ফিউজিটিভ
লুৎফুল হোসেন
আবার সেই সমুদ্র। বেড়াতে যাবার ভেন্যু হিসেবে বহুকাল আগেই পচে রদ্দি। তবু ঘুরে ফিরে আসা হয়েই যায় মাঝে মাঝে। এবারের আসাটা অকস্মাৎ এবং অনেকাংশে অনিচ্ছায়। বলা যায় অনুরোধের ঢেঁকি গেলা। নিজের কাজ শেষ হয়ে গেলেও অন্যের কাজে একটু সহায়তার অনুরোধ শেষমেষ প্রসন্ন মনেই গলাধ:করণ করা। কাজের চাপে চ্যাপ্টা হতে হতে সেই তাড়া মাথায় করেই ফিরে যাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ অনুরোধে মনে হলো, চুলায় যাক কাজকর্ম। উইকএণ্ডের দু’দিন নামকাওয়াস্তে কাজটুকুর ছুতায় সমুদ্রের পাড়ে বসে একটু নোনা বাতাস লাগিয়ে আসি গায়ে।
মাঝে বেশ কিছুদিন এমুখো হইনি যদিও। তবু সেই রদ্দি সাগর পাড়। বার বার এসে এসে টান খুইয়েছি যার। তার পরও নিকটবর্তী হতেই তটে এসে আছড়ে পড়া ঢেউ ভাঙা শব্দে শব্দে ভেতরের অনুভূতি পালটে যাচ্ছিল যেন। পূর্ণাঙ্গে পুড়ে যাওয়া কাঠকয়লা থেকে খসে পড়া টুকরো ছাইয়ের মতো খসে পড়ছিলো অন্তর্গত সমস্ত দেয়াল ও প্রতিরোধ। সবটুকু পুড়ে যাবার পর ছাইয়ের যেমন থাকে না বাস্তবিক কোনোরূপ প্রতিরোধ। ঠিক অমনই অসহায় অক্ষম হয়ে উঠছিল অন্তর্গত সত্তা।
চেক ইন সেরে সি-ভিউ রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ফের ঝট করে সমুদ্রের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ার মুহূর্ত থেকে সশব্দে অর্গল ভাঙতে থাকে অন্দরে। এক একটা ঢেউ ফেনায়িত জলরাশি নিয়ে তুমুল প্রতাপে যেনো বালুতটে নয়, আছড়ে পড়ছিলো আমার ভিতরে সযত্নে রক্ষিত মিহি কোনো কাচ পাত্রের গায়ে। থেকে থেকে ঝনঝন শব্দে তার বেপরোয়া ভাঙচুর শুনতে পাচ্ছিলাম ভিতরে ভিতরে।
বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝে উঠবার ন্যূনতম সম্ভাবনাটুকুও নেই। অথচ ভিতরে খরস্রোতা জলের দুর্বার ছলাৎ ছলাৎ। কখনো সেই শব্দ ছাপিয়ে উচ্চকিত ভেঙে পড়া কাচ-দেয়ালের ঝনঝনানি কানে তালা লাগিয়ে দেবার মতো উর্ধগামী হতে হতে এক সময় এম্পলিফায়ারের যেন দয়া হলো। আস্তে আস্তে ভাঙচুরের শব্দ স্তিমিত হতে হতে দূরে বালির উপর নোনাজলের আছড়ে পড়া ভোঁতা আর গুমগুম করা শব্দের সহনীয়তায় এসে থামলো। দিনভর বৃষ্টিতে হিম হওয়া নোনা হাওয়ার চেয়ে হয়তো ফেনায়িত পানপাত্র স্বস্তি আনতে কিছুটা হলেও বাড়তি ভূমিকা রেখেছে।
অকস্মাৎ এই আসার পেছনে কারোই কোনো ভূমিকা ছিল না। আচমকা কলিগ কাম বন্ধু কৌশিক বললো মাত্রই ভিতর থেকে কে যেন সায় দিয়ে দিল, সচেতন আমি কিছু বুঝে উঠতে না উঠতে। হয়তো হাসফাঁস ভাবনা-যন্ত্রণার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি না হোক, কিয়দ পরিত্রাণ খুঁজতে এর চেয়ে ভালো কোনো পথ ছিল না। সেই পথ খুঁজে দিতে নিমজ্জনের জমাট অন্ধকারে আলো ফেলবার মানুষটি বলতে তো কেউই নেই নেই। কেউ নেই এই আঁধারের সন্ধান জানবে, কেউ নেই এই আঁধার থেকে পরিত্রাণের পথে আলো ফেলবে, আরোগ্য না হোক – কিছুমাত্র উপশমের চেষ্টা করবে।
আলোকিত ঝলমলে উদ্যান কিংবা খেলাঘর ছাড়া আঁধারকে কিছুমাত্র সময় দখলে নেবার, মনযোগ টেনে রাখবার সুযোগ দেবে অমন মানুষও হয়ত আজকাল নেই আর এই পৃথিবীতে। অন্ধকারের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা ছাড়া আর পথটাই কী? চারপাশে কাউকেই তো ঝলমলে আলোকঝর্ণার উৎসব ছাড়া অন্য কোনো উপলক্ষে কাছে ডাকিনি কখনো। নিয়ত অনভ্যাসের তো অপারঙ্গমতার আঁতুরঘর ছাড়া অন্য কিছু হয়ে উঠবার সম্ভাবনা নেই, কোনো অভাবনীয় অলৌকিক ছাড়া।
বন্ধুরা সকলে গ্লাসভর্তি পানীয় সাজানো রঙিন টেবিলটাকেই বোধকরি ভালোবেসে ফেলেছিল আমার চাইতে বেশি। আজ তাই আমি না থাকলেও ওই টেবিলটার কাছে তাদের নিত্য যাতায়াত, অব্যাহত উৎসবমুখর জমায়েত। জানা হয়নি তাদের কারো আদৌ এই অধমের কথা মনে পড়ে কি-না! শুধু এটুকু জানি, শুভ্রর ভিতর থেকে কোনোদিনই মুছে যাবে না আমার নাম। তবে হাজার মনে পড়লেও এই নামখানা উচ্চারণ সে কোনোদিনই করবে না। এ নিয়ে কিছুমাত্র দ্বিধা বা সন্দেহ আমার নয়, অন্যদেরও নেই।
শেষ বিকেলে পৌঁছে সন্ধ্যার সমর্পণটুকু আত্মস্থ করার পর মনে হলো, ডিনারেই দেখাটা সেরে ফেললে কাল হয়ত সামান্য কিছু কাগজ আদান-প্রদানে মিটে যাবে দায়িত্ব। তাতে অপেক্ষার পালে অসমাপ্ত কাজের বাতাস পালে বেশি তোড়জোড় করবার সুযোগ পাবে না। কৌশিক কোনো নাম দেয়নি। হঠাৎ কথায় নামটা জানতে পারেনি। শুধু বলেছে এই হোটেলটার নাম। সিডব্লুসি থেকে যারাই এখানে আসে, এই হোটেলটাতেই ওঠে। প্রজেক্ট ইন-চার্জ কে? এই প্রশ্নটা করলে রিসেপশন থেকেই সংযোগ ঘটিয়ে দেবে। সহজ সমীকরণটুকু হাতে করেই চলে আসা।
লবিতে নেমে খানিক দাঁড়িয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম ভীড় নেই এখন এই হোটেলটায় সামান্য কয়জন মানুষ বসে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রিসেপশনে গিয়ে বলতেই জানালো হ্যাঁ, আছেন উনি গত চারদিন ধরেই। এক সপ্তার বুকিং দিয়ে এসেছেন। মিস চৌধুরী, সিডব্লুসি-র প্রজেক্ট ডিরেক্টর। বললাম, জানাবেন আমি, আশেক রহমান, এইচএণ্ডবি হেড অফিস থেকে মি. কৌশিক আহমেদের কিছু কাগজপত্র দিতে এবং নিতে এসেছি।
ফ্রন্ট ডেস্কের পরিপাটি মেয়েটা তার চেয়েও পরিপাটি করে বললো, জ্বি উনি মানে মি. রহমান একটু আগেই চেক ইন করেছেন। লবিতে আছেন। আমি ইশারায় পুল সাইডের একটা টেবিল দেখিয়ে বললাম, ওখানটায় আছি আমি। চোখের ইশারায় বুঝে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে মেয়েটা বললো, জ্বি উনি পুলসাইডে বসছেন।
ব্যস, সহজেই প্রাথমিক কথা বলার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি টেবিলে গিয়ে পুলের দিকে মুখ করে বসলাম। অপেক্ষার সময়টা কাটাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে পুলের মাঝখানের ফোয়ারাটা থেকে জল ছড়িয়ে যাবার দৃশ্যটা মুখস্ত করতে থাকলাম।
ধারণার চেয়ে দ্রুতই ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা এগিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বললো, এই যে ইনি। আমি ঘুরে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কুড়ি বছরের ব্যবধানে সেই চেনা মুখ সেই খামখেয়ালি পারিপাট্য, সুরমা রঙের একটা সুতি শাড়ি অমনই পাট ভাঙা যত্নে পরা। সামান্য কয়টা চুলে ধূসরতার ছোঁয়া ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। চশমার কাচের আড়ালে তার চোখ দুটোতে বিস্ময় ছলকে ওঠা দৃষ্টি এড়ালো না। স্বাভাবিক অভ্যস্ততায় উঠে দাঁড়িয়ে গ্রিট করলাম, বসতে বললাম। ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা চলে যাবার পর লম্বা সময় দুজনই নৈঃশব্দের আঙিনায় স্মৃতির পাতা মেলছিলাম। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত, আমার মতো সে-ও তা-ই করছিল।
ওয়েটার অর্ডার নিতে এলে সেই নৈঃশব্দ্য ভাঙলো। আমি শুধু বললাম, কী দিতে বলবো? নিজে থেকেই বললো সে, ক্লিয়ার ভেজিটেবল স্যুপ আর ফ্রুট সালাদ। আমি দুখানা বিয়ারের সাথে একটা গার্লিক মাশরুম আর ক্যাশুনাট স্যালাদ দিতে বললাম।
ওয়েটার চলে যেতে শুধু জিজ্ঞেস করল, এলকোহল এখনও নৈমিত্তিক? আমি অল্প হেসে বললাম, লঙ আইল্যাণ্ড আইসড টি এখন বিয়ারে নেমে এসেছে। এটুকুই। ফের আমরা কথা না খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই ডুবে থাকলাম। খাবার দিয়ে গেলে নড়াচড়ার সুবাদে মনে হয় নীরবতাও বিরতি নিল।
আমি কাজের কথাগুলো বললাম। কৌশিক যা যা বলেছিল। বললাম, কাগজপত্র কাল দুপুরের মধ্যে গুছিয়ে দেবো। তখন তার কাগজপত্রগুলো বুঝে নেবো। বললো, কাল বাইরে কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে তিনটা বাজবে। তারপর দেখা হবে, এখানে লবিতেই।
হাল্কা মেন্যুর ডিনার শেষ হতে খুব একটা সময় লাগল না। কথারা খুব একটা ফুরসত পেল না এর মাঝে। শেষে একটা গ্রিন টি চেয়ে নিয়ে সে শুধু বললো, ফ্যামিলি ছেলেমেয়েরা কোথায় কেমন? আমি হেসে বললাম ওদের দেখা এখন অব্দি পাইনি। আমি জানি আমাদের উত্তুঙ্গ সময়ের শেষ প্রান্তে অকস্মাৎ ওর যখন পিএইচডি স্কলারশিপ এলো, ও তখন অপেক্ষার পাল গুটিয়ে ডানা মেলতে উন্মুখ ছিল। তাই সেদেশে ইটালিয়ান সহপাঠীর সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে তার সময় লাগেনি খুব একটা। ওটুকুই। এরপর আর কখনো জানার চেষ্টাও করিনি।
আমার প্রশ্নহীন গোনাগাঁথা কথার পিঠে উঠে যাবার সময় শুধু বললো, আমিও একাই। তুমি হয়ত অনেক গল্প শুনেছো। গল্পগুলো আসলে গল্পই ছিল। শুধু শুরুর সেই সময়ের ক্যারিয়ারিস্টিক ভাবনাগুলো একে একে জীবনের নানা মোড়ে জেগে ওঠা চরে আটকা পড়ে গেছে। এক সময়ে বাবা-মা আর বড় আপা চলে যাবার পর আপার মেয়েটার টানে আর দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছায় ডোনার এজেন্সি লিংকগুলো নিয়ে দেশে চলে এসেছি।
শূন্য টেবিলে জলপতনের শব্দ আর আমার তেষ্টা পাওয়া গলায় আরো কয়টা বিয়ার ঢালতে ঢালতে বসে থাকলাম সার্ভিস আওয়ার শেষের পরও অনেকটা সময়, শূন্য লবিটায় স্মৃতির নিউরন ছড়িয়ে দিতে দিতে।
রাতটা ভালো ঘুম হয়নি। পরদিন তিনটার আগেই কৌশিকের সাথে কথা অনুযায়ী কাগজগুলো গুছিয়ে একটা ফাইল খামবন্দি করে ফ্রন্ট ডেস্কে দিয়ে রাখলাম মিস চৌধুরীর জন্য। আর বললাম উনি যা কিছু দেবেন তা আমার ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিতে। প্ল্যান পালটে পরের রাত না থেকে দুপুরেই চেক আউট করলাম। একটু স্বস্তির জন্য সাগরপাড়ে আসার বদলে ভিতরে ধ্বংসস্তূপ নিয়ে ফিরে চললাম।
ফিরে চললাম না বলে বলা উচিৎ, পালাতে চাইলাম অতীত গহ্বরে নিমজ্জিত হতে থাকা থেকে বাঁচতে। এভাবেই তো বেঁচে আছি। পলাতক আমি। জীবন থেকে, স্মৃতি থেকে, অতীত থেকে, অপূর্ণতা থেকে, সঞ্চিত সমস্ত ভুল থেকে, সত্যের খড়গ থেকে, প্রতিনিয়ত শুধু পালিয়েই তো বেড়াচ্ছি।
তারিখঃ জুলাই ৫, ২০২১