বসন্ত বউরি

সেই নাম না জানা পাখিটা আজো এসে বসেছে পুকুরপাড়ের পেয়ারা গাছটাতে। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে খাচ্ছে পাকা পেয়ারা। দোতলা বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে আছে রেশমী। এমন অদ্ভুত সুন্দর পাখি কখনও দেখেনি সে। শরীরের রঙ ঘন সবুজ,  কাকের মত গোল গোল কালো চোখ, চোখের চারপাশে হলুদ, ঘাড়ে ধুসর রঙের উপর কালো ডোরা। ঠোঁটের পাশে লাল ছোপ।

আজ রেশমী প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। হাতে ডি.এস.এল.আর ক্যামরা, ফটোগ্রাফী শেখার চুড়ান্ত পরীক্ষা দেবে বলে মুখিয়ে আছে।  পাখিটা এসে গাছে বসতেই টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তারপর গুগলে সার্চ দিতেই বেড়িয়ে এল নামটা।

বসন্ত বউরি।

কি সুন্দর নাম। রেশমী ভাবে যেমন সুন্দর পাখি তেমন তার নাম। রেশমী জানতে পারে বসন্ত বউরি নানা জাতের হয়। এই পাখিটা এশীয় গোত্রের অর্থাৎ এশীয় বসন্ত বউরি।

ছবি তোলার আনন্দে রেশমীর মনটা নেচে উঠে। ভুলে যায় এ বাড়ির নতুন বউ সে। গ্রিলের ফাঁকে  হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে, ‘এই পাখি তুই আমার বন্ধু হবি?’

পাখিটাও যেন রেশমীর কথা বুঝতে পেরে ডেকে উঠে কুটরু-কুটরু-কুটরু। যদিও রেশমী জানে বনের পাখি কখনও বন্ধুত্বের শিকলে বাঁধা পড়েনা।

রেশমী বিভোর হয়ে শুনছিল পাখির ডাক। এমন সময় বাড়ির কাজে সহযোগিতা করার মেয়ে কাজলী এসে ডাক দেয়, ‘নুতন বৌদি।’

এমন আনন্দ মুখর সময়ে ডাক দেয়ায় রেশমী একটু বিরক্ত হয় তবুও বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস  করে, ‘কীরে কাজলী?’

‘কাশু গোয়ালা এসেছে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়।’

রেশমীর শশুরবাড়ি অনেক বড়। বাড়িতে কৃষি কাজ, মাছের চাষ, রান্না বান্নার লোকের অভাব নেই। বলতে কি রেশমীকে আজ পর্যন্ত কুটোটি নাড়তে হয়নি। ঘর গৃহস্থালির সবকিছু এখনও শাশুড়ি মা দেখেন।

কয়েক পুরুষের ব্যবসা ওদের। সোনালী কটন মিলের মালিক ছিলেন ওর দাদা শশুর। নিজের মায়ের নামে দিয়েছিল মিলটা। রেশমীর স্বামী টেক্সটাইল ইঞ্জিনীয়ার হয়ে মিলের অনেক আধুনিকায়ন করেছেন। বাড়িতে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। গোয়ালে গরু আছে ডজন দুয়েক। গরুগুলো দেখা শোনার লোক আছে পাঁচজন। কাশু গোয়ালা সেই পাঁচজনের একজন।

রেশমী দোতলা থেকে নীচে নেমে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে কাশু গোয়ালা বরাবরের মত দুহাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, ‘পেন্নাম কর্তা মা।’

প্রথম প্রথম কাশুর মুখে কর্তা মা ডাকটা শুনলে রেশমীর একটু অস্বস্তি হত। বয়স এখনও পঁচিশ পেড়োয়নি,  বিয়ে হয়েছে সবে কয়েকমাস আগে, গেল বৈশাখে। এ বয়সে কেউ  ‘কর্তা মা’ ডাকলে অস্বস্তি  হওয়ারই কথা। যদিও এই বিশাল তালুকদার বাড়ির একমাত্র বউ রেশমী। শাশুড়ি মা অবশ্য আছেন। কাশু গোয়ালা উনাকে ডাকে মা জননী। তবুও কর্তা মা ডাকটা শুনলে কেমন যেন পুরোন আমলের জমিদার বাড়ির গিন্নি বলে মনে হয় নিজেকে।

রেশমীর শ্বশুর বাড়িতে বিরাট রাধাকৃষ্ণ মন্দির। বছর জুড়ে নানা রকম অনুষ্ঠান হয়। আটবছর আগে তেমনি এক অনুষ্ঠানে এসে এখানেই থেকে যায় কাশু বাড্ডা। তিনকুলে কেউ নেই, গলায় তুলসী মালা, নাম সংকীর্তন করতে করতে আকুল হয়ে কাঁদছিল।

রেশমীর শাশুড়ি মন্দিরে গিয়েছিলেন ঠাকুরের ভোগ দিতে, তাঁকে দেখে পায়ের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকে কাশু,’ মা জননী, আমারে আপনার চরণে ঠাঁই দেনগো মা জননী।

রেশমীর দাদা শ্বশুর ছিলেন মহৎ প্রাণ মানুষ। তাঁর কড়া নির্দেশ, আশ্রিতকে কখনও দূরে ঠেলা যাবেনা। আজ তিনি নেই কিন্তু তাঁর সেই নির্দেশ এখনও অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। এ বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যা তাই নেহায়েত কম নয়। তবে কাশু বাড্ডা কেবল আশ্রিত হয়ে থাকতে চায়নি, কৃষিকাজ ভালই জানে সে তবে গো পালনই তার প্রিয় কাজ। রেশমীর শ্বশুর মশাই কাশুকে গোয়ালের কাজে নিয়োগ করেন, আজ তাই কাশু বাড্ডা হয়ে উঠেছে কাশু গোয়ালা।

কর্তা মা ডাকটাতে রেশমীর আপত্তি আছে জেনে রেশমীর শাশুড়ি  একদিন কাশুকে জিজ্ঞেস  করলেন, ‘ও কাশু তুই বৌমাকে কর্তা মা ডাকিস কেন? নুতন বউ লজ্জা পায়।’

কাশু বলল, ‘উনি যেদিন বাড়ি এইলেন তখন উনারে দেইখ্যে আমার কর্তা মা’র কথা মনে পইড়ে যায়। তাই আমি উনারে কর্তা মা বলি।’

শাশুড়ি মা জিজ্ঞেস করেন,’ তা তোর সেই কর্তা মা’টি কে?’

কাশু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ ছেইলেন একজন! আমারে খুব স্নেহ কইরতেন।’

‘এখন কোথায় তিনি?’ শাশুড়ি মা জানতে চান।

‘ নাই, স্বর্গবাসী হইয়েছেন! তাইতে আমি দেশান্তরী হইয়েছি।’

‘ওরে বাবা, কাশু? তোর কর্তা মা’র জন্যে তুই দেশান্তরী হয়েছিস?’

‘ তিনি যে মা ছেইলেন, আপনার মত। মা ছাড়া সন্তান কি কইরে থাকে মা জননী?’

এরপর আর কোন কথা হয়না। কাশু যথারীতি প্রণাম করে চলে গিয়েছিল। কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস  করেনি। তাছাড়া কাশু নিজের সম্পর্কে কিছু বলতেও চায়না।

রেশমীর শ্বশুর মশাই বলেন, ‘ওকে কিছু জিজ্ঞেস কোরনা, নিশ্চয়ই ছেলেটার মনে গোপন কোন ব্যথা আছে। সেই ব্যথাকে উসকে দিয়ে কি লাভ?’

রেশমীও আর কিছু বলেনা। কর্তা মা নামটা থেকেই যায়। বরং এখন কাশুর মুখে কর্তা মা শুনতে ভালই লাগে। আজ বউরি পাখিটির কুটরু-কুটরু ডাক শুনে রেশমী কাশুর মুখের কর্তা মা ডাকটার সাথে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায়।

নিতান্তই সাদাসিধে মানুষ কাশু। সারাদিন গোয়াল আর সন্ধ্যা হলে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে কীর্তন করে সময় কাটে।

কাশুর আচরণ দেখে মনে হয় লেখাপড়া কিছু শিখেছিল সে, হিসাব নিকাশ করতে পারে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর পত্রিকার পাতায় চোখ ডুবিয়ে বসে থাকা কাশুর আরেকটা অভ্যাস। প্রথম পাতার প্রথম অক্ষর  থেকে শেষ পাতার শেষ অক্ষর পর্যন্ত কাশু সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সুর্য ডোবার আগে আগে গোয়াল ঘরে গরুগুলো হাম্বা স্বরে ডেকে উঠলে কাশু পত্রিকা রেখে গোয়ালে যায়।

‘পেন্নাম মা জননী।’ কাশু আবার হাত জোড় করে মাথা ঝোঁকায়। রেশমী দেখে শ্বাশুরি মা এসেছেন,’ কিরে কাশু কিছু বলবি? একেবারে বৌ শাশুড়ি  দুজনকেই ডেকে নিয়ে এলি?’

‘মা জননী আমায় এবার ছুটি দেইতে হবে, দেশের বাড়ির ডাক এইসেছে।’ কাশু ঘাড় নীচু করে বলে।

‘কী বলছিস!’

‘ হ্যঁগো মা জননী আমি এবার দেশে ফিইরে যাব। বউ ছেইলে মেইয়ের সাথে দেখা কইরতে যাব।’

‘ তোর বউ ছেলে মেয়ে!’ শ্বাশুরি মা বিস্মিত, রেশমীও অবাক হয়। এতদিন জানত লোকটার কেউ নেই অথচ আজ বলছে বউ, ছেলে, মেয়ে!

‘ হ্যাঁ মা জননী। আমার বউ ছেইল, একটা ছেইলে ছেইল সাত বছরের।  মেয়েটার বয়স তহনও দুবছর হয় নাই। আধো আধো স্বরে ডাকত বাব্বা। ‘

‘এসব কথা এতদিন বলিসনি কেন?’

‘ কি কইরে কই মা জননী? আমিযে খুনী।’

‘ খুনী!’ সবাই আঁৎকে উঠে।

কাশু মাথা নীচু করে ঘরের বারান্দায় বসে পড়ে। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা পত্রিকার পাতা তুলে ধরে রেশমীর সামনে। সেখানে কালিতে দাগ দেয়া একটা সংবাদ, ” নিশিতপুরের সর্বজয়া মন্ডল হত্যার প্রকৃত আসামী গ্রেফতার।”

বিস্মিত  রেশমী একবার শাশুড়ির দিকে তাকায় তারপর এক নিশ্বাসে সংবাদটা পড়ে ফেলে।

সুন্দর বন অঞ্চলের একটা গ্রাম নিশিতপুর। সেই গ্রামের সাবেক জমিদার পরিবার, মন্ডল পরিবার। সেই পরিবারের কর্তা মা সর্বজয়া মন্ডল। আট বছর আগে সর্বজয়া মন্ডল খুন হন।

পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ভাড়াটে খুনী লাগিয়ে বিধবা সর্বজয়াকে খুন করে তাঁরই মৃত স্বামীর ছোট ভাই। অন্য একটি মামলায় আটক হওয়ার পর পুলিশের জেরার মুখে সেই ভাড়াটে খুনী স্বীকার করে সর্বজয়া হত্যাকান্ডের কথা। সবশেষে প্রতিবেদক লিখেন

“এই হত্যাকান্ডের দায় নিয়ে গত আট বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মন্ডল বাড়ির কর্তা মা সর্বজয়া মন্ডলের স্নেহধন্য বিশ্বস্ত কাজের লোক কাশু বাড্ডা।”

কাশু এবার ডুকরে কেঁদে উঠে, ‘ মা জননী এই একটা খবরের জন্যি আমি আট বছর এইখানে লুকাইয়া ছেইলাম। প্রেত্যেকদিন খবরের কাগজ তন্ন তন্ন কইরে খুঁইজে দেইখেছি। আমি জাইনতাম একদিন না একদিন সত্য ঘটনা বাইর অইয়া আইবই। তারপর বৈশাখ মাসে এবাড়িতে যখন নূতন বউ আইসলেন আমার মনে অইল, একি! এ কারে দেইখলাম! এযে আমার কর্তা মা! কোথায় জানি একটা মিল, সেই মায়াভরা মুখ, সেই দেবীর মত চেহারা। তখনই জাইনতাম এবার আমার মুক্তি মেইলবেই।

কাশুর কথা শুনে রেশমী কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে, কি বলবে  খুঁজে পায়না। সেই জংলী পাখিটির মতই সহজ, সরল, সুন্দর মনের মানুষ কাশু গোয়ালা। কোন সুদূরের এক স্নেহময়ী কর্তা মা যাঁর সাথে রেশমীর মিল কিংবা সেই কর্তা মা’র আসনে ওকে বসিয়ে এই মানুষটি ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাচ্ছে এটা ভাবতেই রেশমীর দুচোখ জলে ভরে উঠে।

‘তোমার পরিবার, তারা কোথায় এখন?’ শাশুড়ি মা প্রশ্ন করেন।

‘ জানিনা মা জননী। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় গোয়ালে গরুগুলানরে রাইখা ছেইলেডারে উঠানে বসাইয়া আমি কর্তা মা’র ঘরে যাই। ঘরে ঢুইকে দেখি কর্তা মা’র রক্তাক্ত লাশ। আর আমার দাওখান পইড়া ছেইল লাশের সামনে, রক্তমাখা। এমুন সোময় কাজের মাইয়াডা ঘরে ঢুইকে আমারে দেইখে চিৎকার দিয়া উঠে, খুন! খুন! কাশু, কর্তা মারে খুন কইরেছে। হঠাৎ আমি ভয় পেইয়ে যাই। একছুটে বাড়ি থেইকে বের হইয়ে আসি। উঠানে বইসা ছেইল ছেইলেডা, ওরে কইলাম, বাপরে বাড়িত যা, মায়েরে কইস আমি পলাইয়া যাইতাছি! ‘

‘ছেলেডা কি বুঝল জানিনা হঠাৎ কাঁইনতে শুরু কইরলে আর আমার পিছন পিছন দৌঁড়াইতে লাইগলে। আমি তখন দ্বিগবিদ্বিগ হারাইয়া দৌঁড়াইতেছি।  ছেইলেডা পিছনে চিৎকার করে  বাবা-আ, বাবা-আ। বড্ড ন্যাওটা ছিল ছেইলেডা। অহন না জানি ক্যামুন আছে।’ কাশু বড্ডা  হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। তালুকদার বাড়ির ইট-কাঠ, গাছ-পালা, পশু-পাখি সব যেন স্তব্ধ  হয়ে যায়। শুধু গোয়াল ঘরের গরুগুলো তারস্বরে চিৎকার করে হাম্বা.. হাম্বা..।

কাশু গোয়ালা চলে গেছে আজ তিনদিন। আট বছরের পলাতক জীবন ছেড়ে কাশু বাড্ডা এখন স্বাধীন ভাবে বাঁচবে। সেই বসন্ত বউরি পাখিটিও আর আসেনি। জঙ্গলে পাহাড়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় এই পাখি।কয়েকদিন আগে ঝড়ের তান্ডবে  দলছুট হয়ে চলে এসেছিল লোকালয়ে। পাহাড়ি পাখি এখন হয়ত আবার ফিরে গেছে পাহাড়ে ।

কাশু বাড্ডার জীবনেও বয়ে গেছে এক ঝড়। যে ঝড় তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার পরিবার থেকে। পাখিটি হয়ত তার পুরোন দলটিকে খুঁজে পাবেনা হয়ত নতুন কোন দল খুঁজে নেবে কিন্তু কাশু কি ফিরে পাবে তার সংসার ? তার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার?

তারিখঃ জানুয়ারি ১১, ২০২১

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

প্রকাশক - Publisher

Site By-iconAstuteHorse