প্রান্তরসীমা

 

রেলগাড়িটা হুসহুস শব্দ তুলে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে খানিক গড়িয়ে অবশেষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই তো ঘণ্টা তিনেক আগেও, বিকেলের পড়ন্ত আলোয় চারিদিক এত ফাঁকা বলে মনেই হচ্ছিল না। আসলে যতক্ষণ আলো থাকে, ততক্ষণ নির্জনতা ঠিক ধরা পড়ে না; অনুভূত হয় না নৈঃশব্দের শিরশিরে ভাষা। যেহেতু সেই আলো এখন বেশ কিছুক্ষণ হলো মরে গেছে, নির্জনতা আর নৈঃশব্দ্যের হাত ধরাধরি করে আধিপত্য বিস্তারে কোথাও বাধা নেই। এতক্ষণ ধরে যে ঘাড় গুঁজে রেলগাড়িটার অপেক্ষায় ছিল, এখন সে ঘাড় তুলে দেখতে পায় প্ল্যাটফর্ম চত্বরটা শুনশান আর তার সাথে চমৎকারভাবে মানানসই একটা রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করছে। তার কামরাগুলোর লালচে আলোয় দেখা যাচ্ছে ভিতরের সবটা। জানালার আসন যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, সব খালি। দরজার কাছে কারও নড়াচড়া নেই। কেমন যেন পরিত্যক্তের মতো, গাড়ির ভিতরটা  ফাঁকা। তবু তীব্র এক আশা জড়ানো কৌতূহল নিয়ে, বড় নিবিষ্ট মনে গাড়িটার ভিতরে ছায়া আবছায়াগুলো সে খুঁজতে থাকে। লালচে আলোর ছায়াগুলো বেশি ঘন হয়ে পড়ে, একথা তার খুব ভালো করে জানা। তার লক্ষ্য কামরার ভিতরকার সব সুস্পষ্ট ছায়া। এই ছায়ারা তাকে সেইসব অবস্থানের নিশ্চয়তা দেবে যা বাইরে থেকে সরাসরি দেখতে পাওয়া যায় না। এটা একধরনের পরোক্ষ আশ্বাসের মতো যা তার আশাকে আরও কিছুটা ভরসা জোগাবে। সে তো জানে, এই রেলগাড়ি চেপে সবার আসার কথা ছিল। এটা একটা অভিযান যার অভিযাত্রী সে নিজেও। এতে চড়ে তারও তো কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর অঙ্গীকার ছিল, আজও তা আছে।

এখন সে খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখতে থাকে। টিকটিক করে সময় পার হয়। বিরাট কালো, গোলমুখো কয়লার ইঞ্জিনটা দাঁড়িয়ে ধক ধক করে হাঁপায় যেমন এবার ক্রমশ উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সে। সেই উত্তেজনা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। পরের পর রেলগাড়ির খোলা জানালাগুলো দিয়ে ভিতরে সে দেখতে পায় বেঁটে, মোটা, লম্বা, চওড়া, এবড়োখেবড়ো অবয়বের রকমারি ছায়া কিন্তু তারা সবাই অচঞ্চল, স্থির। কোথাও কোনো নড়াচড়া নেই। সে ভীষণভাবে চায় সময় থমকে থাক। প্রাণপণে চেয়েও প্রতিবার প্রবল উত্তেজনায় হাঁপিয়ে চূড়ান্ত হতাশায় তাকে রেলগাড়ির পাদানে পা রাখার ইচ্ছেটার গলা টিপে মেরে ফেলতে হয়। শুধু তো একবার নয়, দিনক্ষণ, তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে এমনটা বারবার হয়। কিন্তু এবার আর নয়। প্রত্যেকটা বছর এইদিনটার জন্য অধীরভাবে সে অপেক্ষা করে। আজ আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। তারা যদি নাই আসে, পথের মানুষ যদি দিশাহীনের মতো পথ ছেড়ে চলে যায়, গন্তব্যে তাকে একাই যেতে হবে। সে অনেক ভেবেছে। এই এতগুলো বছর, নিশ্চয় করে বলতে গেলে তেতাল্লিশটা বছর ধরে, একটা জার্নি, বা বলা ভালো একটা স্বপ্ন নিয়ে পথের মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে আছে অথচ দেশকাল, সময়, বলয়, কত কিছু পালটে পালটে গেছে। তাদের সবার তো একসাথে অভীষ্ট লক্ষ্যে থাকার কথা ছিল। এই পালটে যাওয়ার অভিমুখ তৈরি করে দেবার কথা ছিল। নন্দন কাননের ফল, ফুল আর ইমারতগুলো সবারই ছুঁয়ে থাকার কথা ছিল অথচ সে কী করে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, আজ আপ্রাণ চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। এইদিনটাতে সে কুয়াশাবৃত হয়েছিল। সবটুকু তাই ঘন কুয়াশায় ঢাকা। শুধু যাত্রার কথাটুকু আজও মনে রাখতে পেরেছে তাই সেটাই এখন তার ধ্যান, জ্ঞান, একমাত্র লক্ষ্য।

কিন্তু আজকেই কেন? এতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করার পর আজ কেন তার ধৈর্যচ্যুতি? কারণ সে বুঝতে পারছে, মানুষ ক্রমশ দিনের আলোর উজ্জ্বলতার সমান উজ্জ্বল আলো তৈরি করে ফেলেছে। দিনের আলোয় যে নির্জনতা হারিয়ে যায়, সেই আলো নিভে গেলে নির্জনতা আবার ধীরে ধীরে ফেরে কিন্তু এরপর এমন একটা দিন আসবে যখন সেই নিরঙ্কুশ শুন্যতা আর ফিরবে না। রাতের শরীর জড়িয়ে জাগা উজ্জ্বল আলো তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলবে। প্রকৃতি ঘুমহারা হবে। মানুষ স্বপ্ন হারাবে। তার এই যে রেলগাড়ি, যার খোলের ভিতর জ্বলে লালচে ডুমো ডুমো আলো, যে আলোর ছায়ায় জমে থাকে জানা অজানা অনেক গল্প, যাকে কয়লার ভুস-ভুসে ইঞ্জিন বহুদূর থেকে টেনে টেনে নিয়ে আসে শুধুমাত্র তার জন্য, সে এক অভিযাত্রী বলে। যার জন্য সে সাগ্রহে দাঁড়িয়ে  নিরন্তর অপেক্ষা নিয়ে, সেই রেলগাড়ি যদি রাত-চুরি করা আলোর প্রচণ্ড উজ্জ্বলতায় ভয় পেয়ে কোনোদিন আসবার পথ ভুলে যায়? তাহলে কী হবে?

তার ভিতরে বয়ে চলেছে আজ ভিন্ন প্রবাহ। সে আর দেরি করতে চায় না। ওরা যদি না আসে, না এলো। তাতে ওর এতকালের বিশ্বাস, ভালোবাসা, নমনীয়তা আর মানবিক বোধে কোনো ঘাটতি পড়বে বলে মনে হয় না। এমনতর ভাবনারা যখন ওকে ঘিরে জড়িয়ে ক্রমশ একটা সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে শুরু করেছে, দৈত্যাকার কালো ইঞ্জিনের হুইসলটা তীব্র কুউউউউ শব্দে যাবতীয় নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে খানখান করে দিল। ভেঙ্গে ছত্রখান হলো তার ভাবনার পেয়ালা পিরিচ। ঠিক তখনই ভুস-ভুস করে ইঞ্জিনের নাক মুখ দিয়ে সাদা সাদা বাষ্পের ছোটো ছোটো কুণ্ডলীগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করল। রেলগাড়ির কামরাগুলো হাল্কা দুলে উঠল যেন। যে কিনা ট্রেনের কামরা ভিতরে ছায়া খুঁজছিল, যে কিনা ভাবছিল এবার অপেক্ষা শেষ করার কথা, যার ভাবনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিল দিগ্বিদিকে, সে ত্বরিতগতিতে উঠে দাঁড়াল। মানুষ বিপন্ন হলে যেমন জাগতিক সব কিছু নিমেষের মধ্যে জড়ো করে নিয়ে নিশ্চিত বা অনিশ্চিত, যে কোনো লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনই ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো সে আছড়ে পড়ল, দুলতে দুলতে এগিয়ে যেতে চাওয়া ট্রেনের কামরায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরেধীরে উঠে দাঁড়াল সে, সদ্য সচল হওয়া রেলগাড়িটার অভ্যন্তরে। তার ডান থেকে বাঁদিক, কামরার ভিতরে যতদূর পর্যন্ত একটা নিখুঁত সরলরেখা বাধাহীন টানা যায়, ততদূর শুধু হাহাকার, শুন্যতা ভেসে। ওকে দেখে কিছু তখন কিছু হাওয়ারা জড় হয়। তাতে আরও কিছু হাওয়া মিলে দলে ভারি হয়ে কামরার ভিতরে এক গুঞ্জন তোলে- ট্রেটর! …… ট্রেটর! …… ট্রেটর! ……… শব্দটা ক্রমশই ভারি হতে থাকে আর কী আশ্চর্য, ওই লালচে ডুমো ডুমো আলোর নীচে সে যে বিস্ফোরিত চোখে দাঁড়িয়ে থেকে যায়, তাতে তার  অবয়ব থেকে স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ কোনো ছায়াই কিন্তু জন্ম নেয় না।

হঠাৎ প্রকাণ্ড এক বাজ পড়ল কোথাও, বিনা মেঘে বজ্রপাত। কাছেই এক পলস্তারা খসা বাড়ির গা থেকে আরও কিছু আস্তরণ খসে গেল। এক রুগ্ন বয়স্কা মহিলা আধো ঘুমে বাজ পড়ার আওয়াজ ছাড়িয়েও যেন বাতাসের কথা শুনতে পেলেন। সধবা না বিধবা, আলাদা করে কিছু বোঝা যায় না এখন। যে কথা শুনে শুনে তাঁর কান ভোঁতা হয়ে গেছে, সে কথায় তিনি শুধু পাশ ফিরে শুলেন।

এই বিশ্বাসঘাতক শব্দটা বড়ই প্রাচীন। আদি অনন্তকাল থেকে মানুষ সেটা জানে। ঐ মহিলা যেমন সেটা জানেন, তাঁর শ্বশুর-মশাই আর শাশুড়িও তেমন জানতেন। এটা বেশ ভালো জানে রাষ্ট্র-যন্ত্র আর জনগণ; জানে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অনুসারী যারা আর কিছু অবুঝ ছেলেপুলের দল। তারা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে জানে এই শব্দটার মাহাত্ম্য। প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত হয় যখন যেমন, তখন তেমন, যাকে কেউ সুবিধাবাদী অবস্থান বলে চিহ্নিত করে, কেউ প্রাজ্ঞতা। অথচ কী আশ্চর্য কথা, এইসব অবস্থানের বিবিধতা সে বুঝতে চাইত না। সে তো ছিল স্বপ্নমোহে। স্বপ্নভঙ্গের জন্য অন্যের দিকে আঙুল তোলা তত্ত্ব সে মানত না। বলত, আগে তো বিশ্বাস অন্তরে চাই- আমার তোমার শিকড়ে, গভীরে সে রস পাক, হাত-পা ছড়াক সহজ আনন্দে। আরও বলত, আগে তো নিজের মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলো সামলাই, তারপর বাইরেটা হবে। সেখানে ছড়াবে ধীরে, মৃদু প্রাকৃতিক সুগন্ধের মতো। সংস্কার- আমূল সংস্কার চাই ভিতরে-বাইরে। লক্ষ্য আর মোক্ষ ভাবনা তার একই অভিমুখে কেন্দ্রীভূত ছিল।

এমন এক একটা মানুষ চিরকাল আম-আদমি্র ভিড়ে মিশে থেকে যায়। হঠাৎ করে যখন হারিয়ে যায় তখন আম-আদমির একজন বলে কেউ খোঁজ রাখে না কিংবা বলা ভালো খুঁজে পেতেই চায় না। সবার আসলে ভীষণ তাড়া। নানান জনের নানান এজেন্ডার ভিড়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। জটিল অঙ্ক কেমন জটিলতর হতে চায়। শুধু দিনদিন এইসব আম-আদমিদের গালের চোয়াল ঠেলে ওঠে, মুখের লাবণ্য ক্ষয়ে যায় কিন্তু চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে ঝকঝক করে। স্বপ্ন এদের মরে না কিন্তু এরা বাঁচে কি? না বাঁচলে সে আজও কেমন করে বেঁচে আছে? কেউ কেউ অবশ্য ভাবতেই পারে, এটা আসলে ওর বিশ্বাসটুকু যা আজও বেঁচে আছে। তাই কি প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে এমন এক রেলগাড়ির জন্য সে অপেক্ষা করে? তবে কি তার প্রতীক্ষার অন্ত্য হবে আজ? ওই যে মহিলা আধো ঘুমে পাশ ফিরে শুলেন, তিনি বিশ্বাসঘাতক তত্ত্বটা খুব ভালো বোঝেন। বারবার একটা মানুষকে সনাক্তকরণে ভুল হতে থাকলে কী হয়, জানেন। কোনো সরকারি হোমরাচোমরা কেউ, সান্ত্বনা দিতে চেয়ে অনেকদিন পর যখন বলে বসেন- মে বী হি ইজ লস্ট ইন ওয়াইল্ডারনেস, তখন কী সুন্দর একটা কবিতার লাইনের মতো শোনায়। ওই তো! উনি কিছু একটা স্বপ্ন দেখতে দেখতে আবার চিত হয়ে গেলেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে তাঁর, খুব বড় একটা গভীর শ্বাস পড়ে গেল।

দীর্ঘ অপেক্ষায় কারও পড়ে থাকা স্বপ্নের অবশেষটুকু নিয়ে, নির্জন আঁধার জড়িয়ে ১৯৭১-আপ প্রান্তরসীমা এক্সপ্রেস, শেষবারের মতো প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল।

 

তারিখঃ এপ্রিল ১১, ২০২২

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse