দেখো এবার। নৌকার পাটাতনে পড়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দুয়েকটা শুঁড় বাড়িয়ে বোধহয় বোঝার চেষ্টা করল, তার পরই নীলরং ফিকে হতে শুরু করল। গায়ের ডুমো ডুমো দাগ গাঢ় খয়েরি, নীলচে গোলাপী গায়ের রং এখন তার । ডো হেসে আলতো করে ছেড়ে দিল জলে। লক্ষ্য করলাম, আবার সে উজ্জ্বল নীলে ফিরে গেছে! ডো বলল, ওর মন খারাপ হচ্ছিল, সমুদ্রকে ভালবাসে তো!

পুত্র আর পুত্রবধূর ভারি মজা। ওরা চলে গেল অনেক দূর। আমি উঠে এলাম বোটে। ডোর সাথে গল্প করতে…

ডো ওর বাবা মাকে দেখেনি কখনও। কেন? জানে না। ও জানতো একমাত্র সিসিলিয়া গ্রেসিয়াকে। ডো সিলি বলে ডাকতো তাকে। এঞ্জেলো ছিল সিসিলিয়া গ্রেসিয়ার একমাত্র মেয়ে।

মোটামুটি ভালোই বাসতো সিলি। কিন্তু এঞ্জেলোর পেটে ক‍্যান্সার হওয়ার পর অতো টাকা কোথায় সিলির!

সম্বল তো তাগাইতাই শহরে ভলক‍্যানো দেখতে আসা ট‍্যুরিস্টরা। ওখানে  সিলির একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। ওর মেজাজ খারাপ  হলেই, ডো মার খেতো।

এঞ্জেলোরও যতো আবদার ছিল ডোর কাছেই।
একদিন এ‍্যাঞ্জেলো বলল,
—- মাকে কষ্ট দেবনা। চল! পালাই! আমাকে কিছুদিন নিজের মতো বাঁচতে দে।

পালিয়ে পাংলাও আসা। মাঝে মাঝে সিলিকে টাকা দিতে গিয়ে, মার খাওয়া। এঞ্জেলোকে দেখাশোনা করা, রাতে গান আর দিনে বোট। এই ছিল ডোয়ের জীবন।

হঠাৎ একটু দূরে জল উত্তাল হয়ে এল। অনেকগুলো কালো কালো মাথা ! ডো আঙুল দেখিয়ে বলল,

— ওয়াচ‌! ডলফিন ডলফিন!

চোখের সামনে একদল ডলফিন ডুবছে, ভাসছে, খেলা করছে…

তীরে এসেও রেশ রয়ে গেল।

ডো বলল,

—- কাল একবার আসবে? তোমাকে জর্জের সাথে দেখা করাব।

বললাম, —- জর্জ কে?

—- আমার আর এঞ্জেলোর বন্ধু। খুব লাজুক। বেশি মানুষ থাকলে আসে না।

—- কোথায়  থাকে?

হাসলো ডো। সমুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

—- ও ডলফিন। আসার সময় যে ঝাঁকটা দেখালাম, ঐ ঝাঁকে ছিল।

মাঝে মাঝেই বৃষ্টি, এটাই ইক্যুয়েটরের কাছাকাছি জায়গাগুলোর বিশেষত্ব । কপালে হাত রেখে দূরে সমুদ্রে তাকালো একবার। আজ খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যাবে। বলছিল ডো। প্রশান্ত মহাসাগরের এই অংশটা ফিলিপিয়ান সী। এখানে সবসময়ই ট্যুরিস্টের আনাগোনা লেগেই থাকে, তাই ওদের বোটও কখনও ফাঁকা থাকেনা। আজ ডলফিন দেখাতে পেরেছে বলে, যতোগুলো টাকা বাড়তি ছিল, দিয়েছি তাকে। ঐটুকু ছাড়া কীইই বা পারি! ভাগ্যিস ডো নিল।

তাড়াতাড়ি নেমে, ডো মরা কোরাল মাড়িয়ে মাড়িয়ে ঘরে চলল। ঘর বলতে, গোটা চারেক নারকেল গাছের গুঁড়ি কে থাম করে ছাউনি আর পাতার বেড়া দেওয়া পাঁচিল। ভাবলাম, অনেকক্ষণ দেখেনি এঞ্জেলোকে।

গীটারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বলল,

—-আজ সারারাত ওর প্রোগ্রাম…

ভাবছিলাম, সমুদ্রতীরের এই নিশাচর জীবন আর এঞ্জেলোর মৃত‍্যুর জন্য অপেক্ষা, এইই ডো’য়ের যাপন।

ডো ওর ঘরের  পিছনের কাজুগাছের তলায় শুয়ে পড়লো। এখানে একটা লাল পতাকা পোঁতা। আমি  এগিয়ে গিয়ে  ওর মাথার কাছে বসলাম।

—- এঞ্জেলো কোথায়?

ডো ওর স্বভাব সিদ্ধ হেসে, দুটো হাত থাবড়ালো ওর দুপাশে। বলল,

—- এই তো! এই কোরাল বেডে শুয়ে আছে।

হঠাৎ করে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার। মাথাটা ঘুরে উঠল… ডো কীসব যেন বলে যাচ্ছে…

কিছুক্ষণ সময় লাগল সামলাতে, ও বলছে,

— ওর আর কোনোও কষ্ট নেই। শুধু আমি কাছে না এলে, আমায় গান ভুলিয়ে দেয়। আর গান না গাইলে, সিলিকে খাওয়াব কী? ও তো এঞ্জেলোর ওপর রেগে আছে। ভাবছে ওর এঞ্জেলো ভালো আছে আমায় নিয়ে। আমিই ওকে যেতে দিই না। তাই গেলেই আমায় খুব মারবে সিলি…হা হা হা…

রাতে বহোল বীচ ক্লাবে খেতে গিয়ে শুনলাম ডো গাইছে,

—- কাম ব‍্যাক এঞ্জেলো! প্লিজজ্ কাম…

ওর নিজের লেখা গান।

পরেরদিন সেবু পেসিফিক ফ্লাইট ধরলাম, বুকভর্তি স্মৃতির সাথে। ভালো থাকো ডো মাই ফ্রেন্ড…

 

তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শ্যামল ঘোষ
শ্যামল ঘোষ
2 years ago

অসাধারণ

Indrani Tuli
Indrani Tuli
2 years ago

wonderful

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse