বরুণদেবের রাজপাটে

প্রতিবার আমি সুমন্ত্র আর অরূপ তিনজনেই ঘুরতে বের হই। কিন্তু অরূপের বিশেষ অসুবিধা থাকায় এবার বের হতে পারছে না। ওর জায়গায় ঋতম যাবে, ঋতম আমার ছোট ভ্রাতৃসম। ঠিক হলো নতুন কোথাও যাব ভিড়-ভাড় থেকে দূরে। মেঘালয় আর বাংলাদেশের বর্ডার ব্যালাট বা বেলাট। ওখানে থাকার হোটেল পাব কি না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই তিনজনের জন্য একটা টেন্ট আর কিছু ড্রাই ফুড সঙ্গের সম্বল। তিনটে বাইকে নির্দিষ্ট দিনে গুয়াহাটি থেকে ভোরবেলা যাত্রা শুরু হলো। গুয়াহাটি শহর পার করেই শুরু হলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। যদিও শিলং পর্যন্ত ফোর লেন রাস্তা। পাহাড়ের চুড়ো থেকে সূয্যি মামা সবে উঁকি মারছেন। সকাল সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নংপো। শিলং গুয়াহাটির মাঝামাঝি জায়গায় এই নংপোর অবস্থান। ছোট্ট এক পাহাড়ি শহর। শহরের সীমা ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে এক রেষ্টুরেন্টে পরোটা, মিষ্টি, চা সহযোগে ব্রেকফাষ্ট সেরে নিলাম। কিছুদূর চলার পর পৌঁছলাম বড়াপানি। রাস্তার পাশে বিশাল এক হ্রদ (উমিয়াম লেক) যার জন্য স্থানীয়দের দেওয়া নাম বড়াপানি। পাশেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।  হ্রদের পাশে পথিকদের বসার ব্যবস্থা, কিছু চায়ের এবং ভাজাভুজির দোকান। হ্রদের জলে প্রথম রোদের কিরণের খেলা চলছে। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখার জন্য আমরাও থেমে গেলাম। দাঁড়িয়েই যদি গেলাম চা’টাই বা বাদ থাকবে কেন। চা পর্ব শেষ করে আবার চলা শুরু। শিলং শহর ঢোকার আগেই আমরা ডানদিকের পথ ধরে নিলাম। একটু এগিয়েই বাঁদিকে চলে গেছে শিলং পিকের রাস্তা, আজ আর আমরা ঐ পথ ধরছিনে। সোজা রাস্তায় গিয়ে এরারফোর্সের এরিয়া পার করে বাঁদিকে চেরাপুঞ্জীর পথ। আগে যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হত। কিছু বৎসর যাবৎ সেই শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে মৌসীনরাম । আমরাও সোজা এই মৌসীনরাম পথেই চলতে থাকলাম। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো ছবির মতো পাহাড়ি গ্ৰাম। পরপর পাথর সাজিয়ে বাড়ির ঘের দেওয়া। ঘেরের ভিতর সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। উঠোনে রান্নার বাসনকোসন রোদে দেওয়া রূপার মতো চকচক করছে। খাসিয়ারা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির এক পাশে জ্বালানী কাঠ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। প্রতিটি বাড়ি দেখলেই মনে হয় এদের সৌন্দর্যবোধ আছে। সামনেই বরুণ দেবতার রাজধানী মৌসীনরাম আগে একসময় বরুণ দেবতার রাজধানী চেরাপুঞ্জী ছিল এখন মৌসীনরাম। রাস্তা থেকেই আমাদের স্বাগত জানাতে বরুণ দেবতা ওনার দূত পাঠিয়ে দিয়েছেন। দূতের নাম মেঘ। বড় এক টুকরো মেঘ আমাদের আলিঙ্গন করে চলে গেল। চারদিকে কিছুই দেখতে পারছি না। বাইক নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। আলিঙ্গন পর্ব শেষে দেখা গেল আমাদের সবার গায়ের উইণ্ডচিটার ভিজে গেছে। এই অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করার ভাষা নেই। মৌসীনরাম ঢোকার মুখে বাঁ’দিকে পথ চলে গেছে সয়ম্ভু শিব মন্দিরে। ভাবলাম শিব লিঙ্গ দর্শন করে যাই। এখানে কোনো মন্দির নেই, বিশাল এক পাথরের নীচে শিব লিঙ্গ, লিঙ্গের ঠিক উপরেই স্তনের মতো ওখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল চুঁইয়ে ঠিক শিব লিঙ্গের মাথায় পড়ছে। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার ব্যালাটের পথ ধরলাম। মৌসীনরাম এসেছি আর বরুণ দেবতার কৃপা পাব না তাই কি হয়! শুরু হলো বৃষ্টি, বাইক দাঁড় করিয়ে রেইনকোট পড়তে বাধ্য হলাম। মৌসীনরাম বাজার এলাকা পার করেই এবার উৎরাই। কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হলো জঙ্গল। পথের অবস্থাও তথৈবচ। একে সরু রাস্তা তার উপর এবড়ো খেবড়ো। এদিকে পথের পাশে কোন চায়ের দোকান পাওয়ারও জো নেই। বিকেল তিনটে নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম ব্যালাট বাজার। বেশ কিছু ছোট ছোট দোকান নিয়ে এই বাজার। সবই টিনের চালা দেওয়া ঘর। বাজার এলাকা খুবই ঘিঞ্জি। একজায়গায় বাইক রেখে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে সরু গলি দিয়ে ঢুকে একটা ছোট হোটেল পাওয়া গেল। একচালা ছোট ঘরে দু-তিনটে বসার বেঞ্চ, এটাই হোটেল। ভাত, ডাল, ভাজা আর মাছের ঝোল, তবে সব কিছুতেই এতো ঝাল সেটা আর বলার নয়। কোনমতে ক্ষুধা দমন করার জন্য একটু খেয়ে নিলাম। বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ভারত – বাংলাদেশ বর্ডার। ব্যালাট জায়গাটা মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে, এর পর থেকেই সমতলে বাংলাদেশ শুরু। বাজার থেকে উঁচুনিচু পথে কিছুদূর গিয়েই কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশ দিয়ে বি. এস. এফ – এর টহল দেওয়ার পাকা রাস্তা। এদিকে ভারতের তরফে কাঁটাতারের বেড়া, নোম্যান্স ল্যাণ্ডের ওদিকে বাংলাদেশের বেড়াও দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভেতরে ঢোকার গেট রয়েছে। নোম্যান্স ল্যাণ্ডের দুপাশের লোকেদেরই জমি থাকায় তারা সকালে গেটে নাম লিখিয়ে ঢুকে যায় চাষ – আবাদ করতে, আবার বিকেলে ফিরে আসে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার নোম্যান্সল্যাণ্ডে একটা অস্থায়ী হাটের জায়গা আছে। যেখানে প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে। সেদিন দুপাশের দোকানদার এবং খরিদ্দার সবাই সেই হাটে কেনাবেচা করতে আসে। ঐ দিন সবাই হাটে কেনাবেচার সঙ্গে সঙ্গে ওপারে থাকা তাদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে যায়। আমাদের ইচ্ছে ছিল সেই হাটে যাওয়ার, কিন্তু আমরা গিয়েছিলাম শনিবার যার জন্য হাট দেখা হলো না। বর্ডারের পাশে টিলার ওপর ছোট ছোট বাড়ি। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে, কোথায় থাকব তার ঠিকানা নেই। ওখানেই গ্ৰামের এক ভদ্রলোক নির্মল বর্মনের সঙ্গে পরিচয় হোল। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারলাম রাতারাতি দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় এই গ্ৰামের অনেকের নিকট আত্মীয়ের বাড়ি ঐ দেশে চলে গেছে। যার জন্য একমাত্র হাটের দিনটাতেই সবার সঙ্গে দেখা হয়।

 

যেহেতু কোন হোটেল নেই তাই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, রাতের মতো আপনার বাড়িতে থাকা যাবে কিনা? ভদ্রলোক জানালেন, থাকতে দিতে অসুবিধা নেই তবে ওনাদের থাকার একটাই ঘর। আমরা বললাম, তার জন্য কোন অসুবিধে নেই আমরা উঠোনে একটু জায়গা পেলে তাবু টাঙিয়ে থাকতে পারব। শুধু রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভদ্রলোক রাজি হলেন। এমন সময় দুজন বি . এস . এফ এর জওয়ান আমাদের দেখে কাছে এসে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। বি. এস. এফ এর জওয়ানের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সেই গ্ৰামের ভদ্রলোক একটু দূরে চলে গেলেন।

 

হয়তো স্থানীয় লোকেরা বি. এস. এফের লোকদের একটু সমীহ করে চলেন। বি. এস.  এফ – এর লোকটি আমাদের গ্ৰামের লোকটির বাড়িতে থাকার কথা শুনে প্রথমেই মানা করে দিলেন। ওনার বাড়ি, বর্ডার এলাকায় হওয়ায় চোরাকারবারীর সন্ধানে রাতে বি. এস. এফ – এর লোকেরা হঠাৎ হঠাৎ গ্ৰামের বাড়ি গুলোতে খানাতল্লাসি চালায়। সেক্ষেত্রে আমাদের দেখলেও হয়ত রাতে ঝামেলা করতে পারে। তাই বি. এস. এফ – এর লোকটি আমাদের পি. ডব্লিউ. ডি – র গেষ্ট হাউসে নতুবা ওনাদের ব্যারাকের পাশে ছোটো শিবমন্দিরের পাশে টেন্ট টাঙিয়ে রাত কাটানোর পরামর্শ দিলেন। পথে আসতে আসতে বি. এস. এফ – এর একজন অফিসার ও আমাদের একই উপদেশ দিলেন। ভদ্রলোক সঙ্গের জওয়ানটিকে পি. ডব্লিউ. ডি – র গেষ্ট হাউস দেখিয়ে দিয়ে চৌকিদারকে বলে দিতে বললেন। আমরাও বাইক নিয়ে সেই জওয়ানের সঙ্গে বাইক নিয়ে চললাম। রাস্তা থেকে একটু দূরে ছোটো টিলার ওপর গেষ্ট হাউস। চারদিকেই বড় বড় গাছপালা। দিনের বেলা’ই কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। গেষ্ট হাউসের চৌকিদার আমাদের ঘরটি দেখিয়ে দিলেন। নামেই গেষ্ট হাউস, তৈরী হওয়ার পর থেকে মনে হয় কোনওদিন কোন গেষ্ট এখানে থাকেনি। শুধু দুটো রুম আর একটা বাথরুম আছে। রুমে না আছে কোন আসবাব না কোন বিছানা। রুমের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করারও কোনো ব্যবস্থা নেই, বাথরুমেও তাই। ইলেকট্রিকের তো কোন কানেকশনই নেই। আর থাকলেও কোন কাজে আসত না, কারণ এখানে সন্ধ্যার পর কোন দিনই  ইলেকট্রিসিটি থাকে না। মেঝেটা চৌকিদার একটু ঝাড়ু দিয়ে দিলেন। মেঝেতেই আমাদের স্লিপিং ব্যাগ পেতে শুতে হবে। মেঝেতে পাতার মতো কোনও মাদু্রও নেই। বারান্দায় তিনজনের বাইক রেখে জায়গাটা দেখতে বের হলাম। উঁচু নীচু রাস্তার দু’পাশে ছোটো ছোটো বাড়ি, কিছুটা দূরে একটা গীর্জাও  চোখে পড়ল। গেষ্ট হাউস থেকে একটু দূরেই ছোটো এক চায়ের দোকান। এখানে অর্ডার দিলে ভাতও বানিয়ে দেয়। আর কোনও বিকল্প উপায় না থাকায় তিনজনের জন্য রাতের খাবার অর্ডার দিয়ে এলাম। দোকানের উল্টো দিকেই এক ভদ্রমহিলা সব্জীর দোকান করছিলেন। এখন দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরবেন, আবার সকালে বসবেন। ওনার কাছ থেকে দুটো মাদুর রাতের জন্য চেয়ে নিলাম। গেষ্ট হাউসে ঢুকে মাদুরের ওপর তিনজনের স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে রেখে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম হোটেলে। খাবার তৈরী হয়ে গেছে। ডাল, ভাত, একটা সবজি আর ডিমের ওমলেট। এখানে এই খাবার রাজকীয় খাদ্যই বলতে হবে। গেষ্ট হাউসে এসে বাইক তিনটেও রুমে ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার উপায় না থাকায় বাইক তিনটে দিয়ে দরজা চাপা দিয়ে দেওয়া হলো। পাশেই জঙ্গল কোন জীবজন্তুও ঢুকে যেতে পারে। নিদেনপক্ষে শেয়াল ঢুকেও পা ধরে টানাটানি করতে বাধা নেই। জানালার কাচ না থাকায় ডিসেম্বর মাসের পাহাড়ি ঠাণ্ডা হু হু করে ভেতরে ঢুকছে। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছি একদিকে শেয়াল আর অন্যদিকে কুকুরের কোরাসের যুগলবন্দী। ভোর থাকতে উঠে বেরিয়ে গেলাম প্রাতঃভ্রমণে। ভোরবেলাতেই চায়ের দোকান খুলে গেছে, আমরাও  চা পান করে এসে তৈরী হয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে চৌকিদারও এসে গেছে। ওর হাতে কিছু বখশিস দিয়ে গেষ্ট হাউস ছেড়ে পথে নামলাম। তার আগে গতকাল রাতের চায়ের দোকানে তিনজনের জন্য রুটি সব্জী তৈরী করতে বললাম। বসে বসে রুটির জন্য অপেক্ষা করছি আর অন্যান্য খদ্দেরের খাওয়া দেখছি। এখানের স্থানীয় লোক খাসিয়ারা এবং বাঙালিরাও সকালের ব্রেকফাষ্টে দেখলাম ভাত খাচ্ছে। ছোটো এক থালা ভাতের স্তুপের ওপর এক টুকরো মাংস আর একটু ঝোল দিয়ে দিচ্ছে। আর সবাই প্রথমে চারপাশ থেকে সাদা ভাত চামচ দিয়ে খেয়ে শেষে মাংসের টুকরো চিবিয়ে উঠে যাচ্ছে। দুই গোষ্ঠি মিলেমিশে এখানে এক সুন্দর মিশ্র সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে। অনেকক্ষণ ওদের এই খাওয়া দেখলাম। আমাদের রুটি সবজিও তৈরী। শেষে এক কাপ করে চা খেয়ে বাইকে ষ্টার্ট দিলাম। এবার আমাদের যাত্রা ডাউকি বর্ডার।

 

গতকাল এই পথই ছিল উৎরাই আজ চড়াই উঠতে হচ্ছে। এবড়োখেবড়ো পথে বাইক চড়াই উঠতে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। আজ দূরত্ব যদিও বেশি নয় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার কিন্তু এই চল্লিশ কিলোমিটার উঠতেই অনেক সময় লেগে যাবে। এই পথে গাড়ি খুবই কম চলে। একসময় চড়াই শেষ হলো। মৌসীনরাম পার করে পথের পাশে চা দোকানে বাইক দাঁড় করালাম। জায়গাটা পাহাড়ের উপর অনেকটা টেবিল টপ মতো। খুবই সুন্দর। ডিমের অমলেট আর চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। এবার সোজা ডাউকি।

 

আজ ডাউকিতে পর্যটকদের প্রচুর ভিড়। গাড়ি রাখার জায়গা নেই। একে সরু রাস্তা তার উপর এতো গাড়ি। তবু আমাদের বাইক হওয়ায় সুবিধে হয়েছে। কোনমতে ফাঁকফোকর দিয়ে ঝর্ণার উপরের ব্রীজ পার করে ওপার সোজা চলে গেলাম তামাবিল বর্ডার। বাংলাদেশ ঢোকার জন্য কাষ্টম এবং ইমিগ্ৰেশন অফিস রয়েছে। একদিকে লম্বা ট্রাকের লাইন, সব বোল্ডার নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায়। বাইক কাষ্টমস অফিসের সামনে রেখে সবাই গেটের কাছে চলে গেলাম। এদিকে ভারতের গেট ওদিকে বাংলাদেশের, দুই গেটের মাঝে একশো মিটারের মতো ব্যবধান। দু’গেটের ঠিক মাঝে সিমেন্টের চৌকোনা পিলার, পিলারের গায়ে এদিকে বাংলাদেশ আর ওদিকে ভারত লেখা। পিলারের কাছে পর্যন্ত দু দেশের লোকই যেতে পারে। ওখানে দাঁড়িয়ে এই দেশের লোক ঐ দেশের লোকের সঙ্গে বার্তালাপ করতেও অসুবিধা নেই। তবে দু দেশের বর্ডার ফোর্সই সবার ওপর নজর রাখে, যাতে এক দেশের লোক অন্য দেশে ঢুকে যেতে না পারে। সবাই সীমানা পোষ্টের সামনে দাঁড়িয়ে ফোটো তুলছে। আমরাও ব্যতিক্রমী হলাম না। আমাদের সঙ্গে ফোটো তোলার জন্য বাংলাদেশের একটি পরিবার এগিয়ে আসায় আমরাও তাদের সঙ্গে ফোটো তুললাম। এখানে এলে মনে হয় দু’দেশের লোকের সব কিছুতে এত মিল থাকা সত্ত্বেও শুধু কিছু লোকের রাজনৈতিক লাভালাভের জন্য দুই দেশকে কত দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যাক! এখন এসব ভাবতে গেলে ভ্রমণের আনন্দটাই বিরক্তিতে ভরে উঠবে। সেই পরিবারের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলে ওখান থেকে চলে এলাম ডাউকিতে ঝর্ণার  কাছে। পাহাড়ের ঝর্ণার জল ব্রীজের নীচে একটা লেকের আকার নিয়েছে। আবার লেকের জল বাংলাদেশে নদী হয়ে ঢুকে গেছে।

 

নদীর একপাশে বাংলাদেশের লোক দাঁড়িয়ে, ভারতের দিকের পর্যটকদের লেকে বোটিং করা দেখছে। বাংলাদেশের লোকেরা এদিকে বোটিং করতে পারে না ওদিকের নৌকাকে বি. এস. এফ – এর লোকরা ঢুকতে দেয় না। ভারতের দিকের বোটিং এর জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই সুন্দর। লেকের এক পাশে একটু বালির চর অন্যপাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল। নদীর উপর দিকে ঝর্ণা, লেকের জল এতো স্বচ্ছ যে অনেক গভীরের পাথর মাছ সব স্পষ্ট দেখা যায়। দূর থেকে লেকে ভাসমান নৌকার ছবি তুললে মনে হয় নৌকোটা শূন্যে ভাসছে। নদীর চরে বাঁশ দিয়ে তৈরী একটা ছোট সুন্দর রেষ্টুরেণ্ট রয়েছে। তার পাশে অনেক তাঁবু খাটানো, পর্যটকরা ইচ্ছে করলে ভাড়া করে তাঁবুতে রাত কাটাতে পারেন। আমরা তিনজনে একটা নৌকা ভাড়া করে কিছুক্ষণ লেকে ঘোরাঘুরির পর চরের রেষ্টুরেন্টে মোমো আর চা খেয়ে ফিরে এসে নৌকা ছেড়ে দিলাম। একদিকে ভারতের লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাশেই বাংলাদেশের লোকও ঘোরা ফেরা করছেন। বাংলাদেশের দিকে অনেক মুখরোচক খাবারের দোকান। আমরা হুট করে বাংলাদেশের এরিয়ায় ঢুকে কুলের আচার কিনে আনলাম। বি এস এফ আর বি ডি আর এর লোকরা সব সময় নজর রাখছে কে কোন দিকে যাচ্ছে তাদের আবার ডেকে ঘুরিয়ে পাঠাচ্ছে। নদীর পার থেকে উঠে বাইকে স্টার্ট দিয়ে চললাম মেঘালয়ের আর একটি গ্ৰামে যেটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সব থেকে পরিষ্কার গ্ৰামের খেতাব অর্জন করেছে।

পাহাড়ের ঢাল দিয়ে পাকা সরু রাস্তা। রাস্তার দু’পাশেই থরে থরে সুপারি গাছ। রাস্তাটা ভারতের দিকে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে, নিচে বাংলাদেশের জমি। পাহাড়ের ঢালে মাঝে মাঝে বি. এস. এফ – এর ছোট ছোট নজরদারির ক্যাম্প। ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে পথ। এক জায়গায় মোড় ঘুরতে গিয়ে আমার বাইকের পেছন চাকা স্লিপ করে সাইডে চলে গেল। অনেক কসরত করে বাইক কণ্ট্রোল করলাম।  জঙ্গলের জন্য অন্ধকার আরো গাঢ় মনে হচ্ছে। রাস্তাও ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছি না, জিজ্ঞেস করার মতো লোকও নেই। অনেক ঘুরপাক খেয়ে শেষে গিয়ে উপস্থিত হলাম মাওলাইনং গ্ৰামে। খুঁজে খুঁজে রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে একটা হোমস্টে পেয়ে গেলাম। বাঁশের মাচার উপর সুন্দর একটা তিন বিছানার রূম, সঙ্গে এটাচড বাথরুম। এখানে প্রচন্ড ঠাণ্ডা। তিনজনের জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। সুমন্ত্র আর ঋতমের জন্য মাংস ভাত আমার জন্য নিরামিষ। পরদিন খুব ভোরে উঠে গ্ৰাম দেখতে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দু’পাশে একটু পর পর নোংরা ফেলার জন্য বাঁশের তৈরী শঙ্কু আকৃতির ঝুড়ি। এটা পুরোপুরি প্লাষ্টিক বর্জিত এলাকা। গ্ৰামের লোকেরা নিজেদের তত্ত্বাবধানে পুরো এলাকা পরিষ্কার করে রাখেন। চায়ের দোকান এখনও খোলেনি। গ্ৰাম ঘুরে এসে হোমস্টেতে চা খেলাম। সকাল আটটা নাগাদ রুটি, সব্জী আর ওমলেট দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করে হোমস্টের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে একেবারে বের হয়ে যাব। হোমস্টে থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে ছোট ঝর্ণার উপর রুট ব্রীজ। পাহাড়ি ঝর্ণার দু পাশে দুটি গাছের শিকড় বেড়ে প্রাকৃতিক ব্রীজ হয়ে গেছে। ব্রীজের ওপর দিয়ে এখন অনায়াসে লোক ঝর্ণা পারাপার করতে পারে। তবে ব্রীজ দেখতে যাওয়ার জন্য অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়। এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা।

তারিখঃ জুলাই ৬, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse